#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||২০তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
“আপনার হাজব্যান্ডের একাধিক ডিজঅর্ডার আছে। এমন মানুষের সাথে আপনি এত বছর ধরে সংসার করছেন তা-ই ভেবে পাচ্ছি না।”
অরবিন্দ ভট্টাচার্যের কথা শ্রবণগত হতেই হচকচিয়ে উঠল সবাই। বিশেষ করে বাসন্তী। এমনটাও শুনতে সে চায়নি। মূলত অনিমেষের কথার দ্বারা তার মনে ক্ষীণ আশার সঞ্চার হয়েছিল। যে নায়িম আর আট-দশটা স্বামীর মতোই হবে একটু চিকিৎসা পেলেই।
“এসব কী বলছেন আপনি আঙ্কেল? নায়িম তো একদম স্বাভাবিক। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজি, মার্জিত, মাদকদ্রব্য থেকে দশ হাত দূরে থাকে, শিক্ষিত একজন শিল্পী; তবে ও কীভাবে…?”
মৃদু হাসলেন অরবিন্দ ভট্টাচার্য।
“নায়িমের ওসিডি আছে। ওসিডি বলতে ওবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার। এই যে বললেন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজি, মাদক সেবন করে না এর দ্বারা সে নিজেকে পার্ফেকশনিস্ট হিসেবে রাখতে চায়। এই রোগীরা সাধারণত মাত্রাতিরিক্ত পরিষ্কার, পরিপাটি চায় সবকিছু। ধরেন চামুচের জায়গায় চামুচ না রেখে ভুলবশত ঘরে রাখলেন, দেখে পুরো ঘর উদ্ধার করে ফেলবে। ভায়োলেন্টও হতে পারে। নায়িম তো বোধহয় হয়ও।
নায়িমের নিশ্চিত অপরিষ্কার মানুষ একদম পছন্দ নয়। আপনাদের কথায় মনে হচ্ছে পবিত্রতা এই টার্মটাও নায়িমের একটা অবসেশন। সে চায় সবকিছু পবিত্র থাকুক। দেখবেন যখনই নায়িমের মনে হবে কিছু অপরিষ্কার বা অপবিত্র হয়ে গেছে তখন তাকে বারবার পরিষ্কারের প্রয়াস করবে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধুবে।”
শেষ করতেই শব্দ করে কেশে উঠেন তিনি। ইদানীং যেন সর্দি বেড়েই চলেছে। তাঁর কথায় বাসন্তীর মনে পড়ে যায় এসকর্ট সার্ভিস থেকে ছাড়া পাওয়া দিনটি। যখন জ্ঞানহারা হওয়া অবধি নায়িম তাকে বাথটবে রেখেছিল।
“আর মিসেস খান? আপনার স্বামী আপনাকে মাত্রাতিরিক্ত পজেজিভ বা প্রোটেক্টিভ কেন? বেশি ভালোবাসে বলেই। তাহলে তো অনিমেষ তোমাকেও তোমার বন্ধু বড় বেশিই ভালোবাসে। তাই তো এত বছরেও কারো সাথে বন্ধুত্ব করতে দেয়নি।” হেসে উঠেন তিনি। অনিমেষ একটু লজ্জাই পায় এমন রসিকতায়।
“বাঙালিদের এক অভিমত হলো যারা বেশি ভালোবাসে, তারাই না কি সন্দেহ করে, মাত্রা ছাড়া পজেজিভ হয়। আসলে যা হয় তা হলো, তারা মানসিক রোগী বৈকী কিছুই নয়। আপনার স্বামীর একটা অবসেশন আপনি নিজেও। তাই-ই আপনাকে নিয়ে এত সীমাহীন সতর্কতা তার।
আর আপনার স্বামীর এমন সন্দেহপ্রবণ আচারণ করার কারণ কী জানেন? উনার ডিলিউসন্যাল জ্যায়ালসি ডিজঅর্ডার আছে। এটাকে ওথেলো সিন্ড্রোম বা মরবিড জ্যায়ালসিও বলে। ইট’আ সাইকোলজিকাল ডিজঅর্ডার, যেটাতে কোনো প্রমাণ ছাড়াই সর্বক্ষণ মানুষ ভাবে তার পার্টনার বা স্পাউজ বা ফিয়ন্সেকে সন্দেহ করে। তাদের প্রেমনিষ্ঠা নিয়ে সন্দেহ ভাবনা তাদের মনে আসে। ভয়ে থাকে প্রিয় মানুষ হারানোর। কোনো পুরুষের সাথে কথা তো দূরে থাক দেখলেই… যেমনটা নায়িমের ক্ষেত্রে হয়।”
