টক্সিক_রিলেশনশীপ পর্ব ২১

#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||২১তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
নায়িমের চিন্তার মাঝেই কামড় পড়ে ঘাড়ে। সূক্ষ্ম ব্যথায় গা শিউরে উঠে। না কি কিছু অন্যরকম অনুভূতির দরুণও এই শিহরণ কে আর জানে?

“হোয়াদ্দা হেল!”
সামনে তাকাতেই মুখে তালা লাগে যুবকের। সেই একই নারীমূর্তি চাপা হাসছে তাকে কামড়ে। তাহলে কী বাস্তব সবই!

“উঠো না নায়িম! আজকে আমাকে রান্নায় হেল্প করবে, বুঝলে? চৈতালি আপুর শরীর খারাপ রাত থেকে… আমি একা একা ওত কাজ কী করেই বা সামলাব?”

নায়িম ড্যাবড্যাব করে দেখেই যাচ্ছে নিজের বসন্তকুমারীকে। এ কোন রূপ দেখাচ্ছে আজ তার একান্ত নিকটবর্তী নারী? গতকাল রাতে বাসন্তী প্রশ্নবিদ্ধ করার পর সে যখন শুতে আসে বাসন্তী তখন তন্দ্রায় ডুবে। তা দেখে কোনো কথা ছাড়াই সে একপাশে ঘুমিয়ে পড়ে।

“কী হলো? উঠো! আজব তো!” কাটখোট্টা কথাবার্তা বাসন্তীর।

চিন্তায় ভাটা পড়ে যুবকের। যুবতীর হাবভাব তার নিকট ভালো ঠেকছে না। ভাবে,

– কষ্ট পেয়ে পাগল হয়ে যায়নি তো এই মেয়ে?

“তুমি ঠিক আছো বসন্ত? এসব নিয়ে কষ্ট পাওয়ার কী আছে? দেখো আমি তো তোমার সাথেই আছি, থাকব। অন্যকেউ তোমার জায়গা নিতে পারবে না আমার জীবনে। তুমিই একমাত্র নারী থাকবে যে আমাকে গভীর ভাবে ছুঁয়েছে, ছুঁবে।”

তার সান্ত্বনায় যেন আরও ভড়কে গেল বাসন্তী। মনে মনে বলে,
– ওরে পাগল, বলোস কি না আমি পাগল?

“কী সব আজাইরা কথা লাগায় দিয়েছো? উঠো তো বিছানা থাকে। কিছু তো করো না, খালি প্যানপ্যানানি আর ঘ্যানঘ্যানানি। আমার হয়েছে আচ্ছা জ্বালা।”

ঠিক সেই মুহূর্তের মায়ের চেঁচানোর আওয়াজে সশব্দে কেঁদে উঠল নায়িমের পাশে শুয়ে থাকা নাহিবা। নায়িম হুড়মুড়িয়ে উঠে কোলে নিয়ে শান্ত করতে শুরু করল তাকে।

বাসন্তী বাবা-মেয়ের ভালোবাসা দেখে আলতো হাসল। তারপর বিছানা গুছাতে লেগে পড়ে।

“ওকে আমার কোলে দেও, আর তুমি ওর ট্রলিটা নিয়ে আসো। যেটা অনিমেষ ভাইয়া গিফট্ করসে সেটা আনবা, তোমার কেনাটা না।”

অত্যন্ত স্বাভাবিকতার সাথেই আদেশ করল বাসন্তী, যেন এমনটা কারো জন্যই নতুন না। নায়িমকে কিছু বলতে না দিয়ে নাহিবাকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে। তার চোখেমুখে ব্যস্ততা ও প্রয়োজনের অধিক স্বাভাবিকতা।

নায়িম হাত-মুখ ধুয়ে, একদম পরিপাটি হয়ে ট্রলি নিয়ে ড্রইংরুমে আসলো। বাসন্তী তখন ভাজি করার জন্য গাজর কাটছে।

“এসেছেন মহারাজ? বেশ তাড়াতাড়িই এসে পড়েছেন মনে হলো। আরও আধঘণ্টা পর আসতেন ট্রলি নিয়ে।”

নায়িম এতক্ষণ না রাগলেও বাসন্তীর এমন বিদ্রূপমাখা কথায় বেশ রাগান্বিত হয়ে উঠল।

“এবার কিন্তু বেশ বাড়াবাড়ি করছো বসন্ত! মেজাজ খারাপ করে ফেলছো।”

তার এই ক্রোধ ঠাহর পেল না বাসন্তীর কাছে। বরং, বেশ রসকষহীন জবাব রমণীর।

“রান্নাঘরে যান, রাতের বাসন পড়ে আছে কয়েকটা। একটু সাহায্য করো আমায়।”

