#চিত্তদাহ
লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা
পর্ব ৩৫
🍂🍂🍂
সকাল গড়িয়ে দুপুর নেমেছে। দরজা জানালায় বন্ধ করে তাতে পর্দা দিয়ে রাখায় ঘরে রোদের ছিটে ফোঁটাও নেই। বদ্ধ ঘরে শুভ্রতা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ঘুমের মধ্যে মনে হলো কেউ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। শুভ্রতা আড়মোড়া দিয়ে পিট পিট করে চোখ খুললো। মাথার কাছে উমা বসে আছে। ঠোঁটে তার কিঞ্চিৎ হাসি। হাসি মুখে শুভ্রতাও উঠে বসলো।
~সময় কত হয়েছে দেখেছিস? এত দেরি পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বি না?
শুভ্রতা ঘড়ির দিকে তাকালো। দুপুর ১২ টা বাজে। ঠিক তখনই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ এলো। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো উমা নেই। তিলোত্তমার আসতে এখনও কিছু সময় বাকি। সে এভাবে কখনোই দরজা ধাক্কায় না। গুনে গুনে ৩ বার টোকা দেয়। আজকের ধাক্কাটা এতোই জোরে দিচ্ছে যেনো দরজাটা এখনি খুলে যাবে। সে প্রচন্ড বিরক্ত হলো। বিছানার পাশের টেবিল থেকে গ্লাস হাতে নিয়ে স্বজোরে ছুঁড়ে মারলো দরজার কাছে। মুহূর্তেই খন্ড খন্ড হয়ে গেলো গ্লাসটা। দরজা ধাক্কানো বন্ধ হয়েছে। বিছানার পাশ হাতড়ে ফোনটা নিয়ে দেখলো অরণ্যের মেসেজ। ঝাপসা চোখে সম্পূর্ণ মেসেজ পড়তে পড়তেই দরজার দিকে পা বাড়ালো,
~বুড়ি, নুর আসছে তোর বাসায়। ভীষণ ক্ষেপে আছে। তার ধারণা তোর সাথে আমার সম্পর্ক আছে। আমি বলার পরও বিশ্বাস করছে না যে তুই আমার বোন। তুই মাথা ঠান্ডা রেখে একটু সামলে নিস।
শুভ্রতা ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে মারলো। মাথা ঘুরাচ্ছে। নিজেকে কোনো মতে সামলে নিয়ে দরজা খুলে তিলোত্তমার উদ্দেশ্যে বলতে লাগলো,
~কি সমস্যা তিলো? কতবার বলেছি আমাকে ডাকবি না। আমি মাকে দেখি তো!
শুভ্রতার মনে হলো নুরের গলার স্বর শুনতে পেয়েছে সে। চোখ থেকে হাত সরিয়ে তাকাতেই দেখলো নুর, উপমা, রিদিতা আর রুপা দাড়িয়ে। উমার মৃত্যুর দিন সেই যে রুপা গিয়েছিল। তারপর আজ এলো ওর বাসায়। শুভ্রতার মনে হলো ওরাও উমার মতই তার হ্যালুসিনেশন। রুপা যখন তাকে ধাক্কা দিয়ে ঘরে ঢুকতে চাইলো তখন শুভ্রতা বুঝতে পারলো ওরা হ্যালুসিনেশন নয়। সত্যিই এসেছে।
________________________________________
ওয়াশরুমে এসে চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিলো শুভ্রতা। মনে হচ্ছে মাথাটা প্রচন্ড ঘুরছে। তার মনে হচ্ছে অরণ্যের মেসেজ, নুরের এখানে আসা সবটাই তার ভ্রম। বাইরে থেকে তিলোত্তমার গলার আওয়াজ আসছে। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হলো। দীর্ঘদিন পর চোখে সূর্যের আলো পড়তেই তার মনে হলো চোখের একদম সামনে কেউ টর্চ জ্বালিয়ে রেখেছে। মৃদু আর্তনাদ করে বলে উঠলো,
~আহ! তিলো পর্দা লাগা। আমার চোখে লাগছে।
চোখে একটু স্বস্তি মিলতেই সে চোখ মেললো। সামনে নুরকে দেখে হুশে এলো এবার। এতদিন পর ওদের দেখতে পেয়ে মনটা খুশি হয়ে উঠলো। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো প্রিয় বান্ধবীকে। তবে সেই খুশি বেশিক্ষণ টিকলো না। নুরের ধাক্কায় অবাক হলো। মস্তিষ্ক যেনো কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। তার নজর পড়লো নুরের হতে থাকা ওষুধের পাতার দিকে। মায়ের ওষুধ নুরের হাতে দেখতেই মেজাজটা কিঞ্চিৎ খারাপ হলো। জোরপূর্বক হেসে ওষুধটা ফেরত চাইলেও নুর দিলো না দেখতেই সে বিরক্ত হলো।
~অরণ্যের সাথে কি সম্পর্ক তোর?
