১.
সিনথিয়ার সৎমা তাকে চোর অপবাদ দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিল! সিনথিয়ার নিজের জন্মদাতা পিতা দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখল সেটা। সিনথিয়ার হয়ে একটা কথা পর্যন্ত বলল না। একবারও ভাবল না এই মাঝরাতে সিনথিয়া কোথায় যাবে।
সিনথিয়া যার পুরো নাম সিনথিয়া আক্তার। সবেমাত্র অনার্স ফাস্ট ইয়ারে পড়ছে। সিনথিয়া যখন ক্লাস টেনে পড়ে তখন সিনথিয়ার মায়ের মৃত্যু হয়। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তার বাবা আবার দ্বিতীয় বিয়ে করে। তখন থেকেই সিনথিয়ার সাজানো গোছানো জীবনটা নষ্ট হয়ে যায়।
সিনথিয়া অন্ধকার রাস্তায় হেটে চলছে। আর ভাবছে আজ সারাদিন তার সাথে কি কি হলো। আজ রোজ দিনকার মতো ভার্সিটি থেকে ফেরামাত্রই সিনথিয়ার সৎমা তাকে বলেছিল সে যেন রান্নাবান্না সব করে নেই। কিন্তু সিনথিয়ার শরীর কিছুটা খারাপ থাকায় সে ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়তেই রাজ্যের ঘুম এসে তার চোখে হানা দেয়। সৎমায়ের কথার যে অবাধ্য হয়েছিল সিনথিয়া এটা সে মেনে নিতে পারে নি।
তাই নিজের দামী গয়না সিনথিয়ার ব্যাগে লুকিয়ে রাখে। সিনথিয়ার বাবা রাতে বাড়িতে ফেরামাত্রই নিজের গয়না হারিয়ে যাওয়ার নাটক করে। তার নাকি সন্দেহ সিনথিয়ার উপর।
মাঝরাতে দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ শুনে সিনথিয়া যখন উঠে দরজা খুলি সাথে সাথে সৎমা ও বাবা মিলে সিনথিয়ার ঘরে ঢুকে পড়ে। তাকে কিছু না বলেই দুজনে মিলে তার ঘরে তল্লাশি চালানো শুরু করে। সিনথিয়া কিছুই বুঝতে পারছিলাম। সিনথিয়ার সৎমা ব্যাগের মধ্যে চেক করে বলে,
‘এই দেখ পেয়ে গেছি আমার গয়না।’
সাথে সাথে সিনথিয়ার নিজের জন্মদাতা পিতা কোন কিছু বিচার না করেই ঠা’স করে তার গালে থা’প্পর মে’রে দিল। সিনথিয়া হতবাক নয়নে তাকিয়ে থাকল। সিনথিয়ার সৎমা তার এবং তার মায়ের নামে একের পর কুকথা বলতে লাগল।
এসব করেও শান্ত হলো না তারা। সিনথিয়ার সৎমা তাকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে বাড়ি থেকে বের করে দিল।
এসব ভেবে নিজের চোখ দিয়ে বেড়িয়ে পড়ে একবিন্দু অশ্রু মুছে নিল সিনথিয়া। নিজের ভাগ্যকে তো বরণ করে নিতেই হতো। আচমকা কেউ পিছন থেকে সিনথিয়ার নাম ধরে ডাকল,
‘সিনথিয়া।’
সিনথিয়া পিছনে ফিরে তাকাল। তাকে যে ডেকেছে সে আর কেউ নয় তাদের পাড়ার বখাটে ছেলে রাজীব। ছেলেটা অনেক দিন থেকে সিনথিয়াকে বিরক্ত করে। আজ এই মাঝরাতে তাকে একা দেখে হয়তো কোন কুবুদ্ধি এসেছে তার মাথায়। এমনটা ভেবেই সিনথিয়ার সারা শরীর শীতল হয়ে আসে।
