#এক_জীবনে_অনেক_জীবন(৩০)
#শেষ_পর্ব
***********************************
সাদাত ফাইল হাতে এমডি স্যারের রুমে যাচ্ছিল । ফোনে রিং বাজতেই তাকিয়ে দেখলো জারা’র নাম ভেসে আছে ! ওহ, হার্টের একটা বিট যেন মিস হয়ে গেল । কেন এমন হয় বারবার, কেন জারা’র নামে তার এতো উতলা লাগে ? এতো চেষ্টার পরেও সে কেন এই অবস্থা থেকে বের হতে পারছে না ? আর কতো কষ্ট পাবে সে, আর কতো ক্ষরণ হবে বুকের ভেতর ? ধরবে না ঠিক করেও কলটা রিসিভ করলো সে –
হ্যালো জারা……
ভাইয়া কেমন আছো ?
ভালো । তুমি ?
ভালো আছি । তুমি কবে আসবে ?
আমার আসার ঠিক নেই, না-ও আসতে পারি ।
প্লিজ ভাইয়া তুমি আসো । বিয়ের দিন অন্তত আসো । তোমার সাথে আমার কথা আছে । না জিজ্ঞেস করা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছি না ।
কী কথা বলো ।
না এখন না , সামনাসামনি বলবো । তুমি আসো প্লিজ, প্লিজ ভাইয়া ।
আচ্ছা দেখি ।
দেখি না, প্রমিজ করো তুমি আসবে ।
আচ্ছা ঠিক আছে ।
ওকে ভাইয়া, রাখছি তাহলে । লাভ ইউ ভাইয়া ।
লাইনটা কেটে গেলে সাদাতের শরীরটা ঝিমঝিম করতে লাগলো, জারা কী বললো তাকে ! ও এভাবে ডাকছে কেন ? জারা’র কাছ থেকে দূরে থাকার জন্যেই তো সে বিয়েতে গেল না । খালু তো তাকে অনেক সাধাসাধি করেছিল । জারাকে যদিও বলেছে সে আসবে কিন্তু সাদাত ঠিক করলো সে বিয়েতে যাবে না ।
.
.
গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে আশপাশের পুরোটা জায়গা কাঁচা ফুলে সাজানো হয়েছে । নানারকম বিদেশি ফুলের ভীড়ে বহুদিন পর রজনীগন্ধা আর বেলীফুলের সুবাস পেলেন তাবাসসুম । ফুলের সুবাসে চারপাশ মম করছে । নিয়ন বাতির আলোয় কেমন মায়াবী একটা পরিবেশ চারদিকে ! তাবাসসুমের হঠাৎ মনে হলো জারা’র বিয়েতে এমন আয়োজন করলে দারুণ হয় , পরক্ষণেই মনে হলো অকারণে এতো মাত্রাতিরিক্ত খরচ তিনি কখনোই করবেন না । বিয়ের কথা মনে হতেই একটা আশংকা তার মনে উঁকি দিলো, কিছুদিন পরে যখন জারা’র বিয়ে হবে তখন অবধারিতভাবে এই দুর্ঘটনাটা সামনে আসবেই । কতো লোকের কতো ধারালো কথা, কতো মন খারাপ করা পরিস্থিতির মুখোমুখি যে হতে হবে তাদের । তাবাসসুম নিজের মনকে সান্ত্বনা দিলেন , সেই সময়ের কথা ভেবে এই সময়ে মন খারাপ করে থাকার কোনো মানেই হয় না । যা হওয়ার তা সময় আর পরিস্থিতিই ঠিক করে দেবে ।
অনুষ্ঠানের একটা জিনিস খুব ভালো লাগলো তাবাসসুমের, ডিজে পার্টির নামে যে বুক কাঁপানো, কান ফাটানো সাউন্ড সিস্টেম চলে আজকালকার অনুষ্ঠানগুলোয়, সাথে হিন্দি সিনেমার নাচ গানের হাস্যকর অনুকরণ, সেটা কেন জানি তার খুব অরুচিকর আর অস্বাস্থ্যকর মনে হয় । কানের বারোটা বাজিয়ে, মাথাব্যথা ধরিয়ে ষোলোকলা পূর্ণ করার নাম না-কি বিনোদন ! এখানে সেই জিনিসটা দেখলেন না তিনি । তার বদলে প্রফেশনাল লোক দিয়ে বাড়ির নানা বয়সী মানুষদের নিয়ে বিভিন্ন রকম ইভেন্টের আয়োজন করা হয়েছে । এই কনসেপ্টটা ভালো লাগলো তাঁর । এখানে এসে ভালোলাগার আরেকটা কারণ হলো, এমন অনেক আত্মীয়ের সাথে দেখা হয়েছে, একই শহরে থেকেও শুধুমাত্র ব্যস্ততার কারণে যাঁদের সাথে বহুদিন দেখা হয়নি ।
অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে, খাওয়াদাওয়া চলছে । টেবিল-চেয়ারের পাশাপাশি যাঁরা জমিয়ে আড্ডা দিতে চায় তাদের জন্য ঘাসের ওপর গদি-বিছানার ব্যবস্থা আছে । তাবাসসুম’রা তিন বোন তাঁদের অন্যান্য কাজিনদের সাথে মিলে গদি বিছানায় বসে আড্ডা দিচ্ছেন । গল্পের কোনো মাথামুণ্ডু নেই । কখনো ছোটবেলার স্মৃতিচারণ চলছে তো কখনো ছেলেপেলের লেখাপড়া নিয়ে ভোগান্তি আবার কখনো দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ । তাবাসসুমের মামাতো বোন ফ্লোরা থাকেন চট্টগ্রামে । ওনার দুই ছেলে আর এক মেয়ে । ছেলে দু’টো বড়, তারা অনুষ্ঠানে আসেনি । তিনি মেয়ে আর স্বামীকে নিয়ে এসেছেন । ছোটোবেলায় এই বোনের সাথে ভীষণ ভাব ছিল তাঁর । বিয়ের পর চট্টগ্রামে চলে যাওয়ায় ধীরে ধীরে যোগাযোগ কমে এসেছে । ফোন কথা হয় কদাচিৎ ৷ অনেক বছর পর আবার দেখা হওয়ায় দারুণ আড্ডা জমে উঠলো দু’জনের মধ্যে । ছেলেমেয়ের প্রসঙ্গ উঠতেই ফ্লোরা বললেন –
তুই তো মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলি, আমি তো বড়টার জন্য মেয়ে খুঁজছি কিন্তু সবকিছু মিলে ঠিক মনমতো হচ্ছে না । কিছুদিন আগে এক মেয়েকে পছন্দ করলাম সবাই , মেয়েরাও নেহালকে পছন্দ করেছিল । শেষে আমার ছেলে বেঁকে বসলো । বলে কি-না এই মেয়ে খুব বেশি মর্ডান । এর সাথে না-কি তাল মিলিয়ে চলতে গেলে বারবার হোঁচট খেয়ে পড়তে হবে । কী একটা অবস্থা বল তো দেখি ?
ইয়াসমিন বললেন –
ফ্লোরা তোর ছেলে কী করে ? লেখাপড়া শেষ করেছে ?
জি আপা পাশ করে বেরিয়েছে গত বছর, আমাদের কোম্পানিতেই জয়েন করেছে । আপনার কাছে ভালো কোনো মেয়ের খোঁজ আছে আপা ?
দু’টো মেয়ে ছিল কিন্তু গতমাসে একটার বিয়ে হলো আরেকটার এনগেজমেন্ট হয়ে গেল ।
পাশ থেকে আরেক কাজিন বললেন –
এখানে কয়েকটা মেয়ে দেখলাম, বেশ ভালো লাগলো মেয়েগুলোকে দেখে । বিয়ে তো আসলে ভাগ্যের ব্যাপার । খুঁজতে থাকো ফ্লোরা আপা , একসময় পেয়ে যাবে । আচ্ছা দুপুরে যে একটা মেয়েকে দেখলাম সাদা থ্রিপিস পরা ছিল, কোমর ছাড়ানো সিল্কি চুল, ঐ মেয়েটা কার ? এই আপা তোমাকে দেখালাম না মেয়েটাকে, মনে আছে তোমার ? খুব স্নিগ্ধ চেহারা, আমার কিন্তু খুব ভালো লেগেছে মেয়েটাকে । পাশে বসা বড় বোনকে বললেন সেই কাজিন ।
ও তো তাবাসসুমের মেয়ে । তুই তো আমাকে জিজ্ঞেস করে আর দাঁড়ালি না ।
তাবাসসুম আপা তোমার মেয়ে এত্তো বড় হয়ে গেছে !
