এক্সিডেন্টলি প্রেম পর্ব ৩০

#এক্সিডেন্টলি_প্রেম♥
#পার্ট-৩০♥
#Ayanaa_Jahan(Nusraat)♥

আজ আবারও আকাশের একটা নির্দিষ্ট জায়গা জুড়ে মেঘ করছে। আবহাওয়ার ঊষ্ণ-আর্দ্র খেলায় মাতোয়ারা হতে হতে অবশেষে হার হয়েছে সূয্যিমামার। সেই থেকেই মেঘের সাথে সেকি অভিমান তার! তাদের লুকোচুরি খেলায় আবিষ্ট আকাশটা মাঝ থেকে মুচকি মুচকি হেসে চলেছে। সূয্যিমামা মেঘের আড়ালে লুকোতেই ফোঁটা ফোঁটা তরল আকাশের বুক চিরে ধরায় নামছে আবার মেঘ পালাতে নিতেই ঝিলিক মেরে উঁকি দিয়ে চলেছে সূর্যের হলদেটে আলো। ঝিরিঝিরি বর্ষণের তালে খিলখিল করে হেসে উঠছে গাছপালা। প্রকৃতির এই ঠান্ডা হিমেল হাওয়ায় গা ভাসিয়ে নেচে উঠছে তাদের মন। পাতায় পাতায় দোল খেয়ে সে কি নিদারুণ অবিশ্রান্ত ভ্রম!

এই প্রকৃতির মায়া জড়ানো লুকোচুরি খেলার নির্বাক বিচারক হয়ে জানালার কোল ঘেঁষে বসে আছে অন্বিতা। বিষন্ন মনে আকাশ জুড়ে ঘুরেফিরে চলেছে তার ফাঁকা দৃষ্টি। একগুচ্ছ কালো মেঘ বিসৃত হয়ে আছে তার মাথার ওপর। অন্বিতার কাছে মনে হচ্ছে মেঘটা শুধুমাত্র তারই মন খারাপের সঙ্গী হতে এসেছে। নয়তো তাদের ছাদের ওপর ব্যতীত অন্য কোথায় বিরাজমান নেই কেনো সে? মেঘের মনও বুঝি অন্বিতার ছটফটানো হৃদপিন্ডটার মতো খারাপ? সেও কি চাইছে মুক্ত হয়ে ছুটে চলতে কোনো এক পানে? তবু নাড়ির টানে থেকে যেতে হচ্ছে তাকে পুরোনো ঠিকানাতেই?

এসব আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো অন্বিতার বুক চিরে। ভরা চাহনি নিক্ষেপ করে জানালা দুটো বন্ধ করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো সে। বিছানার একপাশে রাখা জামদানী শাড়িটার দিকে ভেজা চোখে তাকালো। এই শাড়িটায় নিজেকে মুড়িয়ে অন্য কারো সামনে প্রদর্শন করতে হবে ভাবতে গেলেই বুক ভারী হয়ে আসছে তার। তবু নিরুপায় সে। নিজেকে গোটাতে কিংবা ভালোবাসার মানুষটির ভালোর জন্য এটুকু বিসর্জন দেওয়া কী খুব বেশি কঠিন? হয়তো উত্তর হ্যাঁ কিংবা না, তাতে আদৌ কিছু যায় আসেনা অন্বিতার। তার সুক্ষ্ম মস্তিষ্ক বেজায় জট পাকিয়ে ধীর হয়ে পড়ছে ইদানীং। অতিরিক্ত ভাবনার সাথে বন্ধুত্ব করায় বোধহয় স্নায়ুকোষগুলো দিনকে দিন দূর্বল হয়ে পড়ছে তার।