বসন্ত কুমারীর এমন খামখেয়ালিপনা আর সহ্য হচ্ছে না নায়িমের। ক্রোধে দেহের সর্বশক্তি দিয়ে সোফায় লাথি মারে নায়িম। বাসন্তী জোরালো শব্দে কেঁপে উঠলেও প্রতিক্রিয়া নেই। এ যেন ঘি হয়ে পড়ে নায়িমের ক্রোধের অনলে।

বাসন্তীর দিকে ঝুঁকে গাল চেপে ধরে তার।

“বেশি বাড় বাড়িস না, জানে মেরে ফেলব।”

“তোমার হাতে মৃত্যুও অমৃত প্রিয়। বিষাদে মরণ হয়েছে কতবার, কিন্তু আফসোস সেই ভয়ানক বেদনার মৃত্যু তোমার নজরে পড়ল না।”

চাকু সামনে আনে বাসন্তী। নায়িম খাণিক সরে যায়।

“তোমার হাত নোংরা করবে কেন প্রিয়? আমিই নাহয় তোমার কাজ সহজ করে দেই।”

বলে যেই না গলায় ছুড়ি ঠেকাতে যাবে তখনই নায়িম ছুড়ি ছিনিয়ে নিয়ে সজোরে আছাড় দেয় মেঝেতে। চুলের মুঠি চেপে রিনরিনে সুরে শুধায়,

“পেয়েছোটা কী তুমি? সবসময় এই ছুড়ি ছুড়ি খেলা…! আমাকে পোষ মানাতে চাও তুমি? আমাকে? আমি সেই ছেলে না।”

ব্যথা লুকিয়ে শব্দ করে হেসে উঠে বাসন্তী।

“তুমি বুঝি কুকুর পোষ বানাব তোমায়? আমি তো তোমায় জয়ী করে তোমাকে জয় করতে চাই। আর কতবার ছুড়ি ছিনিয়ে নিবে আমার, এক ফাঁকে একা করেই দিব তোমায়।”

ধাক্কা দিয়ে বাসন্তীকে সরিয়ে দেয় নায়িম। টেবিলে থাকা সবকিছু ছুড়ে ফেলে দেয় মেঝেতে। ফ্রাস্টেশনে মাথায় দাউদাউ করে ক্রোধানল জ্বলছে তার। নিজের মাস্ক আর চশমা বের করে নেয় ড্রয়ার থেকে।

“এই বা*র ঘরে থাকবই না আমি! তুই আমার সাথে বাহাদুরি করোস? আমিও দেখব তোর এই সাহস কতক্ষণ থাকে। আসলে তোরা সব মেয়ে এক পদের, সব দাস বানাইতে চাস ভালোবাসার নামে। এইজন্যই ভালোবাসি নাই তোরে কখনো।”

কথাটা কানে ঢুকতেই অস্থির হয়ে পড়ে বাসন্তী। ছুড়ি তুলে নিয়ে এক পা এক পা করে এগিয়ে যায় নায়িমের দিকে।

“যুবক, বল ভালোবাসি, অধরে দে ভালোবাসার ছাপ। তা নাহলে মুক্তি দিব? এক ধরণী দিব আমি বিহীন, সুখী হ না তুই আমি হীনা হয়ে। না করেছে কে বা?”

দৃঢ় কণ্ঠ তার। নায়িম খেয়াল করল বাসন্তীর চোখে আজ অন্যরকম জেদ, অটলতা। তাকে কেন যেন প্রভাবিত করল তা। বাসন্তী তার অমূল্য রতন, যে রতন জীবনে একবারই পায় মানুষ। তাই হারাতে দেওয়ার সুযোগ নেয়। অধরে শুষ্ক এক ছোঁয়া দিয়ে। অনুভূতিহীন ‘ভালোবাসি’ উচ্চারণ করেই ঠাশ করে দরজা লাগিয়ে বের হয়ে যায় সে।

বাসন্তীর চোখে অশ্রুময় তৃপ্তি। সে আপন মনেই বিড়বিড়ায়,

“আমার সবটুকু আবেগ, সুখ, অনুভূতি নিংড়ে দিয়ে বেদনা, কষ্ট, অবজ্ঞা, অপমান মাথা পেতে নিয়েছি তোর ভালোবাসার বিনিময়ে প্রিয়। আর তুই কত সহজেই বলে দিলি ভালোবাসিস না। আমিও ভেবে নিয়েছি তোর ভালোবাসা আমি ছিনিয়ে নিবই, নিব!”

