আলো_আঁধার পর্ব ৭

#আলো_আঁধার [৭]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

কাজের মেয়েটা দীপ্তর সামনে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে। দীপ্তর চোখ আগুন গরম। পারলে সে মেয়েটাকে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলে। মেয়েটা কাঁদো কাঁদো মুখে মাথা নুইয়ে আছে। দীপ্তর দিকে তাকানোর দুঃসাহস করছে না। দীপ্ত হাত শক্ত করে মুঠো করা। চেঁচিয়ে উঠে বলল সে,

-“আলোকে কোথায় গেছে?’

মেয়েটা এবার কেঁদেই ফেলল। কোন কথা বলতে পারছে না সে।

-” এক কথা আমি দ্বিতীয় বার জিজ্ঞেস করব না। আলো কোথায় গেছে?’

-” জানি না স্যার। জানি না।”

-” তোকে আমি আলোর সাথে থাকতে বলেছিলাম? ওর খেয়াল রাখতে বলেছিলাম তোকে? তুই থাকতে আলো কাউকে কিছু না বলে কীভাবে কোথাও চলে যায়! ওকে একা রেখে কোথায় গিয়েছিলি তুই? কাজে ফাঁকি দিচ্ছিলি,তাই না?”

-“না স্যার। আমি ম্যাডামের সাথেই ছিলাম। সব সময় ছায়ার মতো উনার দেখাশোনা করেছি।”

-” তাহলে ও কোথায় গেছে জানিস না কেন? কেন জানিস না বল।”

দীপ্তর চিৎকারে আত্মা কেঁপে উঠছে মেয়েটার।

-” সকালে আমি উনার জন্য নিচে খাবার আনতে গেলে মেজ মা’কে আপনার রুমে যেতে দেখেছি। আমি খাবার নিয়ে যেতে যেতে উনি বেরিয়ে গেলেন। আমি রুমে গিয়ে দেখি আলো ম্যাডাম কাঁদতেছেন। মনে হয় মেজ মা উনাকে কথা শুনিয়েছে। এই বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেছে। আমি আলো ম্যাডামকে অনেক বার জিজ্ঞেস করেছি, কাঁদেন কেন? মেজ মা আপনাকে কিছু বলছে? উনি কোন কথারই উত্তর দিলেন না।”

-“মেজো মা!”

দীপ্ত ভাবতে পারছে না। এই মেজো মা এতটা বেড়েছে! দীপ্তর না করা স্বত্বেও আলোর কাছে গিয়েছিল। মেজো মা চলে যাবার পর আলো যেহেতু কেঁদেছে, তাহলে মেজো মা আলোকে যে অতি বাজে কথা শুনিয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। দীপ্তর সারা গায়ে আগুন জ্বলছে। মেজো মা’কে ছাড়বে না সে। দেখে নেবে।

-“মেজো মা, মেজো মা, মেজো মা। কেন আমার রাস্তায় এলে তুমি? তোমাকে আমি সাবধান করে দিয়েছিলাম। তবুও আমার ব্যাপারে নাক গালালে! আমার কথা শুনলেই না। এবার তোমাকে পস্তাতে হবে মেজো মা।”

দীপ্ত আলোকে খুঁজতে বেরিয়ে গেল।

-” কোথায় যেতে পারে আলো? আলোর যাওয়ার মত কোন জায়গা তো আমি রাখিনি। সবদিক বন্ধ করে তবেই তো তোমাকে আমার কাছে এনেছিলাম। তুমি মেজো মা’র কথায় কষ্ট পেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে, কোথায় যাবার জায়গা আছে তোমার তা কেন একবার ভাবলে না।”
_________________________

