#চিরসখা (৮)
স্ত্রীর গায়ে চাদর টেনে আসাদ বিছানা ছাড়ে। মেধা ঘুমোচ্ছে। আম্মা উঠা মানে রান্নাঘরে শব্দ শুরু। মাকে ফোন দিয়ে লাভ হলো না। এত ঠান্ডার ভেতর গোসল করতে হবে। গিজার ছেড়ে আসাদ ফ্লাস্কে পানি গরম করে লিকার চা বানিয়ে বউকে ডাকে। গড়িমসি করে জেগে চা হাতে নিয়ে মুখ কোচকায় মেধা। দুধ ছাড়া চা খেতে ওর ভালো লাগে না। চাদর মুড়ে আবার শুয়ে পরে মেধা। আসাদ গোসল সেরে রান্নাঘরে চা’র পানি বসায়। কাজের লোক ওকে সাহায্য করতে এলে মানা করে। আসাদের মা সেমাই রান্না করছিলেন। ছেলের কান্ড দেখে তার গলার রগ রাগে মোটা দেখাচ্ছে।
–এত আদিখ্যেতা ভালো না, আসাদ।
–ঠান্ডা পরেছে আম্মা।
–তো! তোমার বাবা কবে আমাকে চা বানিয়ে খাইয়েছেন।
–আব্বা দেয়নি, আমি দিয়েছি তো।
–বউকে বউ হিসাবে দেখো।
আসাদ চা বানিয়ে সিংকে গা হেলিয়ে দাঁড়ায়। আম্মার হাতে এক মগ চা দেয়। আসাদের মা চা খেয়ে আরো চিনি মেশান।
–এই যে তোমার ডায়বেটিস। তুমি চিনি দিয়ে খাও, এটা ঠিক?
–হয়েছে। বয়স কালে তোমাদের কাছে ঠিক বেঠিক শেখা লাগবে না।
–মেধাকে তোমার কেমন লাগে।
–কেমন আবার লাগবে, খুব সেলফিশ।
–নতুন, সহজ হবে পরে।
–সহজ – কঠিন না আসাদ।
–তাহলে।
–স্বামীর প্রতি স্ত্রীর নতুন হোক বা পুরাতন, একটা টান থাকে। তোমার বউ নিজের প্রতি উদাসীন।
–ওর একটা পাস্ট আছে।
–তুমি ভালো থাকলে আমার কিছু বলার নেই। তবে, বউ সামলাতে শেখো।
আসাদ চায়ের ট্রে নিয়ে রুমে এসে স্ত্রীকে ডাকে। মেধা ওঠে অনেকক্ষণ পর। শীত জাঁকিয়ে বসেছে। অনাবৃত শরীর মুড়ে চা খায়। চমৎকার হয়েছে, হিরকের মতো। হিরকের কথা মনে হতে মেধার মুখ তেতো হয়। ঠান্ডা চা বিস্বাদ লাগে। আসাদ আসার আগে বারান্দায় গিয়ে ফুলের টবে চা ঢালে মেধা। শিউলি ফুলের গাছ। প্রচুর ফুল ফুটেছে। কুয়াশার ভেতর ভোরে ফোটা সুগন্ধি ফুল মেধার ভালো লাগে। এখন লাগছে না। হিরক ওকে শিউলি ফুলের মালা কিনে দিতো। সে সব দিনের কথা মনে হলে বুকের ভেতর খালি লাগে। আসাদের দরজা খোলার শব্দ পেয়ে মেধা আবার বিছানায় চাদরে ঢেকে শোয়৷ ও যে উঠেছে, জেগে আছে, আসাদকে বুঝতে দেবার দরকার নেই৷ কাল রাতে যা হবার হয়েছে।
