#গোধুলীর_শেষ_প্রহরে
#পর্বঃ৭ (বোনাস পর্ব)
#রাউফুন (ছদ্মনাম)
অনবরত কলিং বেলের শব্দে মুহুর্তেই মুহুর রাগ উঠে গেলো।সে শিউলী আপাকে ডাকলো।কিন্তু তার সারা মিললো না।এলিওনারের পার্ক নোভেল বুক তার হাতে।বেশ রোমান্টিক নোভেল বুক টা।ওটা হাতে নিয়েই উঠলো সে দরজা খুলে দেওয়ার জন্য।ভাবলো দরজা টা খুলে দিয়েই ঘরে গিয়ে আবার বসবে পড়তে।একটা মেইন জায়গায় পড়ছিলো রোমান্টিক মুহুর্ত ছিলো তখন।এমন সময় সে কারোর বিরক্ত পছন্দ করে না।তার পরনের টি-শার্ট আর স্কার্ট।গলায় মেরুন রঙের উড়না পেচানো।চুলে বেন পড়া।ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চুলের হাত থেকে বাঁচতেই চুলের বেন পরেছে সে।সে গিয়ে দরজা খুলতেই অবাক হয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
“খালা মনি তুমি?কত দিন পর এলে তুমি!কেমন আছো তুমি?আমাদের কি মনে পরে না তোমার।”
সাহিরার খুশিতে চোখে ভিজে উঠলো।আনন্দে চোখে জল এসে গেছে তার।এতো দিন পর ভাগনিকে দেখে চোখের তৃষ্ণা মেটাচ্ছেন তিনি।
“পাগলি মেয়ে তোদের কি আমি ভুলতে পারি।ভুলিনি বলেই তো এলাম তোদের কে দেখতে।
মুহু চেঁচিয়ে মাকে ডাকলো,
“ও মা, মা গো দেখো কে এসেছে।ও খালা মনি তুমি কি বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকবে আসো ভেতরে আসো।”
প্রিতি ঘরের কাজ করছিলেন।ছোট মেয়ের চেচামেচি তে বাইরে বেরিয়ে এলেন।কারণে অকারণে মেয়েটার চেচানো অভ্যাস।তিনি চোখে চশমা ঠিক করে এগিয়ে এলেন।
“কে এসেছে শুনি যে এভাবে চেচাচ্ছিস ষা’ড়ে’র মতো।”
কথা শেষ করতে করতেই তার চোখ পরলো তার বোন সাহিরার দিকে।তিনি কিছু টা জোরে হেঁটেই এগিয়ে এলেন।বোনকে জাপ্টে ধরে বুকে আগলে নিলেন তিনি।কত দিন পর দেখলেন তার বোনকে।ছোট বোন যে তার প্রান।ওর বিয়ের পর ওঁকে বাড়ি থেকে কেউই মানে নি।বাড়ির বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করেছিলো যে তার ছোট বোন।কিন্তু সে তো তার বড় বোন তিনি মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন নি।কিন্তু গত দুই তিন বছরে মাঝে মাঝে ফোনে কথা হওয়া ছাড়া আর দেখা সাক্ষাৎ ছিলো না তাদের মধ্যে।আবেগে আপ্লুত হয়ে দুই বোনই অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছেন।কেউ কোনো কথা বলছেন না।নীরবে দুজন দুজনের অভিমানের পাহাড় গলাচ্ছেন।
