চিত্তদাহ লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা পর্ব ৫০

0
506

#চিত্তদাহ
লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা
পর্ব ৫০

🍂🍂🍂

দুপুরের সময়। প্রচন্ড রোদে খা খা করছে চারদিক। ঘন্টা খানেক আগেই শুভ্রতাদের গাড়ি শহরের রাস্তা ছেড়ে গ্রামে ঢুকেছে। শুভ্রতা উৎফুল্ল চোখে রাস্তা দেখছে। এতক্ষণের বিরক্তিভাব হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। মনে এসে হানা দিয়েছে একরাশ ভালো লাগা। জানালার কাঁচ নামিয়ে দিতেই প্রকৃতির শীতল বাতাস তার গা ছুয়ে গেল। নিমিষেই মনটা হয়ে উঠলো সতেজ, ফুরফুরে। বাতাসের কারণে সুন্দর গুছিয়ে রাখা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গেলো। শুভ্রতার সেদিকে খেয়াল নেই। সে প্রকৃতি দেখতেই ব্যস্ত। পাশে তাকালে দেখতে পেতো এক জোড়া চোখ বিবশ হয়ে, অনিমিখে তাকেই দেখে যাচ্ছে। সে চোখের দিকে তাকালে হয়তো শুভ্রতার আর প্রকৃতিবলাস করা হয়ে উঠতো না। লজ্জায় তার চোখ থাকতো নত হয়ে, গাল দুটোতে দেখা দিতো রক্তিম আভা। প্রকৃতিতে বিভোর থাকা কন্যার আর জানা হলো না এই চোখ জোড়ার মালিক তাকে কতটা চায়। জানা হলো না সে বার বার নিজেকে হারায় শুধু তার এক চাহনীতে।
গাড়ি থামলো আরো ত্রিশ-চল্লিশ মিনিট পর। ৪ টি গাড়ি থেমেছে একে একে। গাড়ি থামতেই সকলে একে একে নেমে দাড়ালো। গাড়ি থেকে নেমে সকলেই অবাক চোখে চেয়ে রইলো সামনের দিকে। পুরানো দিনের জমিদার বাড়ি। যার প্রতিটা নকশায় ফুটে উঠেছে আগের যুগের সৌন্দর্যের ছোঁয়া। প্রতিটা ইট সাক্ষী আছে কয়েক প্রজন্মের জমিদারির, আর ভালোবাসার। বাড়ি থেকে নজর সরিয়ে সামনে তাকাতেই লাফিয়ে উঠলো উঠলো রিদিতা। মৃদু চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো,
~ইন্নালিল্লাহ!

তার হটাৎ এমন আচরণে ভ্রু কুঁচকে রইলো সামনে দন্ডায়মান যুবক। সকলের অবাক চাহনি নিজের ওপর স্থির বুঝতেই সে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করলো। কিন্তু সামনের লোকটার মধ্যে কোনোরূপ ভাবাবেগ সে দেখতে পেলো না। আচমকাই সে হাক ছাড়লো,
~মজিদ!
~জি স্যার বড় মা রে ডাকতাছি।

হটাৎ এমন হাক ছাড়াতে পুনরায় ঘাবড়ে গেলো রিদিতা। আরেকটু হলেই তার পরান পাখি উড়ে যেতো। সে উপমার বাহু শক্ত করে চেপে ধরে দাড়িয়ে রইলো। বিরক্ত হলেও কিছু বললো না। ওর কান্ড দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো তরী।
~তোমরা এদিকে দাড়িয়ে থাকো। আমি যাচ্ছি বাড়িতে।

বলেই ছুট লাগালো জমিদার বাড়ির ভেতর দিকে। শুভ্রতা উকি দিয়ে দেখতে চাইলো ভেতর দিকটা। তবে ব্যর্থ হলো। মিনিট খানেক এর মধ্যেই তাদের কাছে ছুটে এলো কয়েকজন মানুষ। শুভ্রতা আন্দাজ করলো ওনারা এই বাড়িতেই থাকে। হয়তো বা এই বাড়িরই মালিক। সকলের চোখে মুখেই আনন্দের ছোঁয়া। এক জোড়া হাত তার গাল ছুঁতেই সন্ধি ফিরে পেলো শুভ্রতা। রাহেলা খাতুন শুভ্রতার দু গাল ধরে বলছেন,

