#গোধুলীর_শেষ_প্রহরে
#পর্বঃ৫
#রাউফুন (ছদ্মনাম)
মুহুকে সারা ভার্সিটিতে খুঁজেও কোথাও যখন না পেলো তখন কুহুর টেনশন আরও বাড়লো।মেয়েটার তো ফোনটাও অফ দেখাচ্ছে।এতেই কুহুর চিন্তা চার গুন বেড়েছে।কোথায় যেতে পারে ভেবেই পেলো না।হঠাৎ করে কিছু একটা মনে হতেই সে ছুটলো।প্রিন্সিপাল স্যার কে অনুরোধ করে আজকের মতো বিদায় নিলো সে।ফার্স্ট ডে ভেবেই প্রিন্সিপাল স্যার তেমন মাথা ঘামালেন না।নিশ্চয়ই মুহু সেখানেই গেছে কুহু যেখানকার কথা ভাবছে।সে যেতে যেতে কাউকে একটা ফোন করলো।তারাহুরো করে যেতেই কারোর সাথে সজোরে ধাক্কা লাগলো তার।ডায়াল লিষ্টে কাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তির নাম্বার জ্বলজ্বল করছে।হাত থেকে ফোন টা ছিটকে পরেছে তার।কুহু কো’প দৃষ্টিতে তাকালো ধাক্কা লাগা ব্যাক্তির দিকে।লোকটিও সঙ্গে সঙ্গেই তার দিকে তাকিয়েছে।
শৈবাল ওর বন্ধুদের কাছে যাচ্ছিলো।একটাকেও এখন সে পাচ্ছে না কাছে পিঠে।তখনকার মেয়েটির উপর তার ক্ষোভ এখনো আছে।মেয়েটার একটা ব্যবস্থা করতেই সে হন্তদন্ত হয়ে খুজছিলো বন্ধুদের।বেখায়ালি হাটতে গিয়েই ধাক্কা লাগলো কারোর সাথে।সামনের মেয়েটিকে দেখেই শৈবালের কেমন যেনো চেনা চেনা লাগছিলো।এক ধ্যানে তাকিয়ে থেকে মনে করার চেষ্টা চালালো।ব্রেইনের স্নায়ুর উপর একটুখানি চাপ খাটালো সে।পরক্ষণেই মনে পরলো ইশরা ইনাম মুহু নামের আইডিতে এই মেয়েটার ছবি সে দেখেছিলো।এই মেয়ের সাথে একদিন কথা হয়েছিলো শুধু।সে ইম্প্রেশন কথা বার্তা বললেও তেমন গুরুত্ব পাইনি মেয়েটির কাছে।যদিও একদিনই কথা হয়েছিলো।হঠাৎ করেই মেয়েটির সঙ্গে এইভাবে দেখা হবে সে ভাবেও নি।মেয়েটিও নিশ্চয়ই তাকে চিনতে পেরেছে।কিন্তু ও এখানে কি করছে?প্রশ্ন জাগতেই সে অকপটে সরাসরি প্রশ্ন করলো,
“তুমি তো সেই যার সঙ্গে আমি মেসেঞ্জারে গত একদিন কনভারসনে ছিলাম?”
কুহু স্বস্থানে দাঁড়িয়ে ভ্রু সংকুচিত করে তাকালো ছেলেটির দিকে।আবার চোখ নামিয়েও নিলো সে।কি বলছে ছেলেটা এসব।তার সাথে কখন এই ছেলের কথা হলো।আশ্চর্য তো!সে এই সময় কথা বাড়াতে চাইলো না।এখন সময় নেই তার হাতে।সে হাতরে ফোন তুলে নিলো।বিনা বাক্যে পা চালিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলো কুহু।কিন্তু শৈবাল পথ আগলে দাঁড়িয়ে পরলো ওর সামনে।
কুহুর দৃষ্টি ধারালো হলো।সে ক্রুদ্ধ হয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“সমস্যা কি আপনার?এইভাবে পথ আটকে দাঁড়ালেন কেন?”
