কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব -১৭+১৮+১৯

#কুয়াশা_মিলিয়ে_যায়_রোদ্দুরে
#পর্ব_১৭
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা

“কুয়াশা তিন্নির মেয়ে হয়েছে। কিন্তু!”

“কিন্তু কী? আপু ঠিক আছে তো মা?”

“তিন্নির শারীরিক অবস্থা ভালো না। ওকে র ক্ত দিতে হবে।”

“র ক্ত পাওয়া যায় নি?”

“না। কুয়াশা সমস্ত মান-অভিমান ভুলে তুমি আজই বগুড়ায় এসো। তোমার আর ওর র ক্তে র গ্রুপ এক। ওকে বাঁচাও তুমি!”

“আপু আমার সাথে কী কী করেছে সব ভুলে গেলে মা?”

“ভুলিনি রে মা। কিন্তু একজনের জীবন নিয়ে প্রতিশোধ নিতে চাও তুমি? দিন শেষে তিন্নি কিন্তু তোমার বোন। ওকে বাঁচানো দরকার। অন্তত ওদের মেয়ের জন্য ওর বেঁচে থাকা দরকার। তুমি আর কথা না বাড়িয়ে চলে এসো। ডক্টরস ক্লিনিকের দ্বিতীয় তলায় আসবে।”

আর কিছু বলার সুযোগ পায় না কুয়াশা। তার আগেই কল কেটে যায়। কুয়াশার মুখে লেগে আছে তাচ্ছিল্যের হাসি। যে হাসি বলে দিচ্ছে,

“আমার ক্ষতি করে এখনো আমার সাহায্য দরকার তোমার। নিয়তি বুঝি একেই বলে? হয়তো তাই!”

খুব দ্রুত তৈরি হয়ে বাস স্ট্যান্ডের দিকে রওনা দেয় কুয়াশা। বিকালের বাসে উঠে রাত এগারোটার মধ্যেই ক্লিনিকে পৌঁছে যায় সে। আজ অনেক দিন পর সবাইকে একসাথে দেখছে সে। সবার মুখেই বিষন্নতার ছাপ স্পষ্ট। কুয়াশা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সর্বপ্রথম তিন্নি আর ফয়সালের একমাত্র মেয়েকে কোলে তুলে নেয়। অতঃপর ছোট্ট রাজকন্যার কপালে তার ওষ্ঠদ্বয় স্পর্শ করে। বাচ্চার চোখে-মুখে খুশির ঝিলিক দেখে হাসিমুখে বাচ্চাটাকে বুকে আগলে নেয় সে। ফয়সাল এসে কুয়াশার সামনে দাঁড়িয়ে করুণ স্বরে বলে,

“কুয়াশা তিন্নিকে বাঁচাও। ওর অবস্থা অনেক খারাপ। এই মুহূর্তে একমাত্র তোমার র ক্ত ওকে বাঁচাতে পারবে। নতুবা ওও শেষ হয়ে যাবে।”

কুয়াশা শক্ত কণ্ঠে জবাব দেয়,

“কোথায় যেতে হবে সেখানে নিয়ে চলুন আমাকে। আমি প্রস্তুতি নিয়েই এসেছি।”

ফয়সাল দ্রুত কুয়াশাকে নিয়ে চলে যায়। একটা বেডে তাকে শুইয়ে দিয়ে তার শরীর থেকে র ক্ত নেওয়া হয়। সেই র ক্ত তিন্নির শরীরে প্রবেশ করানোর পরেই সবাই চিন্তামুক্ত হয়। কারণ তিন্নির অবস্থা এখন কিছুটা ভালো। আশঙ্কা অনেকটা কমে গিয়েছে। কুয়াশা চোখ বন্ধ করে ভাবছে,

“তোমার পাপের শাস্তি পাওয়া হয়তো এখান থেকেই শুরু আপু। এটা কেবল শুরু হলো। ভবিষ্যতে হয়তো আরো অনেকভাবে তুমি বুঝতে পারবে, তুমি আমার সাথে যা করেছ সেটা মারাত্মক অন্যায়। এই অন্যায় ক্ষমার যোগ্য নয়। তাই তোমাকে শাস্তি পেতেই হবে। আজ আমি তোমাকে বাঁচালাম। কারণ তোমার জীবন নিয়ে আমি প্রতিশোধ নিতে চাই না। আর বাচ্চাটা নিষ্পাপ। ওকে মা হারা করতে চাই না। তাই আমার র ক্ত দিয়ে আজ তোমাকে নতুন জীবন দিলাম আমি।”

নিজের মনে কথাগুলো বলে কুয়াশা গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। সে প্রচুর ক্লান্ত আজ। এখন তার বিশ্রামের প্রয়োজন। সারারাত ঘুমিয়ে ভোরে ঘুম ভাঙে কুয়াশার। পাশে তাকিয়ে দেখে মা বসে আছে।

“মা তুমি এখানে কী করছ?”

