#এক_জীবনে_অনেক_জীবন(১২)
*********************************
এই তো চিনতে পেরেছিস ।
মনে পড়লো সাদাতের । তাদের চেয়ে দুই ক্লাস ওপরে পরতো রফিক । লেখাপড়ার চাইতে অন্য সবদিকে তার খেয়াল থাকতো বেশি । কোথায় কোন খেলা, কোথায় প্রতিযোগিতা হচ্ছে, কোথায় ঝগড়া- মারামারি এইসবে তার মন পড়ে থাকতো । দুই ক্লাসে ফেল করার পর ক্লাস নাইনে ওঠার পর সাদাত তাকে পেয়েছিলো সহপাঠী হিসেবে । বিভাগ আলাদা হওয়ায় একসাথে কখনো ক্লাস করতে হয়নি রফিকের সাথে কিন্তু ইউনুস স্যারের ম্যাথ কোচিং-এ রফিকের সাথে দেখা হতো । কোনো এক বিশেষ কারণে সে সাদাতকে খুবই পছন্দ করতো । জোর করে সাদাতের সাথে বাসায়ও চলে এসেছিলো কয়েকবার । সাদাতের খুব অস্বস্তি হতো ওর সাথে মিশতে । গায়েপড়া স্বভাবের রফিককে সাদাতের ভালো লাগতো না আরো একটা কারণে, বানিয়ে বানিয়ে প্রচুর মিথ্যে বলতো ছেলেটা । ওর মিথ্যেগুলো অচিরেই ওর নিজের কথাতেই ধরা পড়ে যেতো কারণ মিথ্যে বললে তো মানুষের মনে থাকে না আগে কী বলেছিলো । সে কারণে পরে যখন ঐ একই গল্প করতো, আগেরটার সাথে সেটার কোনো মিলই থাকতো না ।
সেই রফিককে এতোদিন পরে দেখে একটু অবাক হলো সাদাত । আগের চেয়ে বেশ ধীর স্থির হয়েছে কথাবার্তায় । চেহারাতেও বেশ ভদ্র একটা ভাব ফুটে আছে । রফিক কথার পিঠে কথা বলেই যাচ্ছে । দু’একটা কথার উত্তর না দিলে খারাপ দেখায় তাই সাদাত সৌজন্য করে বললো –
হুম আমারও ভালো লাগলো তোমাকে দেখে । অনেকটুকু পাল্টে গেছো তুমি ।
আর তুই আগের মতোই আছিস, ইনোসেন্ট টাইপ ।
সাদাত মৃদু হেসে ডাক্তারের রুমের দিকে তাকালো ।
রফিক বললো –
তারপর বল তোর কী অবস্থা , বিয়ে করেছিস ?
না, মাত্রই তো চাকরিতে ঢুকলাম । তুমি বিয়ে করেছো ?
আরে না, বিয়ের সময় কোথায় ? বিজনেস গোছাতে এতো ব্যস্ত থাকি যে সময় করে উঠতে পারি না তবে কিছুদিনের মধ্যে বিয়েটা করে ফেলবো ।
ভালো ।
তুই তো আগের মতোই আছিস । এখনো এতো কম কথা বলিস কী করে ? এতো কম কথায় চাকরি করিস কেমনে দোস্ত ?
আমার চাকরিটায় আসলে কথার চেয়ে কাজ বেশি করতে হয় তাই খুব একটা অসুবিধা হয় না ।
আমার তো বিজন, তপু, সালেহীন ওদের সবার সাথে যোগাযোগ আছে । তোর কথা কতো জনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেউ বলতে পারলো না ।
কথা বলতে বলতেই রফিক পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে বললো –
দে তোর মোবাইল নাম্বারটা দে । এইবার আর তুই হারাতে পারবি না ।
সাদাত খুব অনিচ্ছা সত্ত্বেও মোবাইল নাম্বারটা বলতে যাবে তক্ষুনি নিলুফারের নাম আর সিরিয়াল নাম্বার শুনতে পেলো স্পিকারে । সাদাত বললো –
মা’কে দেখিয়ে নিয়ে আসছি রফিক । এসে কথা বলছি তোমার সাথে ।
ঠিক আছে তুই ডাক্তার দেখানো শেষ করে আয়, আমি এখানেই আছি ।
সাদাত মা’কে নিয়ে ডাক্তারের রুমে ঢুকে গেলো ।
ডাক্তার দেখানো শেষে বাইরে এসে আগের জায়গায় আর রফিককে দেখতে পেলো না সাদাত । আশপাশে তাকিয়ে দেখলো, পুরো রুমের কোথাও নেই রফিক । সাদাত মনে মনে ভাবলো ভালোই হয়েছে রফিক না থাকাতে, নতুন করে আর ওর সাথে কোনো সম্পর্কে জড়াতে চায় না সে । এ ধরণের আঁতেল মার্কা ছেলেমেয়েদের সাথে মিশতে তার একদমই ভালো লাগে নি আগেও আর এখন তো আরো লাগে না ।
মায়ের ব্লাড টেস্ট আর এক্সরে করানো শেষে ওষুধ নিয়ে হসপিটাল থেকে বের হলো সাদাত । নিলুফার জিজ্ঞেস করলেন –
কার সাথে কথা বলছিলি তখন ? চেহারাটা কেমন চেনা চেনা লাগছিলো ।
তোমার মনে আছে মা ওর কথা ? ওর নাম রফিক । আমার সাথে কয়েকবার বাসায় এসেছিলো স্কুলে থাকার সময় ।
মনে করতে পারছি না কিন্তু চেহারাটা কেমন পরিচিত লাগলো ।
.
