চন্দ্ররঙা_প্রেম_২ পর্ব ১১

#চন্দ্ররঙা_প্রেম_২
#পর্বঃ১১
#আর্শিয়া_সেহের

রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে।‌ পিহু এখন কিছুটা স্বাভাবিক। রুমঝুম তাকে একটু আগে খাইয়ে দিয়ে গেছে। রুমঝুম বেরিয়ে গিয়ে তনিমকে পাঠালো রুমে। তনিমকে ঢুকতে দেখে পুনম আর শিরীন পিহুকে বিছানায় বসিয়ে রুম থেকে চলে গেলো। পুনম যাওয়ার আগে তনিমের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“আপু খুব নরম মনের মেয়ে ভাইয়া। ওকে কষ্ট দিও না কখনো। আগলে রেখো।”
তনিম পুনমের কথায় হাসলো। পুনম আরেকবার পিছু ফিরে পিহুকে দেখে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।

তনিম দরজা আটকে পিহুর কাছে এসে দাঁড়ালো। পিহুর দিকে তাকিয়ে বললো,
-“তুমি কাপড় পাল্টে ঘুমিয়ে পড়ো। আমি আরো কিছুক্ষণ পরে ঘুমাবো।
আর শুনো,আমার কাছে তুমি সম্পূর্ণ নিরাপদ। তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমি তোমাকে স্পর্শ করবো না কখনো।‌”

পিহু ধীর গতিতে বিছানা থেকে নেমে এলো। তনিমের পা ছুঁয়ে সালাম করে বললো,
-“আমি আপনাকে স্বামী হিসেবে মেনে নিয়েছে। এখন আমার উপর আপনার পুরো হক আছে। আমি চাইলেই আমাকে স্পর্শ করতে পারেন,আমি বাঁধা দিবো না। এতে আমার পাপ হবে।”

তনিম পিহুকে নিজের দিকে ঘুরালো। পিহুর কপালে চুমু খেয়ে বললো,
-“এতো পাপ পুন্যের হিসাব করতে হবে না। ফ্রেশ‌ হয়ে নাও এখন।”
তনিম পিহুকে ছেড়ে সরে যেতেই পিহু তনিমের হাত চেপে ধরলো। তনিম জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে পিহুর দিকে তাকালো। পিহুর দৃষ্টি মেঝেতে। সে ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
-“সত্যিই ভালোবাসেন আমাকে?”
তনিমের একটুও ভাবান্তর হলো না পিহুর এমন প্রশ্নে। সে হেঁসে বললো,
-“আজকে গল্প করবে?”
পিহু চোখ তুলে তাকালো। তার প্রশ্নের জবাবে তনিমের এমন প্রশ্নে খানিকটা অবাক হয়েছে সে। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বললো,
-“হ্যাঁ করবো।”
তনিম হেঁসে বললো,
-“আচ্ছা তাহলে ফ্রেশ হয়ে এসো।”
পিহু চুপচাপ ফ্রেশ হয়ে এলো। হালকা গোলাপি রঙের একটা থ্রিপিস পড়েছে সে। তনিম পিহুকে বিছানায় বসতে বলে নিজেও ফ্রেশ হয়ে এলো।

-“আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি পিহু। তবে বিয়েটা এভাবে করতে চাইনি।”
তনিম বিছানায় বসতে বসতে বললো।
পিহু নির্বিকার ভাবে বসে আছে। তনিম পিহুর হাত ধরে বললো,
-“আমাকে তুমি করে বলবে এখন থেকে। ঠিক আছে?”
পিহু শুকনো একটা হাঁসি দিয়ে বললো,
-“চেষ্টা করবো।”

তনিম পিহুর কোলে একটা বালিশ রেখে তার উপরে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। পিহুকে বললো,
-“আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাও।”
পিহু চুপচাপ তনিমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তনিমের মা আজ অনেকক্ষণ তার কাছে ছিলো।‌ অনেকটা সময় নিয়ে সে পিহুকে সম্পর্কের মানে বুঝিয়েছে। বিয়েটা যেভাবেই হোক সেটা বড় কথা না,বিয়েটা তো হয়েছে।এখন স্বামীর সাথে সহজ হয়ে সম্পর্ক সুন্দর রাখাটা জরুরি।