শৈবাল চমকিত হলো মেয়েটির কন্ঠঃ শুনে।পুলোকিত, আপ্লূত হলো তার হৃদয়।এতো সুন্দর কন্ঠের অধিকারীনি এই মেয়েটি।সে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে।নিজেকে সামলে আবার জিজ্ঞেস করলো সে,
“আপনি ইশরা ইনাম মুহু তাই তো?হ্যাঁ কি না?”
“নো মুহু ইজ মাই সিস্টার নেইম।ইটস মী ইকরা কুহুলতা!
কুহু আর দাঁড়াইনি।দ্রুত পা চালিয়ে চলে এলো।এই ছেলেটা তার বোনের নাম কিভাবে জানলো?আর জানলেও তাকে কেন মুহু বলছে।কেন? প্রশ্ন জাগলেও এই সময় এই ব্যাপার নিয়ে ভাবার সময় তার কাছে নেই।সে ভার্সিটির গেট অভার করে বেরিয়ে এলো।
শৈবাল অবাক হয়ে ওর চলে যাওয়া দেখলো।এই প্রথম বোধহয় কোনো মেয়ে তার দিকে ফিরেও তাকাইনি।একবারের জন্যও না।তাকে দেখেও নি দ্বিতীয় বার।তার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকাইনি এই প্রথম কোনো মেয়ে।শুধু রাগে একবার দেখেছিলো বাট তার দৃষ্টি ছিলো প্রখর।অতি ভয়ংকর তেজ দেখেছে সেই দৃষ্টিতে।কি ধা’রা’লো সেই চাহনি!
এর মধ্যেই আগে শিশির পরে মোর্শেদ, ওঁদের পিছনে শাহেদ,স্বপন,রিমন,আশিক এলো তার কাছে।যদিও ওরা আরও কিছু টা আগে ক্লাস রুম থেকে বেরিয়েছিলো।নতুন মেমের সঙ্গে শৈবাল কে কথা বলতে দেখে সবাই দাঁড়িয়ে গেছিলো।নতুন মেমে যেতেই তারা এসেছে এখানে।কিছু টা দুর্বল ছিলো তাদের চাল চলন।কিন্তু ওরা স্বাভাবিক আচরণ করতে চাইলো।ওঁরা কেউই চাইলো না শৈবালের অনুপস্থিতিতে যা হয়েছে ওঁদের সাথে তা জানাতে।তখন আবার শৈবাল যদি বলে বসে ও ছাড়া তারা ছয় জন কিচ্ছু না।কারণ এর আগে কখনোই এরকম হয়নি।সব সময় শৈবাল ছিলো তাদের সাথে।এখন শৈবাল না থাকাই যে এমন টা হবে তারা তো সেটা জানতো না।শৈবাল তখনও খালি গেটের দিকে তাকিয়ে ছিলো তবদা খেয়ে।মোর্শেদের ডাকে সম্বিত ফিরলো তার,
“কি রে শৈবাল তুই নতুন মেমের সঙ্গে কি কথা বলছিলি রে?”
শৈবালের অবাকে কপালে তিনটা রেখায়
ফুটে উঠলো।ভ্রু যুগলের মাঝ বরাবর কুচকে এলো।সে জানতে চাইলো,
“নতুন মেম মানে?কার কথা বলছিস তুই?”
“আরে একটু আগে যার সঙ্গে কথা বলছিলি তুই তিনিই তো আমাদের ভার্সিটির নতুন শিক্ষিকা!”
রিমনের কথায় শৈবাল বলে, “কিহ!উনি আমাদের নতুন শিক্ষিকা?”
“হ্যাঁ রে উনিই তো।কি তেজি মেম।আজকে আমাদের সাথে**!”
