চিত্তদাহ লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা পর্ব ৫৭

0
457

#চিত্তদাহ
লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা
পর্ব ৫৭

🍂🍂🍂

হাসপাতালের করিডোরে চিন্তিত মুখে এদিক থেকে ওদিক হাটাহাটি করছে চন্দ্র। করিডোরের চেয়ারে বসে নিঃশব্দে কাদঁছে শুভ্রতার বান্ধবীরা। করিডোর জুড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে তাদেরই কান্নার আওয়াজ। মাহতাব আর অরণ্যকে পাঠানো হয়েছে বাড়ির মানুষের খেয়াল রাখতে। আহাদ ডাক্তার মিজানের সাথে কেবিনে আছে। অর্ণব নিশ্চুপ হয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাড়িয়ে আছে। তাকেই শান্তনা দেওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে মাহাদ। শুভ্রতার কিছু হলে সে আবারো একা হয়ে যাবে। তার বয়স যখন ৬ তখন এতিমখানা থেকে তাকে নিজ বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন উমা। উমা তখন ছিল ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এতিমখানা আর বৃদ্ধাশ্রমের মানুষদের প্রতি ছিল তার ভীষণ মায়া। সে মায়া আরো গভীর হয় যখন তার সাক্ষাৎ হয় অর্ণবের সাথে। সেদিনই অর্ণবকে নিজের ছেলে বলে পরিচয় দেন তিনি। বাড়ি নিয়ে আসেন নিজের সাথে। কখনো অনুভব করতে দেয়নি অর্ণব এতিম। বছর চারেক আগেই সে বিদেশে গিয়েছিল কাজের সুবাদে। সুন্দর সাজানো গোছানো সংসারটা যে সে ফিরে এসে এমন দেখবে তা কখনোই ভাবেনি সে। শুভ্রতা তার হৃদয়ের বিরাট এক অংশ। শুভ্রতাকে সে বরাবরই আগলে রেখেছে। অর্ণব আর অরণ্য বডি গার্ডের মতো সবসময় তাকে প্রোটেক্ট করেছে। আর আজ? মৃত্যুর সাথে লড়ছে সে। কিছুই করার নেই তার। বুকে চিনচিন ব্যাথা অনুভব করতে লাগলো অর্ণব। জীবনের একমাত্র কাছের মানুষটাকে হারানোর ভয় ক্রমশই বাড়তে শুরু করেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাসপাতালে এসে পৌঁছালো আশহাব, মাহতাব আর অরণ্য।

~শুভ্রতার হটাৎ এমন হলো কেনো? যাওয়ার আগ পর্যন্তও সে তো ঠিকই ছিল।

অরণ্যের প্রশ্নে কান্না থেমে গেলো তিলোত্তমাদের। রিদিতা কান্নাজড়িত গলায় জবাব দিলো। শুভ্রতার জ্ঞান হারানোর আগের সব ঘটনা খুলে বললো সে। অরণ্য দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চন্দ্রের দিকে তাকালো। নুরকে ভালোবাসে বলে আজ প্রথমবারের মতো আফসোস হচ্ছে তার। প্রথমবার মনে হচ্ছে সে ভুল কাউকে ভালোবেসেছে। সে নুরকে ভালো না বাসলে হয়তো আজ এত কিছু হতোই না। মুখটা লাল হয়ে উঠেছে চন্দ্রের। রাগে নাকি কষ্টে ঠিক বুঝা গেলো না। মানুষটা নিজের অনুভূতির বিষয়ে বেশ চাপা স্বভাবের। মেয়েটার প্রতি ভীষন রাগ জন্মালো তার। এই এক বন্ধুত্বের জন্য বারে বারে মৃত্যুর দিকে ছুটে যায় সে। সে কি জানে না তার জন্যই চন্দ্র বাঁচে? চন্দ্রের ভালোবাসার কি কোনো মূল্যই নেই তার কাছে? তার কাছে শুধু তার বন্ধুত্বই প্রিয়? হাজারো প্রশ্ন মনে জমা হলো। তবে জবাব নেই। মন খারাপটা ক্রমশই বাড়লো। শ্রাবণের কালো মেঘের মতোই খারাপ লাগাটা আচ্ছাদিত করলো তার মনকে। ভাবনায় ছেদ ঘটলো কাঁধে আহাদের হাতের ছোঁয়ায়। বন্ধুকে দেখতেই চন্দ্র চিন্তিত চিত্তে প্রশ্ন করলো,
~কি অবস্থা ওর? হটাৎ জ্ঞান হারালো কেনো? জ্ঞান কি ফিরেছে ওর?