অফিস যাবার আগে আসাদ বউয়ের কপালে চুমু খায়। মেধা নড়ে না। চুপ করে পরে থাকে। আসাদ চলে গেলে আরো কিছু সময় গড়ায়। পেটে ক্ষুধা লাগছে। আচ্ছা, হিরক ওর সাথে প্রতারণা করলো কেনো। আসাদের জায়গায় হিরক হলে ক্ষতি হত? একটা অসভ্য, জানোয়ার পুরুষ লোক।
হিরকের মেসেজ মুছে মেধা। ভয়েস মেসেজটা মুছতে পারে না। বারবার ফোন বুকে চেপে শোনে। আসাদের মা দরজায় ধাক্কা দেন। মেধা দ্রুত কাপড় সামলে নেয়।
–নাস্তা খাও।
–আসছি।
–আমার বোন আসবে। তোমার আম্মাকে দাওয়াত দিয়েছি।
–আম্মার হাঁটু ব্যাথা।
–তোমার বোনের সাথে কথা হলো। কই বেয়ানের হাঁটুর কথা বলেনি।
মেধা বোঝে উনি জাল ফেলে মাছ আটকাতে এসছেন। চাদর ভাঁজ করে বিছানা গোছায় মেধা। ওনার সামনে বসে থাকা যায় না। আসাদের মা মেধার হাতে নতুন আংটি দেখেন। বিয়ে হতে না হতে ছেলেকে খসানো শুরু। স্বামীর প্রতি আগ্রহ নেই একফোঁটা। শ্বশুড়বাড়ির কাউকে আপন করতে পারলো না। সোনা কিনতে ভোলেনি।
–কালকে কোথায় গেলে।
–আসাদ জানে।
–তোমার বলতে অসুবিধা আছে?
–মনে নেই।
–তৈরী হয়ে আসো। বিয়ের পর বাসায় মেহমান আসলে মেয়ে বউরা এক পদ রাঁধে। তোমাদের বলি না, এ যুগের মেয়ে। কেমন করো না করো ঠিক নেই। আমার এই বোনের মুখ ভালো না। চুপ থেকো।
মেধা ভাবে, এনার মুখের থেকে ও ভালো না হলে কেমন মুখ হবে।
— আমি কিছু রাঁধতে পারব না।
–পারব না বলে হলো না। কয়টা ডিম কোরমা করো।
আসাদের মা হঠাৎ মেধার মাথায় হাত রাখেন।
–বিয়ে হয়েছে, সংসারে মন দাও।
–সংসার করছি তো।
–এটাকে সংসার বলে না।
–আমি এর বেশী পারি না।
–যা পারো তাই করো। পুরুষের মন পেতে চেষ্টা করা লাগে। আমার ছেলের অন্তর ভালো৷ ওকে দুঃখ দিও না।
মেধা সারাদিন ধরে ঘরের জিনিষপত্র গোছায়৷ আসাদের মা মানা করেন না। কিছু স্বাভাবিক কাজ করলে মেয়ের মন ঘরে বসতে পারে। মেধা ডিমের কোরমার সাথে এক পদ আমড়ার চাটনি করে ফেললো। আসাদের মা খুশি হয়। স্বাধীনতা দিলে পোষা কবুতর ঘরে ফিরে।
–শাড়ি পরো। ছোট সোনার গয়না আছো, না তোমার আম্মার কাছে।
–আছে।
–একা শাড়ি পরতে পারবা?
