#এতো_চাই_তোকে
#পার্ট_১৩
#Mst_Liza
টানা তিনদিন পর জ্ঞান ফিরলো আমার।চোখ খুললে চোখের সামনে আপুকে দেখতে পেলাম।আমাকে উঠে বসতে দেখে রিপোর্টের উপর থেকে চোখ সরিয়ে নিলো আপু।আমার দিকে এগিয়ে এসে রিপোর্টটা আমার সামনে রাখলো।আমার দু’ কাঁধে হাত রেখে উঠিয়ে বসালো আমাকে।আমি একটু সজাগ হলে হৃদের কথা মনে পরলো।অমনি আমি বেড থেকে নামতে চাইলাম।আপু বাঁধা দিলো আমায়।উঠে গিয়ে কেবিনের দরজাটা আস্তে করে বন্ধ করে এসে আমার সামনে দাড়ালো।রিপোর্টটা উঠিয়ে আমার সামনে ধরে বলল,
—“এই রিপোর্টটা বলছে তুই প্রেগনেন্ট ফুল।আমি জানতে চাই তোর সন্তানের বাবা কে? সায়ান নাকি হৃদ?”
মুহূর্তে আমার চোখ বেয়ে দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পরলো।আমি পেটে হাত রেখে বললাম,
—“আমি প্রেগনেন্ট? হৃদের সন্তান!”
আপু আমাকে ধরে ঝাঁকিয়ে বললো,
—“যদি তোর আর হৃদের সম্পর্কটা এতোই গভীর হয়ে থাকে তাহলে সেদিন কেন বলেছিলি হসপিটালের সকলের সামনে তুই সায়ানকে ভালোবাসিস?”
আমি আপুর মুখের দিকে তাকালাম। আপুকে বললাম,
—“তোমার জন্য। তোমার আর মেঘ স্যারের সংসারটা বাঁচাতে।কিন্তু সেটা শুধুই অভিনয়। আমি পারবো না হৃদকে ছাড়া থাকতে।আমার হৃদ কেমন আছে আপু?”
আপু সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।কেঁদে উঠে বলল,
—“আমি জানতাম আমার বোন এমন কিছু করতে পারে না। যেটা অসম্মানের।অনেক বড় হয়ে গিয়েছিস তাই না? হৃদকে তুই এতো ভালোবাসিস আমাকে একটাবার বলার প্রয়োজন মনে করলি না? আমি তোকে সেদিনও জিজ্ঞাসা করেছিলাম হৃদকে ভালোবাসিস কিনা।তুই কেন বললি না আমাকে? আমি যদি জানতাম এতো বড় একটা অন্যায় কখনো করতাম না তোর সাথে।আমার কাছে মেঘ যতোটা ইমপটেন্ট তুইও ঠিক ততোটাই ইমপটেন্ট।মেঘ যদি সত্যি আমাকে ভালোবাসে কিছুতেই আমাকে ছাড়বে না।কিন্তু ওর সাথে থাকবো বলে তোর জীবনটা নষ্ট করবো এটা কিভাবে ভাবলি তুই? হৃদ তোর।ওকে আমি তোর জীবনে ফিরিয়ে দিবো কথা দিচ্ছি।”
আমি আপুর হাতদুটো শক্ত করে ধরে বসলাম। আপুকে বললাম,
—“আমার হৃদ সুস্থ আছে তো?”
আপু মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ অর্থ বোঝালো।আমাকে আপু কিছু বলতে যাবে এমন সময় আপুর ফোনটা বেজে উঠলো। ফোন রিসিভ করে কথা বলে আপু আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
—“এখন আমার একটা সার্জারি অপারেশন আছে।তুই বিশ্রাম নে।আমি অপারেশন শেষে তোকে হৃদের কাছে নিয়ে যাবো।”
আমি বললাম,
—“এতোক্ষণ আমি অপেক্ষা করতে পারবো না আপু।আমি ওকে না দেখে থাকতে পারবো না।ওর কেবিনটা কোথায় বলো আমি গিয়ে দেখা করছি।”
আপু আমাকে বলল,
—“হৃদ হসপিটালে নেই ফুল।হৃদের জ্ঞান ফেরার পর প্রিয়া অনেক জেদ ধরে হৃদকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছে।হৃদের পুরো টিটমেন্ট মেঘ নিজে করছে।আমি শুধু হসপিটাল সামলাচ্ছি।”
আপুর মুখে এ কথাটা শুনে আমি আর বসে থাকতে পারলাম না।উঠে দাড়িয়ে হাত থেকে একটানে সেলাইয়ের সুচ ছাড়িয়ে নিলাম। আপুকে বললাম,