“তোমার পাশে বসে আছি। আমার মেয়েটা একদম ভালো নেই। তোমার চেহারা বলে দিচ্ছে এটা।”

“মা জানো? রায়াদ বিয়ে করেছে।”

“কবে?”

“এইতো কিছু দিন আগে।”

“ওর কথা এখনো কেন মনে করো তুমি?”

“চাই না মনে করতে। কিন্তু চাইলেও কি প্রথম ভালোবাসা ভুলে থাকা যায় মা?”

“ওর মত ছেলেকে মনে রাখার কোনো দরকার নেই। ওকে যত তাড়াতাড়ি ভুলতে পারবে তত তাড়াতাড়ি নিজের জীবনে ভালো কিছু অর্জন করতে পারবে।”

“শুধু রায়াদ নয়। তুরাবের কাজকর্ম আমাকে প্রতিনিয়ত খুব কষ্ট দিচ্ছে। আমি আর এসব মেনে নিতে পারছি না মা। আমিও মানুষ। আর কত সহ্য করব?”

“তোমাকে আমি বলেছিলাম এই কেস হাতে না নিতে। কিন্তু তুমি তো আমার কথা শুনলে না। মলিও মানা করল। কারোর কথায় শুনলে না।”

“ব্যক্তিগত ঝামেলার জন্য আমার পেশাগত জীবনকে তো হুমকির মুখে ফেলতে পারি না। আমিও এই কেস হাতে নিতে চাইনি। কিন্তু আমার কাছে আর কোনো উপায় ছিল না। না চাইতেও তুরাবের কেস আমাকেই নিতে হয়েছে।”

“এমন ছেলের সাথে আর কতদিন বিয়ের মত সম্পর্কে আবদ্ধ থাকতে চাও তুমি?”

“আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি।”

“কী সিদ্ধান্ত?”

“সময় আসলে সব জানতে পারবে। সবার আগে তোমাকেই জানাব। চিন্তা করো না মা। আমার কিছু হবে না। ভালো থাকব আমি। তোমার মেয়েকে আর কেউ কষ্ট দিতে পারবে না। এমনভাবেই নিজেকে তৈরি করার চেষ্টা করছি আমি।”

“আচ্ছা অনেক কথা হয়েছে। এবার তোমাকে কিছু খেতে হবে।তোমার শরীর অনেক দুর্বল।”

“আপু কেমন আছে?”

“এখন ভালো আছে।”

মা-মেয়ের কথা বলার এক পর্যায়ে কুয়াশার মামি অর্থাৎ তিন্নির মা সেখানে চলে আসেন।

“কুয়াশা মা এখন কেমন আছিস?”

“ভালো আছি মামি।”

“শরীর কি অনেক দুর্বল লাগছে?”

“খুব বেশি না। ঠিক আছি আমি।”

“তিন্নি তোর সাথে একটু কথা বলতে চাচ্ছে। তুই কি একবার ওর কাছে যাবি?”

“না মামি। আমি তোমাদের বলে দিচ্ছি, ওর কাছে যাওয়ার জন্য আমাকে কেউ জোর করবে না।”

“একবার!”

“এই মুহূর্তে আর কথা বলতে ভালো লাগছে না আমার। আমি আর একটু বিশ্রাম নিতে চাই। তোমরা এখন আসতে পারো।”

কথাটা বলে নিজের চোখ দু’টো বন্ধ করে নেয় কুয়াশা। মেয়ের এমন আচরণ দেখে আর কিছু বলেন না মিসেস নাহার। তার মেয়ে যা চায় তাই হবে। তাই নিজের ভাইয়ের বউকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন তিনি।

কুয়াশার সারাদিন চলে যায় ক্লিনিকে। সন্ধ্যায় কিছুটা সুস্থবোধ করায় নিজের বাড়িতে চলে আসে সে। এসে সবার আগে সাফওয়ানকে কল দেয়। রিং হওয়ার দুই সেকেন্ডের মধ্যে সাফওয়ান কল রিসিভ করে। যেন এতক্ষণ সে কুয়াশার কলের জন্যই অপেক্ষা করছিল।

“আসসালামু আলাইকুম।”

“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কুয়াশা কেমন আছ তুমি? শরীর কি এখনো দুর্বল লাগছে?”

