জলঅরণ্যের ওপারে পর্ব ৪

#জলারণ্যের_ওপারে
——————————

৪.
‘আরে আরে, বেয়াই মশাই। নেন নেন, দই নেন। একটা খেলে ডায়বেটিস বেড়ে যাবেনা।’ বলে নমিরুন বেগম একটা ছোট দইয়ের বাটি তুলে দিলেন আলতাফ চৌধুরীর হাতে। আলতাফ চৌধুরী হাসতে হাসতে দইয়ের বাটিটা হাতে নিলেন। নমিরুন বেগম মঞ্জুরার দিকেও একটা দইয়ের বাটি বাড়িয়ে দিলেন। মঞ্জুরাও হাসিমুখে হাতে নিলেন সেটা। মঞ্জুরা ও আলতাফ দুজনে হচ্ছেন মোহনার বাবা মা। আজ ওয়ালিমা উপলক্ষে মোহনার বাবার বাড়ি থেকে অনেক আত্মীয় স্বজনরা এসেছে। মোহনা বসে আছে বাবা মায়ের মাঝখানে। আলতাফ মেয়ের দিকে তাকালেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে হাসিমুখে বললেন, ‘খাবি?’

মোহনা নিচের দিকে তাকিয়েছিলো। সেদিকে তাকিয়েই মাথা নাড়লো, সে খাবেনা। আলতাফ আর কিছু বললেন না। মঞ্জুরা বললেন, ‘জামাইকে দেখছিনা যে? কোথায়?’

‘জানিনা।’ সাথেসাথেই এক মুহূর্তও বিলম্ব না করে কথাটা বলে উঠলো মোহনা। যেন এই প্রশ্নটি করা ঘোর অপরাধ। আলতাফ আর মঞ্জুরা ভারী অবাক হলেন। কিন্তু কিছু বললেন না। তখনই দেখলেন সোহানার সাথে সৌমিক আসছে। মঞ্জুরা বললেন, ‘ঐতো।’

আলতাফ তাকালেন। মুখে হাসি ফুটলো তার। মঞ্জুরা আবার বললেন, ‘আসার পরথেকে দেখছি ছেলেটার ফুরসত নেই। দৌড়াদৌড়ি করছেই। শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কোথাও কিছুর কমতি হচ্ছে কিনা নিজে সামাল দিচ্ছে। কতো ভালো ছেলে!’

এবারও আলতাফ কিছু বললেন না। মাথা নাড়লেন হেসে হেসে। সোহানা আর সৌমিক এসে দাঁড়ালো উনাদের সামনে। সৌমিক এসেই প্রথমে মোহনার দিকে তাকালো। তারপর আলতাফ আর মঞ্জুরার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘সব ঠিক আছে তো? আপনাদের কোনো সমস্যা হচ্ছেনা তো?’

‘আরে না না। তুমি বসো একটু।’ বললেন আলতাফ। তিনি কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছেন না। কেমন একটা গুমট ভাব কাজ করছে উনার মাঝে। এই ছেলেটাকে দেখলে উনার ভেতর একটা অপরাধবোধ জাগে। উনি কি কোনো ভুল করলেন?

‘জ্বি।’ বলে বসলো সৌমিক। মোহনার সামনাসামনি। তারপর তাকালো সে মোহনার দিকে। চোখাচোখি হতেই বিরক্তি নিয়ে চোখ সরালো মোহনা। মনেমনে হাসলো সৌমিক। তারপর সোহানার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তুমিও বসো।’

‘আরে দুলাভাই! বসতে বসতেই তো এলাম। একটু দাঁড়াই।’ বললো সোহানা। তারপর বাবা মার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘এবার যাওয়া উচিত, বাবা। সন্ধ্যা হয়ে এলো।’

‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস।’ বলতে বলতে উঠলেন আলতাফ। সৌমিক ব্যস্ত হয়ে বললো, ‘এখনই চলে যাবেন? আজ থেকে যান।’

কথাটা শুনে আলতাফ হো হো করে হাসলেন শুধু। কিছু বললেন না। মঞ্জুরা হেসে হেসে বললেন, ‘মেয়ের শ্বশুরবাড়ি এভাবে থাকা যায়না বাবা। আর শোনো, তোমরা তো ফিরা যাত্রায় যাবে। থাকবে তো? থাকতে হবে কিন্তু।’

সৌমিক হাসলো। বাবা মাকে বিদায় দিতে গিয়ে অনেক কাঁদলো মোহনা। সবাই বেরিয়ে গেলেও সোহানা তখনও মোহনার কাছে দাঁড়িয়ে রইলো। মোহনা তখন কিছুটা শান্ত। এই ঘরে আপাতত ও আর সোহানা ছাড়া কেউ নেই। সোহানা আস্তে করে ডাকলো, ‘আপু।’

‘হুম।’

‘আমার মোবাইলটা আজকে সকালে হাত থেকে পানি ভর্তি বালতিতে পড়ে গেছে।’

মোহনা মাথা তুলে তাকালো। দেখলো সোহানার দৃষ্টি করুণ। সে বললো, ‘তাহলে আজকে এতো এতো ছবি তুললি কার ফোন দিয়ে?’