.
অনেকক্ষণ যাবত তাবাসসুমের চেহারাটা থমথমে হয়ে আছে । কায়সার বেশ বুঝতে পারছেন কিছু একটা হয়েছে কিন্তু সবার সামনে জিজ্ঞেস করতে পারছেন না কথাটা । একেকবার মনে হচ্ছে স্বর্ণা কী কোনো বিষয় নিয়ে কিছু বললো তাবাসসুমকে ? মেয়েদের এই বিষয়গুলো খুবই সেনসেটিভ । কখন যে কোন কথা ধরে বসে থাকে, বুঝতে পারা মুশকিল ।
রাতে যখন রুমে এলেন তখন আর কায়সার তাবাসসুমকে জিজ্ঞেস করলেন –
আজকে তোমার কী হয়েছিল বলো তো ? সারাদিন মুড অফ ।
কিছু না তো , এমনি একটু খারাপ লাগছিল ।
এটা একটু খারাপ লাগার নমুনা ? স্বর্ণা কিছু বলেছে ?
না না, স্বর্ণা কেন কিছু বলবে ? ও বেচারি নিজের সাধ্য মতো করে যাচ্ছে আমাদের জন্য ।
তাহলে ? তোমার তো এতো সহজে মন খারাপ হয় না তাবাসসুম ।
কায়সারের কথায় তাবাসসুমের কান্না চলে এলো ভীষণ । কথাটা কারো কাছে বলতে পারলে একটু হালকা লাগতো তার কিন্তু এখন বলবেন কার কাছে ? এই আনন্দের সময়টা তিনি নষ্ট করে ফেলতে চাইছেন না । তার ওপর মেয়ের যে রকম উদ্ধত আচরণ আজ দেখলেন, এই মেয়ে তো লোকজনের সামনে নাস্তানাবুদ করে ছাড়বে মনে হচ্ছে ।
কী হলো তাবাসসুম বলো ? তোমার কী অসুস্থ লাগছে, ট্রিপগুলো ক্যান্সেল করে দেবো ?
না না ট্রিপ কেন ক্যান্সেল করবে ? এরা সবাই কতো আগে থেকে প্ল্যান করে রেখেছে । মনটা খারাপ লাগছে রোজা’র জন্য । মেয়েটাকে নিয়ে আসলে ভালো হতো । মন খারাপ করছিল ।
আবার আসা যাবে সবাই একসাথে । শুধু এ জন্যেই তোমার মন খারাপ, অন্য কিছু না তো ?
না আর কিছু না ।
আমার কিন্তু সারাদিন খুব টেনশন হচ্ছিলো তোমার এমন চেহারা দেখে । ওহ, জারা’র আজকে কী হয়েছিল বলো তো ?
কেন ও আবার কী করলো ?
কেমন যেন ছটফট করছিল মনে হলো ।
ও তো এ রকমই । কোথাও স্থির হয়ে বসতে দেখেছো ওকে ? সারাক্ষণই ছটফটানি লেগে আছে ।
জারা যদি এখানে চলে আসতে পারে তাহলে ভালোই হবে, কী বলো ?
হুম, আমি চাই ও এখানে চলে আসুক । শাফিনকে বলেছি আমি । শাফিনও কালকে কথা বলছিল জারা’র সাথে চলে আসার বিষয়টা ।
তবে শাফিনের চলে আসাটা যতো সহজ হয়েছে, জারা’র অতো সহজ হবে না মনে হয় ।
চেষ্টা করতে তো দোষ নেই ।
জারাও যদি চলে আসে, তুমি কিন্তু একা হয়ে যাবে তখন ।
ছেলেমেয়েদের তো আর সারাজীবন নিজের কাছে ধরে রাখা যায় না । বড় হলে ছেড়ে তো দিতেই হয় । গতবছর এমন সময় আমার তিন ছেলেমেয়ে আমার কাছে ছিল অথচ এখন দেখো, দু’জনেকেই ছেড়ে দিতে হয়েছে । জারাও এভাবেই দূরে সরে যাবে সময়ের প্রয়োজনে । আর আমি একা হলাম কোথায় ? তুমি আছো না আমার সাথে ?