অন্বিতা পরনের সালোয়ার বদলে শাড়ি পড়ে নিলো। শুকনো মুখটায় সামান্য ক্রিমটাও মাখার ইচ্ছে জাগে না তার। শুষ্কতায় চড়চড়ে ভাব এসেছে ত্বকে। সেই শুষ্কতা মেটাতে অনেকটা বাধ্য হয়েই ফেইস ক্রিম লাগালো মুখে। খোলা লম্বা চুলগুলোকে নিয়ে কী করা যায় ভাবতেই ভ্রু কুঁচকে এলো তার। চুলগুলো হাতের মুঠোয় নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখতে শুরু করার মুহুর্তেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ কানে এলো। ঘাড় ঘুরিয়ে আগ্রহী চোখে তাকাতেই ওপার থেকে মিষ্টি হেসে ইশারায় ভেতরে আসার পারমিশন চাইতে আফসানা বেগমকে দেখা গেলো। অন্বিতাও মৃদু হেসে সঙ্গ দিলো তার সাথে। চোখের ইশারায় ভেতরে এসে বসতে বলতেই ঘরে আগমন ঘটলো আফসানা বেগমের। তার নিঃশব্দে দ্বিধাভরা আকুঞ্চন বড্ড চোখে লাগলো অন্বিতার। ভ্রু কুঁচকে প্রশ্নোক্ত গলায় সে বলল,

—– আন্টি কিছু হয়েছে কী? আপনার মুখটা এমন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে কেনো?

আফসানা বেগম হতাশাভরা চোখে তাকালেন। অন্য কারো বাগদত্তাকে নিজের ছেলের বউ বানাতে চাবার ইচ্ছে না থাকলেও অন্বিতাকে নিজের পুত্রবধূ বানাবার ইচ্ছে ষোল আনা ছিল তার! মনের এই সুপ্ত কামনা আজীবন সুপ্ত থাকলেও শেষ মুহুর্তে এসে বড্ড আহত অনুভূতি হচ্ছে আফসানা বেগমের। আফসানা বেগম অন্বিতার চুলগুলো দু-হাতের মুঠোয় নিয়ে মৃদু হাসলেন। ড্রেসিং টেবিল থেকে হাতে চিরুনি তুলে নিয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বললেন,

—– বুঝলে তো অন্বিতা, তোমার মতো একটা মেয়ের বড্ড শখ ছিলো আমার। কিন্তু আল্লাহ আমার ইচ্ছেটা বড্ড দেরিতে পূরণ করায় নূহা এখনও ৮ বছরেই পা দিতে পারলো না। তবে আমার তাতে আক্ষেপ ছিলো না। নিজের মেয়ে না হোক তোমার মতো একটা ছেলের বউ এলে অভাবটা পূরণ হবে চেবেই আশা নিয়ে বাঁচতাম। কিন্তু আশাটা বোধহয় এবার আর পূর্ণ হলোনা আমার।

অন্বিতা কপাল কুঁচকে উপরে চোখ তুলে তাকালো। প্রশ্নোক্ত গলায় আবারও প্রশ্ন ছুড়ল,

—– কে বলেছে পূরণ হবে না? আপনি নিশ্চিন্ত থাকবেন আন্টি, আপনার ছেলে নিজে থেকেই তার বউ খুঁজে এনে আপনার সামনে হাজির করবে!

আফসানা বেগম কপালে ভাঁজ ফেলে ঠোঁট বাঁকালেন, অবাক কন্ঠে বললেন,

—– নিজে থেকে! সেটা কিভাবে?

অন্বিতা মুচকি হেসে বলল,

—– ওভাবেই!

____________________________

পাত্রপক্ষের সামনে মাথায় আধহাত ঘোমটা দিয়ে চুপচাপ বসে আছে অন্বিতা। থেকে থেকে এটা-ওটা প্রশ্নের জবাব দিয়ে চলেছে তো আবারও নিস্তব্ধতায় ছেয়ে যাচ্ছে তার মন। পাশেই আনন্দ বসা। সবসময়ের মতো বোনের প্রশ্নংসা করলেও আজ পরিমাণটা বেজায় কমে গেছে তার। আনন্দ এখনোও “বিয়ে” শব্দটার পরিপূর্ণ অর্থ সম্পর্কে জ্ঞানসম্পন্ন নয়। তার কাছে বিয়ে মানে ঢাকঢোল বাজিয়ে নাচ-গান করা, কিংবা পেটপুরে কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া। তবুও কোনো এক অজানা কারণেই বোনের বিয়েতে বিন্দু পরিমাণেও খুশি নয় সে।