মাথায় পিহুর হাতের স্পর্শে তনিমের চোখ বুজে এলো ঘুমে। কিন্তু কিছু একটা মনে পড়তেই ঝট করে চোখ মেললো।‌ বেশ‌ কিছুক্ষণ নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে পিহুকে বললো,
-“তোমাকে আরো একটা কথা বলার আছে পিহু। আমি জানি না এটা শোনার পর তুমি কেমন রিয়েক্ট করবা তবে আমি চাই তুমি এই কথাটা সহজভাবে নেওয়ার চেষ্টা করবে। যে কোনো কিছু শোনার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত তো তুমি?”

পিহু বুঝতে পারছে না তনিম এমন কি কথা বলবে যেটার জন্য সে এতোটা সিরিয়াস। তবুও নিজেকে বেশ শক্তভাবে উপস্থাপন করলো‌ তনিমের সামনে। তনিমের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে নিচু স্বরে বললো,
-“বলুন।”
তনিম এক নিঃশ্বাসে বললো,
-“রুশান স্যারের ভালোবাসার মানুষটি অন্য কেউ না বরং তোমার ছোটবোন পুনম।”
পিহুর হাত থেমে গেলো সাথে সাথেই। তনিম মাথাটা উঁচু করে পিহুর দিকে তাকালো। পিহু তার দিকেই বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে।

তনিম উঠে বসলো। পিহুর দিকে না তাকিয়েই বললো,
-“আমি তোমার থেকে লুকাতে চাই নি বলে এখনই বলে দিলাম। আমি চাই তুমি সবটা একসাথেই সামলে উঠো। তোমাকে বারবার কষ্ট পেতে দেখতে ভালো লাগবে না আমার।”
পিহুর কোনো হেলদোল নেই। তনিম পিহুর কোল থেকে বালিশটা নিয়ে বিছানায় রাখলো । পিহুর বাহু ধরে শুইয়ে দিলো। নিজেও পিহুর পাশে শুয়ে পিহুর চুলে হাত বুলাতে লাগলো। পিহু স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তনিমের দিকে। পলক পড়ছে না। তনিম শান্ত কন্ঠে বললো,
-“ঘুমাও। চোখ বন্ধ করো।”
পিহুর মধ্যে কোনো ভাবান্তর নেই। তনিম এবার একটু উচ্চস্বরে বললো,
-“চোখ বন্ধ করতে বলেছি না তোমাকে?”
পিহু এবার চোখ বন্ধ করলো। তনিমও চোখ বন্ধ করে পিহুর মাথায় বিলি কেটে যাচ্ছে।

মিনিট খানেকের মাথায় ফুপানোর শব্দ কানে এলো তনিমের। মূহূর্তেই চোখ মেলে তাকালো তনিম। পিহু চোখ বন্ধ করে ঠোঁট কামড়ে কেঁদে চলেছে। তনিম উদ্বিগ্ন হয়ে পিহুর দিকে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বললো,
-“এই পিহু, কাঁদছো কেন? কষ্ট হচ্ছে? বলো আমাকে।‌ কেঁদো না, প্লিজ।”
পিহু চোখ বন্ধ অবস্থায় তনিমের বুকের মধ্যে ঢুকে পড়লো। তনিমকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। কান্নার বেগ বেড়ে গেলো শতগুণ। তনিমের হাত-পা অবশ হয়ে আসছে পিহুকে এতো কাছে পেয়ে। মেয়েটা বুকের সাথে মিশে কেঁদে চলেছে সমানে। তনিম ইতস্তত করে জড়িয়ে ধরলো পিহুকে। এমন সময়ে একটা বিশ্বস্ত আশ্রয়ের খুব প্রয়োজন ছিলো পিহুর যা সে পেয়েছে।
পিহু কাঁদতে কাঁদতে তনিমের বুকের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লো।‌ তনিম এখনো শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে পিহুকে। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে একটু কাঁদার সাথে সাথেই ঘুম হানা দিয়েছে পিহুর চোখে। তনিম একধ্যানে পিহুর দিকে তাকিয়ে আছে। মায়াবী মেয়েটাকে আবছা আঁধারে আরো মায়াবী লাগছে। এই মেয়েটা সারাজীবন তার বুকে এভাবেই লেপ্টে থাকুক। এটুকুই চায় তনিম।

