আলো_আঁধার পর্ব ১৯

#আলো_আঁধার_১৯
#জেরিন_আক্তার_নিপা

ডিভোর্সের কথা শুনে আলো কতক্ষণ চুপ করে রইল। শুভ্র ওর মুখের দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে থেকে মনে মনে ভাবল, ভুল কিছু বলে ফেললাম নাকি? আলো কি রাগ করেছে? এরকম চুপ করে আছে কেন? শুভ্র কিছু বলতে যাওয়ার আগে আলো বলল,

-“ঠিকই বলেছ। ওই লোকের সাথে আমার সব সম্পর্ক অনেক আগেই ভেঙে গেছে। ওর সাথে এখন আমার কোন সম্পর্ক নেই। শুধু একটা সাইনের জন্য ওই লোকের সাথে জুড়ে থাকার কোন মানে হয় না। আমার আরও আগেই ডিভোর্স নিয়ে নেওয়া উচিত ছিল। বাচ্চাটার জন্য শুধু অপেক্ষায় ছিলাম। এখন তো সে-ও নেই। শীঘ্রই ডিভোর্সের জন্য এপ্লাই করে ফেলা উচিত।’

-“হুম। তোমার যেকোনো হেল্প লাগলে আমি তো আছিই।’

-“সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড যে তুমি।’

শুভ্র মনে মনে দীর্ঘশ্বাস চাপল। বলল,

-“ওই বেস্ট ফ্রেন্ডই ভাবো! এর বেশি কিছু ভাবা যখন অন্যায়।’

-“কী বিড়বিড় করো?’

-“কিছু না।’

-“আজকাল তোমাকে বড় রহস্যময় লাগে। কোন কথাই সম্পূর্ণ বলতে চাও না। অর্ধেক বলে, অর্ধেক মুখে আটকে রাখো।’

এর দুই দিনের মধ্যেই আলো কোর্টে ডিভোর্সের জন্য এপ্লাই করল। কোর্ট থেকে নোটিশ আসতে আসতে কম করে হলেও মাস কয়েক লাগবে। দুই পক্ষের ইচ্ছা না থাকলেও ডিভোর্স হতে তিন মাস সময় তো লেগেই যাবে। নাসিরের আপত্তি করবার কিছু নেই। সে আলোকে অনেক আগেই বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। এতদিনে হয়তো একটা বিয়েও করে ফেলেছে। আলো এখন শুধু কোর্টের নোটিশের জন্য অপেক্ষা করছে। এছাড়া তার আর কি-ই বা করার আছে? আলোর দিন ভালোই কাটছে। নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকার পাশাপাশি বাকি সময়টা শুভ্রর সাথে কাটে। শুভ্রকে প্রথম প্রথম সে ভুল বুঝেছিল। তার ভুল বোঝার পেছনেও একটা কারণ ছিল। রাহা! আলো ভেবেছিল রাহার সাথে শুভ্রর প্রেম ভালোবাসার সম্পর্ক আছে। শুভ্র রাহাকে ঠকাচ্ছে। কিন্তু পরে জানতে পারল, রাহাই বরং কয়েক বছর ধরে শুভ্রর পেছনে পড়ে ছিল। মিসেস আমিনা সেই জন্যই ওদের বিয়ে ঠিক করেছিল। কিন্তু রাহা বেচারীর কপালে শুভ্রর ভালোবাসা লেখা থাকলে তো! শুভ্র তার ভাগ্যেই নেই। তাইতো বিয়ের শপিং করে ফেলার পরও শেষ পর্যন্ত বিয়েটা হলো না।