অন্বিতা আজও নিজ হাতেই চা সাথে টুকটাক নাস্তা বানিয়েছে। সচারাচর কার্যক্রমের মধ্যেই পড়ে বিধায় দোমনা ভাব আসেনি তার মাঝে। তবে তার এই সাধারণ কর্মকান্ডগুলোই পাত্রপক্ষের কাছে অসাধারণ বলে মনে হচ্ছে। তাদের মতে অন্বিতার মতো লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে হাজারে কেনো? লাখ খানেক মেয়ের মাঝেও খুঁজলে পাওয়া বড়ই দুষ্কর। অন্বিতার সম্পর্কে নতুন করে কিছু জানার ছিলো না তাদের। প্রতিবেশীদের থেকেই তার অজস্র গুণের পসরা শুনতে শুনতে প্রায় মুখস্থই হয়ে গিয়েছে সবার। যার দরুন শুধুমাত্র ভদ্রতার খাতিরেই মেয়ে দেখতে আসা তাদের। অন্বিতার মতো মেয়েকে যেকোনো পরিবার তাদের ছেলের বউ বানাতে চাইবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। মেয়ে এতোদিন বিয়ে করবে না বলে হাজারও ঘটক ফিরিয়ে দিলেও অবশেষে এসে রাজি হলো। এখন কি আর অপেক্ষায় থাকা যায়? লেইট করলে মেয়ে হাত ছাড়াও তো হয়ে যেতে পারে। বলা তো যায় না! সেই আশংকায় আজই পাকা কথা সেড়ে ফেলতে এসেছেন মি. শরীফ খানের পরিবার।

ছেলে পেশায় ডাক্তার। রংপুর মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে বেরিয়েছে সে। দেখতে শুনতে মা-শা-আল্লাহ লম্বাচওড়া সুঠাম গড়নের অধিকারী, আচরণেও খুবই নম্রভদ্র স্বভাবের। উজ্জ্বল শ্যামলার মাঝে বেশ দেখতে। আমজাদ হোসেনেরও ছেলে পছন্দ হয়েছে ভীষণ। তাছাড়া অন্বিতা বলেছে বাবার পছন্দই তার পছন্দ হবে নিঃসন্দেহে! তার একমাত্র মেয়ে এতোদিন বাদে এসে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে, পরে যদি কোনো কারণে মত পাল্টে আবারও বলে বসে, “পাত্রপক্ষকে মানা করে দাও আব্বু, আমি কিছুতেই বিয়ে করবো না!” এই ভয়েই আগেভাগেই শুভ কাজ সম্পন্ন করতে চাইছেন তিনিও৷ হাজারে হোক মেয়ে হয়ে জন্ম হয়েছে অন্বিতার। বাপের বাড়ি আজীবন থাকা কী তার চলে? কখনো না কখনোও প্রকৃতির নিয়মের বেড়াজালে বন্দী হয়ে অন্য ঠিকানাতেই তো পাড়ি জমাতে হবেই তাকে! বাপের বাড়িতে আর কতোদিন?

কথাবার্তার এক পর্যায়ে উভয় পরিবারেরই একে-অপরকে পছন্দ হলে ছেলে-মেয়েকে একান্তে কথোপকথনের জন্য অন্বিতার ঘরে পাঠাতে চাইলেন সবাই। তবে আপত্তিকর উক্তি পোষণ করলো শাহীন। তার কথামতো ঘরে নয় বরং প্রকৃতির হাওয়া গায়ে মেখে ছাদে বসেই কথাবার্তা বলাটা মনোরম দেখায়। ছেলের এমন ব্যক্তিত্ব দেখে বড্ড খুশি হলেন আমজাদ হোসেন। অন্বিতা এবং শাহীনকে নিজেদের মাঝে আলাপন জারী করবার জন্য পাঠালেন অবশেষে।