এদিকে মুহুর চোখ পরলো দরজার বাইরে গাড়ি থেকে বেরোনো শ্যাম পুরুষের দিকে।মানুষ টিকে দেখে তার হাত অনবরত কাঁপছে।চোখ যেনো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়েছে তার।হাতে তার মিষ্টির প্যাকেট।অন্য মনষ্কো হয়ে হেঁটে আসছে এদিকেই।সে অজান্তেই এলিওনারের নোভেল বুক দিয়ে নিজের মুখ টা ঢেকে তাকিয়ে আছে তার দিকে।অবাকে মুখ দিয়ে রা টি ও বের হচ্ছে না।
এদিকে সারাফ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কিছুটা বিব্রতবোধ করছে।সাহিরা বেগম ওঁকে রেখেই চলে এসেছেন।সে তো আর কাউকেই চিনে না।সে কিভাবে এভাবে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে পারে।সামনের মেয়েটার দিকে চোখ পরলো তার।তাকে দেখে তার চেনা লাগছিলো এক পলকে।মুহুর্তের মধ্যে সেদিনের ফুলবাবু নাম দেওয়া মেয়েটির কথা মনে হচ্ছে তার।মেয়েটির নাম টাও তার অজানা।মুখ টা ঢাঁকা মেয়েটির বড় বড় অক্ষরে লেখা এলিওনার পার্কের রোমান্টিক নোভেল বই দিয়ে।সে যার কথা ভাবছে এটা কি সে নাকি।ধ্যাৎ সেই নাম না জানা মেয়েটি কিভাবে হতে পারে।ওই মেয়েটাকে তো অনেক গরীব মনে হয়েছিলো তার।ওর নিশ্চয়ই এতো বড় বাড়ি থাকবে না।
মুহু কয়েক কদম এগিয়ে এলো দরজার কাছে।সে অস্ফুটে বলে উঠলো,
“ফুলবাবু তুমি এখানে?”তোমার এতো বড় গাড়ি কিভাবে হলো।ফুল বিক্রি করেও এতো বড় লোক হওয়া যায় বুঝি!”
ফুলবাবু ডাক টা শুনেই সারাফের শরীরে আলাদা একটা কম্পন সৃষ্টি হলো যেনো।সারাফের ধারণা সত্যিই হলো।তার মানে সে ঠিকই চিনেছে।দুই মাস পর সে দেখলো মেয়েটিকে।অকারণেই মেয়েটিকে তার মনে পরতো।ওর তাকে প্রথম দিন দেখেই ‘আই লাভ ইউ’ বলে দেওয়া টা সে ভুলতে পারেনি।কিন্তু এটা সে সিরিয়াসলিও নিতে পারেনি।ভেবেছিলো ছেলেমানুষী করে বলেছে মেয়েটি।কিন্তু সাহিরা যে এখানে আসবেন সে ভাবেও নি।সারাফ একবার শুনেছিলো সাহিরার বড় বোন আছেন।কিন্তু সেটা যে এই মেয়েটার বাড়ি সেই টা তো ওর ধারণার ও বাইরে ছিলো।মুহু তখনও মুখ ঢেকেই রেখেছে।
সারাফ ছোট করে জবাব দিলো,”তোমার এখনো মনে হচ্ছে আমি কোনো ফুলওয়ালা?”
মুহু ওর কথার পরিপ্রেক্ষিতে উত্তর না দিয়ে নিজের মতো প্রশ্ন করে বসলো,”তুমি আমার বাড়ি চিনলে কি করে ফুলবাবু?”
সারাফ নিঃসংকচে সাহিরা বেগম কে দেখিয়ে উত্তর দিলো,”ওই যে উনি আছে না?উনার ছেলে আমি।”
মুহুর চোখ বড় বড় হয়ে এলো।ততক্ষণে সে মুখ থেকে বই টা নামিয়ে বুকের কাছে এনেছে।এরপর সারাফ একটু ঝুকে বলে,
”তুমি রোমান্টিক নোভেল বুক ও পড়ো বুঝি?”