“সরি টু ইন্টারাপ্ট। আমার অনেক পরিচিত মানুষ আছে যাদের ওসিডি এবং সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স আছে। তারাও ভায়োলেন্ট হয়। কিন্তু নায়িমের মতোন এমন হিংস্র বা অমানবিক কাউকে হতে দেখিনি। এত রাগ বা নিয়ন্ত্রণ হারা হওয়া কেন? এটা কি ডিলিউসন্যাল জ্যায়ালসির জন্য।”
“নায়িমের ইন্টারমিটেড এক্সপ্লোসিভ ডিজঅর্ডারও আছে। এজন্যই ফ্রাস্টেশন সহ্য করার ক্ষমতা শূণ্যের কোঠায়, সহ্যক্ষমতা কম বা নেই, অল্পতেই রেগে যায়। আগুনের মতো ছাড়খাড় করে দেওয়া, ঠিক-বেঠিক জ্ঞানবোধ হারিয়ে ফেলা অন্ধ ক্রোধ, নিয়ন্ত্রণহীন বোধ করা এর কারণেই। এই ডিজঅর্ডারটি মূলত এবং সাধারণত একটি কারণেই হয় তা হলো এবিউসিভ চাইল্ডহুড। মানে ছোটবেলায় কোনো অত্যন্ত ভয়াবহ শারীরিক বা মানসিক বা শাব্দিক আঘাত পাওয়া।”
বলে ভ্রু কুঁচকে তাকান তিনি। বাসন্তী বিনীত সুরে প্রশ্ন করে,
“সুস্থ হবেন তো উনি? কোনো উপায় নেই?”
“অবশ্যই আছে। তবে তার জন্য একান্তই নায়িমের সহযোগিতা প্রয়োজন। আর আমার একটা সন্দেহ আছে যে নায়িমের ওএলডি আছে। অবসেসিভ লাভ ডিজঅর্ডার মানে এমন একটি কন্ডিশন বোঝায় যেখানে আমরা একজন ব্যক্তির প্রতি অবসেসড হয়ে পড়ি আর মনে হয় যে আমি তাকে ভালোবাসি।”
“না, না, নায়িম তো সবসময় বলে যে ও ভাবীকে ভালোবাসে না।” বলেই জিভে কামড় দেয় অনিমেষ। আড়চোখে বাসন্তীর দিকে তাকায় সে। মেয়েটি অবিশ্বাস্য চাহনির সহিত তাকে দেখছে।
“তবে ভালোই।”
ঘোর ভাঙল অনিমেষ ও বাসন্তী দুজনেরই। ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে পড়ল তারা।
বাসন্তীর মনটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে পড়ছে। তবুও নিজেকে জুড়ে রেখে মনকে মিথ্যে আশা দিচ্ছে বারবার।
– না, না, এমন হতে পারে না। নায়িম তো আমাকে কত্ত ভালোবাসে! কত খেয়াল রাখে আমার! উনার সমস্যা বলেই সব রাগারাগী, অত্যাচার। কিন্তু ভালোবাসে তো।
মনে মনেই তার সব ভাবনা, বোঝাপড়া। এত বছর এত অমানবিক অত্যাচার সহ্য করার কারণ কী? শুধুমাত্র একটু ভালোবাসা পাওয়া, প্রকৃত ভালোবাসা, দেবদাস উপন্যাসের পাতায় পাতায় যে ভালোবাসার আভাস পাওয়া যায়, সেই ভালোবাসা। জীবনে কারোরই তো ভালোবাসা পাওয়া হয়নি। বাবার পর নায়িমই একমাত্র ব্যক্তি যে তাকে ভালোবেসে কাছে টেনেছিল। এই একমাত্র মানুষটিকে যাতে খোয়াতে নাহয় তাই-ই তো দাঁতে দাঁত চেপে সব সয়েছে।
নিজেকে শূণ্য মনে হচ্ছে বাসন্তীর। সে এমন নারী যে কি না চিকচিকে সোনা ক্রয়ে টাকা বিলিয়েই গেছে, অথচ নেওয়ার সময় দেখে থলি ভর্তি বালু।
অনুভূতির টানাপোড়নে তার একবার মনে হলো অনিমেষকে প্রশ্ন করবে। তবে জানে তার উত্তর হবে মিথ্যে, অশুদ্ধ কিংবা উত্তরই পাবে না। শুধু শুধু আর শব্দ খরচ করবে কেন ভেবেই চুপ থাকল। নিকাবের আড়ালে ভাঙাচুরা নারীটির অনুভূতি আর কারো জানা হলো না।
___
বেডরুমে বিছানায় বসে বসে ফল কাটছে বাসন্তী। নায়িম দেখেই বিরক্ত এবং রাগান্বিত হলো।
“তোমাকে না কত্তবার বলসি যেখানে যেটা করার সেখানে সেটা করবা। এটা কী ফল কাটার জায়গা? কীচেনে যাও! যত্তসব!”