অবশেষে কোর্ট থেকে নোটিশ এলো। নাসির, আলো ওদের দু’জনকেই উকিলদের সাথে দেখা করতে হবে। ওদের দু’জনকে সামনে রেখে উকিল কিছু প্রশ্ন করবে। আলো শুভ্রকে সাথে নিয়ে গেল। সেখানে নাসিরকে দেখে আলো অবাকই হলো। লোকটা একেবারে পাল্টে গেছে। রোগাপটকা শরীর, চেহারা ভেঙে বসে গেছে। আলোর দেখা আগের লোকটার সাথে এই লোকের কোন মিল নেই। নাসির আলোর কাছে ক্ষমা চাইল। নিজের ভুল অনেক আগেই বুঝতে পেরেছে সে। আলো যেন তাকে ছেড়ে না যায় সেজন্য হাতে পায়েও ধরল। কিন্তু কিছুতেই আজ আলোর মন গললো না। সেই দিনের কথা কখনও ভুলতে পারবে না আলো। তার এত বড় পেটটা নিয়ে সে স্বামীর হাতে অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করেছে। ওই সন্তান নিজের না বলে লোকটা তাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল। চাইলেও আলো ওসব কথা ভুলতে পারবে না। নাসির ওর বাচ্চার কথাও জিজ্ঞেস করল। ওটা যে তারই সন্তান তাতে এখন আর কোন সন্দেহ নেই। বাচ্চাটা এই দুনিয়ায় নেই শুনে নাসির ছেলেমানুষের মত কাঁদল। ওর কান্না দেখেও আলো কঠিন হয়েই রইল। একদিন সে এর থেকেও বেশি কেঁদেকেটে লোকটার পায়ে পড়ে কাকুতি মিনতি করেছিল। তবুও তার উপর লোকটার দয়া হয়নি। যে লোক নিজের বউকে অবিশ্বাস করে, সন্তানকে অস্বীকার করে, তার ক্ষমা পাওয়ার কোন যোগ্যতা নেই। তার সারাজীবন একাই থাকা উচিত।
শুভ্র ওদের কাছে যায়নি। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে দূর থেকে ওদের দেখছি। আলো কি লোকটাকে ক্ষমা করে দিবে? যতই হোক লোকটা আলোর স্বামী। ওর জীবনের প্রথম পুরুষ। প্রথম ভালোবাসা হোক বা স্বামী, সন্তান হোক। প্রথম জিনিসের প্রতি আলাদা টান থাকে। লোকটা আলোর সামনে কাঁদছে তবুও আলো নির্বিকার। শুভ্রর লোকটার জন্য খারাপও লাগছিল। আবার আলোর সিদ্ধান্তে খুশিও হচ্ছিল। যাক আলো তাহলে পুরোনো জীবনে ফিরে যাবে না।
এদিকের কাজ শেষ করে ওরা যখন বাড়ি ফিরছিল তখন আলো চুপচাপ চোখ বুজে গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে পড়ে রইল। শুভ্র বার কয়েক আলোকে দেখল। কিছু বলতে গিয়েও বলল না। আলোও বাড়ি ফেরার আগ পর্যন্ত কোন কথাই বলল না৷ ওভাবেই পড়ে রইল। গাড়ি থেকে নেমে আলো সোজা ভেতরে এসে নিজের ঘরে চলে এসেছে। শুভ্র এখন আর ওকে ডাকল না। আলো তার মত সময় নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।

-“জানো শুভ্র, এই বিশ/বাইশ বছরের জীবনে আমি মানুষের এত রূপ দেখেছি যে, এখন মানুষকে বিশ্বাস করতেই ভয় লাগে। তার থেকে আমি একটা কুকুর বেড়ালকে চোখ বুজে বিশ্বাস করে নেব। তবুও মানুষকে না। মানুষ বিষধর প্রাণীর থেকেও ভয়ংকর হয়।’

-“জীবনে বিশ্বাসটা জরুরি আলো।’

-“জরুরি বলেই পদে পদে সবাইকে বিশ্বাস করে শেষ পর্যন্ত ঠকেই এসেছি। কেউই আমার বিশ্বাসের মর্যাদা দেয়নি। যাকেই বন্ধু হিসেবে বিশ্বাস করেছি সে-ই আমার পিঠে ছুরি মেরেছে।’

শুভ্র কিছু বলল না। আলো একাই বলতে থাকল।

-“ওই লোককে দেখে আজ তোমার হয়তো মায়া হতে পারে। অথচ এই লোকের এমন রূপ আমি দেখেছি সেটা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। তখনকার এই লোকের সাথে আজকের এই লোকের আকাশ পাতাল তফাত। অথচ মানুষ দু’জন একই। গতকাল সে যে ছিল আজও সে-ই আছে। বদলে গেছে শুধু আশেপাশের পরিবেশ। সময়ের সাথে সাথে মানুষও বদলায়। সেদিন যে নিজেকে ঠিক মনে করেছিল। আজ তার কাছে মনে হচ্ছে সে ভুল ছিল। আজ সে আমাকে ফিরে পাবার জন্য কাঁদছিল। একদিন আমি কেঁদেছিলাম সে যেন আমাকে ত্যাগ না করে।’

-“ভালো খারাপ মিলিয়েই পৃথিবী। আমাদের খারাপ জিনিস গুলোকে ভুলে গিয়ে, ভালো জিনিস গুলোকে সাথে নিয়ে জীবনে এগিয়ে যাওয়া উচিত।’

-“বলাটা যত সহজ করাটা ততটা না। অতীতের কালো স্মৃতি গুলো যখন চোখের সামনে ভেসে উঠে তখন ভবিষ্যতও অন্ধকার মনে হয়। ওই দু’জন লোকের জন্য আমি আমার সন্তানকে হারিয়েছি। মায়ের ব্যথা তুমি বুঝবে না শুভ্র। বুঝলে বলতে না, খারাপ জিনিস গুলোকে ভুলে যাও আলো। জীবনে এগিয়ে যাও। দশ মাস ও আমার ভেতরে ছিল। ওকে নিয়ে আমি কী কী সহ্য করেছি তা শুধু আমিই জানি। একসময় মনে হয়েছিল মৃত্যুই বুঝি আমার জীবনে সবকিছুর সমাধান। বাবুটার জন্য শত কষ্ট, দুঃখ, যন্ত্রণা পেয়েও আমি নিজেকে শেষ করে দিতে পারিনি। ও আমাকে বেঁচে থাকার সাহস দিয়েছে। কিন্তু দেখো, শেষ পর্যন্ত ওকেই আমি হারিয়ে ফেললাম। ওই দু’জন মানুষ, ওরা আমার জীবনে না এলে আমার জীবন সম্পূর্ণ অন্য রকম হতো।’