মুহুর হুস ফেরে এতে।হাতে থাকা বই টা সরিয়ে পিছনে মুরে দুই হাতে লুকালো।সে শুকনো ঢুক গিলে নিলে।এই মুহুর্তে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে তার।সে সারাফের এমন চাহনিতে লজ্জা পেলো ভীষণ ভাবে।সেদিন তাকে হুট করেই ‘আই লাভ ইউ!’বলে দেওয়ার কথা মনে পরতেই আরেকদফা লজ্জারা এসে ঘিরে ধরলো তাকে।লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে তার।হুট করেই সে দৌড়ে পালালো সেখান থেকে।সারাফ হা করে তাকিয়ে রইলো ওর যাওয়ার দিকে।’যাহ বাবাহ একবার ভেতরেও আসতে বললো না তাকে মেয়েটা।’
সাহিরা বেগম বোন কে পেয়ে ভুলেই গেছিলেন সারাফের কথা।মুহু কে এভাবে দৌড়ে পালাতে দেখে তিনি দরজার দিকে তাকালেন।ইশ সারাফ নিশ্চয়ই এতক্ষণ দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলো।সারাফ তখন মিষ্টির প্যাকেট বের করছিলো গাড়ি থেকে।আর তিনি এসে দরজার কলিং বেল চাপে।বোনের বাড়িতে এসে দাঁড়াতেই তার মন অস্থির হয়ে গেছিলো।তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিলো মনে!শৈবালের বাবা কিছু দিনের জন্য বাইরে গেছেন গতকাল।তাই তিনি আসতে পেরেছেন।আহারে ছেলেটা কে এভাবে না রেখে আসলেই পারতেন তিনি।এখন তার কেমন যেনো লাগছে।তিনি তারাতাড়ি গিয়ে সারাফ কে ভেতরে নিয়ে এলেন।বড় বোনের সাথে সারাফের আলাপ করিয়ে দিলেন তিনি।সারাফের চোখ যেনো অন্য কিছু দেখার আশা করছে।মেয়েটার নাম জানতে ইচ্ছে করছে ভীষণ ভাবে।
•
“সেদিন আমাকে ফুলওয়ালা বলার কারণ?”
ছাদে বসে ছিলো মুহু।এমন সময় সারাফের কন্ঠে কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলো।এই সময় সে সারাফকে এখানে একদমই আশা করেনি।সারাফ নিজে থেকেক বলে উঠলো,
“আসলে কিছু ভালো লাগছিলো না।তাই ভাবলাম তোমাদের ছাদ টা ঘুরে দেখা যাক।তাই ছাদে এলাম।কিন্তু ছাদে এসে যে তোমাকে দেখতে পাবো ভাবিনি।”
মুহু কি বলবে ভেবে পেলো না।সে নিরুত্তর রইলো।এতো চঞ্চল মেয়ে সে।অথচ তার সব চাঞ্চল্য যেনো উবে গেছে এই মানুষ টাকে দেখে।সারাফ ফের প্রশ্ন করলো,
“আমাকে ফুলওয়ালা বলার কারণ বললে না যে?”
মুহু তার খালা মনির সঙ্গে কথা বলে সোজা ছাদে এসেছিলো।সে সময় সারাফ ফ্রেশ হচ্ছিলো বোধহয়।ওর মুখোমুখি হতে চাচ্ছিলো না বলেই চলে এসেছে ছাদে।ঠিক করেছিলো ওর সামনেই পরবে না আর।নিজেকে সামলে সারাফের প্রশ্নে মুহু চোখে হাসলো।সে বললো,
“আসলে সেদিন জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় তো আমি রাস্তায় দেখেছিলাম তোমাকে।তুমি ফুলের ডালা মাথায় নিয়ে রাস্তা ক্রস করছো।তাই তো তোমাকে ফুলওয়ালা বলেছিলাম।”
সারাফের মনে পরলো সেদিনের কথা।সেদিন শৈবালকে ভার্সিটি পৌঁছে দেওয়ার জন্য আসছিলো।ট্রাফিক জ্যামে আটকে পরাই তার চোখ পরে একটা ছোট মেয়ের উপর।যার মাথায় ভারী ফুলের ডালা।তখন একটা বাচ্চা মেয়েকে ওইভাবে ভারী ডালা নিতে দেখে তার খারাপ লেগেছিলো।এতো বড় একটা ফুলের ডালা মাথায় নিয়ে রাস্তা ক্রস করার চেষ্টা করছে মেয়েটি।তার উপর ছোট মেয়ে হওয়াই সে ভয় পাচ্ছিলো রাস্তা ক্রস করতে।এরপর সে গাড়িত থেকে নেমে বাচ্চা মেয়েটির কাছে যায়।ওর কাছ থেকে ফুলের ডালা টা নিয়ে ওঁকে রাস্তা পার করিয়ে দিচ্ছিলো সে সময়।ওর সব ফুল কিনেও নিয়েছিলো সারাফ হাজার টাকায়।মেয়েটি বোধহয় তখনই তাকে দেখেছে।তাই তাকে ফুলওয়ালা বলে উপাধি দিয়েছে সেদিন।সে ঠোঁট চেপে হাসি আটকে ফের প্রশ্ন করলো,
“আর আমার ভাইকে কালি মাখানোর কারণ?”