তাবাসসুম বললেন –
ও আমার ছোট মেয়ে জারা । বড়টার বিয়ে হয়েছে গত বছর ।
ফ্লোরা আপা তুমি তাবাসসুম আপার মেয়েকে দেখেছো ?
ফ্লোরা বললেন –
ওকে দেখেছি তা-ও তো আট/নয় বছর হবে, তাই না রে তাবাসসুম ?
হুম ।
জারা’র কী লেখাপড়া শেষ হয়েছে ? বিয়ের বয়স হয়ে গেল না-কি ?
তাবাসসুমের বুকের ভেতর ধুকপুক শুরু হযে গেল । এতো চমৎকার আড্ডাটা শেষে না তিক্ততা নিয়ে শেষ হয় ।
ইয়াসমিন বললেন –
লেখাপড়া শেষ হতে আর বেশি বাকি নেই । এই বছরেই শেষ হয়ে যাবে । তারপর ও আবার বাইরে চলে যাবে পড়তে ।
এভাবে বাঁচিয়ে দেয়ায় বোনের দিকে কৃতজ্ঞ চিত্তে তাকালেন তাবাসসুম কিন্তু আদতে বাঁচতে পারলেন না । মিলি আপা তাঁদের খালাতো বোন ৷ ঠোঁটকাটা হিসেবে তাঁর সুনাম আছে । তিনি বললেন –
তাবাসসুমের মেয়েকে ফ্লোরার ছেলের সাথে দেয় কীভাবে ? এই তাবাসসুম তোমার মেয়ে না পালিয়ে যেয়ে কী সব কেলেংকারি করে আবার ফেরত এসেছে ? এই কান্ড না ঘটালে তো ফ্লোরার ছেলের সাথে এখন কথা চালাতে পারতে তোমরা । একটা দাগ লেগে গেলে যতই সুন্দরী হোক আর বাপের যতই পয়াসা থাকুক , সহজে ভালো বিয়ে হতে চায় না ।
তাবাসসুম কী উত্তর দেবেন বুঝতে পারছেন না ।
ফ্লোরা বললেন –
কী হয়েছিল রে জারা’র, কোথায় গিয়েছিল ?
মিলি আপা বললেন –
কোথায় আবার যাবে ! বয়ফ্রেন্ডের সাথে পালিয়েছিল । পরে বয়ফ্রেন্ডের মন ভরে গেলে ওকে ফেলে চম্পট দিয়েছে । আমি সব শুনেছি ফরিদার কাছে । আহারে খুব খারাপ লেগেছে মেয়েটার কথাটা শুনে । বেচারির চরিত্রে একটা দাগ পড়ে গেল এই বয়সেই ।
মিলি আপার কথার পরেই একটা শোরগোল উঠলো আড্ডায় । অনেকক্ষণ পরে যেন দারুণ লোভনীয় একটা বিষয় পাওয়া গেল আলোচনা করার জন্য । চারদিক থেকে প্রশ্নের তীর এসে বিঁধছে তাবাসসুমের গায়ে । তাবাসসুম অবাক হয়ে গেলেন মানুষের এতো আগ্রহ, এতো কৌতূহল দেখে । মিলি আপার কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণ দেখে তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন । একজন মানুষ এতোটা বিষ উগরে দেয় কেমন করে ! একজন শিক্ষিত মানুষ অন্যের সম্পর্কে এভাবে কথা বলতে পারেন ! তাও আবার এই বয়সে এসে !
ফ্লোরা বললেন –
মিলি আপা এগুলো এভাবে বলবেন না । কিছু যদি হয়েও থাকে, এভাবে বলা কিন্তু উচিত না । তাবাসসুমের দিকে তাকিয়ে বললেন –
সরি তাবাসসুম, তুই কিছু মনে করিস না । কথা যে কোত্থেকে কোথায় গড়াবে আমি বুঝতেই পারিনি ।
তাবাসসুম আড্ডায় আর কোনো আনন্দ পেলেন না । ছন্দ কেটে গেলে কোনো কিছুরই আর আগের জায়গায় ফিরে আসে না । শাফিনকে ফোন করতে হবে বলে তিনি আড্ডা ছেড়ে বেরিয়ে এলেন ।
.