আহাদ নেতিবাচক মাথা নাড়ালো। চন্দ্রের চিন্তা বাড়লো। জ্ঞান ফিরেনি মানে? জ্ঞান ফিরবে না কেনো? কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো ডাক্তার মিজান। তিনি বেশ কড়া গলায় বলে উঠলেন,

~কতবার বলেছি ওকে হাসপাতালে অ্যাডমিট হতে। দিন দিন ওর অবস্থা আরো খারাপ হচ্ছে। হাসপাতালে থাকলে ট্রিটমেন্টের কারণে ও হয়তো আরো কিছুদিন বাঁচতে পারবে, হয়তো একটু সুস্থ থাকবে। কিন্তু এই মেয়েটা শুনলে তো!

~ওর এখন কি অবস্থা? (চন্দ্র)

~চিন্তা করবেন না, ইন শাহ আল্লাহ কয়েক ঘন্টার মধ্যেই জ্ঞান ফিরবে।

চন্দ্র আর অপেক্ষা করলো না। কেবিনে ঢুকতে চাইলে বাঁধা দিলো মিজান। চন্দ্র ভ্রু কুঁচকে তাকালে মিজান চিন্তিত গলায় বললো,
~আপনি ওর স্বামী। আপনার কথা ও নিশ্চিত শুনবে। আপনি বুঝানোর চেষ্টা করুন। জিদ ধরে বাসায় বসে থাকলে হবে না। সুস্থ থাকতে হলে প্রপার ট্রিটমেন্টের প্রয়োজন। আপনি নিজেও ডাক্তার। আপনি অবশ্যই বুঝতে পারছেন আমি কি বলছি।

চন্দ্র কোনোরূপ জবাব দিলো না। সে নিঃশব্দে কেবিনে প্রবেশ করলো। ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে গেলো বেডের কাছে। সাদা সিঙ্গেল বেডে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে তার প্রেয়সী, তার অর্ধাঙ্গিনী। চোখ মুখ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে আছে। গায়ে এখনও তার সেই রক্তমাখা সাদা জামা জড়ানো। সে যদি জানতো সে দূরে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই এমন কিছু হবে তবে এক সেকেন্ডের জন্যও একা ছাড়তো না সে শুভ্রতাকে। নিজের প্রতিই এক চাপা অভিমান জন্মালো তার। প্রচন্ড আক্ষেপে বুকখানা ভার হয়ে গেলো। প্রেয়সীর মলিন মুখপানে তাকাতেই অনুভব করলো বুকের চিনচিনে ব্যাথা। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে বার বার। চন্দ্র চোখ মুছে শুভ্রতার পাশের চেয়ার টেনে বসলো। শুভ্রতার ক্যানেলা লাগানো হাত টা খুব সাবধানে নিজের হাতে নিলো। ভাঙ্গা গলায় বললো,

~পরীক্ষা নেওয়ার জন্য তো আল্লাহর কাছে বহু উপায় আছে। আল্লাহ আমার ক্ষেত্রে সব থেকে কষ্টদায়ক উপায়টাই কেনো বেছে নিলো শুভ্রতা? আমার পরীক্ষা নেওয়ার কি আর কোনো উপায় ছিল না?

এক বিন্দু অশ্রু চন্দ্রের গাল গড়িয়ে শুভ্রতার হাতে পড়লো। চন্দ্র তার হাত থেকে নিজের অশ্রু মুছে দিয়ে বললো,
~বাবাকে ছোটবেলার থেকেই দেখেছি জনগণের সেবায় নিজেকে ব্যস্ত রাখতে। সবসময় বলেন, মানুষের সেবা করলে নাকি আল্লাহ খুশি হন। আল্লাহকে খুশি করার জন্য মাহতাব বাবার দেখানো পথে হাঁটলেও আমি চলেছিলাম নিজের দেখা স্বপ্ন পূরণ করতে। মানুষের সেবার জন্য ডাক্তার এর চেয়ে ভালো পেশা আমি খুঁজে পাইনি। আমি তো সর্বদা মানুষের সেবা করলাম। চেষ্টা করলাম, সর্বদা চেষ্টা করলাম মানুষকে সুস্থ করতে। যেনো সুস্থ হয়ে সে তার প্রিয় মানুষের কাছে ফিরে যেতে পারে। কিন্তু এতো কিছুর পরও আল্লাহ আমার প্রিয় মানুষটাকে নিজের কাছে নিয়ে যাচ্ছেন কেনো শুভ্রতা? আমি কি তাকে খুশি করতে পারিনি?