—“আমার হৃদ প্রিয়ার কাছে? আমি হৃদের কাছে যাবো।ও বাড়িতে আমি হৃদকে আর এক মুহূর্ত থাকতে দেবো না।আমি ফিরিয়ে আনবো আমার হৃদকে।”
কথাগুলো বলতে বলতে কেবিনের দরজা খুলে ছুটতে লাগলাম বাইরের দিকে।আপু আমাকে পেছনের থেকে ডাকলো।কিছু বলতে চাইলো আমায়। আমি না শুনেই চলে আসলাম। সার্জারির কারণে আপু পেশেন্টের কথা ভেবে হসপিটালের গেইট পর্যন্ত এসে থেমে গেলো।আর আমি অটোতে উঠে চলে আসলাম আপু আর মেঘ স্যারের বাড়িতে।
খুব জোরে চিৎকার করছি হৃদের নাম ধরে ডেকে।ভেতরে এসে দেখতে পেলাম খাবার টেবিলে হৃদ বসে আছে।এক লোকমা ভাত মুখে দিয়ে খুব জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে হৃদ।প্রিয়া আমার কন্ঠ শুনে পিছনে ঘুরে আমাকে দেখতে পেলো।আমাকে কিছু না বলে হৃদের দিকে এগিয়ে গেলো।হৃদকে বলল,
—“এই সব খাবার আমি নিজের হাতে বানিয়েছি।তোমাকে খেতেই হবে হৃদ খেতেই হবে।”
হৃদ খুব জোরে নিশ্বাস নিতে নিতে বলল,
—“অনেক ঝাল খেতে পারবো না আমি।”
প্রিয়া হৃদের মুখটা শক্ত করে ধরে মুখের মধ্যে ঠেসে ঠেসে খাবার ভরে দিয়ে বলতে লাগলো,
—“তোমার জন্য আমি হাত পুড়িয়ে সকাল থেকে রান্না করেছি।তুমি খাবে।যতো ঝাল হোক তোমাকে খেতেই হবে আমার রান্না।”
আমি তাকিয়ে দেখলাম হৃদের সারা মুখে ভাত লেপটে আছে।হৃদের খুব কস্ট হচ্ছে। আমি আর এক মুহূর্ত দেড়ি না করে।এগিয়ে গিয়ে প্রিয়াকে টেনে কষিয়ে দু’গালে কয়েকটা চড় মারলাম। প্রিয়াকে বললাম,
—“দেখতে পারছিস না আমার হৃদ কস্ট পাচ্ছে। এতো ঝালের তরকারি খাই না আমার হৃদ।তারপরও তুই ওকে জোর করে খাওয়াচ্ছিস?”
প্রিয়া ভাইয়া বলে চিৎকার করে উঠলো।কেঁদে উঠে ভাইয়া বলে ডাকতে লাগলো।আমি হৃদের সামনে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বললাম পানি খাও হৃদ।হৃদ গ্লাসটা আমার হাত থেকে টেনে নিয়ে পাগলের মতো পানি খেয়ে চলেছে। তবুও যেন হৃদ শান্ত হচ্ছে না।খুব জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে আর বলছে ঝাল! ঝাল!
প্রিয়াকে সরিয়ে দিয়ে চেয়ার টেনে হৃদের সামনে বসলাম আমি। হৃদের মুখটা দুই হাতে আকড়ে ধরে ওর ঠোঁটে খুব শক্ত করে চুষে নিলাম।সারা মুখে যেখানে যেখানে এটো লেগে আছে চুষে নিয়ে বললাম,
—“এখনও ঝাল লাগছে হৃদ।”
হৃদ আমার মুখের দিকে বড় বড় চোখ করে তাকালো।কিছুক্ষণ তাকিয়ে আমাকে কিছু না বলেই এক ধাক্কায় চেয়ার থেকে নিচে ফেলে দিয়ে বলল,
—“কোথা থেকে এসেছে এই মেয়েটা?”
আমি অবাক চোখে হৃদের দিকে তাকালাম।হৃদ এমন কেন করলো বুঝতে পারলাম না।মেঘ স্যার আর সায়ান সিঁড়ি থেকে নিচে নামলো।সায়ান আমাকে নিচে পরে থাকতে দেখে উঠিয়ে দাড় করিয়ে বলল,
—“এর নাম ফুল।খুবই ভালো মেয়ে।আমার হবু স্ত্রী। প্রিয়া যেমন তোমার হবু স্ত্রী।”
হৃদ রাগি দৃস্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
—“ভালো না অভদ্র।এই মেয়েটাকে তুমি বিয়ে করতে চাইছো?”