.
কোনোভাবেই যাবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়ার পরেও কী এক অমোঘ টানে সাদাত বিয়ের আগের রাতে রিসোর্টে গিয়ে পৌঁছালো । ছেলের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান চলছে তখন । নিলুফার ছেলেকে দেখে ভীষণ খুশি হলেন । ছেলেকে রেখে এসে আনন্দ করতে তাঁর মন মোটেও সায় দিচ্ছিল না ।
জারা চুপচাপ দোলনায় বসেছিল । সাদাতকে দেখে দোলনা ছেড়ে উঠে এলো । কাছাকাছি আসতেই চোখাচোখি হলো দু’জনের । জারা সবুজ সিল্কের শাড়ি পরে আছে ! সব মেয়েরাই অবশ্য একই শাড়ি জড়িয়েছে গায়ে । সাদাতের বুকের ভেতর একটা তার ছিঁড়ে গেল যেন । উহ, এতো সুন্দর লাগতে হবে কেন ওকে ? এই সবুজে কী আর কাউকে এতোটা সুন্দর লেগেছে কখনো !
জারা এসে সাদাতের হাতটা ধরে বললো –
ভাইয়া তোমার সাথে আমার কথা আছে । ওখানে চলো, ঐ দোলনার ওখানে ।
সাদাত আলগোছে হাতটা ছাড়িয়ে নিলো । এটা ঠিক না, একদম না । এভাবে কষ্টে বুকের ভেতর এলোপাতাড়ি ঝড় বয়ে যাওয়া ঠিক না । সে বারবার নিজেকে সামলে নেয় , বারবার জারা নামের ঝড় এসে সব লন্ডভন্ড করে দিতে চায় ।
ভাইয়া আমি তোমার ওপর খুব রাগ করেছি ।
জারা’র কথায় সম্বিত ফিরে পেল সাদাত । বললো –
কেন জারা, কী করেছি আমি ?
তুমি এভাবে লুকালে আমার কাছ থেকে !
কী লুকিয়েছি ? বুকের ভেতর ডামাডোল শুরু হলো যেন সাদাতের ।
আদির কথা । তুমি আদিকে আগে থেকেই চিনতে ?
আদি কে ?
নামটা উচ্চারণ করতে জারা’র কেমন গা ঘিনঘিন করছিল তবুও বললো – রফিক ।
ও আচ্ছা । আবার কী হলো, ওর কথা কেন আসলো ?
তুমি ওর বন্ধু ?
না, স্কুলে একসময় ক্লাসমেট ছিলাম ।
যেদিন পুলিশ ওকে ধরলো সেদিন তুমি ওর বাসায় গিয়েছিলে ?
হুম খালু যেতে বলেছিলেন ।
ভাইয়া আমাকে একটা হেল্প করো প্লিজ ।
কী হেল্প ?
আমি একবার ওর বাসায় যেতে চাই ।
রফিকের বাসায় !
হুম ।
কেন ?
আমার একটু কাজ আছে ।
ওখানে কী কাজ ! আর ও তো জেলে ।
আমি কিচ্ছু করবো না, ওরা জানতেও পারবে না আমি কে । আমি শুধু ওর ফ্যামিলিকে একবার দেখবো ভাইয়া ।
আমি কীভাবে তোমাকে ওখানে নিয়ে যাবো জারা? খালা জানতে পারলে খুব রাগ করবেন ।
কেউ জানবে না । ওর বাড়ির মানুষও বুঝবে না । আমি তোমার বোন হিসেবে যাবো । না কোরো না, ভাইয়া প্লিজ এই একটা বার আমার কথাটা রাখো ।
ওর বাসায় গেলে তোমার মন খারাপ আরো বাড়বে জারা । আমি বলছি তুমি যেও না ।
একবার শুধু একবার যাবো । দেখেই চলে আসবো । প্লিজ নিয়ে চলো ।
জারা যে এমন কিছু বলতে পারে, সাদাত আশাই করেনি । বাধ্য হয়ে সে রাজি হলো । জারা’কে কথা দিল নিয়ে যাবার । এই মেয়ের মাথায় কী ঘুরছে সে কিছুই বুঝতে পারছে না ।
জারা’র মনের ভেতর একটা অনুশোচনার কাঁটা থেকে থেকে খোঁচা দিয়েই যাচ্ছে । আদিকে যে শাস্তি দেয়া হলো সেটা কী আদৌ তার প্রাপ্য ? সে একবার সচক্ষে মিলিয়ে নিতে চায় আদির সত্য-মিথ্যাগুলো ।
.
