#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ২১
-প্রণব!!! তুই? তুই এখানে কীভাবে?
চোখে মুখে একরাশ বিস্ময় ফুটিয়ে তুলে প্রশ্ন করলো আনিলা। প্রণব সেদিকে কর্ণপাত করলো না। নিজের বুকের ওপর স্পৃহার ঠেকিয়ে রাখা মাথা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো। এক হাতে ওকে জড়িয়ে ধরে অন্য হাত দিয়ে স্পৃহার গালে হালকা বারি দিয়ে ব্যস্ত স্বরে বললো,
-স্পৃহা, চোখ খোলো! লুক এট মি, স্পৃহা!
কিন্তু স্পৃহা নির্বিকার ভঙ্গিতে জ্ঞানহীন অবস্থাতেই পড়ে রইলো। প্রণব এবার ওকে কোলে তুলে নিয়ে প্রান্তিকে তাড়া দিয়ে বললো,
-মাকে ফোন দিয়ে আসতে বল! অথবা কোনো ডক্টর পাঠাতে বল। ফাস্ট!!
প্রান্তি মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানিয়ে ফোন ঘাটতে শুরু করলো।
.
পুরো রুম জুড়ে পিনপতন নীরবতা। স্পৃহাকে কিছুক্ষণ আগেই ডাক্তার এসে দেখে গিয়েছেন। আপাতত ওর মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে রাখা হয়েছে। স্পৃহার দিকে মুখ করে গম্ভীরভাবে দুই হাত দিয়ে নিজের মুখ চেপে বসে আছে প্রণব। অদূরে দেয়ালে ঠেস দিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে প্রান্তি। আনিলাও এক সাইডে দাড়িয়ে হাসফাস করছে। কিন্তু কিছু বলতে পারছে না সে।
আনিলার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ যাবৎ উৎসুক দৃষ্টিতে সবটা পর্যবেক্ষণ করছে আশফি। অবশেষে নিজের কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে মুখ উঁচিয়ে আনিলার দিকে তাকিয়ে বললো,
-মাম্মা, তোমরা সবাই এমন স্যাড মুডে কেন দাঁড়িয়ে আছো? কিউট মাম্মা এভাবে শুয়ে আছে কেন? কী হয়েছে? আমায় বলো না!
আশফির কথা কানে পৌঁছুতেই প্রণব মুখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে ওর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকায়। আনিলার দিকে তাকিয়ে মন্থর কন্ঠে বলে,
-তোর ছেলে?
আনিলা উপর নিচে হালকা মাথা দুলাতেই প্রণব জোরপূর্বক মুখে হাসির রেখা টেনে আশফির দিকে হাত বাড়িয়ে বললো,
-হেই, চ্যাম্প! কাম টু মি।
আশফি ধীর পায়ে এগিয়ে এসে প্রণবের কোলে বসলো। প্রণব ওর মাথার চুল গুলো এলোমেলো করে দিয়ে বললো,
-নাম কী তোমার?
আশফি স্পৃহার দিকে তাকিয়ে থেকেই বললো,
-আমার তো অনেক নাম! তুমি আশফি বলেই ডেকো।
-আচ্ছাহ্? আমার নাম জানতে চাইবে না?
-তোমায় তো আমি চিনি-ই! তোমাকে তো সবাই-ই চেনে!! রকস্টার বলে কথা। টিভিতে তোমার অনেক গান শুনেছি। তোমাকেও অনেক দেখেছি, হুম!
প্রণব ভ্রু বাঁকিয়ে হেসে বললো,
-তাই নাকি? দ্যাট’স গ্রেট! তাহলে আমাকে তুমি কী বলে ডাকবে?
আশফি ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ভাবুক ভঙ্গিতে বললো,
-উমমম্… রকস্টার বলেই ডাকবো। মিস্টার রকস্টার! ওকে?
বলেই নিজের হাতের ছোট্ট মুঠো বাড়িয়ে দিলো। প্রণবও সেই মুঠোয় নিজের হাতের মুঠো মিলিয়ে হাসি মুখে বললো,
-ওকে, ডান! কিন্তু তুমি তো সেই কখন এসেছো! এখনো কিছু খাওনি। খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই। প্রান্তি, ওকে নিচে নিয়ে গিয়ে কিছু খাইয়ে দে তো!
