ঝরাপাতার দিনগুলি পর্ব ১৫

#ঝরা পাতার দিনগুলো
#পান্না হাবিব

পর্ব -১৫

ঈদের পরের দিন সকালে নাস্তা বানিয়ে সবাইকে ডাকছি খাওয়ার জন্য আর একটা ট্রেতে খাবার রেডি করছি। কে যে স্যাক্রিফাইস করবে তার তো ঠিক নাই। রান্নাঘর থেকে এসে দেখি সাব্বির আর রিশাদ একসাথে টেবিলে বসে আছে। বাহ আজকে কারোরই স্যাক্রিফাইস করার মুড নাই দেখি!!
আম্মু আব্বু এদের দুজনকে একসাথে দেখে খাওয়া বাদ দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। যাক একসাথে টেবিলে খেতে তো বসছে।
সকাল ১১টা করে আবার রিতু আপু আসছে মেয়ে আর হাসবেন্ড কে নিয়ে। কি খুশি সবাই। ইশ আমাদের বাসায়ও প্রতি ঈদে এমন হতো। ভাইয়ারা সবাই গ্রামে ঈদ করতে চলে আসতো।
বরাবরের মতো এইবারও নিশ্চয়ই বড়ো আপু আর সেজো আপু ঈদের দিন বিকেলে চলে আসছে।

রাতে রিতু আপুরা খাওয়া দাওয়া করে চলে গেলো।
“কালকে তুই আর সাব্বির যেয়ে তোদের বাড়ি থেকে ঘুরে আয়। আর পরেরদিন রিশাদ যেয়ে তোদেরকে নিয়ে আসবে। এর পরের দিন তো চলেই যাবি তুই। কালকে না গেলে কখন যাবি আর” আম্মুর এমন কথায় খুশিতে গতরাতের ওর ফ্রেন্ড আসার কথা ভুলে গিয়েছি।

রাতে সাব্বিরও এই নিয়ে কিছু বলেনি। সারা রাত খুশিতে ঘুমও হয়নি ঠিকমতো। খুব ভোরে উঠে ব্যাগ গুছিয়ে রেডি হলাম। সাব্বিরের কোনো খবরই নেই। জেগে আছে ঠিকই। ইচ্ছে করে এমন করছে। এতো রাগ উঠতেছে ওর উপর।
-কারো যেতে ইচ্ছে না করলে রাস্তা পর্যন্ত দিয়ে আসলেই হবে।আমি যেতে পারবো একা একা।
অনেকটা রাগের স্বরেই বললাম।

একটু পর মাঝ রাস্তায় এসে সত্যি সত্যি গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো!!!
এতো কস্ট হচ্ছিলো। সাথে খুব বেশি টাকাও নেই। কাটায় কাটায় ৪০০ টাকা আছে। সবাই মনে হয় ভুলেই গিয়েছে যে আমিও একটা মানুষ আর আমারও টাকার দরকার হতে পারে। যাই হোক এইবার গিয়ে মেজোভাই থেকে টাকা নিবো। কারোর তো অন্তত জানা উচিত কি হচ্ছে আমার জীবনে। টাকা সেইফ করার জন্য লোকাল বাসে করে গুলিস্তান পর্যন্ত আসলাম। ঈদ উপলক্ষে বাস ভাড়াও বেশি।
গুলিস্তান থেকে বাসে উঠলাম। আরও দুইবার গাড়ি চ্যাঞ্জ করতে হবে। আল্লাহ আল্লাহ করছি যেনো টাকার জন্যে কোনোখানে বেইজ্জতি হতে না হয়।
ইশ বাড়িতে কতো পিচ্চিগুলো আছে। কারোও জন্যে কিছু নিতে পারলাম না। নাহ এইবার বাড়ি যেয়ে সবাইকে সব কিছু খুলে বলবো। আর কতো সহ্য করবো। আমার কি ঠেকা পরছে। হাবিজাবি চিন্তা করতে করতে বড়ভাবি কে একটা ফোন কর‍তে ভুলেই গিয়েছিলাম। আরে ধুর আমি তো একাই যাচ্ছি। ফোন না করলেই কি হবে।

রিকশা থেকে নেমে বাড়ির পিছন দিক দিয়ে পুকুরপাড় হয়ে ঢুকলাম। কেমন শান্ত মনে হচ্ছে বাড়িটা। এইরকম লাগছে কেনো। মানুষ জন কই সব?
তিনটা ঘরের দুটোই বন্ধ দেখছি। সবাই একটা ঘরে কি করছে ভাবতে ভাবতে এসে দেখি দরজায় বিশাল সাইজের একটা তালা ঝুলছে!!!