_____________________________

ছাদের গা ঘেঁষে উঠা আমগাছের কচি কচি পাতাগুলো হাল্কা হাওয়ায় দুলছে। আকাশের মেঘ পুরোপুরি কেটে না গেলেও নিজের কালো বর্ণ বদলে সাদাটে বর্ণ ধারণ করেছে। সূর্যের তীক্ষ্ণ আলোয় আলোকিত ছাদের মেঝে ঝিলিক মেরে উঠছে থেকে থেকেই। এই পাকা মেঝেতেই দুটি ছায়ামানবের অবয়ব মাঝে দু হাত দূরত্ব রেখে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। বাতাসের তোড়ে অন্বিতার খোপা করা সত্ত্বেও কপালের ওপর পড়ে থাকা সামান্য চুলগুলো উড়ছে অবলীলায়। অন্যসময় হলে নিজের এই বের হয়ে যাওয়া অবাধ্য চুলগুলোর ওপর চরম ক্ষিপ্ত হতো সে৷ কিন্তু এই মুহুর্তে এই ছোট্ট বিরক্তির উৎসকে তেমন পাত্তা দিচ্ছে না তার মন। তার সবটা জুড়ে ঘুরেফিরে চলেছে অন্য কারো বিচরণ। শাহীনের প্রতি মোটেও মনোযোগ নেই তার। শাহীন বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ একইভাবে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে তাকালো। কি দিয়ে কথা শুরু করা যায় ভাবতেই ব্রেইনটা যেনো অতিশয় ব্যাকুল হয়ে পড়ছে তার। অন্বিতাও চুপচাপ! মেয়েটার চঞ্চলতা সম্পর্কে বাহিরের লোকেদের মুখে এতো এতো কাহিনী শুনে কানদুটো ঝালাপালা করার পর এমন ফলাফল মোটেও আশা করেনি সে। অন্বিতা কী তবে লজ্জা পাচ্ছে? তাই হবে হয়তো। নতুবা এরকম চুপচাপ স্বভাবের অন্বিতাকে তো কেউই চিনত না কোনোকালে। এসব আকাশ-পাতাল ভাবনার বেড়াজালে নিপীড়িত মনটাকে স্থির করে ছাদের এক কোণায় লাগানো গোলাপ গাছের টব দেখে উপস্থিত বুদ্ধির সন্ধান পেলো সে। সামান্য স্বরে গলা খাঁকারি দিয়ে উঠে বলল,

—– ছাদটা কিন্তু দারুণ, ওই ফুলের গাছগুলো কী আপনি লাগিয়েছেন?

অন্বিতা জবাব দিলো না। মেঝেতে তার স্থির দৃষ্টি ফেলেই কোনো এক ভাবনায় মত্ত হয়ে রইলো। শাহীনের কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ প্রতিফলিত হলো। অন্বিতার ভ্রম কাটাতে আবারও বলে উঠলো,

—– এক্সকিউজ মি অন্বিতা, আপনি কী শুনতে পাচ্ছেন?

অন্বিতার ভ্রম কাটলো এবার। চমকে উঠে এদিক-ওদিক তাকিয়ে কে কথাটা বলল খুঁজতে নিতেই হাত উঠিয়ে নিজের দিকে তাকাতে ইশারা করলো শাহীন। ভ্রু কুঁচকে ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,

—– এইযে এদিকে, বলছিলাম ফুলের টবগুলো কী আপনি লাগিয়েছেন?

অন্বিতা ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে শান্ত হলো। সে যে এখানে একা নয় বরং আরো কোনো মানবের অস্তিত্ব তার আশেপাশেই আছে তা এক মুহুর্তের জন্য ভুলেই গিয়েছিল সে। পরিস্থিতির সামাল দিতে কাঁপাকাঁপা গলায় চটজলদি উত্তর দিলো,

—– জ..জ্বি আমি লাগিয়েছি!

—– আচ্ছা, বাই এনি চান্স আপনি কী আমায় ভয় পাচ্ছেন? দেখুন আমি বাঘ বা ভাল্লুক নই। তবে আমায় ভয় পাবার তো কোনো কারণ দেখছি না।

অন্বিতা কপালে ভাঁজ ফেলে চোখ তুলে তাকালো। দৃঢ় গলায় বলে উঠলো,

—– আমি আপনাকে ভয় পেতে যাবো কেনো? একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম এইযা। এখন বলুন আমার বিষয়ে কী কী জানতে চান, যদিও আমার সম্পর্কে ৯০% জেনেই ফেলেছেন বাকিদের কাছ থেকে। এখন বাকি ১০% এ আমায় নিয়ে ঠিক কী কী প্রশ্ন জমাট বেঁধে আছে তা উপড়ে ফেলুন। আমি উত্তর দিতে প্রস্তুত।