___

– কেন এতো বিষের বিক্ষোভ জ্বেলে তনুতে পরানে
বার বার কষ্টের করুন হার কণ্ঠে তুলে নাও?
কেন এতো কষ্ট পাও, কেন এতো কষ্ট পাও তবে?

সারা রাত্রি হেঁটে এসে শেষে যদি না পেলে সকাল
তবে এই জাগরন কেন, কেন এই হেঁটে আসা
দুঃখময় কুয়াশার রাতে? কেন তবু শুশ্রূষার দিকে ছুটে ঘৃনাকে হারানো?

যেদিকে ফিরেছে মন সেইদিকে ফেরাও নিজেকে।(রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ)’

বিষাদ মনে কবিতাটি আবৃত্তি করে যাচ্ছে চৈতালি। সে সাহিত্যানুরাগী মেয়ে নয় মোটেও। তবে কবিতা আবৃত্তির প্রতি একটা ঝোঁক আছে, বিশেষ করে রুদ্র বাবু আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা আবৃত্তির দিকে।

এই কবিতাগুলোর মাঝে অন্যরকম এক শক্তি আছে, যা প্রেমে না পড়েও তার মাধুর্যতার আভাস দেয়, বিরহবেদনা না পেয়েও বিরহের দমবন্ধ অনুভূতি বোধ করায়।

“বেশ ভালো আবৃত্তি করো তো তুমি আপু। থামলে কেন?”

চৈতালি সচকিত হয়ে চোখের অশ্রু মুছে নিয়ে বাসন্তীর দিকে ঘুরল। তার জন্য নাস্তা নিয়ে এসেছে সে। অন্যান্য দিনের চেয়ে আজ বহু বেশি দ্বিধাহীন লাগছে মেয়েটিকে।

“শুধু শুনেই গেলে মনে আর নিতে পারলে না।”

“মানে?”

“সারা রাত্রি হেঁটে যদি সকালই না পাও, তবে কেন এই জাগরণ বা হেঁটে আসা? কেন এত কষ্ট সয়ে নেওয়া? ভালোবাসা কি তবুও পেল?”

“আমার মা-বাবার যখন তালাক হয় তখন আমার বয়স মাত্র দশ। সেই তালাকের পর থেকে একটা মুহূর্ত শান্তির পাইনি, কেউ কখনো ভালোবাসেনি। মা তো মারতই, আবার যে যখন মন চাইত গায়ে হাত তুলত। খুব লাগত বুঝলে? মায়ের মার সহ্য করা যায়, তার শাসন করার অধিকার ভালোবাসার সাথে, কিন্তু ভালোবাসা বিহীন শাসন…?

মাটাও না কোনোদিন এই বাবা ছাড়া মেয়েটিকে আদর করেনি। আমি বড় বেশিই তৃষাতুর ছিলাম শুধু একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য এবং নিজের সবটুকু ভালোবাসা দেওয়ার জন্য। আফসোস কেউ নেয়নি, কেউ দেয়নি, নায়িম ছাড়া। তার মার-ধর সব সহ্য করতে ঐ যে দিনশেষে তার দুটো প্রেমময় কথা, আদর-সোহাগ, আমার অসুখে যত্ন পেতাম। ভালোবাসিও তো বলত, হয়তো মিথ্যেই।

তবুও কেউ ভালোবাসার ছিল, কপট হলেও। আমার ভালোবাসার তৃষ্ণা আমাকে বাধ্য করেছিল সব মেনে নিতে। তাছাড়া যেতামই বা কোথায়? কেউই তো নেই আমার।” থেমে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল সে।

চৈতালি ভাবল,
-মেয়েটা আসলেই আজ কেন যেন দ্বিধাহীন, শক্ত।

“আমি তো আমিই, বোকাসোকা এক তৃষ্ণার্ত নারী। তুমিও তো শুধু কবিতা বলেই গেলে মনে লাগালে না। ‘যেদিকে ফিরেছে মন, সেইদিকে ফিরাও নিজেকে’, তোমার মন কি সত্যিই এইদিকে? না কি পড়ে আছে সেই ছোট্ট দুই রুমের স্বস্তা ফ্ল্যাটে কম আয়ের মানুষটার সাথে? ভালো আছো তো তুমি? সত্যিই ভালো আছো?”

বাসন্তী চৈতালির হৃদয়েকথার বিষ মাখা তীরে ছুড়ে দিয়ে আর একদণ্ড দাঁড়াল না, বের হয়ে গেল। নির্দয়ের ন্যায় একবার তাকিয়ে দেখলেও না তার তীরে কতটা তড়পাচ্ছে লাস্যময়ী তরুণীটি।
Next:

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here