আশফি মুখ ছোট করে বললো,
-হুম, অনেক খিদে পেয়েছে আমার। আমি খেয়ে আসছি এখুনি।
বলেই প্রান্তির হাত ধরে বেরিয়ে গেল। প্রণব আশফির ছোট্ট সত্তাটিকে অপলক দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে ভাবলো, প্রকৃতি এতো নিষ্ঠুর কেন? এই নিষ্পাপ শিশুটাকে অন্তত নিজের নিষ্ঠুরতা থেকে বঞ্চিত করতে পারতো। জন্মের আগেই পিতৃহারা হলো। তবুও বাবা নামক একটা বটবৃক্ষের ছায়াতলে আশ্রয় পেয়েছিল সে। কিন্তু সেই ছায়াটাও ওর জীবনে দীর্ঘস্থায়ী হলো না।
-এটা তোর বাড়ি? স্পন্দন ভাইয়া যে বললো স্পৃহা ওর ফ্রেন্ডের বাসায়। তার মানে তোর বোন স্পৃহার ফ্রেন্ড।
আনিলার বাক্যস্রোত কানে ভেসে আসায় চিন্তাজগতে ভাটা পড়লো প্রণবের। সে চোখ ঘুরিয়ে আনিলার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো,
-সবটা তো বুঝতেই পেরেছিস! উত্তর আর কী দেবো?
-এতো বছরে একবার যোগাযোগ অন্তত করতে পারতি আমার সাথে!
প্রণবের ভ্রু কুঁচকে গেল। তপ্ত সুরে বললো,
-‘যোগাযোগ করতে পারতি’ মিনস হোয়াট? বিয়ে করে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিলি তুই। তোর কাছে হয়তো আমাদের স্কুল টু কলেজ লাইফের বন্ধুত্ব থেকে সংসার জীবনটার প্রায়োরিটি বেশি ছিল! ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পরও তোর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি আমি। কিন্তু কোনো খোঁজ পাইনি।
একদমে কথাগুলো বলেই আনিলার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাশভারী কন্ঠে বললো,
-‘যোগাযোগ করতে পারতি’ কথাটা আমার দিকে ছুঁড়ে না দিয়ে নিজেকেই বলতে পারিস। আই থিংক, দ্যাট উড বি মোর লজিক্যাল। এমন তো নয় যে, তুই জানতি না আমার ব্যাপারে কিছু! তোর ছেলেই একটু আগে বলে গেল সবটা। আমার সাথে দেখা করা অর কন্ট্যাক্ট করাটা খুব একটা কঠিন ছিল না তোর জন্য।
প্রণব কথাগুলো বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে রইলো। আনিলা অপরাধীর ন্যায় মুখ ছোট করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রণবের কথাগুলোতে রাগ ও অভিমানের এক মিশ্রিত সুর উপলব্ধি করতে পারছে সে। তাই অপরাধী সুরে বললো
-আচ্ছা, সরি! বিয়ের পর থেকে একের পর এক ঝড় এমনভাবে আক্রমণ করছিল আমায় যে, মাথা কাজ করা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমার অবস্থাটা তখন যুক্তি খাটানোর মতো ছিল না। আজও নেই!
প্রণব আনিলার অবস্থাটা বুঝতে পেরে কিছুটা নরম হলো। নিভৃতে একটা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বললো,
-সেজন্য-ই কথা বলছি তোর সাথে। নয়তো ইগনোর করতাম।
আনিলা আহত দৃষ্টিতে তাকালো প্রণবের দিকে। প্রণব প্রসঙ্গ পাল্টাতে আহিরের লেখা চিঠিটা দেখতে দেখতে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,
-চিঠিটা এখন কেন দিয়েছিস স্পৃহাকে? এতো ওর কতো বড় ক্ষতি হলো, জানিস?
-ওর সবটা জানা জরুরি ছিল। আহিরের কাছে কথা দিয়েছিলাম আমি। সেটা খেলাফ করার ক্ষমতা আমার নেই।
প্রণব চিঠির ওপর থেকে চোখ সরিয়ে গম্ভীর চাহনি নিক্ষেপ করলো আনিলার ওপর। তেজস্বী কন্ঠে বললো,
-স্পৃহার হেল্থ ইস্যুটা আমার কাছে বেশি ইম্পর্ট্যান্ট এখন। তবে আহিরের ব্যাপারটা ক্লিয়ার হওয়ায় ভালো হলো। নেক্সট টাইম ওকে এ ব্যাপারে কিছু বলার আগে আমায় জানিয়ে নিবি।
আনিলা বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে। হতবিহ্বল হয়ে বললো,
-স্পৃহা তোর বোনের ফ্রেন্ড, তাই না? তুই তো ওকে চিনিসও না! তাহলে ওর ব্যাপারে এতো সেনসিটিভ ……
প্রণব আনিলার কথা শেষ হওয়ার আগেই চিঠির ওপর মনোযোগী হয়ে ওকে আবার প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
-আহির মারা গেল কীভাবে? কী হয়েছিল ওর?
