এক মুঠো গোলাপ পর্ব ২৮

এক মুঠো গোলাপ
Sinin Tasnim Sara
২৮
____
অলসতায় ভরা শীতের সকাল। পুরো শহর কুয়াশায় ঢাকা। খোলা আকাশের নিচে দাঁড়ালেই মনে হচ্ছে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে বসবাসরত মানুষের একটা মূল সমস্যা, শীত আর গরমের মাঝামাঝি থাকতে থাকতে শিশিরবিন্দু মাথায় পড়লেই অসুস্থতা জেঁকে বসে।
বেশ কয়েকদিন যাবৎ শৈত্যপ্রবাহ চলছে। সূর্যের দেখা নেই। বাসার বাইরে কতটা দিন পা রাখা হয়নি, বলতে পারেন না কবির সাহেব। একে তো শারিরীক অসুস্থতা, তার ওপর ঠান্ডা!
স্ত্রীর শাসন তো আছেই। মনটাও ইদানীং ভালো থাকে না। মেয়ে দু’টো ছাড়া বাড়িটা কেমন নিস্তব্ধ।
এখন তবু সঙ্গী রয়েছে। সঙ্গীহারা হবার পর কি অবস্থা হবে ভাবলেই একরাশ বিষণ্ণতা ঘিরে ধরে।
,
বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে পত্রিকার ফ্রন্ট পেইজ গুলোতে অমনোযোগে চোখ বুলচ্ছিলেন আর নানামুখী চিন্তায় মগ্ন ছিলেন কবির সাহেব। চিন্তা ভঙ্গ হলো সেন্টার টেবিলের ওপর বেজে ওঠা ফোনের শব্দে। চোখের সামনে থেকে পেপার সরিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে ফোনটা টেনে নিলেন। ছোটো শ্যালক আসাদের নম্বর দেখে খানিক অবাকই লাগলো। প্রায় পাঁচ বছর হবে আসাদের সাথে তার যোগাযোগ নেই অর্থাৎ কথাবার্তা বন্ধ। বাসায় যাওয়া-আসা তো হয় কিন্তু শ্যালকের সাথে কোনোপ্রকার কথাবার্তা তিনি বলেন না আর না ওপাশের ব্যক্তিটা বলে।
মস্তিস্কে ঘুরপাক খাওয়া নানাবিধ চিন্তা বাদ দিয়ে কলটা রিসিভ করলেন কবির সাহেব। গম্ভীর গলায় বললেন_
— হ্যালো।
খানিক নীরবতার পর আন্তরিক ভাবে সালাম জানালেন আসাদ সাহেব। বহুদিন যোগাযোগ না থাকায় আড়ষ্টভাব চলে এসেছে। অন্তরে কথা জমা কিন্তু গলা দিয়ে বেরুচ্ছে না। অবস্থা বুঝতে পারলেন কবির সাহেব। হালকা কেশে বললেন_
— কি ব্যাপার আসাদ? এতদিন পর।
— জ্বী দুলাভাই। একটু দরকারি কথা ছিল।
— হ্যাঁ বলো।
— হেমাঙ্গিনী কি এখন ঢাকায় থাকে?
— হেমাঙ্গিনী কে আসাদ?
— দুলাভাই..
— তোমাকে একদিনই বলেছি ওকে এই নামে সম্বোধন করবে না। ওর নাম সুপ্ত, হেমাঙ্গিনী নয়।
— সত্যিটা আর কত অস্বীকার করবেন আপনারা।
— দেখো পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে, সবাই সবার জীবনে সুখী আছি। এতদিন বাদে কেন সুখটা নষ্ট করতে চাইছো!
— আমি ওর বাবা। আমার কি ইচ্ছে করে না ওকে একবার দেখতে, মাথায় হাত রেখে আদর করতে?
— তুমি ঊনিশ বছর আগেই সে অধিকার হারিয়েছ আসাদ।
— আপনি তো সবটাই জানতেন। ইনফ্লুয়েন্সড না হলে..