“না। আমি এখন ভালো আছি।”

“ঢাকায় ফিরবে কবে? এদিকে তো তুরাবের কেস কোর্টে উঠবে আগামী পরশু। সেখানে তোমাকে থাকতে হবে।”

“আমি আগামীকাল ফিরে যাব। তুমি চিন্তা করো না।”

“তোমাকে আরো একটা খবর দেওয়ার ছিল।”

“হ্যা বলো।”

“আমাদের একটা পুরোনো বাড়ি আছে। ঢাকা থেকে কিছুটা দূরে। এখন ফাঁকা পড়ে আছে। আগে ওখানে আমার দাদুবাড়ির লোকজন থাকত। এখন যেহেতু কেউ থাকে না, তাই আমি চাই ওই বাড়িতেই বৃদ্ধাশ্রম তৈরি করতে। বাড়িটা অনেক বড়ো। একপাশে বৃদ্ধাশ্রম আর অন্য পাশে এতিমখানা বানালে কেমন হবে?”

“বাহ্! এটা অনেক ভালো হবে। কিন্তু তোমার পরিবার রাজি হবে?”

“আমি উনাদের থেকে অনুমতি নিয়েছি। এটা নিয়ে ভাবতে হবে না। তুমি রাজি থাকলে আমি আগামীকাল থেকেই বাড়ির কাজকর্ম শুরু করতে চাই।”

“আমার কোনো আপত্তি নেই। তবে খরচ আমি বহন করব। এতে না করতে পারবে না তুমি।”

“আচ্ছা আমরা দু’জন মিলে সমাম সমাম করে দিব। এবার ঠিক আছে?”

“হুম।”

“খেয়েছ?”

“হ্যা৷ তুমি?”

“আমি খাব একটু পর। অনেক কথা হলো। এখন তুমি ঘুমাও। তোমার আরো বিশ্রামের দরকার।”

“রাখি তাহলে।”

“সাবধানে থেকো। শুভ রাত্রি।”

“শুভ রাত্রি।”

সাফওয়ানের সাথে কথা বলা শেষ করে কুয়াশা ফোন একপাশে রেখে চোখ বন্ধ করে নেয়। তার কোনোকিছুই ভালো লাগছে না। আজ বেশিক্ষণ ভাবনার জগতে থাকতে পারল না সে। অল্প কিছু সময়ের মধ্যে চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে আসে কুয়াশার।

অন্যদিকে তিন্নি যখন থেকে শুনেছে যে কুয়াশা তাকে র ক্ত দিয়ে বাঁচিয়েছে ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে কুয়াশার সাথে কথা বলার জন্য তার মন অস্থির হয়ে উঠেছে। কিন্তু কুয়াশা তার সাথে কথা বলতে চায় না, এই কথাটা শুনে তার মন ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। তার মনের মধ্যে কিছু একটা নিয়ে প্রচন্ড পরিমাণে অস্থিরতা কাজ করছে!#কুয়াশা_মিলিয়ে_যায়_রোদ্দুরে
#পর্ব_১৮
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা

“আজ কেস কোর্টে উঠবে। তবে আমার মনে হয় না এই কেস খুব বেশিদিন চলবে। আশা করছি, তোমার প্রথম কেস দুই দিনেই শেষ হয়ে যাবে।”

কুয়াশা নিজের গায়ে কালো গাউন জড়াতে জড়াতে বলে,

“আজকেই এই কেস বন্ধ হয়ে যাবে কিনা এটা ভাবছি। মিহি নামের মেয়েটা এত কাঁচা কাজ করে পুলিশের কাছে আসলো কীভাবে?”

“পাগল হলে যা হয়।”

সাফওয়ানের কথায় কুয়াশা হাসিমুখে উত্তর দেয়,

“এমন কেসে নিজেকে জড়াতে হবে কখনো ভাবিনি। না মানে আমিই হয়তো প্রথম নারী যে কিনা নিজের স্বামীর বিরুদ্ধে আসা এমন অভিযোগের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। এই জীবন নিয়ে হাসব নাকি কাঁদব বুঝতে পারি না!”

“আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে কুয়াশা। এখন মন খারাপ না করে কোর্টে চলো। তোমার জীবনের প্রথম কেস এটা। খুব সাবধানে কথা বলতে হবে।”

“হ্যা জানি। দেখা যাক কি হয় আজকে।”

“চলো এখন।”

সাফওয়ান আর কুয়াশা একসাথে বের হয়ে যায় কোর্টের উদ্দেশ্যে। কোর্টের সামনেই তুরাবের সাথে দেখা হয়ে যায় তাদের। কুয়াশা তুরাবের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে,

“ভয় পাবেন না। এটা খুব ছোট একটা কেস। হ্যা, অভিযোগটা বড়ো। কিন্তু আমাদের কাছে অনেক প্রমাণ আছে। আশা করছি আজই এই কেস বন্ধ করে দেওয়া হবে। খুব বেশি হলে আগামী ডেট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু আপনার কোনো ক্ষতি হবে না এটুকু বলতে পারি। কারণ এই কেসে আপনি সত্যিই নির্দোষ। তবে জীবনের খাতায় নন!”

কুয়াশার শেষ বাক্য শুনে তুরাবের মুখ অন্ধকারে ছেয়ে যায়। সব সময় এই মেয়েটা তাকে খোঁচা দিয়ে কথা বলে। এটা করে যে মেয়েটা কি এমন শান্তি পায় তা তুরাব কিছুতেই বুঝতে পারে না।

“কুয়াশা আমাদের এখন ভেতরে যাওয়া উচিত।”

“হ্যা চলো।”

কুয়াশা সাফওয়ানের সাথে ভেতরের দিকে চলে যাওয়ার সাথে সাথে তুরাবও এগিয়ে যায় সেদিকে। কোর্টে সবাই উপস্থিত। এখন শুধু জজ আসার অপেক্ষা। যথা সময়ে জজ সাহেব চলে আসেন। নিজ আসন গ্রহণ করে কেসের কাজ শুরু করার নির্দেশ দেন। প্রথেই কাঠগড়ায় তুরাবকে তোলা হয়। অপরপক্ষের উকিল ইচ্ছামতো তুরাবের উপর দোষ দিতে থাকে। কুয়াশা নিশ্চুপ হয়ে সব শ্রবণ করছিল। অতঃপর কুয়াশার সময় আসলে সে মিহিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। এরপর একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকে।

“মিস মিহি আপনার কথা অনুযায়ী মিস্টার তুরাব তৌহিদ আপনার সাথে প্রেমের নাটক করে শারীরিক সম্পর্ক করেছে। কিন্তু পরবর্তীতে আপনাকে বিয়ে করতে সে রাজি হয়নি। ঠিক তো?”

“হ্যা।”

“এখন আমার প্রশ্ন হলো, আপনাদের ব্যক্তিগত সময়ের মুহূর্ত কে ভিডিয়ো করল? আর সেই ভিডিয়ো আপনিই বা কীভাবে পেলেন? পুলিশকে দেখালেন কীভাবে?”

কুয়াশার কথায় মিহি চুপ করে যায়। কোনো উত্তর দিতে পারে না।

“চুপ করে থাকবেন না। উত্তর দিন।”

“আসলে তুরাব যদি আমাকে ছেড়ে চলে যায় এই ভয় থেকে আমি নিজেই ভিডিয়ো ধারণ করেছিলাম।”

“আপনি এমন আমতা আমতা করছেন কেন? যাইহোক, এখন প্রশ্ন হলো যার কাছে এত ভয় তার কাছে নিজেকে বিলিয়ে দিলেন কেন?”

“ভালোবাসি তাই। ওকে হারানোর ভয় পেতাম আমি। তাই ওও যা যা বলেছে সেটাই করেছি আমি।”

“আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন, আপনি যদি মিস্টার তুরাবকে এতটা ভালোবেসে থাকেন তাহলে ওনার থেকে দশ লাখ টাকা কেন চেয়েছেন?”