আরও সপ্তাহ কয়েক কেটে গেল। শুভ্র শেষ পর্যন্ত সাহস করে আলোকে তার মনের কথা জানিয়ে ফেলল। আলো হয়তো শুভ্রর থেকে কখনও এরকম কিছু আশা করেনি। সে শুধু শুভ্রকে একজন ভালো বন্ধুই ভেবেছিল। এর বাইরে শুভ্রকে নিয়ে তার মনে অন্য কোন অনুভূতি জন্ম নেয়নি। শুভ্রর মুখেও ভালোবাসার কথা শুনে আলো প্রথম কয়েকদিন শুভ্রর সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিল। বাড়ি থেকেও চলে যাবার ব্যবস্থা করছে সে। এখান হাতে কাজ আছে। বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতে পারবে। রাতে শুভ্র খাবার টেবিলে এসেছে বলে আলো আসেনি। সে শুভ্রর মুখও দেখতে চায় না। শুভ্রও সবার মতই। আজ আলোর মনে হতে লাগল সব ছেলেরাই একরকম। কোন মেয়ে কয়টা দিন হেসে হেসে ক’টা কথা বললেই ওরা মনে করে বসে মেয়েটা হয়তো তাকে ভালোবেসে ফেলেছে।
আলো শুভ্রকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিল। শুভ্র দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে ওর পথ আটকে দাঁড়াল।

-“আলো প্লিজ। আমার সাথে কথা বলা অন্তত বন্ধ কোরো না। আমরা এখনো ভালো বন্ধু। সব সময় থাকতে পারি। তুমি আমার সামনেও আসো না। আমি কি খুব বড় অন্যায় করে ফেলেছি!’

আলো ভ্রু কুঁচকে তীক্ষ্ণ চোখে শুভ্রকে দেখে।

-“আমি তোমাকে বন্ধু ভেবেছি। শেষ পর্যন্ত তুমিও আমার বিশ্বাস রাখতে পারলে না।’

-“এভাবে বলছো কেন আলো? মনের উপর কি কারো জোর চলে? আমি নিজের মনকে অনেক বুঝিয়েছি। অনেক বারণ করেছি। কিন্তু আমি ব্যর্থ। মন আমার কথা শুনেনি। আমি পারছিলাম না। কথাগুলো তোমাকে না জানালে ভেতরে ভেতরে নিজেই শেষ হয়ে যেতাম। মনে এক মুখে আরেক, এভাবে আমি তোমার চোখে চোখ রাখতে পারছিলাম না। তাই বলে দিয়েছি।’

আলো শুভ্রর কোন কথা শুনতে নারাজ।

-“আমি বলে দিয়েছি। তুমি না করে দিয়েছ। এখন আমরা আগের মত স্বাভাবিক থাকতে পারি না?’

-“না। এখন কিছুই আগের মত হবে না। তুমি আমাকে বন্ধু ভাবতে পারলেও আমি আর পারব না। আমার মনে হবে তুমি আমাকে পেতে চাইছ। তাই আমাকে সাহায্য করছ। আমার কথা ভাবছ।’

-“আলো প্লিজ।’

-“তুমি তোমার মায়ের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করে নাও শুভ্র। রাহাই তোমার জন্য ঠিক আছে। সবথেকে বড় কথা, রাহা তোমাকে ভালোবাসে। ও তোমাকে সুখী করতে পারবে। আমি আর দু’দিন পরেই তোমাদের বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছি। তোমার ভবিষ্যত সুন্দর হোক এই প্রার্থনা করি আমি।’

শুভ্র অসহায় মুখে দাঁড়িয়ে রইল। আলোকে বলে ভুল করে ফেলেছে সে। না বললেই হতো। মনের কথা মনেই থাকত এটাই ভালো হতো। তাহলে আলোও বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চাইত না। এখানেই তার চোখের সামনে থাকত। অন্তত রোজ রোজ সকাল বিকেল আলোকে দেখতে তো পেত! আলো তার অনুভূতি না জানলে তার সাথে আগের মতই ব্যবহার করত। এখন তো আলো তার সাথে কথাও বলতে চায় না। সব ভুলে তারই। তার দোষেই আলো তার থেকে দূর হয়ে যাচ্ছে। কিছুই করার নেই তার।

চলবে___

/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here