আনিলার মুখ মুহুর্তেই অন্ধকার হয়ে গেল। চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। জড়িয়ে আসা গলায় বললো,
-ব্রেইন অ্যানিউরিজম। যেদিন স্পৃহা ওকে বিয়ে করতে রাজী হলো, সেদিন রাতেই ও অসুস্থ হয়ে পড়ে। আমি ওকে হসপিটালে এডমিট করাই। সিটি স্ক্যান করানোর পর ডক্টর নিরাশ হয়ে বলেছিলেন যে, আহির তখন লাস্ট স্টেজে চলে গেছে। আর্টেরি অলরেডি ফুলে ফেটে যাওয়ার পথে। অপারেশন করালে বাঁচানোর চান্স নেই। মেডিসিন নিলে অনির্দিষ্টকালের জন্য আর্টেরি ফেটে যাওয়া আঁটকে রাখা যাবে। কিন্তু যেকোনো সময় সেটা ফেটে ব্লিডিং শুরু হতে পারে। তখন ওকে আর বাঁচানো যাবে না। কানাডা যাওয়ার এক সপ্তাহ আগেও আহির ডক্টরের সাথে ডিসকাস করেছিল। কারণ ও জানতে পেরেছিল, স্পৃহা সংসার জীবনে সুখী নেই। কিন্তু ওকে তখনও হতাশ হতে হয়। অপারেশন করায়নি। কারণ ও জানতো অপারেশন করালে ও বাঁচবে না। তাই ওষুধের ওপর ডিপন্ড করেই এতো দিন বেচে ছিল। কিন্তু মাস খানেক আগে আহির পা নড়াচড়া করার শক্তি হারিয়ে ফেলে। মেডিসিনের সাইড এফেক্টের কারণে এমনটা হয়েছিল হয়তো! স্পৃহার অসুস্থতার কথা শুনে ঐ অবস্থাতেই বাংলাদেশে ফেরার জন্য পাগলামি শুরু করে। আমিও বাধ্য হয়ে বিডিতে ফেরার জন্য টিকিট বুক করে ফেলেছিলাম। কিন্তু ……
এটুকু বলেই আনিলা ফুপিয়ে উঠে। প্রণবের চোখেও পানি জমে রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। এদিক সেদিক তাকিয়ে চোখের পানি নিয়ন্ত্রণ করে সে বললো,
-কিন্তু…
আনিলা একটা ঢোক গিলে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
-ফ্লাইটের দুদিন আগে সন্ধ্যায় আহিরের কান ও নাক দিয়ে ব্লিডিং শুরু হয়। আমি ওকে হসপিটালে নিয়ে যেতে চাইলে ও বাঁধা দিয়ে বলে, “আমার সময় শেষ হয়ে গেছে, আনিলা। আমি ব্যর্থ হয়ে গেলাম। আহির ইজ ডিফিটেড! স্পৃহাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখতে পারিনি। আয়াফকে দেওয়া কথাও রাখতে পারলাম না। আশফির বাবার অভাব পূরণে ব্যর্থ আমি। আমাকে ক্ষমা করে দিও।” বলেই একটা ডায়েরি দিয়ে বলেছিল যে, ওটার ভেতরে একটা চিঠি আছে। আমি যেন স্পৃহাকে চিঠিটা দেই। তারপর-ই নিজের চোখের সামনে আহিরকে শেষ নিঃশ্বাস নিতে দেখেছি আমি।
প্রণব সাথে সাথেই চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেললো। আনিলা কান্নামাখা গলায় বললো,
-আয়াফের মৃত্যু নিজের চোখে দেখিনি আমি। কিন্তু বিশ্বাস কর, আয়াফের মৃত্যুর চেয়ে আহিরের মৃত্যু আমায় বেশি কষ্ট দিয়েছে। ওর অসহায়ত্ব আমি নিজের চোখে দেখেছি। আমার মনে হয় না, আহিরের চেয়ে বেশি স্পৃহাকে কেউ ভালোবাসতে পারবে!
প্রণব দাঁতে দাঁত ঘষে নিজেকে ধাতস্থ করে নিলো। তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে বাঁকা হেসে বললো,
-সেটা তো সময়ই বলে দেবে! ইউ উইল হ্যাভ টু উইথড্র ইয়র স্পিচ। আহিরের প্রার্থনা বৃথা হওয়ার নয়।
# চলবে……
✘কপি করা নিষেধ ✘
[রিচেক হয়নি। ভুল-ত্রুটি মার্জনীয়। ]