কুয়াশার এমন প্রশ্নে চমকে যায় মিহি। তার চোখেমুখে ভয় ফুটে উঠেছে।

“আমি কোনো টাকা চাইনি। এসব মিথ্যা কথা।”

কুয়াশা আপনমনে হেসে জজকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“মহামান্য আদালত আপনি অনুমতি দিলে আমি আমার মক্কেলের হয়ে কিছু প্রমাণ পেশ করতে চাই।”

জজের পক্ষ হতে উত্তর আসে,

“অনুমতি দেওয়া হলো।”

কুয়াশা একটা পেন ড্রাইভ আর তুরাবের ফোন জজের সামনে দিয়ে বলে,

“এই ফোনে যে ভয়েস রেকর্ড করা আছে তা শোনার জন্য অনুরোধ করছি।”

জজ সাহেব ভয়েস চালু করতেই কিছু দিন আগে তুরাবের সাথে মিহির কথপোকথন শুনতে পায়। যেখানে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে, মিহি এই কেস তুলে নেওয়ার জন্য তুরাবের থেকে দশ লাখ টাকা চাচ্ছে।

এই ভয়েস শোনার পর পেন ড্রাইভে থাকা ভিডিয়ো চালু করে জজ সাহেবকে সেটা দেখতে অনুরোধ করে কুয়াশা। ভিডিয়ো চালু করার পর কুয়াশা বলতে শুরু করে,

“এখানে দেখা যাচ্ছে মিস্টার তুরাব চোখ বন্ধ অবস্থায় বিছানায় শুয়ে আছে। মেয়েটার চুলের জন্য তা স্পষ্ট বোঝা না গেলেও খানিকটা বোঝা যাচ্ছে। এছাড়া মেয়েটার শরীর থেকে মিস্টার তুরাবের হাত বারবার সরে যাচ্ছে। এখন আমার প্রশ্ন হলো, একজন অচেতন ব্যক্তি কীভাবে মেয়েটার সাথে ঘনিষ্ঠ হতে পারে? এটা কী নিছকই একটা ষড়যন্ত্র নয়?”

কুয়াশার এহেন কথায় মিহির গলা শুকিয়ে যায়। তার হাত-পা কাঁপতে শুরু করে।

“মিস মিহি প্রশ্নের জবাব দিন। কেন এমন কাজ করলেন আপনি?”

মিহিকে চুপ থাকতে দেখে কুয়াশা পুনরায় জিজ্ঞেস করে,

“কী হলো? আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।”

বারবার প্রশ্ন করার পরেও মিহিকে চুপ করে থাকতে দেখে কুয়াশা চিৎকার করে বলে,

“উত্তর দিন বলছি।”

মিহি নিজেকে সামলাতে না পেরে সমস্ত সত্যি স্বীকার করে নিয়ে বলে,

“হ্যা এসব আমার সাজানো নাটক। আমি টাকার জন্য এসব করেছি। আমাকে দয়া করে ক্ষমা করে দিন। আমি আর কখনো এমন করব না।”

কথাটা বলে কান্নায় ভেঙে পড়ে মিহি। কুয়াশা জজ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলে,

“মিস মিহি নিজেই সব কথা স্বীকার করে নিলেন। এখানে আমার মক্কেলের কোনো দোষ নেই তা পরিষ্কার। সুতরাং, আমি আমার মক্কেলের বিরুদ্ধে আসা এই অভিযোগ তুলে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি। বিনা দোষে আমার মক্কেলকে যেন শাস্তি পেতে না হয় তার জন্য জজ সাহেবের কাছে অনুরোধ করছি।”

জজ সাহেব সমস্ত প্রমাণের উপর ভিত্তি করে এই কেস বন্ধ করে দেওয়ার আদেশ দেয়। একইসাথে মিহির এমন ঘৃণ্য কাজের জন্য তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড প্রদান করে।

এমন রায়ে সবার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। একটা কেস এত সহজে শেষ করার জন্য কুয়াশাকে নিয়ে সবাই বাহবা দিতে থাকে। তুরাব খুশিমনে কুয়াশার দিকে এগিয়ে আসতে গেলে কুয়াশা তাকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যেতে চায়। তুরাব কুয়াশাকে পেছন থেকে ডাকলেও সে সেই ডাক উপেক্ষা করে হাঁটতে থাকে। এমতাবস্থায় তুরাব কুয়াশার হাত ধরে ফেলে।

“কোন সাহসে আপনি আমার হাত ধরলেন?”

“কেন এমন করছ তুমি আমার সাথে?”

“আপনার কেস হাতে নিয়েছিলাম আমি। আপনাকে অনেক বড়ো অভিযোগ থেকে মুক্ত করেছি। আর কী চান?”

“তোমাকে চাই!”

“নিজের সীমানার মধ্যে থাকুন আপনি। এমন কিছু বলবেন না যার জন্য এখন আমাকেই আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে হয়।”

“নিজের স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে চাও?”