“আপনি কি আমাকে ভালোবাসেন?”
বেফাঁস প্রশ্ন বাসন্তীর। চোখে-মুখে কৌতূহল, বেদনার ছাপ, উত্তেজনা স্পষ্ট।
নায়িম আকস্মাৎ এমন প্রশ্নের কারণ বুঝল না। বরং, আরও বেশি বিরক্ত হলো।
“কী সব আজাইরা প্রশ্ন? কীচেনে যাও।”
“বলেন না সত্যি করে, আপনি আমাকে ভালোবাসেন?”
“হ্যাঁ, বাসি। হইসে? আর শুরু করসোটা কী তুমি? আমি কিন্তু রেগে যাচ্ছি।”
বাসন্তীর দিকে তাকাতেই চমকে উঠে সে। রমণী নিজ গলায় ছুড়ি ধরে বসে আছে। তার চোখে অশ্রু, চোখজোড়া জ্বলজ্বল করছে। তাতে অন্যরকম এক জেদ দেখতে পাচ্ছে আজ নায়িম।
“সত্যি করে বলেন ভালোবাসেন না কি? নাহলে এই ছুড়ির আমার চামড়া ভেদ করতে সময় লাগবে না। মিথ্যে বলবেন না দয়া করে। আমি সত্য জানতে চাই।”
শুকনো ঢোক গিলে নায়িম। ভয় হচ্ছে তার, অতিরিক্ত ভয়। যে ভয়ে মিথ্যে বলার জ্ঞান থাকে না।
“বাসি না, বাসি না ভালো। এখন প্লিজ ছুড়ি নামাও। লেগে যাবে বসন্ত। ভয় হচ্ছে আমার।”
বাসন্তীর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। সে শুধুই বিড়বিড়ায়,
“চলে যান। একা ছেড়ে দিন আমায়। চলে যান।”
“আমি যাচ্ছি। তুমি প্লিজ নিজের কোনো কোরো না।”
ভীতিগ্রস্ত যুবক ধীর ধীর পায়ে ঘর ছাড়ে। বাসন্তী স্তব্ধ হয়ে সেখানেই বসে। ভাবছে,
– তার ভালোবাসার ঘর তবে মিথ্যে ছিল? কী করবে এখন? কোথায় যাবে? কীভাবে ভালোবাসার খোঁজ পাবে?
___
“মর্নিং, মাই হাবি। একটা কিস্যি দেও তো মর্নিংটা গুড, বেটার, বেস্ট করতে।”
ঘুমুঘুমু চোখে পরিচিত নারী কণ্ঠে এ কথা শুনতেই হুড়মুড়িয়ে জেগে উঠে নায়িম। অস্পষ্ট ভাবে বলে,
“বসন্ত!”
আর কিছু বলতে পারে না তার আগেই যে একঝাঁক কোমল বোলতা তার অধর ছুয়ে দেয়। সে কী বিষধর ছোঁয়া! স্পর্শ শেষে বাসন্তী চোখে চোখ রেখে শুধায়,
“তোমার হৃদয়ের বিষ শুষে নিচ্ছি প্রিয়তম। তোমার সবটুকু বিষ আমায় দিয়ে দাও, আমার ভালোবাসা টুকু তুমি গ্রহণ করে নেও।”
নায়িমের মাথা স্তব্ধ হয়ে গেছে। বাসন্তীর দ্বারা এমন আচারণ কিছুতেই সম্ভব নয়। তাহলে সে স্বপ্নই দেখছে। অন্যরকম বসন্তের স্বপ্ন।
চলবে…