.
সাদাতের অফিস ছিল না আজকে । অনেক ছুটি জমে গিয়েছিল তাই এ সপ্তাহটা ছুটি নিয়েছে সে । আজকে রফিকের বাসায় যাওয়ার কথা তাদের । এগারোটায় জারা’র আসার কথা । জারা’র অপেক্ষায় আড়ংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে । জারা সময় মতোই চলে এলো । সাদাত বললো –
আরো একবার ভেবে দেখো যাবে কি-না ।
আমার ওপর ভরসা রাখো ভাইয়া । কিচ্ছু করবো না ।
দরজা খোলাই ছিল, সাদাত জারাকে নিয়ে ওপরে উঠে এলো । কলিংবেল বাজাতেই মিনা এসে দরজা খুললো । সাদাতকে দেখে চিনতে পেরে বললো –
সেই যে একদিন আসলে তারপর তো বন্ধুর আর কোনো খোঁজ নিলে না । আসো ভেতরে আসো ।
ভেতরে এসে বসে সাদাত বললো –
আপা কাজের এতো প্রেসার থাকে যে একটুও সময় বের করতে পারি না । রফিক এখন কোথায়, কেমন আছে?
কোথায় আবার, শ্বশুরবাড়িতে ।
সাদাত আর জারা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো ।
কী যে ছোটোলোকের বাচ্চাদের পাল্লায় পড়েছিল আমার ভাইটা , ওকে তো জামিনে বের করাও যাচ্ছে না । আমার মামা খুব চেষ্টা করে করে যাচ্ছে কিন্তু কাজ হচ্ছে না । কী যে কষ্টে আছে রফিক তোমাকে বলে বুঝাতে পারবো না । ও কে ?
ও আমার বোন, সানজিদা । ওকে নিয়ে ওএসবিতে যাবো তো তাই ভাবলাম রফিকের খবরটা নিয়ে যাই ।
তুমি এসেছো, ভালো লাগছে । কেউ তো আসে না । সবাই এমন ভাব করে যে রফিক যেন বড় কোনো ক্রিমিনাল । আমি খুব চেষ্টা করেছিলাম ঐ মেয়েটাকে একবার দেখার । কোনোভাবে ঠিকানা জোগাড় করতে পারলাম না । একবার যদি হাতের কাছে পেতাম তো ঐ কুলাঙ্গারের বেটির অবস্থা খারাপ করে দিতাম । আমার বোকাসোকা ভাইটাকে ফাঁসিয়ে মজা নিয়ে আবার আমার ভাইকেই জেলে পাঠালো ! চিন্তা করতে পারো কতোটা খারাপ হলে একটা মেয়ে এমন করতে পারে ? এরা আসলে ব্যবসা করে বুঝতে পেরেছো । রফিকের থেকে অনেক টাকা বের করে নিয়েছে তো । রফিকের টাকা শেষ তাই ওকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে । আর কতোটা খারাপ চিন্তা করে দেখো , এমনভাবে কেস সাজিয়েছে যেন সব দোষ রফিকের । আবার নতুন কোনো কাস্টমার ধরেছে নিশ্চয়ই এর মধ্যে । আবার কার সহজসরল ছেলেকে পাকড়াও করেছে কে জানে ? এরা তো এসব করেই খায় । এদের বাপ-মা’ও বেজন্মা তা না হলে কোনো ভদ্রলোক কী মেয়ে দিয়ে এভাবে ব্যবসা করতে পারে !