মেধা ছোট করে উত্তর দেয় ‘পারব’। মেসে শাড়ির কুঁচি হিরক ঠিক করত। শাড়ি খুব বেশী নেই মেধার। হিরকের পছন্দের রঙের দিকে হাত যায়। মেধা জিদ ধরে গাঢ় বেগুনী রঙের জামদানী পরে। হালকা গয়নায় সেজে আয়না দেখে। হিরকের সাথে বিয়ের পর কি করবে,কোথায় যাবে, কেমন করে সাজবে, কত প্লান করতো। মেধার আবার কান্না পায়। নোংরা, ভন্ড হিরক। আবার দেখা করে কথা বলতে চায়। ফাঁসীর আসামী তো মেধা। বিয়ে করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড সাজা ভুগছে। মেহমানের জন্য আসাদ মিষ্টি নিয়ে এসেছে। মেধা সুইট ডিশে মিষ্টি সাজায়। আসাদ দূর থেকে দেখে। মেয়েটাকে এত দিনে বউ বউ লাগছে। আসাদের মা লক্ষ্য করেন।
–মেধা ঘরদোর গোছালো। রান্না করেছে।
–ভালো তো। তুমি খুশী।
–আয়শার সামনে আবার মুখ না বাঁকায়।
–ওর ফ্যামেলী আসছে। খারাপ কিছু বলবে না।
রুপা মেধাকে বললো, খুব সুন্দর লাগছে। খেতে বসে সবাই আমড়ার চাটনি চেয়ে খেলো। মেধার আম্মা ডিমের কোরমা খেয়ে কেঁদে ফেল্লেন। তার ডানপিটে ঠোঁটকাটা অস্থির মেয়েটা সংসারী হচ্ছে। বেয়ানকে সব ক্রেডিট দিয়ে আসাদকে দোয়া করলেন। মেধার মনে হলো, তার খুব সুন্দর করে বিয়ে হয়েছে। এখানে সবাই খুশী। শুধু সে খুশী হবার ভান করছে, সত্যি খুশী হতে পারছে না। মা যাবার আগে মেধাকে জামাই সহ বাসায় যেতে বললেন। মেধার নাইওর হয়নি। মেধার বোনের বাচ্চা অসুস্থ ছিলো। আসাদ রুমে এসে মেধাকে বলে,
–ধন্যবাদ।
–কেনো।
–নরমাল থাকার জন্য।
–আমি তার মানে এবনরমাল।
আসাদ হেসে মেধার গাল টানে। মেধা মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
–মন খারাপ করলে।
–হা।
–কি করলে মন ভালো হবে।
–কিছু না। আমি কাল বাসায় যাবো।
–ওকে। সকালে নামিয়ে দেব।
আসাদ কথা না বাড়িয়ে ঘুমিয়ে পরে। মেধা ফোন খোলে। হিরকের মিসকল জমা হয়েছে৷ মেধা অপেক্ষা করছিলো হিরক আবার মেসেজ পাঠাবে। মেধা হিরককে ভুলতে চেয়ে পারছে না কেনো। এত খারাপ বাজে মানুষকে মনের ভেতর পুষে রাখতে কেউ তাকে জোর করেনি৷ তবু মেধা কেন তাকে ভুলতে পারে না। হঠাৎ হঠাৎ কোথায় সব গায়েব হয়ে ভেতরে ছ্যাঁত করে পোড়ে।
পরদিন আসাদ অফিস চলে গেলে মেধা শুয়ে শুয়ে মেল ঘাটে। কোথাও থেকে ডাকেনি। আপাকে ফোন করে জবের জন্য বলে মেধা। কথা শেষে আপা মেধাকে জিজ্ঞেস করে, হিরকের সাথে ওর এখনো যোগাযোগ হয় কি না। মেধা মিথ্যে বলে। হিরকের সাথে সম্পর্ক চালু করে যেন মেধা বোকামী না করে হুশিয়ারী দিয়ে ফোন কাটে আপা। হিরক ফোন করে তখনি। মেধা অন্য সময় হলে ফোন ধরতো না, এখন ধরলো। আপার অতি সতর্কতা বানী তার মেজাজ খারাপ করেছে।
–মেধা, কথা বলো।
–বলতে থাকো।
–তুমি খুব রাগ করে আছো।
— সেটাই তো হওয়ার কথা।
–কাল এলে না।
–কেনো আসব।
–আমার ডাকের কোন মূল্য নেই।
–এখনো আশা রাখো?