শিশিরের চোখ রাঙানিতে থেমে গেলো রিমন।মুখে কুলুপ এঁটে ফিচেল হাসার চেষ্টা করলো পরে।শৈবাল বললো,
“কি হলো থেমে গেলি কেনো রিমন।”
“কিছু না।ও বলতে চাইছিলো যে মেম টা খুব সুন্দরী আছে কিন্তু!”
শিশির আমতা আমতা করে বললো।শৈবাল সন্দিহান দৃষ্টিতে দেখলো ওঁদের সবাইকে।ওঁদের কে কেমন বিদ্ধস্ত লাগছিলো ওর কাছে।কিন্তু তবুও কিছু বললো না সে।ও এখনো ভুলতে পারছে না কুহুলতাকে।তাকে এভাবে ডিসএপয়েন্ট করে নি কেউ এর আগে।আজকে দুজন মেয়ের সাথে তার দেখা হয়েছে।তারা দুজনেই তাকে পাত্তা দেইনি।এর শেষ দেখেই ছাড়বে সে।তবে কুহুলতার প্রতি তার যেনো অন্যরকম এট্রাকশন কাজ করেছে।এরকম অনুভূতির সাথে ওর পরিচয় নেই।এ যেনো এক অন্য রকম কিছু।যা আগে কখনোই হয়নি ওর সঙ্গে।শৈবাল কিছুই না বলে চুপচাপ প্রস্থান করলো সেখান থেকে।ওঁরা সবাই জাষ্ট শৈবালকে হা করে দেখলো।কি হলো টা কি এর।স্ট্রেঞ্জ!
•
কুহু একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে অনবরত কলিং বেল বাজাচ্ছে।তার শরীর অনিমেষ ভাবে কাঁপছে।সে একটু আগেই ফোন করে জানতে পেরেছে মুহু এখানে এসেছে।ওর বেস্ট ফ্রেন্ডের বাড়িতে।এমন একটা শোক সংবাদ শুনেছে কুহু যে খনে খনে কেঁপে উঠছে সে।চোখ দিয়ে পানি পরছে তার।হঠাৎ করেই এমন একটা খবর সে পাবে ভাবতেই পারেনি।এই জন্যই হইতো মুহু ওই ভাবে ভার্সিটি থেকে ছুটে চলে এসেছে।একটা চাপা কান্নার স্বর অস্পষ্ট ভাবে ভেসে আসছে ভেতর থেকে।সে অস্থিরচিত্তে আবার বেল চাপলো।দরজা খোলার শব্দে তাকালো কুহু সামনের মানুষ টার দিকে।কি অবিচল,বিদ্ধস্ত লাগছে মানুষ টাকে।মনে মনে যে এই মানুষ টাকে সে অনেক আগেই নিজের মন সপে দিয়েছে।চেয়েও তার সাথে প্রনয়ের শুরু করতে পারেনি কুহু।ভয় পেয়েছিলো সে।প্রিয় মানুষ টাকে এইরকম অসহায় অবস্থায় দেখবে সে ভাবতেও পারেনি।
“তৌহিদ ভাই এসব কখন হলো?”
হ্যাঁ এটা তৌহিদেরই বাড়ি।মুহুর বেস্ট ফ্রেন্ড তানহার ভাই।তানহার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সাথে সাথে তৌহিদের সঙ্গেও বিভিন্ন ভাবে দেখা সাক্ষাৎ হতো তাদের।তখন সে তৌহিদকে ফোন করেছিলো।আর ফোন করেই এমন চাঞ্চল্যকর কথা শুনেই ছুটে এসেছে সে।তৌহিদ কোনো রকমে ভেতরে আসতে বললো কুহুকে।আজ পাঁচ বছর থেকে তানহার বাবা প্যারালাইজড হয়ে শয্যাশায়ী ছিলেন।তানহার মা আরও আগেই গত হয়েছিলো।যখন তানহার ছয় বছর বয়স তখন।কুহু চোখের অশ্রু মুছে বলে উঠলো,
“আপনি নিজেকে সামলান তৌহিদ!কখন হয়েছে এসব!”