চাঁদের আলোয় রাতের নিস্তব্ধ রাস্তায় হাঁটছে আলো। সকালে দীপ্তর চাচীর কথাগুলো শোনার পরই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, এই বাড়িতে আর থাকবে না। সারাটা দিন কাজের মেয়েটা তার সাথে ছায়ার মতো লেগে ছিল। তখন চেষ্টা করেও বাড়ি থেকে বের হতে পারেনি সে। আলোকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে দেখলে ওই মেয়ে সাথে সাথে দীপ্তকে জানিয়ে দিত। তার দুর্দশা দীপ্ত ভালো করেই জানে। কখনও তাকে একা ছাড়ত না। বন্ধু হিসেবে জোর করে হলেও তাকে আটকাতো। আলো চায়নি দীপ্ত তাকে বাধা দিক। নিজের জীবনে সে একা। পুরোপুরি একা। তাইতো সন্ধ্যায় মেয়েটা নিচে নামলে চুপিচুপি বেরিয়ে আসে আলো। ভাগ্য ভালো তখন গেটের সামনে দারোয়ান ছিল না। থাকলে বাধা দিত নিশ্চয়ই।
বাড়ি কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে আলো চলে এসেছে। দীপ্ত হয়তো তাকে খুঁজবে৷ না বলে চলে আসার জন্য রাগ করবে। করুক। তবুও নিজের জীবনে আলোকে ভুলে অন্য কারো সাথে এগিয়ে যাক। আলো এটাই চায়। সুখে থাকুক দীপ্ত।

ফাঁক রাস্তা। আলো প্রায় বিশ মিনিট ধরে হাঁটছে এতক্ষণে একটা মানুষেরও দেখা পায়নি সে। হঠাৎ ঝোপের পাশ দিয়ে যেতে গা ঝমঝম করে উঠল ওর। এখন কয়টা বাজে? সাথে ঘড়ি না থাকলেও আনুমানিক ন’টার বেশি বাজবে না। এই সময়ে ছিনতাইকারী বা ডাকাতের হাতে পড়ার ভয় না থাকলেও একা মেয়ে ও রাস্তায় কতক্ষণ হাঁটবে। রাতের বেলা বের হয়ে ভুলই করেছে সে। এভাবে পালিয়ে আসার কোন কারণ ছিল না। দীপ্তকে বলে এলেই পারত। দীপ্ত তাকে জোর করে নিশ্চয়ই আটকে রাখতে পারত না। হ্যাঁ, একটু জোড়াজুড়ি অবশ্য করত। কিন্তু ওকে বলে আসা উচিত ছিল। বেচারা দীপ্তও হয়তো এখন তাকে খুঁজছে। এভাবে ওকে টেনশনে ফেলে আলো মোটেও ঠিক কাজ করেনি। এখন ফিরে যাবার পথ বন্ধ। দীপ্তর ফোন নাম্বার থাকলে কোন দোকান থেকে কল করে জানিয়ে দেওয়া যেত। বেচারা রাতের বেলা শুধু শুধু তাকে খুঁজে বেড়াবে।

হঠাৎ আলোর অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিয়ে ঝোপের আড়াল থেকে হুড়মুড় করে দু’টা ছেলে বেরিয়ে এলো। ওদের হাতে ছুরি। আলোর সামনে এসে দাঁড়াল দু’জন। প্রথমে আলোর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। বুকে চেপে ধরে আলো ঘনঘন দম দিল। ছেলে দু’জনের দিকে তাকাল। ওদের ভালো করে দেখল। ছেলে দু’টা নিতান্তই বাচ্চাছেলে। হাইস্কুলে পড়ে হয়তো। ওরা হাতে ছুরি নিয়ে রাতের বেলায় রাস্তায় ছিনতাই করতে বেরিয়েছে! মুখে আবার কাপড় বাধা। নিরাপত্তার জন্য নিশ্চয়ই। যেন মুখ দেখে কেউ চিনে ফেলতে না পারে। চিনে ফেললে যদি বাড়িতে জানাজানি হয়ে যায়। এই ছেলে দু’টো এখনও পাকাপাকি ভাবে সন্ত্রাসী হয়ে উঠেনি। মনে এখনো ডরভয় কাজ করে। তবে ট্রেনিং নিচ্ছে। খুব শীঘ্রই পুরোপুরি সন্ত্রাসী হয়ে উঠবে। এদের বাবা মা এদের খোঁজ খবর রাখে না? ছেলে রাতে বাইরে বেরিয়ে কোথায় কী করে বাবা মা’র তো খোঁজ নেওয়া উচিত। এখন একটু শাসনে ওদের সঠিক রাস্তায় ফিরিয়ে নেওয়া যাবে। দেরি হয়ে গেলে শাসনে কাজে দিবে না।
একটা ছেলে আলোকে অবাক করে দিয়ে বলল,