সোহানার উত্তর তৈরি ছিলো। সে চট করে বলে ফেললো, ‘আরে মায়ের ফোন দিয়ে। এই দেখ।’ বলে ব্যাগ থেকে মায়ের মোবাইলটা বের করে দেখালো। মোহনা একবার মোবাইলটার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘এতো চিন্তার কী? বাবাকে বল, নতুন কিনে দেবে।’

‘উফ, আপু। সামনে পরীক্ষা না? বাবাকে বললে এখন দেবেই না উল্টো বকা দেবে।’

‘তো আমি কী করতে পারি? আচ্ছা আমি বাবাকে বলবো।’

‘আপু, তোর মোবাইল টা দিয়ে দে। তোকে তো দুলাভাই নতুন দিবে।’

মোহনা পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকালো সোহানার দিকে। সোহানা আবার বললো, ‘প্লিজ আপু। দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

মোহনার বুকটা কেমন হুহু করে উঠলো। একটাই স্মৃতি রেখেছিলো সে। আর রেখেই কী হবে? মানুষটা তো খোঁজই নিচ্ছেনা, সে বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে। মোহনা আস্তে করে বললো, ‘নিয়ে আয়। রুমের…’

‘এইযে নিয়েই এসেছি।’ বলে ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে দেখালো সোহানা। হাসলো মোহনা। মোবাইলটা হাতে নিয়ে একবার মেসেঞ্জার চেক করলো। বুকের ভেতর যে ক্ষীণ আশাটা ছিলো সেটাও নিভে গেল। কাঙ্ক্ষিত আইডিটা ডীয়েক্টিভ। নাকি তাকে ব্লক করলো? এক সাগর কষ্ট বুকে চেপে রেখে নিজের আইডিটা ডীয়েক্টিভ করলো মোহনা। তারপর সোহানার হাতে মোবাইলটা দিয়ে দিলো। সোহানা বোনকে জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে গেল। মোহনা বসে রইলো তার ক্ষতবিক্ষত হৃদয় নিয়ে।

দরজার বাইরে সৌমিক দাঁড়িয়ে ছিলো। সোহানাকে দেখতে পেয়েই বললো, ‘তোমার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে।’

সোহানা হাসলো। বললো, ‘অবশিষ্ট বাহ্যিক যেটা ছিলো সেটা আমি নিয়ে যাচ্ছি। এবার আপুর মনের ভেতরটা বদলে পুরোপুরি নতুন বানানোর দায়িত্ব টা আপনার, দুলাভাই।’

‘থ্যাঙ্কিউ, শালি সাহেবা।’ বলে একটা চকলেট এগিয়ে দিলো সৌমিক, সোহানার দিকে। সোহানা চকলেট টা নিয়ে হাসিমুখে চলে গেল। পেছনে দাঁড়িয়ে সৌমিক আপনমনে আওড়ালো, ‘অবশ্যই। অবশ্যই ঐ মনটাকে আমি নতুন রূপ দেব।’ বলে হাসলো সে।

আস্তে আস্তে আত্মীয় স্বজনরা চলে গেলেন। সৌমিকদের বড় বাড়িটা খালি হয়ে গেল। আগামীকাল ফিরা যাত্রায় যাবে মোহনা, বাবার বাড়ি। একটু আগে রাতের খাবারের জন্য ডেকে গেছে রুমি। মোহনা একা একা বসে আছে রুমে। সৌমিক নেই। গেছে কোথাও একটা। হয়তো বন্ধুদের সাথে আছে। মোহনা আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেল। বাড়িতে এখনও কোথায় কী আছে, কটা রুম কিছুই জানেনা সে। ঘুরে দেখতেও ইচ্ছা করেনা। কিছুই ইচ্ছা করেনা তার। বিষন্ন লাগে খুব। নিজেকে অসহ্য লাগে। ডাইনিং টেবিলের সামনে যেতেই সৌমিকের ফুফুতো ভাই মনিরের সাথে দেখা হলো মোহনার। কুশল বিনিময় করলো মনির। মোহনা কষ্ট করে একগাল হাসলো। রুমি হাতে করে তরকারির বাটি নিয়ে এসে মোহনাকে দেখে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো, ‘ওমা! মোহনা। তুমি এখনও চেঞ্জ করো নি? শুধু সাজটাই মুছলে। শাড়িটা খুলবেনা?’

‘হ-হ্যাঁ। ঘুমোবার আগে ক-করে নেব।’

‘ঠিকাছে বসো। খেয়ে নাও। মুখটা কেমন শুকনো লাগছে তোমার।’ বলে খাবার বাড়তে লাগলো রুমি। নমিরুনও এসে খেতে বসেছেন ততক্ষণে। এটা ওটা নিয়ে গল্প করছিলেন সবাই। মোহনা চুপচাপ বসে খাবার নাড়াচাড়া করছে। একটু পর পর এক লোকমা মুখে দিচ্ছে। হঠাৎ মনির বললো, ‘সৌমিক কোথায়?’