তৌহিদ কান্নারত অবস্থায় জবাব দিলো,
“দশটার পর হয়েছে এমন টা।হঠাৎ করেই বাবার শরীর টা খারাপ হতে শুরু করেছিলো।আমরা হসপিটাল নেওয়ার আগেই বাবা দরজার কাছেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।জানেন কুহুলতা আমার বাবা চেয়েছিলেন তার শেষ নিঃশ্বাস টা যেনো তার নিজের বাড়িতেই ত্যাগ হয়।আমার বাবা কথা রেখেছে।মা তো আগেই আমাদের একা করে চলে গেছে আর এখন বাবাও চলে গেলেন।”
কথা শেষ করেই তৌহিদ ভেঙে পরলো কান্নায়।এই সময় একটা মানুষ কে কিভাবে শান্তনা দিতে হয় কুহুর জানা নেই।সে নিঃসংকোচে তৌহিদের পিঠে আদুরে হাত রেখে নরম গলায় বলে,
“আপনি যদি এভাবে ভেঙে পরেন তাহলে তানহাকে কে সামলাবে বলুন তো।আপনাকে তো এই সময় স্ট্রং থাকতে হবে তাই না!আপনি প্লিজ এইভাবে ভেঙে পরবেন না।”
তৌহিদ চোখের পানি মুছে নিলো।সে কুহুর হাত ধরে দাঁড়ালো।তানহার ঘরের সামনে এনে দাঁড় করালো তাকে।মুহুর কোলে মাথা রেখে নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছে তানহা।এসময় মুহুকেই যে তার সবচেয়ে আপন মনে হচ্ছে।থেকে থেকে কেঁপে উঠছে সে।গলায় হিচকি তুলে কাঁদছে মেয়েটা।কি করুন সেই কান্নার দৃশ্য।মুহু তানহাকে এটা সেটা বলে থামানোর চেষ্টা করছে।মুহুর চোখেও জলে টইটম্বুর হয়ে আছে।ভারি ভারি মুক্তোর দানার ন্যায় গড়িয়ে পরছে তার গাল বেয়ে।
কুহু কয়েক কদম পিছিয়ে গেলো এমন দৃশ্য দেখে।কি করবে এখন সে।কি ই বা করতে পারে সে।আল্লাহ তায়ালার হুকুমজারি হলে কেউই যে কাউকে আটকে রাখতে পারে না।আল্লাহর হুকুমেই যে সব টা হয়।আমাদের সবাইকেই তো একদিন এই সুন্দর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হবে।তৌহিদের দিকে তাকালো কুহু।ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামলানোর ব্যর্থ প্রয়াস চালাচ্ছে সে।ওর এমন অবস্থা দেখে বক্ষ চিরে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে তার।
এই বাড়িতে তেমন কেউই আসে নি তৌহিদের বাবার মৃত্যুর খবর শুনে।ওঁদের তেমন আত্মীয় স্বজন ও নেই।চার পাঁচ জন মহিলা আর কয়েকজন পুরুষ মানুষ এসেছেন।পুরুষ মানুষ যারা এখন তৌহিদের বাবাকে ধোয়ানোর কাজ করছে।এগারোটার মধ্যেই তৌহিদের বাবার জানাজা করিয়ে মাটি দেওয়ার কাজ সম্পন্ন হয়েছে।এর মধ্যে সব সময় কুহু, মুহু ওঁদের একদমই একা ছাড়েনি।তানহা এর মধ্যে একবার জ্ঞান শুন্য হয়ে গেছিলো বাবাকে নিয়ে যাওয়ার সময়।মুহু নিজে ওঁকে গোসল করিয়ে দিয়েছিলো ওর বাবার জানাজার আগে।তৌহিদ ও ওর বাবার জানাজার আগেই গোসল করেছে।মুহুর্তেই বাড়িটা কে পাতালপুরী মনে হচ্ছে তার।শোকের ছায়া যেনো ঘিরে আছে বাড়ির চারপাশে।
#চলবে