নুরের প্রশ্নে আকাশ থেকে পড়লো শুভ্রতা। গভীর চাহনী নিক্ষেপ করলো নুরের চোখের দিকে। নাহ! আজ সে কোনো আগ্রহ দেখতে পাচ্ছে না। দেখতে পাচ্ছে এক রাশ সন্দেহ। এই চাহনী তার পছন্দ হলো না। ঠোঁটে আগের ন্যায় জোরপূর্বক হাসি টেনে জিজ্ঞেস করলো,
~তোর চাহনীতে আজ জানার আগ্রহ থেকে বেশি সন্দেহ প্রকাশ করছে কেনো ঝাড়বাতি?
~অরণ্যের সাথে প্রেম করিস তুই? তুই জানিস না আমি ওকে ভালোবাসি? আমার সাথে এমন বেইমানি না করলে হতো না?
নুরের জবাবে তার ঠোঁটের হাসি উড়ে গেলো। কানে বাজতে লাগলো নুরের এক কথা। তার খেয়ালে এলো অরণ্যের মেসেজটাও ভ্রম নয়, বাস্তব। তিলোত্তমা ফোনটা দিলে শুভ্রতা সব ছবি মনোযোগ দিয়ে দেখলো। সবকটা ছবি জুম করে দেখলো। একটা ক্লু পেয়েও গেলো। একটা ছবির মধ্যে পেছনের জানালার গ্লাসে রুপা দাড়িয়ে ছবি তুলছে। শুভ্রতা সবার আড়ালে একবার রুপার দিকে তাকালো। তার বুঝতে সময় লাগলো না এসবের মূলে কে ছিল। কিন্তু কেনো করলো এমন সবটাই অজানা। উপমার দৃষ্টি শুভ্রতার দিকে আবদ্ধ। রুপার দিকে তার এমন চাহনীতেই স্পষ্ট এসবের পেছনে রুপার হাত। উপমা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। রিদিতাকেও ইশারায় দেখালো। অন্যদিকে তিলোত্তমা শুভ্রতার পক্ষ নিয়ে নুর আর রুপার সাথে তর্ক করেই যাচ্ছে। শুভ্রতা অনিবার ছবিটা দেখলো। শেষে নুরকে প্রশ্ন করলো,
~অরণ্য ভাইয়ার সাথে কথা হয়েছে তোর?
সে চাইছে সমস্যাটা নুর অরণ্যের সাথে বসেই সমাধান করুক। রুপার সাথে আগে কথা বলে তবেই সে সবার সাথে আলোচনা করবে। একে তো মাকে হারানোর শোক। তারওপর বান্ধবীদের এমন ব্যবহার। পাগলপ্রায় লাগছে নিজেকে। কিন্তু নুর দমার পাত্রই নয়। সে কথা বাড়িয়েই যাচ্ছে। সাথে বাড়ছে শুভ্রতার মনের দহন।
~নুর? আমি যে কখনোই তোদের খারাপ চাইবো না এই বিশ্বাসটুকুও কি আমি এতবছরে অর্জন করতে পারিনি?