~মাশাহ’আল্লাহ! ওরে চিত্রা, আমার চন্দ্র তো সত্যিই চান্দের মতন বউ খুঁজছে রে। ওর কথা মতোই চন্দ্রাবতী নিয়া আইছে।

শুভ্রতার কপালে ঠোঁট ছোঁয়াতেই শুভ্রতা বোকার মত চোখ পিটপিট করে চাইলো। তার খেয়ালে এলো সে সালাম দেয়নি। সালাম না দেওয়াটা তার কাছে এক প্রকার অভদ্রতা মনে হলো। শুভ্রতা তৎক্ষণাৎ সালাম দিলো,
~আসসালামু আলাইকুম।

শুভ্রতার পর একে একে সবাই সালাম দিলো। রাহেলা খুশি হলেন। চোখে মুখে সন্তুষ্টির ছোঁয়া।
~আমার ছোট নাতবউ কই?

মাহতাব গলা খাকারি দিতেই তার দিকে তাকালেন রাহেলা। মাহতাব চোখের ইশারায় তিলোত্তমাকে দেখাতেই তিনি বুঝতে পারলেন এটাই তার ছোট নাতবউ।
~মাশাহ’আল্লাহ, মাশাহ’আল্লাহ। আমার দুই নাত বউ ই দেখি চান্দের টুকরা।

তিলোত্তমা আর শুভ্রতা মুচকি হাসলো। রাহেলা নিজের আর বাকিদের পরিচয় দিলেন।
~আমি চন্দ্রের দাদী মানে তোমাগো দাদী শাশুড়ি। উনি তোমাগো দাদা শ্বশুর। ও হচ্ছে তোমাগো আরেক দেবর মাহাদ। এটা তোমাগো ফুফু শাশুড়ি আর ফুপা শ্বশুর। আর ঐযে ওইডা, যে হুদাই হাসতেছে , ওয় হইছে মজিদ। এমনে আমাদের বাসায় কাজ করে। কিন্তু খুব ভালো পোলা।

শুভ্রতা আর তিলোত্তমা বিনিময়ে শুধু হাসলো।

~এইযে বড় বউ! বাহিরেই দাড় করিয়ে রাখবে! বাড়ি যেতে দিবে না নাকি! (চন্দ্র)
~তুই বাইরেই থাক। আমার সতীন নিয়া আইছস আবার বাড়ি ঢুকবার চাস! সাহস কত!
~সাহস তো থাকবই , জমিদারের নাতি বলে কথা।

আতাউরের কথায় ভাব নিয়ে দাড়ালো চন্দ্র আর মাহতাব।
___________________________________

বিকেলে সবার সাথে এক ঘরে বসে কথা বলছিলো শুভ্রতা। তরী এসে শুভ্রতার পাশে বসে ফিসফিস করে বললো,
~ভাবী, ছাদে যাবে? চলো যাই।

শুভ্রতা আরো ধীর স্বরে বললো,
~সবার সাথে কথা বলছি তো। পরে যাই?
~না এখনি চলো।

বলেই তরী শুভ্রতার হাত ধরে উঠে দাড়ালো।
~তোমরা আড্ডা দাও। আমরা পরে আসবো।

বলেই এক প্রকার টেনে নিয়ে যেতে লাগলো শুভ্রতাকে। থামলো একদম ছাদের মাঝখানটায় এসে। আগের থেকেই ছাদে রেনুকে দেখে কিছুটা অবাক হলো শুভ্রতা। শুভ্রতা রেনুর কাছে যেতে যেতে বলল,
~তুমি এখানে কি করো?