— ভালোবাসা নামক ডিকশিনারিরতে “ইনফ্লুয়েন্স” বলতে কোনো শব্দ থাকে না। এখানে একটা শব্দই থাকে আর তা হলো বিশ্বাস। যে পার্টনারের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারেনা সে ভালোবাসা কি তা-ই জানেনা।
ভালোবাসার রুলস হলো, একে অপরকে রেস্পেক্ট করা;আগলে রাখা। সুসময়-দুঃসময়ে নিঃস্বার্থভাবে পাশে থাকা এবং দূরত্ব হলেও একে অপরের প্রতি আস্থা রাখা।
যাক গে ভালোবাসা নিয়ে ডিসকাশনের সময়টা বোধহয় আমরা পেরিয়ে এসেছি।
তাছাড়াও তোমার পারসোনাল লাইফে ইন্টারফেয়ার করাটা আমার সাজে না, আমি ইন্টারেস্টেডও নই।
— সাজে না কি! ইন্টারফেয়ার তো করে ফেলেছেন সে-ই কবে। শুধু একটা প্রশ্ন, আমার লাইফটা নিয়ে আর কত খেলবেন আপনারা। এতটা সময় পেরিয়ে গেলো..
— হাসিও না আসাদ। তোমার লাইফ নিয়ে খেলার আমরা কে? আর এসব কথা আসছেই বা কেন! বয়স হয়েছে আসাদ। ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে, অথচ বাচ্চামি করছো তুমি। গ্রো আপ।
— আমার মেয়ে সুপ্তকে আমায় ফেরত দিন দুলাভাই।
— সুপ্ত কোনো খেলনা নয় আসাদ। যে একবার এর বাড়ি তো একবার ওর বাড়ি।
— আমার সাথে হেয়ালি করবেন না।
— ডোন্ট শাউট।
— অবশ্যই আমি শাউট করবো। ইনফ্যাক্ট আমি আপনাদের নামে কেইস করে দিবো, আমার মেয়েকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিজেদের কাছে রেখে দেয়ার জন্য।
— কিসব উল্টোপাল্টা ল্যাঙ্গুয়েজ ইউজ করছো তুমি। সন্তান কে কোনো বাবা-মা ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখে নাকি!
আর কি বললে কেইস করবে। করো। তার পূর্বে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও, সুপ্ত কি জানে তুমি ওর বায়োলজিক্যাল ফাদার?
এ পর্যায়ে চুপ করে গেলেন আসাদ সাহেব। কাতর স্বরে বললেন_
— একজন সন্তানকে তার বাবা-র থেকে দূরে রেখে কি পাচ্ছেন আপনারা দুলাভাই?
— তোমার কথাবার্তা অসংলগ্ন শোনাচ্ছে আসাদ। তুমি মনে হয় উল্টোপাল্টা কিছু খেয়েছো। যাও বাসায় গিয়ে একটা ঘুম দাও। ফ্রেশ মাইন্ডে তোমার সাথে কথা হবে। আর হ্যাঁ সব যেরকম আছে তেমনটাই থাকতে দাও। এতেই সবার মঙ্গল।
কথা না বাড়িয়ে ফোনটা রেখে দিলেন কবির সাহেব।
,
বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ কলিংবেল বাজছে। কে জানে দরজায় কে!
— নিদের বাবা, দেখো না দরজায় কে?
রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বললেন নিশাত। হেলদোল হলো না কবির সাহেবের।
বিরক্ত হয়ে চুলোর আঁচ কমিয়ে নিশাতই পা বাড়ালেন দরজার দিকে।
বিরক্তিভাব কাটিয়ে মেকি হাসি ফুটিয়ে দরজা খুললেন নিশাত।
সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তিদের ওপর দৃষ্টিপড়া মাত্র মেকি হাসিও উবে গেল মুখের। তাৎক্ষণিক একরাশ উদ্বেগ ফুটে উঠলো। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলেন_
— অনিমা তুমি?
_____
ফ্যামিলিসমেত সুপ্তদের বাসায় সম্বন্ধ নিয়ে এসেছে নিদ্রর মা অনিমা । নিদ্র অবশ্য উপস্থিত থাকতে পারেনি তবে সে রংপুরেই আছে।
এদিকে সুপ্ত এসবের কিছুই জানে না। তাকে ইচ্ছে করেই বলেনি নিদ্র। ইনফ্যাক্ট বুঝতেও দেয়নি। আন্সার পজিটিভ হলে ইট উইল বি আ বিগ সারপ্রাইজ ফর হার। আর নেগেটিভ হলে তো….
,
সুক্ষভাবে সারা ঘরে চোখ বুলিয়ে চা’য়ে চুমুক দিলেন অনিমা। নিশাত-কবির সাহেব দু’জনেই তার দিকে তাকিয়ে।
তাদের দৃষ্টি এদিকে বুঝতে পেরে মৃদু হাসলেন অনিমা। নিশাতের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করলেন_
— ছোটো আপা। আপনাকে এত উদ্বিগ্ন লাগছে কেন?