কায়সার হেসে বললেন –
হুম তুমি আর আমি সেই শুরুর দিনগুলোর মতো একা হয়ে যাবো ।
একা না, দু’জন ।
.
.
জারা সুযোগ খুঁজছিল আদির সাথে কথা বলার জন্য । মা’র কোনো ভরসা নেই । মা সবার সামনে বকাঝকা করতে, মোবাইল কেড়ে নিতে কোনো দ্বিধা করবেন না । মোবাইলটা নিয়ে নেয়ার আগে আদির সাথে কথা বলা দরকার । সবাই তখন একসাথে বসে আড্ডা দিচ্ছিলো নিচে । সে শ্রেয়ার রুমে এসে দরজা লক করে আদিত্যকে নক করলো –
হ্যালো আদি
বলো জারা? এখন যে ফোন করলে ? আমি তো এক্সপেক্ট ই করিনি এখন তোমার ফোন ।
আদি একটা প্রবলেম হয়ে গেছে ।
কী হলো আবার ?
মা তোমার বিষয়টা জেনে গেছে ।
কেমন করে ? ওখানে তোমার মা আমার বিষয়টা জানলো কেমন করে ?
মা আমার মোবাইল চেক করেছে । তোমার সাথে কথা শেষ করে ডিলিট করতে ভুলে গিয়েছিলাম । মা সবকিছু পড়েছে ।
তার পরের অবস্থা বলো । উনি তোমার মোবাইল চেক করবেন কেন, তুমি কী ছোট বাচ্চা ?
মা তো আমার মোবাইলটাও নিতে নিতে চাচ্ছেন । তোমার সাথে হয়তো এর মধ্যে আর কথা বলতে পারবো না ।
মানে কী ! মোবাইল কেন নেবে ? মোবাইল নিয়ে নিলে তোমার সাথে আমার যোগাযোগ হবে কেমন করে ? মোবাইল দিও না খবরদার । জারা আমার মনে হচ্ছে এটা তাঁদের কোনো প্ল্যান । আমার কেন জানি মনে হচ্ছে তাঁরা তোমার বিয়ে দেয়ার জন্যই ওখানে নিয়ে গেছে । দেখো জারা এমন কিছু হলে আমি কিন্তু একদম শেষ হয়ে যাবো ।
মোটেও এমন কিছু হবে না । তুমি এটা বেশি বেশি চিন্তা করছো আদি ।
তুমি মোটেও মোবাইল দিতে পারবা না ।
দেখো আদি মা’কে এখন আর রাগাতে চাচ্ছি না । মা যদি আবার মোবাইলটা চায় তো দিয়ে দেবো , না চাইলে তো আর দিচ্ছি না । মা যদি এখন রেগে যান সেটা খুব ভয়ংকর হয়ে যাবে বুঝতে পেরেছো । আমি মা’কে রাগাতে চাচ্ছি না ।
প্লিজ জারা চলে আসো , আমার একদম ভালো লাগছে না । তোমাকে ছাড়া এই শহর থেকে আমার মন উঠে গেছে । হঠাৎ করে কোথাও হারিয়ে যাবো কিন্তু ।
তোমাকে কোথাও হারাতে দিলে তো ।
তাহলে চলে আসো আমার কাছে ।
চলে তো আসবো ই । আর মাত্র ক’টা দিন । আদি প্লিজ আমি যদি এর মধ্যে যোগাযোগ করতে না পারি, তুমি একদম টেনশন কোরো না । শোনো আমি আর বেশিক্ষণ কথা বলতে পারবো না । সবাই নিচে আছে, আমার যেতে হবে ওখানে ।
যেও না জারা প্লিজ ।
কোথাও যাবো না, তোমার কাছে চলে আসবো । আপাতত মা’কে রাগাতে চাচ্ছি না । আমি সুযোগ পেলেই তোমাকে নক করবো । রাখছি আদি, বাই ।
.
.