প্রায় দশ মিনিট ধরে একটা কফিশপে বসে আছে রুশান আর জিহাদ। জিহাদ কিভাবে কি বলবে বুঝতে পারছে না। রুশান দুই হাত টেবিলের উপর রেখে একটু ঝুঁকে জিহাদের দিকে এগিয়ে এলো। শান্ত কন্ঠে বললো,
-“একদম প্রথম থেকে বলো।‌ কিভাবে কি হয়েছিলো সবকিছুই।”
জিহাদ টেবিলের উপর থেকে পানি নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো। গ্লাসটা রেখে রাস্তার দিকে তাকালো। কফিশপের কাঁচের দেয়ালের ওপাশের সবটাই দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। রাস্তা দিয়ে ব্যস্ত গতিতে ছুটে চলছে ছোটবড় সব যানবাহন। ছুটে যাচ্ছে ব্যাস্ত মানুষগুলো।
জিহাদ সেদিকে তাকিয়ে মুখ খুললো –

-” সেদিন প্রিয়া আপুর ছোট বোন পুনমের এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছিলো। খুব ভালো রেজাল্ট করেছিলো পুনম। আমার মা খুব ভালোবাসে পুনমকে। পুনমের রেজাল্টের খুশিতে সে আমাকে চট্টগ্রামে পাঠিয়েছিলো পুনমকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমিও ফুফু বাড়িতে আসার আনন্দে আর না করলাম না। ভোরেই রওনা হলাম। আসতে আসতে প্রায় দুপুর গড়ালো। রাস্তায় কয়েকটা স্কুলের বাচ্চা দের দেখলাম। হয়তো স্কুল ছুটির পর বাড়িতে যাচ্ছিলো। আরেকটু এগিয়ে যেতেই দেখলাম একটা মাইক্রোবাসে প্রায় তিন চারটা বাচ্চাকে ফুটপাত থেকে তুলে নিচ্ছে। বাচ্চাগুলোকে ওভাবে তুলে নিতে দেখেই বুঝেছিলাম হয়তো কিডন্যাপার এরা। দুপুর হওয়ায় রাস্তাও বেশ ফাঁকা ছিলো। সাহায্য চাওয়ার মতোও কেউ নেই। তাই একাই ওদের পিছু পিছু চলে গেলাম। তখনো বুঝতে পারিনি আমি সিংহের গুহার দিকে এগোচ্ছি।
বেশ কিছু সময় পরে একটা খুব পুরোনো বাড়ির সামনে গাড়িটা থামলো। ততক্ষণে ওরা প্রতিটা বাচ্চাকে অজ্ঞান করে ফেলেছে। আমি একটু সামনে বাইকটা পার্ক করে দৌড়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকলাম। সদর দরজার সামনে এসে দেখলাম দরজা খোলা। ভেতরটা জনমানবশূন্য। আশ্চর্য!একটু সময়ের মধ্যে কোথায় গেলো? আমি ভেতরে প্রবেশ করতেই সদর দরজা বন্ধ হয়ে গেলো। পেছনে ফিরে দেখলাম দু’জন লোক দাঁড়ানো। ওরা আগে থেকেই আমার অস্তিত্ব টের পেয়েছিলো। ওদের মধ্যে থেকে একজন আমার দিকে ক্যামেরা ঘুরালো এবং তার কিছুটা পরেই আমাকে নিয়ে ভেতরের ঘরে ঢুকলো। সেই রুমে থাকা আলমারির পেছনে একটা লুকানো দরজা আর ওই দরজার পেছনেই কালো একটা দুনিয়া।
আমাকে নিয়ে ওরা সেখানে ঢুকতেই দেখলাম ভেতরে অগনিত বাচ্চা। কি নিষ্পাপ মুখ গুলো। বাঁচার করুন আর্তনাদ তাদের।
এতোগুলো বাচ্চাকে এমন অবস্থায় দেখে আমি নিজের মধ্যে ছিলাম না। দৌড়ে গেলাম তাদের দিকে। ওটুকু বাচ্চাদের নিয়ে কি করে ওরা সেটা আজও জানি না আমি।