মুহু শব্দ করে হাসলো এবার।মুহুর্তেই ফিরে এলো তার মধ্যে কার চাঞ্চল্য ভাব।আসলে যার যে স্বভাব সে সেটা বেশিক্ষন চেপে রাখতে সক্ষম হয় না।সে হাসছে আর সারাফ তাকে দেখে যাচ্ছে।সে হাসির শব্দ হলো ঝর্নার পানি কলকলিয়ে পরার মতো।মুহু হাসি থামিয়ে জবাব দিলো,
“আপনারা ভাই তো খ্যা’চা লোক।হোক না সে ফর্সা তাই বলে আপনাকে ও এভাবে বলবে।তাই তো কালি মাখিয়ে-ছিলাম ওঁকে।তখন যে ওঁকে কেমন দেখাচ্ছিলো।একটা ছবিও তুলে নিয়েছি সে সময় হিহিহিহি!”
তারপর সে আবার নিজে থেকেই বললো,”ওই ছেলেটা আপনার ভাই হলো কি করে বলুন তো?ওঁকে কিন্তু আপনার মতো ভালো মানুষ একদমই মনে হয়নি আমার।আপনার ভাই হয়ে আপনাকে কিভাবে শ্যামলা বলে ওঁ।”
সারাফ বিগলিত হাসলো।নিচু স্বরে বলে,
“আরে ও ওতো কিছু ভেবে বলে নি।তবে ওর কথাও আমার ভালো লাগে নি।ওর ওই কথার জন্য তোমার ওঁকে কালি মাখানো টা আমি অন্যায় দেখিনি।”
“সে আপনি নিতান্তই ভালো মানুষ বলেই কিছু বলেন নি।আপনার নাম টা জানা হয়নি বাই দ্যা ওয়ে!”
“আমার নাম সারাফ!শাহরিয়ার সারাফ।আর তোমার?”
”আমি ইশরা ইনাম মুহুলতা!সবাই মুহু বলেই ডাকে আমাকে।”
“উম হুম নাইস নেইম!আমি তোমাকে মুহু বলেই ডাকবো।কিন্তু তুমি আমাকে ফুলবাবু নামেই ডেকো।রিয়েলি আই ডোন্ট মাইন্ড।”
রিয়েলি ‘রিয়েলি আই ডোন্ট মাইন্ড’ কথাটা সারাফ মুহুর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলেছে।এতে মুহু কিয়ৎক্ষনের জন্য যেনো স্তব্ধ হয়ে রইলো।সর্বাঙ্গে শিহরণ হলো তার।সারাফ চলে গেলো শিষ বাজিয়ে।পিছনে রেখে গেলো এক জোড়া মায়াময়,মুগ্ধ করা চাহনি।সেই চাহনি দেখেই নির্বিঘ্নে বলে দেওয়া যাবে এই চোখ কারোর প্রেমে পরেছে।গভীর ভাবে প্রেমে পরেছে।
#চলবে
কেমন হয়েছে জানাবেন।রেসপন্স করবেন প্লিজ!