রফিক যদিও ঠিক করেছিল চাকরিতে জয়েন করবে না তবুও শেষ পর্যন্ত জয়েন করেই ফেললো । আব্বার প্রতিদিন সকালের এই হাউকাউ লেকচারের শোনার চেয়ে কয়েকটা দিন সে চাকরিতে সময় দেবে । মা’কে এর মধ্যেও জিজ্ঞেস করেছে সঞ্চয়পত্রের কথা । মা কিছুই বলতে পারলো না । বিষয়টা নিয়ে আব্বার সাথেই কথা বলতে হবে । ব্যবসা যখন করতেই হবে, সে ভালো কোনো ব্যবসা করবে । আব্বা তো স্ট্যাটাস বুঝে না । এখন বসে দোকানদারি শুরু করলে এলাকায় যে রফিককে নিয়ে লোকজন হাসাহাসি করবে, সেই বোধটাও আব্বার নেই ।
প্রথম দু’দিন অফিসে তার কাজের অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর হলো না । তাকে যার সাথে থেকে কাজ শিখতে হবে সেই ছেলেটাকে মোটেও পছন্দ হয়নি তার । সবজান্তা একটা ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়ায় সারাক্ষণ । শুরুতেই একগাদা নীতিবাক্য শুনিয়ে দিয়েছে রফিককে । সেলসে থাকতে হলে না-কি আদবকেতা জানতে হয় খুব ভালোভাবে । সবসময় ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে হয় ।
প্রথমদিন যখন রফিক ফাহিমের সাথে অফিস ভিজিটে গেলো, ফাহিম তাকে বারবার করে বলে দিলো, খুব মন দিয়ে সবকিছু খেয়াল করতে । কীভাবে কথা বলতে হয়, কীভাবে ক্লায়েন্টের সাথে ডিল করতে হয় এইসব । রফিক মনে মন খুব হেসেছিলো । আরে ব্যাটা তুই আমাকে কথা বলা শেখাবি ! এই জীবনে কথাটাই তো সবচেয়ে ভালো বলতে পারি আমি ।
ম্যানেজারের রুমে বসে অস্থিরতায় ছটফট করছিল রফিক । ফাহিম তখন থেকে যে হারে স্যার স্যার করে যাচ্ছে সামনে বসা লোকটাকে, রফিকের মনে হচ্ছিল এমন করে স্যার স্যার বলে সে জীবনেও ডাকতে পারবে না কাউকে । এই জন্যই সে এমন ছোটখাটো চাকরি করতে চায় না । আব্বা নিজেও সারাজীবন করে গেল চাকরগিরি এখন তাকেও সেই চক্করের মধ্যে ঠেলে দিতে চাচ্ছে ।
ম্যানেজারের রুম থেকে বের হয়ে এসে রিসিপশনে চেকগুলো বুঝে নিচ্ছিল ফাহিম । রফিক ঝট করে বলে ফেললো –
আচ্ছা এতো স্যার স্যার করার কী আছে ? আপনি যেমন করে বিগলিত হয়ে যাচ্ছিলেন, আমার খুব হাসি পাচ্ছিলো ।
আপনার হাসি পাচ্ছিলো ! এই কাজটাই আপনাকে শিখতে হবে সবার আগে । কী করে ক্লায়েন্টের সাথে কথা বলতে হয় এটা হচ্ছে ফার্স্ট লেসন । বুঝতে পেরেছেন ? আপনার আচরণ, আপনার ব্যবহারের উপরেই নির্ভর করছে সবকিছু ।
তাদের প্রয়োজনেই তো তারা আপনাদের কাছ থেকে জিনিস কিনবে । এতে এতো তেল দেয়ার কী আছে ?
তা তো কিনবেই কিন্তু মনে রাখবেন, বাজারে এমন শতো শতো কোম্পানি আছে । সব ছেড়ে আপনার কাছ থেকে তখনই তারা প্রোডাক্ট নেবেন যখন আপনি তাদের কনভিন্স করতে পারবেন আপনার প্রোডাক্টের কোয়ালিটি দিয়ে । আর এই কাজটা তখনই সহজ হয় যখন আপনার বিহেভিয়ার পজিটিভ থাকে । আমি কী আপনাকে বুঝাতে পারলাম বিষয়টা ?
রফিক মনে মনে হাসলো ফাহিমের কথা শুনে ।
কাজটাকে ভালোবাসতে শিখুন তাহলে দেখবেন কাজ করে আনন্দ পাবেন ।
জ্বি বুঝতে পেরেছি । মুখে এমনটা বললেও মনে মনে রফিক বললো –
তোমাদের মতো কাঁধে ব্যাগ নিয়ে অফিসে অফিসে ঘুরে বেড়ানোর জন্য এই রফিকের জন্ম হয়নি । রফিকের জন্ম হয়েছে বস হওয়ার জন্য । কিছু সময়ের অপেক্ষা মাত্র , তারপর এই ফকিন্নি জীবন থেকে মুক্তি মিলবে রফিকের । তখন তোমার মতো ফাহিমরা চাকরির জন্য স্যার স্যার করবে এই রফিককে ।…………………