ওরা আমাকে মেরে ফেলতে চায় এটা শুনেই কলিজা কেঁপে উঠেছিলো আমার। হাত-পা কাঁপছিলো। বাচ্চা গুলোর কথা ভুলে গেলাম মূহূর্তেই।‌ তখন শুধুমাত্র নিজেকে বাঁচানোর চিন্তা ছিলো মাথায়।
তখন ওদের বস আমাকে বাঁচার একটা সুযোগ দিলো । শর্ত একটাই। ওদেরকে একটা বাচ্চা দিতে হবে আগামীকাল সকালের মধ্যে। বয়স পাঁচের মধ্যে হতে হবে। অসংখ্য ছুড়ি,রামদা, চাপাতি দেখে আমার মধ্যে মৃত্যুভয় ঢুকে গিয়েছিলো তখন। আমিও বাঁচার রাস্তা খুঁজছিলাম। হঠাৎ ওই লোকের এমন প্রস্তাব পেয়ে আমি রাজি হয়ে গেলাম। ঠিক ভুল বিবেচনা না করেই বললাম দিবো। কোথা থেকে দিবো তা তখনো জানতাম না।

আমাকে ছেড়ে দেওয়ার সময় ওই লোকটা আমাকে এটাও বলেছিলো যে একটু গরমিল হলেই ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। আমি ততক্ষণে ওদের ক্ষমতা বুঝে গিয়েছিলাম। ওখান থেকে ছাড়া পেয়ে সোজা ফুফুর বাড়িতে চলে গেলাম। ফুফু আমাকে দেখে ভীষণ খুশি হলেন। আদর যত্ন করে খাওয়ালেন। আমার বুক দুরুদুরু করছে ওই বাচ্চার চিন্তায়। কোত্থেকে দিবো একটা বাচ্চা?

বিকেলের দিকে ফুফু বললো পুনমের সাথে প্রিয়া আপুর বাড়ি যেতে। মিষ্টি নিয়ে যাবে। আমিও ভাবলাম রাস্তাঘাটে একটা বাচ্চার সন্ধান করা যাবে। প্রিয়া আপুর বাড়ি খুব দূরে ছিলো না। আমি পুনমকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পথেঘাটে পাঁচ বছরের কম কোনো বাচ্চা দেখলাম না। হতাশ‌ হয়ে পুনমের পিছু পিছু আপুর বাড়িতে ঢুকলাম। তখনি কানে এলো এক পিচ্চির আওয়াজ। একটা বাচ্চা ছেলে দৌড়ে এসে পুনমের কোলে উঠলো। বাচ্চাটার নাম সিয়াম। প্রিয়া আপুর ছেলে। হঠাৎ করে মনে হলো সিয়ামকেই বলির পাঁঠা বানিয়ে ফেলি।‌ আমার জীবনটা তো বেঁচে যাবে। তখনই ঠিক করে নিলাম কাল সকালে যেভাবেই হোক সিয়ামকে তুলে নিবো। সন্ধ্যা অবধি প্রিয়া আপুর বাড়িতে ছিলাম। আপু কি রেখে কি খাওয়াবে সেটা ভেবেই অস্থির হয়ে উঠেছিলো। কিন্তু সিয়াম পুরোটা সময় উঠোনে ছিলো।‌ কথায় কথায় জানলাম ও ঘুম থেকে উঠে সন্ধ্যা পর্যন্ত উঠোনেই খেলে।‌
ব্যাস আমার কাজ আরো সহজ হলো।‌ ভুলে গেলাম ও আমার ভাগ্নে। পরদিন ভোর বেলাতেই আমি সিয়ামকে উঠোন থেকে চিলের মতো ছো মেরে তুলে নিলাম। সিয়ামের দাদি দেখেছিলো বাড়ির ভেতর থেকে কিন্তু ততক্ষণে আমি সিয়ামকে নিয়ে রাক্ষসপুরীতে রওনা হয়েছি। আমার মধ্যে মৃত্যু ভয় এতোটাই জেঁকে বসেছিলো যে আমি সিয়ামকে ওই বাড়িটার মধ্যে ঢুকিয়ে দরজা আটকে দিয়ে চলে এসেছিলাম। ভেতরে গেলে যদি আমাকে মেরে ফেলে তাই ভেতরেও যাইনি।