-” সাথে যা আছে বের কর।”

আলো হতভম্ব। জীবনে এমন কিছুও দেখতে হবে ভাবেনি আলো। বাচ্চা বাচ্চা দু’টা ছেলে, তারা নাকি আলোকে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে।

-” এই কারা তোমরা?”

অন্য ছেলেটা বলল,

-” আমরা যেই হই তোর জেনে লাভ কী? যা বলছি তা কর। সাথে যা যা আছে সব বের কর।”

আলোর ইচ্ছে করছে ছেলেটার গালে একটা চড় বসিয়ে দিতে। বয়সে যে আলো তার বড় হবে ছেলেটা বুঝতে পারছে না! তবুও তুই তুই করে কথা বলছে। ইচ্ছেটাকে দমন করল আলো। না জানি ওরা কতটা ভয়ঙ্কর। হাতে ধরা ছুরিটা সত্যিই যদি পেটে ঢুকিয়ে দেয়! না, না। ভাবতেই গা শিউরে উঠছে।

-” তোমরা এই পথে কেন নেমেছ? তোমাদের দেখে তো হাইস্কুলের ছাত্র মনে হয়। এই বয়সে এই পথে… তোমাদের তো সামনে বাকি জীবনটাই পড়ে আছে। পড়াশোনা করে কিছু…

-” চুপ। এই মহিলা চুপ। তোকে জ্ঞান দিতে কে বলেছে হ্যাঁ? ”

হঠাৎ ধমকে আলো একটু ভয় পেল। ছেলে দু’টা এখনো যেহেতু ছুরি চালায়নি তার মানে এরা এতটাও ডেঞ্জারাস না। মারামারি, খুনখারাবিতে এখনো নিজেদের জড়ায়নি।

-” ওই বেডি ওই। সাথে যা আছে বের কর। নইলে পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দেব। একদম মেরে রেখে যাব।”

অন্যজন লক্ষ্য রাখছে এদিকে কেউ আসছে কিনা। এই মুহূর্তে কেউ এসে পড়লে সমস্যা। আলো ওদের আর চটাল না। ছেলেগুলো ওর থেকে কী-ই বা নেবে আর! গলায় তো শুধুমাত্র একটা সোনার চেন আর নাকে একটা নাকফুল। ছেলেগুলো কত আশা নিয়ে তাকে ধরেছে। আজ তার থেকে যা পাবে তা বিক্রি করে যে টাকা পাবে তা দিয়ে কী করবে ওরা? জানতে ইচ্ছে হলো আলোর। মদ, গাঁজা খাবে? নেশা করে মাতাল হয়ে কোথাও পড়ে থাকবে? নাকি এই টাকা দিয়ে ভালো কোন কাজ করবে? ভালো কাজ করার উদ্দেশ্যে নিশ্চয়ই খারাপ কাজে নামেনি। আলো ইচ্ছে করেই গলার চেন খুলে ওদের সামনে দিল। খাটো ছেলেটা ছোঁ মেরে ওর হাত থেকে চেনটা নিয়ে নিল। মুখ দেখা না গেলেও আলো দেখল ওদের দু’জনের চোখই চকচক করছে। মনে মনে হাসল আলো। এদিকে একটা গাড়ি আসতে দেখে আলোকে ফেলে দু’জনই ছুটে ঝোপের উপর দিয়েই ডান দিকে দৌড়াতে লাগল। ওদিকে তো জঙ্গল মনে হচ্ছে। জঙ্গলের ভেতর কোথায় যাচ্ছে ওরা? ভয় পাবে না?
গাড়ি এসে আলোর সামনে দাঁড়াল। আলো ছেলে দু’টার যাওয়ার দিকেই তাকিয়ে আছে। গাড়ি থেকে দীপ্ত নেমে এলো। আলোর সামনে এসে দাঁড়াল। আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর হতাশ গলায় বলল,