সাদাত আড়চোখে জারা’র দিকে তাকালো । রফিকের বোন এতো নোংরা কথা বলবে জানলে সে জারাকে কিছুতেই এখানে নিয়ে আসতো না ।
জারা আর শুনতে পারছিল না । মাথাটা ঝিমঝিম করছে, ঘেন্নায় বমি আসছে । এ কোথায় আসলো সে ! একটা মানুষ এতোটা নোংরাভাবে কথা বলতে পারে ! কারো সম্পর্কে না জেনে এভাবে মিথ্যা কথা বানিয়ে বলা যায় ! তার কারণে তার আব্বু আর মা’কেও কতো খারাপ কথা বলে যাচ্ছে এই মহিলা । এখন সে বুঝতে পারছে আদি তার সাথে কেন এভাবে মিথ্যে বলেছে । এদের বাড়ির পরিবেশটাই এতো নোংরা । এরকম নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের একটা ছেলে মিথ্যের স্বপ্নজাল বুনে তাকে সিঁড়ি বানিয়ে ওপরে উঠে আসতে চেয়েছিল । কী ভয়ংকর ! সে কী করে মানুষ চিনতে ভুল করলো ? এতো বড় ভুল করে ফেললো জীবনে ? ভাগ্যিস সে দেরিতে হলেও সরে আসতে পেরেছে এই ভয়ংকর চক্র থেকে । সে যদি সত্যি এই বাড়িতে চলে আসতো তাহলে তার জীবনটা নরক বানিয়ে ছাড়তো এরা ! ভয়ে জারা’র শরীরটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো । সাদাত ওর দিকে তাকিয়ে বললো –
কী হলো ?
জারা উঠে দাঁড়িয়ে বললো –
ভাইয়া চলো ।
সাদাত মিনাকে বললো –
আপা আমরা যাই ।
আরেকটু বসো । দুঃখের কথা বলার লোক পাই না ভাই । মা তো সারাদিন কান্নাকাটি করতে থাকে । তুমি তো রফিকের বন্ধু । তুমি বুঝতে পারবে আমাদের কষ্টটা ।
ভাইয়া চলো । জারা সাদাতের হাত ধরে টান দিলো ।
চা খেয়ে যাও । বসো, চা নিয়ে আসি ।
না আপা আজকে আর বসবো না । দেরি হয়ে গেলে পরে ডাক্তার দেখানো যাবে না ।
ঠিক আছে, আবার এসো । মাঝে মাঝে এসে খোঁজ নিয়ে যেও আমাদের ।
জারা এক রকম টানতে টানতে সাদাতকে গেটের বাইরে নিয়ে এলো । ভয়ে তার হাত-পা সব কাঁপছে । সে শক্ত করে সাদাতের হাত ধরে রেখেছে ।
সাদাত জারা’র অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করলো –
খারাপ লাগছে ?
ভাইয়া আমি এখানে কেন আসলাম ? এরা কেমন মানুষ ভাইয়া, এরা কী সত্যি ই মানুষ ?
আমি তোমাকে আসতে নিষেধ করেছিলাম । তুমি জোর করলে দেখেই তো আসলাম । আমি তো এদের ফ্যামিলিকে চিনি জারা । আমি চাচ্ছিলাম তুমি এদের এই নগ্ন রূপটা যেন না দেখো । তুমি তো আমার কথা শুনলেই না । এসে অবশ্য ভালো করেছো । মনের মধ্যে কোনো দ্বিধা দ্বন্দ্ব থাকলে এবার ঝেড়ে ফেলতে সুবিধা হবে । তুমি খুব বেশি বোকা জারা আর রফিক সেই সুযোগটাই নিয়েছে । পৃথিবীটা খুব কঠিন জায়গা, খুব কঠিন । এখানে টিকে থাকতে হলে সবসময় চোখ-কান খোলা রাখতে হয় । একটু ভুল, একটু পিছলে যাওয়া মানেই কিন্তু ছিটকে পড়ে যাওয়া । তুমি যে অল্পতেই বেঁচে ফিরতে পেরেছো সেটাও বা কম কী বলো ? মন খারাপ কোরো না জারা । এই অপমান, এই প্রতারণা এই সব কিছু থেকেই ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি খুঁজে নাও জারা । আমরা সবাই তোমার সাথে আছি ।
ভাইয়া মনটা ভালোই হচ্ছে না , খুব কান্না পাচ্ছে আমার ।
মন খারাপ কোরো না । সব ঠিক হয়ে যাবে । চলো তোমাকে বাসায় দিয়ে আসি ।
এখন বাসায় যাবো না । আমি কিছুক্ষণ বাইরে থাকতে চাই ।
কোথায় যাবে বলো ?
আমি জানি না কোথায় যাবো , তুমি কোথাও নিয়ে চলো ভাইয়া । বাসায় গেলে এখন দমবন্ধ লাগবে আমার ।
নিউমার্কেট যাবে, ফুচকা খাবে ?
চলো যাই ।
.