বিশ্বাস করো আমি নিজেকে বাঁচাতেই এটা করেছি। তারপর থেকে আমি নিজেই মরেছি প্রতিনিয়ত। একটা নিষ্পাপ বাচ্চার জীবন নষ্ট করার জন্য, একজন নির্দোষ মেয়েকে অসুস্থ জীবনে ঠেলে দেওয়ার জন্য আমিই দায়ী, এমন ভাবনা আমাকে শান্তি দেয় না। বাঁচতে দেয় না।”

কথাগুলো বলে জিহাদ ডুকরে কেঁদে উঠলো। রুশান মনোযোগ দিয়ে সবটা শুনলো।‌ জিহাদকে বললো,
-“পুলিশের কাছে…”
জিহাদ সবটা না শুনেই বললো,
-“ওই অন্ধকার দুনিয়াতে কয়েকজন পুলিশের ড্রেস পড়া মানুষও ছিলো। তারা তখনই বলে দিয়েছিলো আমি যেন কোনো পুলিশের শরনাপন্ন না হই। তাতে কোনো‌ লাভ হবে‌না উল্টো আমার ক্ষতি হবে।”

রুশান জিহাদের অসহায়ত্ব বুঝতে পারছে। সবাই সাহসী হয় না। কিছু কিছু মানুষ প্রচন্ড ভীতু হয়। মৃত্যু চিরন্তন সত্য জেনেও তারা মৃত্যুকে ভীষণ ভয় পায়। তারা মৃত্যু থেকে পালাতে চায়। জিহাদও সেই দলের অন্তর্ভুক্ত।

রুশান উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
-” আচ্ছা উঠো। আমার সাথে চলো।”
জিহাদ ভীতু চোখে তাকিয়ে বললো,
-“কোথায় যাবো?”
রুশান বাইরের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“সেই বাড়িতে।”
জিহাদ এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
-“আমি যাবো‌না।‌ ওরা মেরে ফেলবে আমাকে। তুমি যাও।”
আশেপাশের মানুষ সবাই তাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে।‌ রুশান সবার দিকে তাকিয়ে ‘সরি’ বলে জিহাদকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। বাইরে এসে জিহাদের কাঁধে হাত রেখে বললো,
-“তুমি চাওনা এসব বন্ধ হোক? বাচ্চারা সুন্দর ভবিষ্যৎ পাক? চাওনা বলো?”
জিহাদ কিছু সময় নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলো। হঠাৎ রুশানের দিকে উদ্ভ্রান্তের মতো তাকিয়ে বললো,
-“চলো।‌ বাইক নিয়ে আমাকে ফলো করো ।”
রুশান মূচকি হেঁসে বাইকে চাপলো। জিহাদও নিজের বাইক স্টার্ট দিলো। দু’জন এগিয়ে যাচ্ছে। রুশান তার লক্ষ্যে পৌঁছানোর সোপান পেয়ে গেছে।এখন শুধু সময়,সাহস আর বুদ্ধি প্রয়োজন।