শুভ্রতার কাতর চাহনী। তবে নুর নিশ্চুপ। শুভ্রতার মনে তৈরি হলো তীব্র অভিমান। ঠিক করলো সে এখন কিছুই বলবে না নুরকে। সে চাইছে তার বান্ধবী নিজ থেকেই খোঁজ লাগাক। গালে চর পড়তেই অভিমানের পাল্লা বাড়লো। অশ্রুধারায় চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। নিজের জন্য সব থেকে কাছের বান্ধবীর মনে এতটা অবিশ্বাস? মেনে নিতে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে তার। তিলোত্তমা এসে শুভ্রতাকে টেনে দূরে সরাতেই সে সরে গেলো। উপমাদের ইশারায় থামতে বললো। কোনোমতে চেয়ারে বসে পড়লো। বুক চিরে কান্না আসছে। সেই সাথে রাগও বাড়ছে। এতক্ষণ ভাবছিল নুরের বুঝতে ভুল হয়েছে। এখন ভাবছে ভুলটা কেনো হলো? একটু বিশ্বাস রাখা যেতো না? ছবিটা মনোযোগ দিয়ে পরোখ করলে তো যেকোনো বাচ্চাও ধরতে পারবে আসল দোষীকে। রাগে তার গা রি রি করে উঠলো। নিজেকে শান্ত করতে লম্বা লম্বা শ্বাস নিলো। কিন্তু না সে ব্যর্থ হচ্ছে।
~আমি চাইছি না রাগের মাথায় উল্টা পাল্টা কিছু বলতে। কাছের মানুষ গুলার সাথে লড়াইয়ের শক্তি আমার মধ্যে আর নেই নুর। আমি সত্যিই অনেক ক্লান্ত। প্লীজ আমার চোখের সামনে থেকে যা।
নুর গেলো না। উল্টা ত্যাড়ামী করতে লাগলো। রুপার কথায় রাগ এবার আকাশ ছুঁলো। হাতের কাছে যা ছিল এক ধাক্কায় ছুঁড়ে মারলো মাটিতে। মনে হতে লাগলো মায়ের সাথে সাথে তার সব সুখ শান্তির মৃত্যু ঘটেছে। অক্সিজেনের সাথে বিষাক্ত কিছু মিশে গেছে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।
~আজ থেকে আমাদের বন্ধুত্ত্ব শেষ শুভ্রতা। এই মুহূর্ত থেকে না তুই আমাকে চিনিস আর না আমি তোকে চিনি।
শুভ্রতার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। মনে পড়লো শ্রুতির সেই অভিশাপ,
“বন্ধুত্বের টানে? যেই বন্ধুত্ত্ব নিয়ে এত বড়াই করিস তুই, তোর যেই বন্ধুমহলের সাহায্য নিয়ে আমার মেয়েকে পালাতে সাহায্য করেছিস! এই বন্ধুরা চিরদিন তোর সাথে থাকবে না শুভ্রতা। তোর সব থেকে কাছের বন্ধু তোকে কাঁদিয়ে রেখে যাবে। একা করে যাবে তোকে। মেয়ে পালিয়ে গেছে বলে যেই অপমান আমাকে সহ্য করতে হয়েছে। আমার স্বামী আমার দোষ না থাকাতেও আমাকে দোষী বলেছে। একদিন দেখবি তোকেও তোর এই বন্ধুরাই বিনা দোষে সাজা দিয়ে যাবে।”
শুভ্রতা ঝট করে উঠে দাড়ালো। দৌড় লাগালো দরজার দিকে। সে পারবে না আর কাউকে হারাতে। একদম মরে যাবে সে। আর কাউকে হারানোর সামর্থ্য তার মধ্যে নেই। প্রথমে মা, বাবা আর এখন বন্ধুমহল। নাহ! একদম এটা হতে দিবে না শুভ্রতা। উন্মাদের ন্যায় ছুটে গেলো নুরের পিছু পিছু। কিন্তু লাভ হলো না। কয়েকদিনের ব্যবধানে হারানোর স্বাদ পুনরায় গ্রহণ করতে হলো তাকে। সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারালো তৎক্ষণাৎ।
________________________________________
জ্ঞান ফিরতেই লাফ দিয়ে উঠে বসলো শুভ্রতা। সামনের সোফায় তিলোত্তমা, উপমা আর রিদিতা বসে। শুভ্রতা ঘন ঘন শ্বাস নিতে লাগলো। বান্ধবীদের মলিন মুখটা নজরে আসতেই কেঁদে উঠলো। রিদিতা আর উপমা উঠে এসে জড়িয়ে ধরলো তাকে।
~একটা বার আমাদের জানালি না শুভি। এতোটা পর ভাবিস আমাদের।
শুভ্রতা মাথা দুলিয়ে না বুঝালো। সে তো চায়নি তার জন্যে ওদের হাসিখুশি মনটা বিষন্নতায় ঘিরে যাক।
.