সে একবার ভাবল দৌড়ে পালাবে কিন্তু পালানোর আগেই রাজীব সিনথিয়ার সামনে এসে দাড়াল। ভয়ে সিনথিয়ার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিল। খারাপ চিন্তাভাবনা ঘুরছিল সিনথিয়ার মনের মাঝে।
রাজীব সিনথিয়াকে বলল,
‘এত রাতে একা বাইরে কি করছ? জানো না এভাবে বাইরে থাকাটা নিরাপদ নয়।’
সিনথিয়া বেশ অবাক হয়ে গেল রাজীবের কথা শুনে। যেই ছেলেকে সিনথিয়া বিপদ মনে করে সে-ই কিনা সিনথিয়ার নিরাপত্তার কথা ভাবছে। সিনথিয়া এই নিয়ে বেশি কিছু ভাবল না। বরাবরের মতো রাজীবকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু রাজীব আমাকে সেই সুযোগ দিল না। সিনথিয়া সামনে এগোনোর চেষ্টা করতেই তার হাত টেনে ধরল। সিনথিয়া কিছু বলবে তার আগেই সিনথিয়ার উদ্দ্যেশ্যে বলল,
‘আমার কথার উত্তর না দেও ঠিক আছে। কিন্তু এত রাতে বাইরে থেকে নিজের বিপদ বারিও না। চলো আমার সাথে সিনথিয়া, তোমাকে তোমার বাড়িতে পৌছে দিচ্ছি।’
সিনথিয়া নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল,
‘আমি আর ঐ বাড়িতে ফিরব না।’
‘কেন ফিরবে না?’
‘সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।’
‘বুঝতে পেরেছি তোমার সৎমা আবার তোমাকে কিছু বলেছে তাইনা। চলো বলছি আমার সাথে। আমি ঐ মহিলাকে শায়েস্তা করে তবে ছাড়ব।’
রাজীব সিনথিয়ার হাতটা শক্ত করে ধরল। সিনথিয়া হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
‘আপনাকে আমার ব্যাপারে এত ভাবতে হবে না।’
রাজীব এতক্ষণ শান্ত থাকলেও এবার আর চুপ থাকল না। সিনথিয়াকে ধমক দিয়ে বলল,
‘তুমি দেখছি ভালো কথা শোনার মেয়ে না। এতক্ষণ ভদ্র ভাষায় বলছি তাই কাজে দেয়নি। যদি আমার কথা না শোন তাহলে কিন্তু এবার তোমাকে কোলে করে তুলে নিয়ে যাব।’
রাজীব যেমন মানুষ তাতে এই কাজটা করা তারপক্ষে খুব স্বাভাবিক। তাই সিনথিয়াও আর আপত্তি করল না। রাজীবের হাত ধরে চুপচাপ এগিয়ে যেতে লাগল।
২.
রাজীব সিনথিয়ার বাড়ির সামনে এসে চিৎকার করে বলতে লাগল,
‘মিসেস লুবনা বেরিয়ে আসুন বলছি।’
মাঝরাতে এত চিৎকার শুনে সিনথিয়ার বাবা সিরাজুল হক এবং সৎমা লুবনা আক্তার বেরিয়ে আসেন। লুবনা আক্তার সিনথিয়াকে দেখে মুখ বিকৃতি করে বলেন,
‘তোর লজ্জা শরম কিছু নেই তাইনা? এত অপমান করে বের করে দিলাম তবুও নাচতে নাচতে চলে এলি।’
সিনথিয়া কোন প্রতিবাদ করল না। সিনথিয়ার এভাবে চুপ থাকা পছন্দ হলো না রাজীবের। রাজীব সিনথিয়ার হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,
‘চুপ করে থাকলেই সবকিছুর সমাধান হয়না সিনথিয়া। এই পৃথিবীতে এখন আর যে সয় সে রয়ের দিন নেই। এখন জোর যার মুলুক তার। তাই নিজের ভালো চাইলে চুপ না থেকে কিছু বলো। তোমাকে নিজের বাবার বাড়ি বের করে দেওয়ার এই মহিলা কে?’