“বারবার আমার স্বামী হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়ে কী প্রমাণ করতে চান? আপনি আমাকে ভালোবাসেন? আমাকে বউ হিসেবে মানেন? আমাকে ফিরে পেতে চান? এসব প্রমাণ করতে চান?”

“যেটা সত্যি সেটা প্রমাণ করার জন্য কিছু করতে হয় না কুয়াশা। আমি সত্যিই তোমাকে ফিরে পেতে চাই।”

“আমাকে ফিরে পাওয়ার খুব ইচ্ছা আপনার তাই না?”

“হ্যা।”

“কিন্তু কেন? আমি আপনাকে বাঁচিয়েছি বলে দয়া দেখাতে এসেছেন?”

“না। মন থেকে তোমাকে অনুভব করতে পারি এখন। এজন্যই চাই যেন আমাদের সম্পর্ক আবার ঠিক হয়ে যায়।”

তুরাবের এমন প্রশ্নে কুয়াশা হাসতে আরম্ভ করে। যেন সে খুব মজার কিছু শুনেছে।

“কী হলো? তুমি এমন করে হাসছ কেন?”

কুয়াশা কোনোরকমে হাসি থামিয়ে তুরাবের দিকে তাকিয়ে বলে,

“আপনাকে আমার কিছু দেওয়ার আছে তুরাব!”

“কী?”

“একটু অপেক্ষা করুন।”

কথাটা বলে কুয়াশা সাফওয়ানকে কাছে ডাকে। তারপর তুরাবকে উদ্দেশ্য করে বলে,
#কুয়াশা_মিলিয়ে_যায়_রোদ্দুরে
#পর্ব_১৯
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা

“কী এটা?”

“ডিভোর্স পেপার!”

কুয়াশার কথায় তুরাব দুই পা পিছিয়ে যায়। একটু আগেই তার হাতে কুয়াশা এই ডিভোর্স পেপার ধরিয়ে দিয়েছে।

“কী হলো তুরাব? খুশি হননি আপনি?”

“কুয়াশা তুমি কি পাগল হয়ে গিয়েছ? এসবের মানে কী?”

“আপনি নিজেই তো আমার থেকে ডিভোর্স চেয়েছিলেন। তাহলে আজ কেন এত অবাক হচ্ছেন?”

“দেখ কুয়াশা আমি এখন ডিভোর্স চাই না। আমি তোমার সাথে থাকতে চাই।”

“কিন্তু আমি যে এমন জঘন্য চরিত্রের কারোর সাথে আর এক মুহূর্ত থাকতে চাই না।”

কুয়াশার এহেন কথায় তুরাব অসহায় চাহুনি নিয়ে তাকায় তার দিকে। এমন চাহুনি দিয়েও সে কুয়াশার মন গলাতে পারে না।

“আমি যখন ডিভোর্স চেয়েছিলাম তখন তো ডিভোর্স দাওনি। তাহলে আজ কেন?”

“আজ আপনি চান না বলেই তো আমি চাচ্ছি।”

“মানে?”

কুয়াশা আনমনে হেসে উত্তর দেয়,

“অনুভূতিগুলো চোখের সামনে শেষ হয়ে যাওয়ার কষ্ট বোঝেন? আজ আপনি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন একদিন এই জায়গায় আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। সেদিন চলে আসার পর ভেবেছিলাম আপনি আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন। কিন্তু না, আপনি তো আমাকে ছেড়ে দিতে চাইলেন! নিজের কাজ শেষে ছুঁড়ে ফেললেন আমাকে। আমার যন্ত্রণা সেদিন আপনি বুঝতে পারেননি। বুঝতে পারেননি আপনাকে নিয়ে আমার মনের কোণে জমে থাকা সুপ্ত অনুভূতিগুলোকে। আর আজ আপনিও ঠিক একই রকম কষ্ট পাচ্ছেন। নিরব প্রতিশোধ নিতে কখনো কাউকে দেখেছেন? আমিই সে যে আপনার উপর নিরব প্রতিশোধ নিলো আজ!”

“তার মানে এজন্যই তুমি আমাকে এতদিন ডিভোর্স দাওনি?”