-” আমাকে না বলে কোথায় চলে গিয়েছিলে আলো? কোথাও যাবার হলে আমাকে বলতে, আমি তোমাকে নিয়ে যেতাম।”

দীপ্তর কথা আলোর কানে গেল না। সে হঠাৎ শব্দ করে হাসতে লাগল। দীপ্ত আলোকে হাসতে দেখে হকচকিয়ে গেল।

-” কী হয়েছে? হাসছো কেন আলো?”

আলো এবারও কিছু বলল না। ডান হাত বুকের উপর রেখে সে হাসতেই আছে। হাসতে হাসতে পেটে ব্যথা পাচ্ছে। হালকা কাতর শব্দ করল।

-“উহ বাবা!”

তবুও তার হাসি থামছে না। সে হেসেই যাচ্ছে। হাসতে হাসতে তার চোখে পানি চলে এসেছে। দীপ্ত অবাক চোখে আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। আলোর এ কী হলো! বুঝতে পারছে না দীপ্ত। কোন কারণ ছাড়া আলো এভাবে হাসছে কেন? হাসতে তো হাসতেই। হাসি থামাতেই পারছে না।

-” বাবা! উহ, পেটে খিল ধরে গেল। আহ।”

দীপ্তর দিকে তাকাল ও। দীপ্তর ফ্যাকাশে মুখ দেখে আবারও হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে একসময় নিজেই থামল। দীপ্তকে উদেশ্য করে বলল,

-” তোমার আবার কী হয়েছে? এরকম ভয় পেয়ে মরার মত সাদা হয়ে গেছ কেন?”

আলো খেয়ালও করল না, সে দীপ্তকে আজ তুমি করে বলেছে। কিন্তু দীপ্ত বিষয়টা শুধু খেয়ালই করল না। মনে মনে খুশিও হলো। ভেতরে আনন্দের শিহরণ খেলে গেল।

গাড়িতে বসে আলো দীপ্তকে তার হাসির কারণটা বলছে। বলার সময়ও আলো হাসছে। দীপ্ত শুনে মনে মনে রাগ হলেও আলোকে হাসতে দেখে নিজেও মুখে হাসি টেনে রাখল।

-” বুঝলে, বাচ্চা দু’টা ছেলে। হাইস্কুলে পড়ে হয়তো। এখনো দাড়িগোঁফ গজিয়েছে কিনা সন্দেহ। ওরা ছুরি হাতে সন্ধ্যার সময় ছিনতাই করতে বেরিয়েছে! ভয় পাওয়া তো দূর বেচারাদের উপর আমার মায়াই হলো। এত কষ্ট করেও খালি হাতে ফিরে যাবে ভেবে নিজের চেন টা-ই দিয়ে দিলাম। যা এই নিয়েই খুশি থাক। মন থেকে খুশি হয়েই দিলাম বুঝলে। ওদের জন্য আজ অনেকদিন পর সবকিছু ভুলে গিয়ে মন থেকে হাসতে পেরেছি। এখন সত্যিই ভালো লাগছে। নিজেকে হালকা হালকা লাগছে। মনে হচ্ছে আমার যে দুঃখ তা আসলে দুঃখ না। জীবনে কষ্ট পাওয়ার চেয়ে খুশি থাকার কারণ অনেক বেশি। ছোট ছোট খুশি নিয়েও বেঁচে থাকা যায়।”

চলবে___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here