রেনু মিষ্টি হেসে একটা বক্স শুভ্রতার দিকে এগিয়ে দিলো। শুভ্রতার এই বক্সটা চিনতে একটুও কষ্ট হলো না। ৩ মাস আগে এমন বক্স প্রতি মাসেই একটা করে পেতো সে। তিন মাস পর আবার পার্সেল দেখে কিছুটা অবাকই হলো শুভ্রতা। উমা থাকলে হয়তো আজও খুশিতে লাফিয়ে উঠতো। শুভ্রতা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। কাঁপা হাতে বক্সটা নিতেই রেনু আর তরী নিচে চলে গেলো। শুভ্রতা ছাদ এর রেলিং ঘেঁষে বসলো। আজকের বক্সটা অন্যান্য বক্স গুলোর থেকে কিছুটা বড়। শুভ্রতা বেশ আগ্রহ নিয়ে বক্সটা খুললো। এবার বক্স এ ছিলো একটা লাল বেনারসি, কিছু গয়না আর অন্যান্য সাজসজ্জার সামগ্রী। আশ্চর্য লাগলো তখন, যখন বুঝলো এসব কিছু একজন বিয়ের কন্যার জন্য কেনা হয়। শুভ্রতার চরম বিস্ময়ে বুক কেঁপে উঠলো। ঝটপট চিঠি খুললো।

“সেদিন ছিল প্রিয় বন্ধুর ২১ তম জন্মদিনের সন্ধ্যা। খুব দেরি করে ফেলেছিলাম অনুষ্ঠানে যেতে। ছুটে যাচ্ছিলাম বন্ধুর বাড়ির ছাদের দিকে। বাড়িতে ঢুকার আগেই হঠাৎ কারো চুড়ির রিমঝিম আওয়াজে আমার পা থেমে গিয়েছিল। মাথা তুলে তাকাতেই দেখলাম এক ১৫ বছরের মেয়ে প্রচন্ড রাগ নিয়ে দাড়িয়ে আছে। কারো সাথে দাঁতে দাঁত চেপে কথা বলছে। হাত নাড়িয়ে বারবার নিজের চুল ঠিক করছে। ঠান্ডায় তার গাল দুটোতে ছড়িয়ে ছিল রক্তিম আভা। চোখে ছিলো এক প্রকার মাদকতা। যার দিকে তাকালেই প্রতিবার নিজেকে হারাই আমি। তোমার এক চাহনীতেই যে আমার বিনাশ নির্ধারিত তা বুঝতে পেরেই সেদিন আর বাড়িতে ঢুকার সাহস করতে পারিনি। নিয়মমাফিক চলা ছেলেটার জীবন কেমন তোমার দেখা পেতেই এলোমেলো হয়ে গেলো। আমার ছোট হৃদয়ে ঝড় তুলতে শুধু তোমার এক হাসিই যথেষ্ট। বাবা মায়ের শান্তশিষ্ট ছেলেটা হুট করেই হয়ে উঠলো অস্থির, বেপরোয়া। এই তুমি বুঝতে পারছো আমার অনুভূতিটা? বুঝতে পারছো তোমায় দেখলে যে আমার সব কিছু এলোমেলো লাগে? দীর্ঘ ৮ বসন্ত ধরে তোমার অপেক্ষায় বসে আছি। ৮ বছর পর মনে হয়েছিলো এইবার তোমার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারবো। তবুও চাইছিলাম না তোমার সামনে যেতে। যদি কিছু ভুল করে ফেলতাম? তাইতো সেদিন জুম্মন কাকা কে দিয়ে কফি পাঠিয়েছিলাম। নিলে না। আমাকে সামনে এনেই ছাড়লে। ভেবেছিলাম তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতেও আমার আর সমস্যা হবে না। কিন্তু দেখো! আমি ব্যর্থ। আচ্ছা, একটা কথা বলো দেখি, আমাকে তোমার অসভ্য মনে হয় কেনো? আমি কি কখনো তোমায় কিছু বলেছি বা গভীর ভাবে ছুঁয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছি? জানো, সেদিন হাসপাতালে তোমায় ওই রূপে দেখে নিজেকে প্রায় পাগল পাগল লাগছিল। ইচ্ছা করছিল জড়িয়ে ধরে বসে থাকি অনেকক্ষণ। তোমার ওষ্ঠে জম্পেশ এক চুমু খাই। আমার কল্পনার থেকেও কোটিগুণ বেশি সুন্দর লাগছিল তোমায়। কত কষ্টে নিজেকে আটকে রেখেছিলাম বুঝতে পারছো? ইচ্ছা করছিলো তখনই তোমায় তুলে নিয়ে বিয়ে করি। মায়াবতী! আমি প্রতিক্ষণে বুঝতে পারছি তোমায় ছাড়া আমার চলবে না, একদমই চলবে না। তোমার প্রতি দয়া দেখিয়ে তোমায় বিয়ে করতে চাইছি এমন ইচ্ছাকে সমুদ্রে বিসর্জন দাও। তোমার হৃদয়ের গহীনে গাঢ়ভাবে লিখে রাখো চন্দ্রের ভালোবাসা শুভ্রতা। চন্দ্রের শুধু শুভ্রতা চাই। বুকের বা পাশটার খালি ভাব দূর করতে আমার তোমাকে চাই। দীর্ঘ ৮ বসন্তে তোমায় নিয়ে সাজানো প্রতিটা স্বপ্ন পূরণ করতে তোমাকে চাই। আমার অপূর্ণ জীবনে পূর্ণতা আনতে তোমাকে চাই। শুধু তোমাকে চাই। এবার বলো, হবে কি আমার বউ? হবে কি আমার চন্দ্রাবতী? হবে কি চন্দ্রের শুভ্রতা?”