~ঝাড়বাতির কাছে ছবি গুলো রূপ দিয়েছে তাই না?
কফিতে মাত্রই চুমুক দিতে নিচ্ছিলো শুভ্রতা। উপমার কথায় তা আর মুখে নেওয়া হলো না। কফির মগটা আগের জায়গায় রেখে নিজের ফোনটা ওদের দিকে এগিয়ে বললো,
~ছবিটাতে লক্ষ করলেই দেখতে পেতো। তবে এতো ঝামেলা হতো না।
~রূপ এমন কেনো করলো? (উপমা)
~জানি না (শুভ্রতা)
~শালা নাতি! রূপ, রূপ কইয়া ডাকি দেইখা এমনে গিরগিটির লাহান রূপ পাল্টায় দেখাইলো! ঠাডা পড়ুক ওর উপ্রে!
রিদিতার কথায় তিলোত্তমা চোখ মুখ কুচকে তাকালো।
~মাত্র কয়েকদিনের জন্য দূরে যেতে দিয়েছিলাম। আর দেখ, ছি! ছি! যা আদব কায়দা শিখিয়েছিলাম, সব ভুলে গেছে।
রিদিতা আড়চোখে তাকাতেই তিলোত্তমা দাঁত কেলিয়ে হাসলো। রিদিতাও ফিক করে হেসে দিলো। শুভ্রতা শান্ত চোখে ওদের কান্ডকলাপ দেখছে। তিন জনে শুভ্রতাকে হাসানোর জন্য নাচানাচি, লাফালাফি করছে। শুভ্রতা হাসলো ও। ক্লান্ত হয়ে তিনজনই লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো শুভ্রতার বিছানায়।
~উপ, রিদি?
~হ্যাঁ, বল।
~একটা ওয়াদা করবি?
~কি?
~রাখবি কিনা বল।
~আচ্ছা রাখবো। বল তুই।
~এখন থেকে নুরের সাথে সাথেই থাকবি তোরা। একদম ছায়া হয়ে। প্রয়োজনে আমাকে ছেড়ে দিবি তবুও ওকে ছাড়বি না।
ওরা বজ্রাহত দৃষ্টিতে তাকালো। শুভ্রতার অভিব্যক্তি একদম স্বাভাবিক।
~রাখবি না?
উপমা আর রিদিতা না চাইতেও রাজি হলো।
~এই তেলাপোকাকে কেনো ওয়াদা করতে বললি না? (রিদিতা)
~কারণ ও জানে শুভিকে ছেড়ে নুরের কাছে থাকলে আমি দুদিনেই পাগল হয়ে যাবো। (তিলোত্তমা)
রিদিতা গাল ফুলালো। তিলোত্তমাও ভেংচি কেটে আগের ন্যায় শুয়ে পড়লো।
~~~
চলবে~