চন্দ্র প্রশ্নবিদ্ধ চোখে শুভ্রতার মুখপানে চেয়ে রইলো। আশা করলো শুভ্রতা তার প্রশ্নের জবাব দিবে। অনেক সময় অতিবাহিত হলো তবে শুভ্রতার জবাব এলো না। চন্দ্র আশাহত হয়ে আবারো বলতে শুরু করলো,

~জীবনে কতটুকু নেকী করেছি আমি জানি না। যদি আমার অর্জিত সবটা নেকীর বিনিময়ে আমি শুধু তোমাকে চাই তবে কি আল্লাহ তোমাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিবে শুভ্রতা?
_____________________________________

~মামা মামী এসেছেন। তোমাকে খুঁজছে।

অরণ্য ক্লান্ত ভঙ্গিতে মাথা দোলালো। উঠে তাদের সামনে যাওয়ার শক্তি বা সাহস কোনোটাই পাচ্ছে না সে। হাত বাড়িয়ে টেবিলে থাকা গ্লাস নিয়ে এক টানে সম্পূর্ণ পানি শেষ করলো। অরণ্য গ্লাস রেখে বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। দরজা পর্যন্ত গিয়ে আবার দাঁড়ালো। ফিরে দেখলো অর্ণব চেয়ারে মাথা এলিয়ে বসে আছে। কপালে এক হাত দিয়ে চোখ ঢেকে রেখেছে। অরণ্য ডাকলো,
~তুই যাবি না?

অর্ণব চোখ থেকে হাত সরিয়ে ঘুরে চাইলো অরণ্যের দিকে। দুর্বল হেসে মাথা নাড়ালো।

~নাহ, একটু একা থাকতে চাইছি।
______________________________________

শুভ্রতার জ্ঞান ফিরেছে কিছুক্ষণ হলো। চোখ খুলতেই আবিষ্কার করলো নিজেকে হাসপাতালের কেবিনে। কেবিনে শুধু তার সাথে একজন নার্স রয়েছে। তার জ্ঞান ফিরেছে দেখে সে মুচকি হাসলো। তারপরই হন্তদন্ত হয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো। হয়তো ডাক্তারকে জানাতে গেছে তার কথা। শুভ্রতা সেদিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মাথা সোজা করে আবারো চোখ বন্ধ করলো। দরজা খোলার আওয়াজে চোখ খুললো। তবে কে এসেছে দেখার ইচ্ছা হলো না। শুধু দুর্বল কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
~কত ঘন্টা পর জ্ঞান ফিরেছে আমার?
~২২ ঘণ্টা।

আর কোনো শব্দ উচ্চারণ করলো না সে। ডাক্তার মিজান কিছু চেক আপ করলেন। স্বাস্থ্যের প্রতি এত অযত্ন নিয়ে কিছু কথাও শুনালেন। শুভ্রতা কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া দেখালো না। চেকআপ শেষ হতেই শুভ্রতা বললো,
~চন্দ্র নিশ্চয়ই বাইরে বসে আছে। ওকে ভেতরে পাঠান।

চন্দ্রের নাম শুনতেই ডাক্তার মিজানের মুখটা মলিন হয়ে এলো। তার অভিব্যক্তির পরিবর্তন শুভ্রতার নজর এড়ালো না। এক ভ্রু উচু করে তাকাতেই সে কেবিন থেকে চলে গেলো। শুভ্রতার সাথে রয়ে গেলো সেই নার্সটি। শুভ্রতা আস্তে আস্তে উঠে বসে নার্সটির দিকে দৃষ্টি স্থির করলে দেখতে পেলো মেয়েটা আগে থেকেই চঞ্চল চোখে তার দিকেই চেয়ে। চোখে মুখে কেমন আগ্রহী ভাব ফুটে উঠেছে। কি নিয়ে এত আগ্রহী সে?