‘কী একটা কাজে গেছে বললো। আসতে দেরি হবে।’ বললেন নমিরুন।

‘আচ্ছা।’

এই ‘আসতে দেরি’ হবে কথাটা শুনে কেন যেন খুব স্বস্তি পেলো মোহনা। অজান্তেই স্বস্তির নিশ্বাস নিলো সে।

মোহনা শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে আছে মিনিট বিশেক ধরে। এই বিশ মিনিট ধরে কান্না করার অনেক চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু আশ্চর্য! মোটেও কান্না আসছেনা তার। এমনকি ঐ মানুষটার কথা মনে করেও কান্না আনতে পারছেনা সে। তাহলে কী অভিমানের পাল্লাটা এতোটাই ভারি হয়ে গেল? এতোটাই ভারি যে চোখও এখন অশ্রু বিসর্জন দিতে চায়না? হাসতে লাগলো মোহনা। শাওয়ার থেকে পানির ফোটাগুলো চুইয়ে চুইয়ে তার শরীর বেয়ে পড়ছে। হাসছে মোহনা। বেদনাদায়ক হাসি। তার জীবনটা কী অদ্ভুতভাবে মোড় নিলো! কী হওয়ার কথা ছিলো আর কী হয়ে গেল। আল্লাহ কখন কার জীবনের মোড় কীভাবে ঘুরিয়ে দেন কেউ বলতে পারেনা। শাওয়ার বন্ধ করলো সে। চেঞ্জ করতে গিয়ে দেখে সে অন্যমনস্ক থাকায় শুধু তোয়ালে, অন্তর্বাস আর সেলোয়ার নিয়ে চলে এসেছে। কামিজ আনেনি। হয়তো বিছানার ওপর রয়ে গেছে। মোহনা সেলোয়ার আর অন্তর্বাস পরে গায়ে তোয়ালে পেচিয়ে বেরিয়ে গেল। তার চুল বেয়ে টুপটাপ পানি পড়ছে। বিছানার সামনে এসে তোয়ালে টা খুলতে যাবে আর ঠিক তখনই দেখতে পেলো সৌমিক সোফায় বসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কয়েক মুহূর্তের জন্য মোহনার মনে হলো সে এই দুনিয়ায় নেই। মঙ্গল গ্রহে পাড়ি জমিয়েছে। তড়িঘড়ি করে বিছানার ওপর থেকে ওড়নাটা নিয়ে শরীর ঢাকলো। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বললো, ‘আপনার মতো একটা অসভ্য আমি জীবনেও দেখিনি। বেরিয়ে যান এখান থেকে। আমি চেঞ্জ করব।’

‘তো? আমাকে বেরিয়ে যেতে হবে কেন?’ ভাবলেশহীন গলায় কথাটা বলে আরো আয়েশ করে বসলো সৌমিক।

‘মানে! আমি চেঞ্জ করব!’ জোর দিয়ে বললো মোহনা।

‘তো করো। আমি কি ধরে বসে আছি?’

‘আপনি থাকলে করব কীভাবে?’

‘আমি তাকাবনা।’ বলেই নিজের মোবাইল দেখতে লাগলো সৌমিক। মোহনা যারপরনাই অবাক। একটা মানুষ এতোটা নির্লজ্জ কীভাবে হয়? সে হিসহিসিয়ে বললো, ‘আপনি কি স্বামীত্ব ফলাচ্ছেন?’

সৌমিক অবাক হয়ে বললো, ‘এভাবে কোনদিন কাকে দেখেছো স্বামীত্ব ফলাতে? স্বমীত্ব ফলায় বিছানায় নিয়ে।’

‘আশ্চর্য! আপনার কি লাজ লজ্জা বলতে কিছু নেই? একটা মেয়ে চেঞ্জ করবে, আপনি এখানে বসে আছেন কেন? শরীর দেখবেন?’

‘তোমার অন্তর্বাস পরা আছে। এখানে দেখার মতো কিছু নেই। চাইলে আমি এখনই ইন্টারনেটে একেবারে ন্যাকেড মেয়ে দেখতে পারি। সো এতো ভাব নেয়ার কিছু নেই। আর বাই দ্য ওয়ে, কেউ একজন আমাকে আজ সকালে বলেছিলো। সে নাকি এতো লজ্জাবতী নয়?’ কথাটা বলে একটা গাঁ জ্বালা হাসি দিলো সৌমিক। মোহনার রাগে পিত্তি জ্বলে উঠলো। কী যে হলো! সে তাৎক্ষণাক ভয়ঙ্কর একটা কাজ করে বসলো।

চলবে…..
©ফারজানা আহমেদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here