.
বাসায় ফিরে এসে নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে কাঁদলো জারা । কতক্ষণ কেঁদেছে সে নিজেও জানে না কিন্তু কান্না শেষে মনটা খুব নির্ভার লাগলো অনেকদিন পর । আদিত্য নামের আগাছাটাকে পুরোপুরি মন থেকে মুছে ফেলতে পারছিল না এতোদিন । সুন্দর সময়গুলো মনে পড়ে যাচ্ছিল বারবার । আজ সব মোহ , সব দ্বিধা , সব অপরাধবোধ থেকে মুক্ত হলো সে । এখন অন্য কিছু নিয়ে ভাববে না আর । এখন তার সমস্ত ধ্যান জ্ঞান হবে লেখাপড়া আর লেখাপড়া । মাঝখানে লেখাপড়ার বেশ ক্ষতি হয়ে গেছে । সেমিস্টারের শুরুতে সে মন বসাতেই পারছিল না পড়ালেখায় । রফিকের বাসা থেকে ফিরে এসে জারা’র ভেতর একটা জেদ চেপে গেল । তাকে, তার বাবা-মাকে নিয়ে মানুষ যে সব নোংরা কথা বলে যাচ্ছে, নিজেকে যোগ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে সেই সব মানুষের মুখ বন্ধ করে দেবে সে । সে ঠিক করলো বন্ধুরা হোক অথবা আত্মীয়স্বজন, যাঁরা ই খারাপ কথা বলুক, যত খারাপ কথাই বলুক না কেন সে আর কোনো কথা গায়ে মাখবে না ।
অনেক দিন পর রান্নাঘরে ঢুকলো জারা । শিল্পী সন্ধ্যার চায়ের আয়োজন করছিল । জারা ঝটপট নুডলস তৈরি করে ফেললো চারজনের জন্য । শিল্পীর জন্য রেখে তাদের তিনজনেরটা নিয়ে মা’র রুমে এসে ঢুকলো । তাবাসসুম আর কায়সার বসে কথা বলছিলেন । মেয়েকে রুমে ঢুকতে দেখে কায়সার বললেন –
কী বানিয়েছো, পাস্তা ?
না আব্বু, নুডলস বানালাম । তুমি পাস্তা খাবে ?
তুমি যা আনবে তা-ই খাবো । কতোদিন পরে তুমি কিছু বানালে বলো তো ?
জারা দু’জনের হাতে বাটি তুলে দিয়ে সোফায় যেয়ে বসলো ।
কায়সার বললেন –
শাফিনের সাথে কথা বলেছিলে?
জি আব্বু, রাতে কথা হয়েছে ভাইয়ার সাথে ।
ও কী বললো ?
ভাইয়া বলেছে আমার কাছে যেটা ভালো মনে হয় সেটাই করতে ।
তুমি কী ডিসিশন নিলে?
আব্বু তোমরা যদি পারমিশন দাও তাহলে আমি মাস্টার্সটা এখানেই করতে চাই । কেন জানি বাইরে যেতে মন চাচ্ছে না ।
তোমার যেটা ভালো লাগবে , তুমি যাতে স্বাচ্ছন্দবোধ করবে সেটাই করো । জীবন তো তোমার । আমরা জোর করে কখনোই কিছু চাপিয়ে দেইনি তোমার ওপরে ।
মা আমি কী পড়তে পারি এখানে ?
তাবাসসুমেরও কয়দিন ধরে এই কথাটা মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিলো । এই রকম পরিস্থিতিতে জারাকে একা বাইরে পাঠানো ঠিক হবে না । সে একা একা আরো বেশি অসহায় বোধ করবে । এই সময়টায় মেয়ের পাশে থাকাটা খুব প্রয়োজন । লোকে কী বলবে, কী ভাববে এসব ধরে বসে থাকলে জীবন চলবে না । লোকের কাজ বলাবলি করা, লোক কথা বলবেই । তাই বলে লোকের ভয়ে নিজের জীবনকে বঞ্চিত করা চরম বোকামির কাজ হবে । তিনি বললেন –
তোমার যদি এখানে পড়তে ইচ্ছে করে তো এখানেই ভর্তি হয়ে যাও । বাইরে তো পরেও যাওয়া যাবে ।
থ্যাংকস মা ।
.
.
আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে । জারা ওর বারান্দায় এসে বসলো । অনেক দিন গান শোনা হয় না । পছন্দের গান চালিয়ে দিয়ে রকিং চেয়ারটায় বসলো সে । সামনের ফ্ল্যাটটায় আলো জ্বলছে । অনেক দিন ফ্ল্যাটটা বন্ধ ছিল । ছোট একটা ছেলে পড়তে বসেছে । ছোটোবেলায় সন্ধ্যা হলে সে-ও বইখাতা নিয়ে পড়ার টেবিলে বসে থাকতো এভাবে । হঠাৎ দমকা বাতাস উঠলো । একজন মহিলা এসে বারান্দা থেকে কাপড় তুলে নিয়ে দরজা জানালাগুলো বন্ধ করে দিলেন । জারা’র নড়তে ইচ্ছে করলো না । একটু না হয় ধুলোবালি লাগবে গায়ে, লাগুক । এতো সুন্দর মুহূর্তগুলোয় দরজা-জানালা বন্ধ করে বসে থাকতে তার একদম ভালো লাগে না । বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না , ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো । সাথে সাথে চারপাশ ঠান্ডা হয়ে গেল, নাকে এসে লাগলো মাটির সোঁদা গন্ধ । জারা তন্ময় হয়ে বৃষ্টির ঝরে পড়া দেখছে । পূর্ণিমার বৃষ্টির আলাদা একটা সৌন্দর্য আছে । মনে হয় যেন চাঁদের গা বেয়ে জোছনা ধুয়ে পৃথিবীতে নেমে আসছে বৃষ্টির রূপ নিয়ে । এই সৌন্দর্য অপার্থিব, এই সৌন্দর্য মাঝে মাঝে মন খারাপ করে দেয় । জারা’র আজ মন খারাপ হলো না । আজ মন খারাপের দিন না । আজ নতুন করে স্বপ্ন দেখার দিন ।
.
.
আপাতত শেষ হলো #এক_জীবনে_অনেক_জীবন । জারা’র জীবনের কিছুটা তুলে এনেছি, কিছুটা বাকি রয়ে গেছে । এক জীবনে এর মধ্যেই অনেক কিছু দেখে ফেলেছে সে, আরো অনেক কিছু দেখার বাকি । সামনের দিনের পথচলা আরো বন্ধুর । ছোট্ট একটা ভুলের মাশুল দিতে গিয়ে কখনো এক জীবন পেরিয়ে যায় নিজেকে ফিরে পেতে । প্রতিকূলতার মাঝেই কেউ কেউ আবার দারুণ ভাবে ঘুরে দাঁড়ায় ।
এই গল্প চলাকালীন নতুন এক অভিজ্ঞতা হয়েছে । আমার আগের ধারাবাহিকগুলোর তুলনায় এই গল্পে পাঠক সংখ্যা অনেক কম তবে যে বিষয়টায় মনটা ভালো হয়ে গেছে তা হলো, নেক্সট লেখা পাঠকও এই গল্পে হাতে গোনা । আমরা এতোটা সময় দিয়ে লেখালেখি করি, পাঠক যদি এক লাইনেও মন্তব্য লেখেন, অনুপ্রেরণা পাই ।
যাঁরা পড়েছেন, মোটামুটি সবাই যেন গল্পের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন পুরোটা সময় । সবাই তাঁদের মনের কথাটা জানিয়েছেন, মতামত দিয়েছেন । ইনবক্সে অনেকেই জানিয়েছেন তাঁদের জীবন কাহিনি । তাঁদের সবার সাথেই যেন অদৃশ্য একটা বন্ধন তৈরি হয়েছিল এই সময়টাতে । এই অনুভূতি তুলনাহীন । তাঁদের সবার প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা রইলো । যেহেতু বইমেলার বিষয়টা মাথায় আছে তাই জারা’র পরবর্তী কাহিনি অনলাইনে শেয়ার করবো না । সবকিছু ঠিক থাকলে ইনশাআল্লাহ আগামী বইমেলায় হয়তো মলাটবন্দী হবে #এক_জীবনে_অনেক_জীবন ।
এই বইটা কবে বেরাবে
Jarar jibon ta half roye gelo…… But purotai bastob mone hoyeche…. Ata socharachor bastobe hoye thake…… Jarar baki jibon ta jante parle khusi hotam…… Thanks…..