এক নিশ্বাসে এটুকু বলে থামলো অন্বিতা। চোখ ফুটবলের সমান করে রাখা শাহীনের দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। শাহীন শুকনো ঢোক গিললো। অন্বিতা চটপটে জানতো কিন্তু এতোটা চালু আগে জানা ছিলো না তার। তবে অন্বিতাকে নিয়ে তেমন কোনো প্রশ্ন বাকি নেই যার উত্তর জানা হয়নি এখন পর্যন্ত৷ তবে অতি ব্যক্তিগত একটা প্রশ্ন মনের এক কোণায় সুপ্ত থেকে গিয়েছে অবশ্য! শাহীন দ্বিধান্বিত চোখে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলো। জিজ্ঞেস করাটা আদৌ ঠিক হবে কিনা বা ঠিক হলেও জিজ্ঞেস করবে কি করে এই ভেবে জট পাকিয়ে চলেছে তার মন। অন্বিতা আবারও ভ্রু কুঁচকে তাকালো। কপালের ওপর পড়ে থাকা চুলগুলো কানের পিঠে ঠেলে দিয়ে বলল,

—– থাক! ঘাম ছোটাতে হবে না। আপনার প্রশ্নের আগেই উত্তরটা দিয়ে দিচ্ছি। আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই ইনফ্যাক্ট পূর্বেও ছিলনা! আর কিছু?

শাহীন এবার আশ্চর্যের চরম পর্যায়ে পৌঁছালো। গোলগাল অক্ষিগোলক দুটো পূর্বের তুলনায় দ্বিগুণ হারে বৃহত্তর আকার ধারণ করলো তার। লজ্জায় চোখ তুলে তাকানোটাও যেনো দায় হয়ে পড়লো! আচ্ছা এই মেয়েটা বুঝি জাদু জানে? মনের কথাটা কিভাবে মুখ ফুটে বলার আগেই বুঝে গেলো? উত্তর ভেবে পেলো না শাহীন। অস্পষ্ট ভঙ্গিমায় ক্ষীণ গলায় বলল,

—– আচ্ছা আপনার আমার সম্পর্কে কোনো কিছু জানার নেই?

অন্বিতা চোখেমুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে ফিরে তাকালো। এই মুহুর্তে ছেলেটাকে সোজা জুসারে ঢুকিয়ে তরলে পরিণত করতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। সে কি এতোটাই গর্ধব! এইটুকুনি বোঝে না যে, “একটা মানুষ তাকে নিয়ে প্রশ্ন করছে না তার মানেটা হলো তার নতুন করে কিছু জানার নেই”? অন্বিতা পাশ ফিরে দাঁতে দাঁত চেপে ধরলো। ভদ্রতার খাতিরে রাগটাকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা চালিয়ে বলল,

—– আজ্ঞে সেরকম কোনো প্রশ্ন থাকলে এতোক্ষণ চুপ থাকতাম না অবশ্যই, তাইনা?

অন্বিতার ভদ্র ভাষায় অপমান ঠেলে দেওয়ার মতো কথায় আবারও লজ্জিত হলো শাহীন! মনে মনে ভাবলো ” মেয়ে তো নয় যেনো পুরাই ধানি লংকা!” আবার পরক্ষণে ভাবলো এখন সে হয়তো পর পুরুষ তাই এরকম রুক্ষ মেজাজ দেখাচ্ছে৷ বিয়ে হলে রুক্ষতার কুঠুরি শূণ্য হয়ে ভালোবাসার প্রদীপ জ্বলবে অবশ্যই! তাছাড়া বিয়ের পর সে ব্যতীত অন্য কারো সাথে এরকম কর্কশ ভাষায় কথা বললে তো ভালোই! এরকম স্বামী ভক্ত মেয়ে কয়টাই বা আছে পৃথিবীতে? ভেবেই বুকটা গর্বে ফুলে উঠলো শাহীনের। একরাশ আশাভরা হাসি হেসে বলল,

—– আচ্ছা তা আমায় আপনার পছন্দ হয়েছে তো? না মানে এটা তো আস্ক করাই যায়। তবে আমার কিন্ত আপনাকে অনেক পছন্দ হয়েছে। আমি এতোদিন আপনার মতোই একজন জীবনসঙ্গিনী সন্ধানে ছিলাম।

অন্বিতা জিহ্ব দিয়ে ঠোঁট ভেজালো। মিথ্যে আশা নিয়ে নতুন জীবন শুরুর সিদ্ধান্তে সামান্য এইটুকুনি মিথ্যেটাই গলায় আটকে আসতে চাইছে তার। তবে বাকি জীবনটা কীভাবে পাড় করবে সে? জানা নেই তার! অন্বিতা আমগাছটার খেলা করা পাতাগুলোর দিকে স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। সহসা বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার। সত্য-মিথ্যের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মিথ্যে এড়াতে সামান্যতম সত্য আওড়ে বলল,

—– আমার নিজের আলাদা করে কোনো পছন্দ নেই। বাবার পছন্দই আমার পছন্দ!