এতোটা কস্ট মনে হয় আব্বু যেদিন মারা গিয়েছিল সেদিনও পাইনি। নিজের মাথার উপর ছাদ হারানোর কস্ট এতোটা বেশি হয় জানলে কখনো বিয়েই করতাম না।
কাঁপা কাঁপা হাতে বড় ভাবিকে ফোন করলাম
-ভাবি কি অবস্থা।
-এইতো ভালো মেহের। তোমার কি অবস্থা।
-ভালো। কোথায় আছো এখন।
-এইতো বাবার বাড়িতে চলে আসছি। তুমি চিটাগং যাবে কবে?
-চলে যাবো ভাবি। মেজো ভাইয়া কই? আর আপুরা আসেনি এইবার বাড়িতে? ছোট ভাইয়া কই?
-তোমার মেজো ভাইয়া তো ঈদের আগের দিন এসে ঈদেরদিন বিকেলেই চলে গিয়েছে শশুরবাড়ি। আর আপুরা কেউ আসেনি এইবার। অনেক করে বলছিলাম আসতে।
-ভাবি ছোট ভাইয়া কই?
-ওরে তো বলছিলাম আমার সাথে চলে আসতে। ছেলে মানুষ কই খাবে। ওতো বললো বড় আপুর বাসায় চলে যাবে।
-ও আচ্ছা। ঠিক আছে ভালো থাইকো।

আমি আর বলিনি আমি এসেছি বাড়িতে এসেছি।
ধপাস করে দরজার সামনে বারান্দায় বসে পড়লাম। চোখ দিয়ে অনবরত পানি পরছে। দোষ তো আমারি। আমি তো কাউকে ফোন দিয়ে আসিনি। ঈদের দিন ছাড়া কারো সাথে কোন যোগাযোগও হয়নি।

হঠাৎ একটা কথা মনে পরতেই বারান্দায় শেষ পিলারটার উপরের দিকে একটা খাজে খুজতে যেয়েই ঘরের চাবিটা পেয়ে গেলাম। চাবিটা হাতে নিয়েই বারান্দায় বসে কান্নায় লুটিয়ে পড়লাম। আম্মু সবসময় এইখানে আমাদের ছোট দুই ভাইবোনের জন্যে চাবি রেখে যেতো। আমি আর ছোট ভাইয়া হঠাৎ হঠাৎ এসে আম্মু আব্বুকে সারপ্রাইজ দিতাম। আমি আসতাম চিটাগং থেকে আর ও আসতো ঢাকা থেকে।

আজকে চাবিটা ঠিকই আছে কিন্তু কোন মানুষজন নেই। আর এই ঘর ছাড়া আমার এখন যাওয়ার কোন জায়গাও নেই। দুনিয়াতে এতো অসহায় নিজেকে কখনো মনে হয়নি।

কি করবো ভাবতে ভাবতে ঘরে ঢুকলাম। আম্মু আর আব্বুর জামা কাপড় জড়িয়ে ধরে শুয়ে পরলাম বিছানায় যেখানে আম্মু আর আব্বু থাকতো।

কখন ঘুমিয়ে গিয়েছি টেরই পাইনি। উঠে দেখি বিকেল হয়ে গিয়েছে। বাড়ির এরিয়া বিশাল আর বাউন্ডারি থাকায় আশেপাশের মানুষ এখনো টের পায়নি যে আমি এসেছি। অনেক খুজে বিস্কুট ছাড়া খাওয়ার কিছু পেলাম না। সন্ধ্যা করে আব্বু আর আম্মুর কবরের মাঝখানে গিয়ে শুয়ে পরলাম। আমার সবথেকে শান্তির জায়গাটা এমন জায়গায় যেখানে সাধারণত মানুষ আসা যাওয়া করে না। সব মানুষ কবরস্থানকে ভয় পায়। কিন্তু আমার জন্যে এর থেকে শান্তির জায়গা আর নেই।
কতো হাসি কান্নার কথা বললাম আম্মু আব্বুর সাথে!!!! আমার কস্ট বোঝার জন্য মনে হয় এরা বাদে কেউ নেই!! দায়িত্ব পালন করলেই সব কি শেষ হয়ে যায়??

মনে মনে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি আর এই দেশে থাকবো না। খুব তারাতাড়ি এই দেশ ছেড়ে চলে যাবো। যেখানে সব প্রিয় মানুষগুলোই আমাকে ফেলে চলে গিয়েছে সেখানে থেকে কস্ট পাওয়ার কোন দরকার নেই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here