“হ্যা। আমি তো আপনাকে ছেড়ে আসার দিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। যেদিন আপনার মনে আমাকে নিয়ে অনুভূতি জন্মাবে ঠিক সেই মুহূর্তে আমি আপনাকে ছেড়ে দিব। সবাই ভেবেছে সমাজের কথা ভেবে আমি আপনাকে ডিভোর্স দিচ্ছি না। আসলে কিন্তু তা নয়। সমাজের কথা আমি কেনই বা ভাবতে যাব? যে সমাজের মানুষজন অসহায় মেয়েদের বলে, স্বামী যেমনই হোক সংসার করতেই হবে। স্বামী যদি পরনারীতে আসক্ত হয় তবুও সংসার করতে হবে। স্বামী যদি প্রাক্তন প্রেমিকার উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য স্ত্রীকে ব্যবহার করে তবুও সেই স্বামীর সংসার করতে হবে। স্বামী যদি ভালো না বাসে তবুও তার সংসার করতেই হবে। স্বামী হাজারো অপরাধ করবে। তবুও চুপ করে সংসার করতে হবে। স্বামী যদি একবার ক্ষমা চায় তাহলে সাথে সাথে ক্ষমা করে দিতে হবে। কোনো অবস্থাতেই সংসার ছাড়া যাবে না। কারণ মেয়েদের আসল ঘর হলো স্বামীর ঘর। এইসব ভাবা সমাজের মানুষজনকে আমি ঘৃণা করি। কেন জানেন? কারণ তারা আমাদের মত মেয়েদের এসব বুঝিয়ে আমাদের আত্মসম্মান বিসর্জন দিতে শেখায়। এমন সমাজ আমাকে নিয়ে কি বলল তাতে আমার কিচ্ছু যায় কিংবা আসে না!”

তুরাব নিজেকে সামলাতে না পেরে কুয়াশার দুই হাত ধরে অনুনয়ের সুরে বলে,

“একটা বার কী আমাকে ক্ষমা করা যায় না?”

“কাকে ক্ষমা করব? যে আমাকে খেলার গুটি বানিয়েছে? যে আমাকে ভালোবেসে কখনো স্পর্শ করেনি তাকে ক্ষমা করব? যে আমার জীবন নিয়ে খেলেছে তাকে ক্ষমা করতে বলছেন আপনি? যে মানুষটা আমার অনুভূতির মূল্য দেয়নি তাকে কী করে ক্ষমা করব আমি? যে আমাকে এক কথায় ডিভোর্স দিতে চেয়েছে তাকে ক্ষমা করব আমি? তাহলে আমাকে মাফ করবেন। আমি এত দয়ালু নই। আমার জীবনের দাম আছে। আমি ফেলনা নই তুরাব। আমার আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে আমি আপনার কাছে ফিরতে পারব না। আমি আপনার ছায়াও আর কখনো দেখতে চাই না।”

“আমি তোমাকে ডিভোর্স দিব না কুয়াশা। তুমি যা ইচ্ছা করতে পারো।”

“আপনি ডিভোর্স দিতে না চাইলেও তিন মাস পর, উর্ধ্বে ছয় মাস পর এমনিতেই আমাদের ডিভোর্স হয়ে যাবে। আর কী জানেন তো? জোর করে কখনো সম্পর্ক টেকানো যায় না।”

“তুমি এভাবে কষ্ট দিতে পারো না আমাকে।”

“ওহ্ তাই? আপনি মনে হয় আমাকে খুব সুখ দিয়েছেন? আপনি এমন এক পুরুষ যে কিনা শতশত মেয়েকে ছুঁয়েছে। আচ্ছা এত মেয়েকে স্পর্শ করলেন। আপুকে কেন ছেড়ে দিলেন?”

“তার প্রতি আমার ওই টান কখনো কাজই করেনি। তাকে ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছা করেনি।”

“সম্পর্কে ছিলেন কেন তাহলে?”

“জানি না। সত্যি বলতে এর উত্তর আমার কাছে নেই।”

“যাইহোক, একটা শেষ অনুরোধ করি? যদি আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দিতে চান তাহলে এই পেপারে সই করে দিবেন। আর কোনোদিন আমার সামনে আসবেন না। ভালো থাকবেন!”