~নাম কি আপনার?
~হিয়া।
~আমার নাম জানেন?

মেয়েটা তৎক্ষণাৎ মাথা দোলালো। অর্থাৎ সে জানে। শুভ্রতাও মাথা দোলালো।

~একটু পানি হবে?

হিয়া এক গ্লাস পানি এনে দিলো তাকে। শুভ্রতা মুচকি হেসে পানির গ্লাস নিলো। শুভ্রতা পানি পান করে জানতে চাইলো,

~বাইরে কে কে আছে এখন?
~আপনার বান্ধবীরা, অরণ্য স্যার, চন্দ্র স্যার, মাহতাব স্যার আর আরেকজনের নাম মনে হয় অর্ণব। সন্ধ্যা অব্দি আরো কয়েকজন ছিল। আমি যতটুকু জানি আপনার মামা বাড়ি আর শ্বশুর বাড়ির লোকেরা ছিলেন। কিছুক্ষণ আগেই ওনারা এখান থেকে গেছেন।

~শুভ্রতা…

মেয়েটির কথার মাঝেই চন্দ্রের গলার আওয়াজ কানে ভেসে এলো। শুভ্রতা বিচক্ষণ দৃষ্টি মেলে তাকালো চন্দ্রের দিকে। সর্বদা গোছালো মানুষটাকে আজ কেমন বিধ্বস্ত লাগছে। মাথার চুল এলোমেলো, গায়ের শার্টটাও কুচকে আছে, মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে আছে। চোখ দুটো অসম্ভব লাল হয়ে আছে। শুভ্রতার মনে প্রশ্ন উদয় হলো। মানুষটা কি অসুস্থ? সে কেবিনে প্রবেশ করতেই হিয়া বেরিয়ে গেলো। শুভ্রতা আনমনেই ক্যানেলা লাগানো হাতটা বাড়িয়ে চন্দ্রকে কাছে ডাকলো। চন্দ্র শুভ্রতার কাছে এসে দাঁড়াতে শুভ্রতা তার কপাল ছুঁয়ে দেখলো। চোখ বন্ধ করে অর্ধাঙ্গিনীর ছোঁয়া অনুভব করলো। শুভ্রতা ব্যথিত গলায় বললো,
~এ কি অবস্থা আপনার? আমার একটু অসুস্থ হয়ে পড়াতে কি অবস্থা করেছেন নিজের!

চন্দ্র সে কথায় কোনো প্রত্যুত্তর করলো না। সে তৃষ্ণার্ত চাতকের ন্যায় শুভ্রতাকে দেখতে ব্যস্ত। শুভ্রতা একটু সরে বসতেই চন্দ্র নিঃশব্দে শুভ্রতার পাশে উঠে বসলো। শুভ্রতা চন্দ্রের বুকে মাথা রাখতেই চন্দ্র প্রাণ ভরে শ্বাস নিলো। মনে হয় কত জনম পর সে মন খুলে শ্বাস নিতে পারছে। কত বছর পর সে তার প্রেয়সীর মুখখানা দেখতে পেলো। শুভ্রতা অস্পষ্ট স্বরে বলল,

~মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে নিজের কি অবস্থা করেছেন চন্দ্র। আর মাত্র কয়েকমাস। আমি চলে গেলে আপনি কি করবেন চন্দ্র? কিভাবে থাকবেন আপনি? আমার খুব চিন্তা হয়। নিজের প্রতি এত অযত্ন দেখলে আমার খুব কষ্ট হয়।

চন্দ্র ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। সে কি করে বুঝাবে এই মেয়েটিকে এভাবে দেখলে তারও কষ্ট হয়? কি করে বুঝাবে প্রিয় মানুষটার মৃত্যুর কথা মনে পড়তেই তার হৃদয় পুড়ে? এমন দহনের সাথে তো সে পূর্ব পরিচিত নয়।
~~~
চলবে~

(চন্দ্র চরিত্রটা সবার কাছে কেমন লাগে? এই গল্পের মধ্যে আপনার সব থেকে প্রিয় চরিত্র কোনটি? আর কেনো? কমেন্টে অবশ্যই জানাবেন। হ্যাপি রিডিং~)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here