শুভ্রতা চিঠি পড়া শেষ করতেই সামনে এসে দাড়ালো চন্দ্র। দু হাত পেছন দিকে গুঁজে দাড়িয়ে আছে। বাম দিকে মুখ করে, চোখ তার দূর আকাশে স্থির। কিছু একটা ভাবছে হয়তো। শুভ্রতা উঠে দাঁড়াতেই চন্দ্র একটু গলা খাকারি দিলো। হটাৎই সে একটা ফুলের তোড়া সামনে ধরে বসলো। আরেক হাতে একটা আংটি। লজ্জায় তার কান লাল হয়ে আছে। সে অসহায় কন্ঠে বললো,
~চলো না বিয়ে করি…

শিশুর ন্যায় মুখ করে চেয়ে আছে প্রেমিক পুরুষ। শুভ্রতা মুচকি হাসলো। ফুল নিয়ে নিজের বাম হাত বাড়িয়ে দিতেই চন্দ্র তার হাতে আংটি পড়িয়ে দিলো। উঠে দাড়িয়ে লজ্জায় এলোমেলো ভাবে এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো। চন্দ্রকে এতটা লজ্জা সে কখনোই পেতে দেখেনি। এই দৃশ্য যেনো চোখ ধাঁধানো। চন্দ্রকে জ্বালানোর জন্য আগ বাড়িয়ে চন্দ্রকে জড়িয়ে ধরতেই চন্দ্র থমকে দাঁড়ালো। শুভ্রতা কান পেতে শুনলো চন্দ্রের বুকের ঢিপ ঢিপ আওয়াজ। বুঝতে পারলো চন্দ্রের হার্ট বিট ফাস্ট হচ্ছে। শুভ্রতা ফের মুচকি হাসলো। সে যেনো চন্দ্রকে জব্দ করতে পেরেছে। চন্দ্র হেসে তাকে জড়িয়ে ধরতেই দরজার ওপাশ থেকে হৈ হৈ করতে করতে বেরিয়ে এলো ছোট বড় সকলেই। শুভ্রতা হকচকিয়ে গেল। এবার বুঝতে পারলো চন্দ্রের লজ্জার কারণ। লজ্জায় সে চন্দ্রের থেকে দূরে আসতে চাইলে চন্দ্র তার হাতের বাধন আরেকটু শক্ত করলো। শুভ্রতা লজ্জায় উশখুশ করতে লাগলো। সবার একেকটা দুষ্টুমিশ্রীত কথায় লজ্জায় মিইয়ে যেতে লাগলো। তবে ভাবাবেগ হলো না চন্দ্রের মধ্যে। সে হেসে হেসে সবার সাথে তাল মিলিয়ে কথা বলছে।
___________________________________