____________________________

কোনো এক আননউন নম্বর থেকে নিজের নম্বরে কল আসায় বিরক্তিতে পিষ্ট নিশান্ত অহেতুক গালমন্দ করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠছিলো। গাছগুলোতে সকাল সকালই পানি দেওয়া উচিত ছিলো তার। তবে সারারাত না ঘুমিয়ে সকালে চটজলদি ঘুম থেকে উঠাটাও বড্ড ডিফিকাল্ট বিধায় দেরি হলো অগত্যাই। ছাদে লেবু গাছটা শখ করেই লাগিয়েছিলেন আফসানা বেগম। তার মতে প্রয়োজনের সময় কখনই হাতের কাছে এই লেবুটাই পাওয়া যায়না! ছাদে যদি নিজেদের একটা লেবু গাছ থাকে তবে মুহূর্তেই দৌড় মেরে টুপ করে লেবু ছিঁড়ে আনা যায়। নিশান্ত অবশ্য লেবু গাছটার পাশাপাশি লুকিয়ে লুকিয়ে অন্বিতার লাগানো ফুলের গাছগুলোতেও পানি দিয়ে আসে। যার দরুন প্রায় প্রতিদিনই গাছে পানি দিতে এসে তাদের আগে থেকেই ভেজা আবিষ্কার করে অন্বিতা। হাজার খুঁজেও নিজের অগোচরে কে গাছে পানি দিয়ে যায় তার উত্তরটা পায়না সে। নিশান্তের অবশ্য ব্যাপারটা দারুণ লাগে। লুকিয়ে লুকিয়ে অন্বিতার প্রশ্নে মাখা কুঁচকানো ভ্রু, সাথে বাঁকানো ঠোঁট! সবকিছুই প্রতিদিনকার ভালো লাগায় পরিণত হয়েছে তার।

—– ননসেন্স! আরে আপনাকে তো বারবার বলছিই আমি জমিল ওর জামিল হোয়াটএভার যেই হোক না কেনো তা নই! আমি…….

এটুকু বলতেই থেমে গেলো নিশান্ত। ছাদের রেলিঙের ধারে অন্বিতার সাথে অন্য কোনো ছেলে দাঁড়িয়ে কথাবার্তা বলছে, দৃশ্যটা দৃষ্টিগোচর হতেই কপালের ভাঁজটা দৃঢ়তর রূপ ধারণ করলো তার। ফোনের লাইন কেটে কান থেকে মোবাইলটা নামিয়ে দু ধাপ এগিয়ে গেলো সে। সাথে তাল মিলিয়ে বাড়তে থাকলো তার হৃদস্পন্দন। অন্বিতা লাল-খয়েরি রঙের জামদানী শাড়ি পড়েছে। কানে রূপালী একজোড়া ঝুমকো। লম্বা চুলগুলোর খোঁপার মাঝে গেঁথেছে কাটা! বাতাসের দোলায় শাড়ির আঁচলটা উড়ছে। তেজ কমে আসতেই আবারও নিইয়ে পড়ছে। এটুকু দেখতেই নিশান্ত চটজলদি চোখ নামিয়ে নিলো। প্রতিবারই অন্বিতাকে দেখলে অজানা এক চিনচিনে অনুভূতিতে ছেঁয়ে যায় তার বুক। তবে এবারের আঘাতটা ভিন্ন। চিনচিনে অনুভূতিটা হঠাৎই পাল্টে জ্বালাপোড়ার রূপ ধারণ করলো তার। কে ছেলেটা? কি তার পরিচয়? সে যেই হোক অন্বিতার সাথে কিসের আলাপন তার? প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর জানা না থাকলেও মেজাজটা বেজায় বিগড়ে যাচ্ছে তার।

অন্বিতা শাহীনের সাথে কিছু টুকটাক বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলো। হঠাৎ চোখের দৃষ্টি ঘুরেফিরে নিশান্তের ওপর পড়তেই মুখটা পূর্বের তুলনায় মলিন হয়ে এলো তার। অন্বিতাকে থমকাতে দেখে ভ্রু কুঁচকালো শাহীন। তার দৃষ্টি বরাবর নজর ফেলতেই ঠোঁট বাঁকালো সে। অন্বিতার উদ্দেশ্যে তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন ছুড়ল,

—– অন্বিতা কে ও?