নিজের মেয়ের হয়ে কোন কথা না বললেও স্ত্রীর নামে এমন কথা শুনে চুপ থাকলেন না সিরাজুল হক। রাজীবকে কিছু বিশ্রী গালি দিয়ে বলল,
‘মাস্তান একটা। যার মা-বাবার কোন ঠিক নেই, অনাথ আশ্রমে মানুষ সে আমার স্ত্রীকে এভাবে বলে। শোন এটা আমার বাড়ি। আর আমার বাড়িতে কে থাকবে আর কে থাকবে না সেই সিদ্ধান্ত নেব আমি। আমার বাড়িতে কোন চোরের যায়গা নেই।’
নিজের জন্মদাতা পিতার মুখে এহেন কথা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না সিনথিয়া। অজান্তেই তার চোখ বেয়ে নোনাজলের স্রোত নামে। রাজীব সেটা লক্ষ্য করে নিজ হাতে সিনথিয়ার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,
‘যাদের কাছে তোমার চোখের জলের কোন মূল্য নেই, তাদের জন্য এটা খরচ করো না।’
রাজীব চোখমুখ শক্ত করে সিরাজুল হকের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
‘আপনার মতো কাপুরুষ আমি খুব কমই দেখেছি। কি বলনেন একটু আগে আমি অনাথ। হ্যা আমি অনাথ। কিন্তু আপনার মতো অমানুষ নই। শুনেছিলাম আপনার প্রথম স্ত্রী বেচে থাকাকালীন আপনি এই মহিলার সাথে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত ছিলেন। এটা জানতে পেরেই তো আপনার প্রথম স্ত্রী হার্ট অ্যাটাক করে মারা যায়। তারপর আপনি এই মহিলাকে নিজের স্ত্রী করে আনেন। যাইহোক সেসব কথা নাহয় বাদ দিলাম। আপনি না একজন উকিল। ন্যায় বিচার করা আপনার দায়িত্ব। অথচ আপনিই কিভাবে অন্যায়কে সমর্থন করলেন। আর কি বললেন চোর? সিনথিয়া চোর হলো কিভাবে?’
লুবনা আক্তার বলে ওঠেন,
‘হ্যা ঐ মেয়ে একটা চোর। আমার দামী গয়না চুরি করেছে।’
লুবনা আক্তারের কথা শুনে রাজীব মৃদু হেসে বলে,
‘আপনার মুখে এই কথা মানায় না। সেলিনা আন্টির মৃত্যুর পর তার সব গয়নাগাটি তো আপনি দখল করেছেন। আমি কিন্তু সব জানি। আর এখন আপনি সিনথিয়াকেই তার মায়ের গয়না চোর বলছেন চোর তো আপনি।’
লুবনা আক্তার রাগী স্বরে বলেন,
‘একটা রাস্তার ছেলে হয়ে তুই আমায় চোর বলছিস। এত সাহস তোর।’
‘সাহসের তো এখনো কিছু দেখেন নি। আমি জীবনে নিজের মাকে দেখিনি কিন্তু সেলিনা আন্টির থেকে মাতৃস্নেহ পেয়েছি। উনি বেচে থাকতে আমার সব খোজ খবর রাখতেন। আমাকে ছেলের মতো দেখতেন। মৃত্যুর আগে আমার হাত ধরে বলেছিলেন ওনার মেয়ের খেয়াল রাখতে আমি শুধু তাই করছি। আর সিনথিয়া তোমাকেও বলছি তুমি আমাকে যতোই ভুল বোঝো, আমি কখনো তোমার পিছু ছাড়িনা কেন জানো? এর কারণ শুধু এটা নয় যে, আমি তোমাকে ভালোবাসি। আরো বড় কারণ হলো তুমি সেলিনা আন্টির মেয়ে। তাই তুমি না চাইলেও আমি তোমার খেয়াল রাখতে বাধ্য।’
কথাটা বলেই সিনথিয়ার হাত ধরে জোর করে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল রাজীব। সিরাজুল হক ও লুবনা আক্তার চেষ্টা করেও তাকে আটকাতে পারল না।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨
#কখনো_বা_দেখা_হবে
#পর্বঃ১
#লেখিকাঃদিশা_মনি