আয়নায় এক ধ্যানে নিজের প্রতিবিম্ব দেখছে শুভ্রতা। তিলোত্তমা শুভ্রতার মাথার ওড়না ঠিক আছে কিনা চেক করছে। মাথায় শেষ পিনটা আটকে দিয়ে হাত ঝাড়া দিয়ে বললো,
~শেষ। এবার আমি চললুম রেডি হতে।
~রিদিতা ওদের কি রেডি হওয়া হয়নি? কতক্ষন একা বসে থাকবো বল তো!
~আমি দেখে আসছি ওয়েট।
~প্রয়োজন নেই। এখানেই রেডি হ। আমি ওদের কল করছি।
~তুই করবি কল? টেক্সটই দে বইন। নয়তো দেখা যাবে সাক্ষাৎ কল বিদ্বেষীর থেকে কল পেয়ে বেচারি খুশিতে হার্ট ফেল করেছে।

তিলোত্তমার কথায় ঠাট্টার সুর স্পষ্ট। শুভ্রতা তার কাঁধে এক চাপড় মেরে বললো,
~তোর যতসব আজাইরা কথা। রেডি হ। আমি কল করে দেখি ওদের রেডি হতে আর কতক্ষন।

শুভ্রতা ফোন হাতে নিতেই দরজায় কড়া নাড়লো রিদিতা। শুভ্রতা গিয়ে দরজা খুলতেই তাকে দেখে রিদিতা বুকে হাত দিয়ে ঢলে পড়লো উপমার গায়ের ওপর।
~হায়! ক্রাশ খাইছি। দোস্ত আমি ছেলে হলে তোকেই বিয়ে করতাম।

শুভ্রতা ভ্রু কুঁচকালো,
~লুচ্চামি ছাড়। এতক্ষণ লাগলো কেনো?
রুপা হাত উচিয়ে কিছু ব্যাগ দেখিয়ে বললো,
~এইগুলোর জন্য।
~এই গুলো কি?

তিলোত্তমার কথায় একটু নড়েচড়ে দাড়ালো ওরা। জবাব দিলো শুভ্রতা,
~চন্দ্র পাঠিয়েছে। একমাত্র ভাইয়ের হবু বউ তুই। তাই পাঠিয়েছে। ঝটপট রেডি হ তুই।
~কি দরকার ছিল এগুলোর। আমি তো কাপড় নিয়ে এসেছি।
~বেশি কথা না বলে জলদি আয় তোকে রেডি হতে সাহায্য করি।

শুভ্রতা ফোন নিয়ে একটু সাইডে চলে এলো। বার কয়েক কল লাগলো নুরের ফোনে। ওপাশ থেকে প্রতিবার জবাব এলো “আপনি যেই নাম্বারে ফোন করেছেন তা এই মুহূর্তে ব্যস্ত আছে”। শুভ্রতার মন খারাপ হলো। ঠোঁট কামড়ে বসে রইলো মিনিট পাঁচেক। ওদিকে তিলোত্তমাকে সাজিয়ে দিচ্ছে উপমা। শুভ্রতা রুপাকে ডাকলো। রুপা এগিয়ে আসতেই শুভ্রতা চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
~নুরের সাথে কথা হয় তোর?

রুপা মাথা নাড়ালো। শুভ্রতা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আজকের দিনটা তার জন্য স্পেশাল। সে মনে প্রাণে চাইছে তার প্রিয় মানুষগুলো তার পাশে থাকুক। হয়তো বিধাতা তা চায় না। শুভ্রতা রুপাকে তিলোত্তমার কাছে যেতে বললে রূপার একটু মন খারাপ হলো। এমন খুশির দিনেও শুভ্রতার মন খারাপ শুধু মাত্র তার ভুলের জন্যে। রুপা যেতেই শুভ্রতা কল লাগালো নিতার ফোনে। অনেকবার রিং হওয়ার পর ফোন রিসিভ করলো নিতা। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
~কেমন আছিস?
~হাপাচ্ছো কেনো?
~নুরের সাথে বসে টিভি দেখছিলাম। তোর কল দেখে ফোন লুকিয়ে ছাদে দৌড় লাগিয়েছি।

শুভ্রতার এক মিশ্র অনুভূতি হলো। যেমন হাসি পেলো তার দৌড়ের কথা শুনে। তার থেকেও বেশি মন খারাপ হলো নুরের থেকে লুকিয়ে কথা বলতে হয় শুনে। শুভ্রতা নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলো অনেকক্ষণ। ওপাশ থেকে নিতা বললেন,
~বিয়েতে সব থেকে কাছের বন্ধু না আসায় মন খারাপ করিস না। সে নিজের ভুল বুঝতে পারলে ঠিকই তোর সাথে দেখা করতে যাবে দেখিস।
~আমার আজ বিয়ে জানো তুমি?
~জানি।
~কে বললো?
~অরণ্য।
~অরণ্য ভাইয়ের সাথে কথা হয় তোমার?