–আজকে দেখা করি।
–না, মেধা শক্ত করে বলে।
–সামান্য একটা অনুরোধ।
–রাখতে পারব না।
–তোমার বউ বাচ্চা সহ আমার বাসায় আসো।
–ওরা এসবে আসছে কেনো।
–আসবে, কারন ওটা তোমার সত্য। সইকে জানাও, তুমি মেধাকে ভুলতে পারো না। মেধার সবটা তুমি ছিলে। পারবে।
–না।
–তাহলে, আর যোগাযোগ করো না।
–আম্মার জন্য সইকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছি মেধা। বিশ্বাস করো, বারবার বলবো, আমি তোমাকে ভালোবাসি।
–আমি একটা বোকা মেয়ে। তোমাকে বিশ্বাস করে ঠকেছি। সই খুব চালাক, ওকে ঠকিও না। কথার জালে সবাই ভোলে না হিরক।
–তোমার ভুল ধারনা গুলো একবার দেখা হলে বদলে যেতো।
–থামো। বন্ধ করো ফালতু কথা। একবার হারিয়ে গেছো। আবার এসে আলাপ জুড়তে চেও না।
–একটা সুযোগ দাও। আমাদের ভালোবাসার দোহাই মেধা। ওটা মিথ্যে ছিলো না। মেধা এবার কিছু বলতে পারে না। ফোনের অপর পাশ থেকে দাঁতে ঠোঁট কাটে। হিরক বোঝে, মাছ টোপ গিলেছে। থেমে লম্বা দম নিয়ে হিরক আবার বলতে শুরু করে,
— যদি ভালো না বাসো তাহলে বলে দাও বাসোনি। আর যদি ভালোবাসো, আমাদের কাছে আসার মুহূর্ত গুলো সত্যি হয়, আমাদের এক সাথে দেখা স্বপ্নগুলো যদি এখনো তোমাকে ভাবায় মেধা, আমাকে একবার দেখা দাও।
মেধা ‘হা’ বা ‘না’ কিছুই বললো না। তবে সে হিরক মরে গেলেও যাবে না। ফোন কাটার আগে হিরক বললো, সে মেধার ডাকের অপেক্ষা করবে। বাকি দিন মেধা এখানে ওখানে মেল পাঠালো। ফোন করে খবর নিলো। আসাদ ওকে ফোন করে খোঁজ নিলে খুব স্বাভাবিক ভাবে কথা বললো। আসাদের মা রুপাকে মেধার পরিবর্তন জানিয়ে বললেন, ছাড়া মুরগী এবার হয়ত ঘর খাবে। মেধার মনের ক্যাসেটের রিলে হিরকের কথা গুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। বিকেলের দিকে মেধা ঘুম থেকে উঠে তৈরী হলো। আসাদের মা, ‘কোথায় যাচ্ছো’ জানতে চাইলে বললো, ‘আসাদের অফিসে’। সত্যি সত্যি আসাদের অফিসে হাজির হলো মেধা। বউকে অফিসে দেখে আসাদ খুশী। ছুটির আগে বের হয়ে দু’জন সোজা হাতিরঝিল চললো। মেধাকে ব্রিজে দাঁড় করিয়ে সূর্যাস্তের কিছু ছবি তোলে আসাদ। মেধা ওখান থেকে আসাদের সাথে তোলা বেশ অন্তরঙ্গ একটা ছবি স্টোরিতে আপ্লোড দেয়। হিরক নিশ্চিত এটা দেখবে, আর জ্বলবে। ও বুঝুক, মেধাকে কেয়ার করার মানুষ আছে।
আসাদ রাতে মেধাকে কাছে ডাকলে আগ্রহ করে সাড়া দিলো মেধা। লাভ বাইটের কিছু চিহ্ন জোর করে মেখে নিলো গালে, গলায়৷ স্ত্রীর পরিবর্তনে আসাদ খুশী। মেধা নিজ থেকে একদিন বদলাবে, সে জানতো। এত দ্রুত সেটা হবে ভাবেনি। আসাদ ঘুমিয়ে গেলে মেধা ফেসবুক খোলে। হিরক ছবি দেখেছে। মেধা ঠিক করে কালকে ও হিরকের সাথে দেখা করবে। আসাদ আর তার সম্পর্ক নরমাল আছে। একবার হিরকের সাথে দেখা করলে আসাদকে ঠকানো হবে না। উল্টো, হিরককে যে ও কত ঘেন্না করে, সেটা ভালো করে প্রকাশ করে আসবে।
(চলবে)