আজকে শান্তদের এসএসসি পরীক্ষা শেষ হলো। পরীক্ষা শেষে শান্ত পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে দেখলো উর্বিন্তা দাঁড়িয়ে আছে গেটের কাছে। শান্ত ধীর গতিতে এগিয়ে গেলো উর্বিন্তার কাছে। উর্বিন্তা শান্তকে দেখেই একগাল হাসলো।‌ শান্ত মুখ ঘুরিয়ে নিলো। এই মেয়ের হাঁসি তার জন্য ফাঁসির সমান।উর্বিন্তা ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“কি রে শান্ত,পরীক্ষা কেমন হয়েছে তোর?”
-“ভলো হয়েছে। তোমার কেমন‌ হয়েছে?”
-“আমারও ভালো। ”
-“এখানে দাঁড়িয়ে আছো‌ কেন? বাড়ি যাবে না?”
উর্বিন্তা মলিন মুখে বললো,
-“যাবো । তার আগে স্কুলে যাবো। স্কুলের জন্য ভীষণ মন খারাপ করছে। আর কখনো ছাত্রী হিসেবে পা রাখতে পারবো না ওই স্কুল প্রাঙ্গণে।”
উর্বিন্তার কথায় শান্তও বেশ আবেগী হয়ে উঠলো। পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
-“এমনটাই তো হবে।‌ নতুনদের জন্য জায়গা তো ছাড়তেই হবে। এটা নিয়ে এতো মন খারাপ করলে চলবে ,উর্বি?”

উর্বিন্তা একটু হাসলো।‌ শান্তর দিকে তাকিয়ে বললো,
-“আমি তোর জন্যই দাঁড়িয়ে ছিলাম। যাবি আমার সাথে স্কুলে?”
শান্ত মুখ ফুলিয়ে বললো,
-“নাহ। আজ যাবো না। বাড়িতে মা একা আছে। আমাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে।”
-“বাকি রা কোথায় গেছে?”
-“তনিম ভাইয়াদের বাড়িতে।”
উর্বিন্তা গাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে বললো,
-“আচ্ছা বাড়ি যা তাহলে। ভালো থাকিস।”
শান্তর বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠলো। উর্বিন্তাকে আর কখনো এভাবে দেখতে পাবে না। দুজনের গন্তব্য হয়তো এবার আলাদা হবে। শান্ত উর্বিন্তার কাছে দৌড়ে গিয়ে বললো,
-“আমাদের আবার দেখা হবে তো, উর্বি?”
উর্বিন্তা পেছনে ফিরে কিভাবে যেন হাসলো। স্নিগ্ধ কন্ঠে বললো,
-“ক্যারিয়ারে ফোকাস কর। তারপর দেখাটা সারাজীবনের জন্যও হতে পারে।”
উর্বিন্তা গাড়িতে উঠে চলে গেলো।‌ শান্ত সেই গাড়ির দিকে চেয়ে রইলো অপলক। এই মেয়েটা তার কাছে ভীষণ রহস্যময়ী।

উর্বিন্তা স্কুলের সামনে এসে দেখলো বেশিরভাগ বাচ্চারা চলে গেছে। সাঁঝ আর সিনিম গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। মাহিম বেলুন উড়িয়ে খেলছে ফুটপাতে। আরো কিছু বাচ্চা আছে বাবা মা’র অপেক্ষায়।

উর্বিন্তা সাঁঝ আর সিনিমকে আদর করে মাহিমকে ডাকলো। মাহিম ওদের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। উর্বিন্তাকে পাত্তা না দিয়ে সে বেলুন উড়ানোয় মনোযোগ দিলো। উর্বিন্তা মুখ বাঁকিয়ে বললো,
-“নিজেকে খুব বড় ভাবিস তুই? পাকনা পোলা একটা। ছেলেধরা লোকেরা ধরে নিয়ে গেলে বুঝবি।”
মাহিম খিলখিল করে হেঁসে বললো,
-“আমি ভয় পাই না হুহ।”
উর্বিন্তা গেইট খুলে স্কুলে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
-“ধরেনি তাই ভয় পাস না। ধরলে বুঝতি বাঁদর একটা।”
সাঁঝ সিনিমের সাথে গল্প করছে গেটে হেলান দিয়ে। সিনিম শুধু হু হা করে উত্তর দিচ্ছে আর ভাবছে এখনো বাবা আসছে না কেন? রাস্তা প্রায় জনমানবশূন্য হয়ে গেছে ।

চলবে………

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here