নিতা কথা ঘুরালেন। শুভ্রতাকে শান্তনা দিয়ে বললেন,
~জীবনে সব কিছু আমাদের ইচ্ছা মত হয় না। আমরা যা চাই তার সবই যে পেতে হবে এমন কোনো কথা নেই। যা পাস নি তা নিয়ে আফসোস করিস না। যা পাচ্ছিস তা দু হাতে আগলে নে।

শুভ্রতা ছলছল চোখে জানালার বাহিরে আকাশের দিকে তাকালো। কষ্টে বুকভার হয়ে আসছে। কি করলে তার মন হালকা হবে জানে না সে। তবে জানতে চায়। শুভ্রতা ধরা গলায় ডাকলো,
~মামনি?

নিতা দুচোখ বন্ধ করলেন। চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো। লম্বা শ্বাস নিয়ে জবাব দিলেন,
~হ্যা মা বল।
~সব কিছু আবার আগের মত হয়ে যাবে তো? অরণ্য ভাইয়া আর নুর এক হবে তো? আমার বন্ধুমহল আবার ঠিক হয়ে যাবে তো?

প্রশ্নের উত্তর দিতে চেয়েও দিতে পারলেন না নিতা। শুভ্রতা অশ্রুসিক্ত চোখেই হাসলো। শুভ্রতার হাসির আওয়াজে একটু চমকালেন নিতা।
~আমার জন্য দোয়া করিও মামনি। রাখছি।

শুভ্রতা কল কেটে চুপ করে বসে রইলো। পেছন ফিরে হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে রইলো শুভ্রতা। তিলোত্তমাকে সাজানো নিয়ে ঝগড়া করছে রিদিতা, উপমা আর রুপা।
~দেখ রিদি, রূপ শুভিকে তোরা ৮০% সাজিয়েছিস। তিলোকে আমি অন্তত ৭০% সাজাবো। তোরা ওর চুল বাঁধবি। (উপমা)
~ইহ বললেই হলো! আমি সাজাবো ওকে। (রিদিতা)
~না আমি সাজাবো। তোরা দুইজন চুল বাঁধ।

বাচ্চাদের মত আই শ্যাডো বক্স নিয়ে টানাটানি করছে তিনজন। মাঝে অসহায় মুখ করে বসে আছে তিলোত্তমা।
~হচ্ছেটা কি এখানে? (শুভ্রতা)
~শুভি, তুই কিছু বল ওকে। ওরা তোকে সাজিয়েছে। এখন আমি তিলোকে সাজাতে চাইছি ওরা দিচ্ছে না। (উপমা)
~শুভি তোকে আমি কত সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছি না? তার মানে ওকে সুন্দর দেখতে হলে আমার কাছে সাজা উচিত, তাই না? ওকে বল মারামারি অফ করতে। (রিদিতা)
~শুভি ওরা দুইজন তখন সাজিয়েছে। এবার আমি সাজাবো। (রুপা)
~হাইশশশ্!!!! চুপ! একদম চুপ! রিদি তুই ওর চুল সেট কর, উপ তুই শাড়ি পড়া, রূপ তুই আমাকে হেল্প কর ওকে সাজাতে। (শুভ্রতা)
~কিন্তু শুভি…(রুপা, রিদিতা, উপমা)
~আর একটা কথা বললে তিনটাকেই রুম থেকে বের করে দিবো।

শুভ্রতার কথায় স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো তিলোত্তমা। আর কিছুক্ষণ এদের টানাটানি চললে হয়তো হাত পা ছড়িয়ে কেঁদে দিতো সে।
~~~
চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here