অন্বিতা নিজের টলমল চোখদুটো নামিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরলো। নোনাজলগুলো সামলে নিয়ে ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলল,

—– ওহ উনি আমাদের বাড়িওয়ালার ছেলে নিশান্ত। আসুন আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেই।

বলেই কয়েক ধাপ এগিয়ে নিশান্তের সামনে সটান হয়ে দাঁড়ালো। অন্বিতার পিছুপিছু শাহীনও গিয়ে দাঁড়ালো তার পাশে। অন্বিতা স্মিথ হাসলো। নিশান্তের কপাল কুঁচকে রাখা মুখশ্রীর উদ্দেশ্যে বলল,

—– মি. নিশান্ত, ইনি হচ্ছে শাহীন, ডক্টর শাহীন খান।
সভাপতিকে চিনেন নিশ্চয় উনার ভাইয়ের ছেলে। অর্থাৎ ভাতিজা! আর শাহীন উনার পরিচয় তো বললামই! এবার বুয়েট থেকে বিএসসি শেষ করে বেরোলেন নিশান্ত।

—– হেই নাইস টু মিট ইউ ব্রাদার!

নিশান্ত মুচকি হাসলো। হাত এগিয়ে শাহীনের বাড়িয়ে রাখা হাতে স্পর্শ করিয়ে হ্যান্ডশেক করলো। নিশান্ত শাহীনের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ল,

—— তা এখানে আসা হলো কি করে? আপনারা একে-অপরকে কিভাবে চিনেন?

শাহীন মাথা ঝাঁকিয়ে হাসলো। অন্বিতার নিকটে একধাপ এগিয়ে গিয়ে বলল,

—– সেকি তুমি জানো না? একই বাড়িতে আছো অথচ জানো না! ভেরী স্ট্রেঞ্জ! যাজ্ঞে এখন জেনে নাও। আমি সম্পর্কে তোমার দুলাভাই হতে চলেছি। আই মিন অন্বিতার উডবি হাজবেন্ড!

শাহীনের এতোসব কথার মাঝে “অন্বিতার উডবি!” শব্দটাই ক্যাচ করে নিলো নিশান্তের ব্রেইন। এতো সহজ একটা মিনিংফুল ওয়ার্ডটার অর্থও ঠিকমতো বুঝতে বড্ড সময় লাগলো তার। কিন্তু কেনো লাগলো? হয়তো মন মানতে চাইছে না সেজন্য! হতেই পারে। অসম্ভব তো নয়। শাহীনের কথার সাথে সঙ্গ দিয়ে অন্বিতাও স্মিথ হাসলো। ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়টা দুমড়ে মুচড়ে একাকার হলেও মিথ্যে হাসির তাড়নায় বলল,

—– হ্যাঁ মি. নিশান্ত! উনি আমার উডবি! খুব শীঘ্রই বিয়ে করতে চলেছি আমরা।

নিশান্তের চারিপাশ ঘোলাটে হয়ে আসতে শুরু করলো। চোখদুটো বড্ড জ্বলছে তার। কান দিয়ে বোধহয় ভ্যাপসা গরম বাতাস বের হতে চাইছে। হৃদপিন্ডটাকে কেউ ক্রমাগত শতশত ছুড়ির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করে চলেছে। ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে চলেছে ব্যাকুল মনটাকে! কিন্তু কেনো এমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে তার? সে তো নিজে থেকেই চেয়েছিলো অন্বিতা তাকে ভুলে যাক। তার যোগ্য লাইফ পার্টনারকে শীঘ্রই খুঁজে পাক। তাও কেনো মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে তার? নিশান্ত দীর্ঘশ্বাস লুকালো। এই মুহুর্তটাতে তো তার সবথেকে খুশি থাকা উচিত! ভেবেই জোড়পূর্বক হাসির রেখা ঠোঁটের কোণে ফুটিয়ে শাহীনকে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানালো। তাকে ছেড়ে দিয়ে অন্বিতার দিকে পলকহীন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

—— শুভকামনা রইলো মিস অন্বিতা! জীবনের নতুন অধ্যায় নতুন করে শুরু করুন! ভালো থাকবেন সবসময়!

#চলবে____________________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here