প্রিয়া এগিয়ে এসে হৃদকে ধরে টানতে লাগলো।হৃদকে সিঁড়ির দিকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
—“তোমার ওষুধের সময় হয়ে গিয়েছে হৃদ। রুমে চলো তোমাকে আমি নিজের হাতে ওষুধ খাইয়ে দেবো।”
হৃদ প্রিয়াকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিয়ে বলল,
—“তোমার হাতে আমি ওষুধ খাবো না।আর না তোমার মতো একটা অভদ্র মেয়েকে আমি বিয়ে করবো।আমার বাড়ি কোথায়? প্লিজ আপনারা আমাকে দিয়ে আসুন।নয়তো আমাকে ঠিকানা দিয়ে দিন।আমি নিজে চলে যাচ্ছি। এখানে আমি আর থাকবো না।”
আমি বুঝতে পারলাম না হৃদ এমন ভাবে কেন কথা বলছে? হৃদকে কিছু বলতে যাবো তখন সায়ান আমার হাতটা টেনে ধরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে একটা রুমে নিয়ে এসে ভেতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিলো।আমার গালে একটা কষিয়ে চড় মেরে বলল,
—“তোমার সাহশ কি করে হয় হৃদের সন্তানকে নিজের গর্ভে ধারণ করবার? তোমাকে আমি ভালোবাসি।তোমাকেই বিয়ে করবো।আমি সবাইকে বলেছি এই সন্তানটা আমার।শুধু আমার পরিবারের সম্মানের কথা ভেবে এই সন্তানটাকে নষ্ট করতে হবে।তোমার মাও আমার সিদ্ধান্তে রাজি হয়েছিলো।শুধু তোমার বোন নষ্ট করতে দেয় নি।আমি তোমাকে চাই কিন্তু হৃদের কোনো অংশ আমাদের জীবনে থাকুক সেটা আমি চাই না।”
সায়ানের কথা শুনে আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না।সহজ সরল মুখটার পেছনে সায়ানের এই নোংরা রূপটা ছিলো? আমি সায়ানের দিকে তাকিয়ে বললাম,
—“তুমি এতোটা নোংরা সায়ান? হৃদ আমার স্বামী। আমার গর্ভে হৃদের সন্তান।এটা জেনেও তুমি এই নোংরা খেলাটা খেললে? এইজন্য বোধহয় আমার জ্ঞান ফিরলে আমার কাছে মা ছিলো না।না জানি কতোটা কস্ট পেয়েছে মা।ছোটবেলা থেকেই মা আমাদের দুই বোনকে এমন শিক্ষায় বড় করেছে।না জানি কি ভেবেছে।কিভাবে বোঝাবো আমি এমন কোনো কাজ করতে পারি না।হৃদের আর আমার সম্পর্কটা পবিত্র।”
সায়ান আমাকে টেনে ধরে বলল,
—“হৃদের স্মৃতি শক্তি নেই। এই এক্সিডেন্টে হৃদ মাথায় প্রচন্ড রকমের আঘাত পেয়েছে।তোমার সব স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছে হৃদ।হৃদের মনে তুমি নেই।ভালো এই হবে তোমার মন থেকেও হৃদকে মুছে ফেলো।”
—“কি বললে তুমি? হৃদের স্মৃতি নেই?”
—“না নেই।আর না কখনো আসবে।হৃদের টিটমেন্টের সব দায়িত্ব যে এখন আমার কাজিন মেঘের হাতে।মেঘ কিছুতেই হৃদের স্মৃতি ফিরে আসতে দেবে না।”
—“আমি এটা হতে দেবো না।আমি তোমাদের সফল হতে দেবো না।”
—“সফল তো আমরা হবোই। তোমার এবোশনও হবে।এখন এইখানে।তারপর আজই আমাদের বিয়ে হবে।”
সায়ান চিৎকার করে ডা.মেঘ স্যারের নাম ধরে ডাকলো।আমি সায়ানকে ধাক্কা দিয়ে রুমের দরজা খুলে ছুটে নিচে নামলাম।হৃদ নিচে থাকায় সায়ান থেমে গেলো।আমি এসে হৃদকে বললাম,
—“হৃদ দেখও ওরা আমাদের সন্তানকে মেরে ফেলতে চাচ্ছে।”
সায়ান এবার এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে টেনে সিঁড়ির দিকে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
—“এসব কি বলছো ফুল? তোমার মাথাটা সত্যি গেছে।চলো উপরে গিয়ে ঠান্ডা মাথায় বসে কথা বলি।”
সায়ান ডা.মেঘ স্যারকে ইশারায় উপরে আসতে বললো। সেটা দেখে সায়ানকে ধাক্কা দিয়ে আমি হৃদের কাছে আবার আসলাম। হৃদের পা জড়িয়ে ধরে বললাম,
—“এমনটা হতে দিও না হৃদ।আমাদের সন্তানকে ওরা মেরে ফেলতে চাইছে কিছু করও।”
হৃদ পা ছাড়িয়ে উঠে দাড়ালো।রাগি দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
—“আমি এখানে থাকতে চাই না।বলেছি আমার বাড়ির ঠিকানাটা দিতে।এতো নাটক দেখতে ইচ্ছে করছে না আমার।”
হৃদ আর কিছু বলতে যাবে মেঘ স্যার একটা ইনজেকশন পেছনের থেকে এনে হৃদের ঘাড়ে ঢুকিয়ে দিলো। হৃদ আস্তে করে ফ্লোরে ঢুলে পরলো।সায়ান এবার নিজের শক্তি দিয়ে আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আমি চিৎকার করছি। এখনও হৃদকে ডাকছি।উঠতে বলছি এমন সময় মিনি, নিশির সাথে আবির চৌধুরীর কন্ঠ শুনতে পেলাম। আবির চৌধুরী হলো প্রিয়া আর ডা.মেঘ স্যারের বাবা।
চলবে,,,,