— নাহ্ তেমন কিছু না।
অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন নিশাত।
— অনেক তো ফর্মালিটি হলো। এখন মূল প্রসঙ্গে আসি। আপা আপনার ছোটো মেয়েটাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আপনাদের মত থাকলে ওকে বাড়ির বউ করে নিয়ে যেতে চাই।
এ পর্যায়ে হালকা কেশে কবির সাহেব বললেন_
— দেখো সুপ্ত তো এখনো পড়ালেখা করছে। ওর বিয়েশাদি নিয়ে আমরা আপাতত ভাবতে চাইছি না। ক্যারিয়ারটা গড়ুক। তারপর বিয়ের কথা চিন্তা করা যাবে।
— আমরা কি ওর পড়ালেখা অফ করে দেবো দুলাভাই!
ছোটোবেলা থেকেই তো আমাকে চেনেন আপা। আমাকে দেখে কি মনে হয় আমি অতটা নিচু মন মানসিকতার মানুষ, বাড়ির বউয়ের ক্যারিয়ারের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবো?
আমি তো নিজেই একজন স্বাবলম্বী মানুষ। খ্যাতনামা মহিলা উদ্যোক্তাদের মধ্যে একজন। আমি অবশ্যই চাইবো আমার বাড়ির বউ উচ্চশিক্ষা অর্জন করুক।
আপনারা চিন্তা করছেন কেন? সুপ্ত আমার কাছে মেয়ের মতই থাকবে।
তাছাড়াও নিদ্র আর সুপ্ত একে অপরকে ভীষণ পছন্দ করে। দু’জনেই প্রাপ্ত বয়স্ক। সময় থাকতেই দায়িত্ব নিয়ে চার হাত এক করে দিই ।
বাচ্চারা যাতে ভুল পথে পা না বাড়ায় সেটা দেখবার দায়িত্ব তো আমাদের বাবা-মায়েরই তাই না?
অনিমার সহজ সরল ব্যবহার বেশ চিন্তায় ফেলে দিলো মিস্টার এবং মিসেস কবির কে।
তার যুক্তির সামনে যেন আজ কিছুই বলতে পারছেন না কবির সাহেব।
এরকম আলাপ আলোচনা বেশ কিছুক্ষণ চললো। নিদ্রর মামা-মামীও এক পায়ে রাজি সুপ্তকে বাড়ির বউ করবার জন্য।
তাদের আগ্রহ দেখে আরো কথা ভুলে যাচ্ছিলেন কবির সাহেব। কিন্তু এত জলদি কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে চাইছেন না।
এজন্য সংক্ষেপে বলে দিলেন, “আমার তো বড় কন্যা বাইরে থাকে। তারও একটা মতামত আছে বোনের ব্যাপারে। তার সাথেও কথাবার্তা বলে দেখি । নিজেরাও চিন্তাভাবনা করি। এরপর না-হয় সিদ্ধান্ত জানাই!”
— অবশ্যই। সময় নিন তবে উত্তর কিন্তু পজেটিভ চাই আপা-দুলাভাই।
মুচকি হেসে বললেন নিদ্রর মামা-মামী।
,
নিশাতের মন দোদুল্যমান অবস্থায়। বুঝতে পারছিলেন অনিমা। ভরসা দিতেই চলে যাবার মুহুর্তে তার হাত ধরে আন্তরিক ভাবে বললেন_
“আপা অতীতে যা কিছু হয়েছে তা ভুলে যান। আমি সত্যিই খুব লজ্জিত তখনকার কর্মকাণ্ডের জন্য। আসলে বয়সটাই এমন ছিলো..
আমাদের সময়টা পেরিয়ে গেছে। আমরা কিন্তু তখুনি মুভ অন করেছি। নিদ্রর বাবা জীবনের অন্য মানে শিখিয়েছে আমাকে। এই যে আজ এতদূর আসতে পেরেছি সব নিদ্রর মুখের দিকে তাকিয়ে।
ভালো-খারাপ সবার মাঝেই থাকে। নিজের খারাপ দিকটাকে সেই কবে মাটিচাপা দিয়ে দিয়েছি বুকের ভেতর।
অতীতের কথা ধরে রাখতে নেই আপা। আমি ভুলে গিয়েছি। আপনারাও ভুলে যান।
নিজেদের ক্লেশের কারণে সন্তানগুলোর মুখের হাসিটা কেড়ে নেবেন না। সম্পর্কটা মেনে নিন, আমি কথা দিচ্ছি আপনার মেয়ে আমার ছেলের কাছে ভালো থাকবে”
চলবে?

[বিয়া খাইবার জন্য রেডি হন 🥱]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here