কথাটা বলে কুয়াশা নিজ মনে হাঁটতে শুরু করে। তার চোখের কোণে পানি জমেছে। এই পানি সে কাউকে দেখাতে চায় না। তাই যথাসম্ভব চোখের পানি লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে সে। সাফওয়ান তার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে প্রশ্ন করে,

“কেন এমন সিদ্ধান্ত নিলে? যে সিদ্ধান্ত তোমার চোখে পানি নিয়ে আসে।”

“আমি তুরাবকে হারানোর জন্য কাঁদছি না। আমি আজ থেকে আমার নামের পাশে ডিভোর্সি তকমা বসবে তার জন্যও কাঁদছি না। আমি কাঁদছি নিজের জন্য। সত্যিকারের ভালোবাসা না পাওয়া এক অভাগী আমি। আমার কপালে এক মুঠো ভালোবাসা নেই। আমি কি ভালোবাসার যোগ্য নই? এই বিশ্বে কেউ কেন ভালোবেসে কাছে টেনে নিলো না আমায়? আমি কি এতটাই খারাপ? ভালোবাসা পাওয়ার কোনো অধিকার কি আমার নেই? আমি তো শুধু এক মুঠো ভালোবাসার আশায় বেঁচেছি এতদিন। কিন্তু আমার ভাগ্যে ভালোবাসার সেই সুখ নেই!”

“এভাবে কেঁদো না। তোমার জীবনেও সত্যিকারের ভালোবাসা আসবে। অপেক্ষা করতে ক্ষতি কোথায়? অপেক্ষার ফল মধুর হয়। তোমার অপেক্ষাও একদিন স্বার্থক হবে। মিলিয়ে নিয়ো আমার কথা।”

কুয়াশা আর কোনো কথা বলে না। সাফওয়ান কুয়াশাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে চলে যায়। তার আগে আদ্রিতাকে বলে দেয়,

“ওর খেয়াল রেখো। পারলে সব সময় ওর পাশে থেকো। আজকের রাতটা ওকে একদম একা রাখবে না।”

সাথে কুয়াশার যত্ন নেওয়ার কথা বলতেও ভোলে না সে। মেয়েটার চোখের পানি একদম ভালো লাগে না তার।

কুয়াশা নিশ্চুপ হয়ে জানালার পাশে বসে আছে। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির বিন্দু বিন্দু ফোঁটা এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে তাকে। চোখের পানি আর বৃষ্টির পানিতে একাকার হয়ে গিয়েছে তার মুখখানা। আদ্রিতা তার পাশে বসে। সেদিকে মেয়েটার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।

“তোর খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না?”

আদ্রিতার এমন কথায় কুয়াশার মধ্যে কোনোরকম পরিবর্তন খেয়াল করে না সে।

“উত্তর দিবি না?”

“আমার না অবাক লাগে।”

“কেন?”

“তুরাবের মত ছেলের সাথে যারা আমাকে সংসার টিকিয়ে রাখতে বলেছে সেই সকল মেয়েদের দেখে অবাক লাগে। তাদের মধ্যে কী আত্মসম্মান বলতে কিছু নেই? ডিভোর্সি মেয়েদের কেন আলাদা চোখে দেখা হয়? মানছি সব মেয়ে ভালো হয় না। কিন্তু কিছু খারাপ মেয়ের জন্য সবাই কেন শাস্তি পায়? কেউ কি নিজ ইচ্ছায় এমন জীবন বেছে নেয়? আমাদের মত মেয়েদের অবস্থা কেন বুঝতে পারে না ওরা?”

“মানুষের কথায় কান দিবি না। তুই যা করেছিস একদম ঠিক করেছিস। চরিত্র যার ঠিক নেই তার সাথে থাকার থেকে ছেড়ে দেওয়া অনেক ভালো।”

হঠাৎ কুয়াশার ফোন বেজে ওঠে। আদ্রিতা ফোন হাতে নিয়ে বলে,

“আন্টি কল দিয়েছে। কথা বল।”

কুয়াশা কানের কাছে ফোন নিয়ে মলিন কণ্ঠে বলে,

“মা!”

“মন খারাপ?”

“ভীষণ!”

“কেন?”

“আমায় কেউ কেন ভালোবাসে না মা?”

“কে বলেছে ভালোবাসে না? তোমাকে সবাই ভালোবাসে।”

“তবে যে আমি স্বামীর ভালোবাসা পেলাম না। পেলাম না নিজের হাতে তৈরি করা সুন্দর সাজানো একটা সংসার। পেলাম না সন্তান সুখ!”

মেয়ের প্রশ্নের জবাবে কোনো উত্তর খুঁজে পান না মিসেস নাহার। এমন প্রশ্নের উত্তরে কী বলা যায়? আদৌও কী এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর আছে? না, এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর হয় না। হয় শুধু নিরবতা!

চলবে??

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here