ডায়েরি পর্ব ১২

#ডায়েরি_পর্ব_১২

জান্নাতুল জান্নাত

৯ই জানুয়ারি রাত ১২:৪৫ মিনিট

তনুর চিঠিটা পেয়ে ক্ষণিকের জন্য পাথর হয়ে গিয়েছিলাম৷ তাহলে তপুর সেদিন হঠাৎ করে উধাও হওয়ার কারণ ছিলো এটা? কিন্তু তপু তৃপ্তির বিষয়ে তো আমার সাথে আলোচনা করতে পারতো৷ তবে কি ও তৃপ্তি আর ওর বিষয়ে ভয় পেয়েছিলো? তাই সেদিন আমাকে মন্দিরে নিয়ে বিয়ে করেছিলো? হায় ঈশ্বর ছেলেটা এতোখানি কষ্ট মনে চেপে রেখেছিলো? কেন আমাকে বললো না? তবে কি ওর বন্ধু সেদিন এই মেয়ের কথা বলেছিলো? আর এতোটা কাকতালীয় বিষয় কি করে হলো? তৃপ্তির মেয়ের নাম তনিমাই রাখতে হলো? অন্য নাম হলে হয়তো আমার সন্দেহ এতোটা দৃঢ় হতো না৷ সারাটাজীবন ছেলেটাকে ভুল বুঝেই গেলাম৷ এই ভুল বোঝাই তো আমার জীবনটাকে এখানে এনে দাঁড় করলো৷ তপু এয়ারপোর্ট থেকেই ওর বাড়ি চলে গিয়েছিলো৷ তনিমা ঠিকানাটা ডায়েরির মাঝে রেখেছিলো৷ আর অপেক্ষা করলাম না৷ তখনই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম৷ আজ আর সাথে ড্রাইভার নিলাম না৷ নিজেই ড্রাইভ করছি৷ যেতে যেতে ভাবছি
“তপু তো বাসে যাবে৷ হয়তো ওর আগেই আমি পৌঁছে যাবো ওর বাড়ি৷”

ঘন্টা চারেক ড্রাইভিংএর পর তপুর বাড়িতে পৌঁছালাম৷ তখন পড়ন্ত বিকেল৷ তপু এখনও এসে পৌঁছায়নি৷ আমি সামনে সিড়িতে বসে অপেক্ষা করছি৷ ঘন্টাখানেক পর তপু এসে পৌঁছালো৷ আমাকে দেখেই ও অবাক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো
-অঞ্জু তুমি এখানে? কখন এলে?
আমি উত্তর না দিয়ে ওর কাছে এগিয়ে গেলাম৷ তপু একটু ইতস্তত করে দূরে সরে গেলো৷
-অঞ্জু এভাবে এগিয়ে আসছো কেন? কি হয়েছে তোমার?
-কিছু হয়নি৷ দরজা খোলো ভিতরে যাবো৷ বসবো৷ জল তেষ্টা পেয়েছে খুব৷ একটু জল খাওয়াবে?
-হ্যাঁ অবশ্যই৷ দাঁড়াও দরজা খুলে নেই৷

তপু দরজা খুলছে আমি ওর পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম৷ ও দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই আমিও ঢুকলাম৷ দরজা আটকে পিছন থেকে ওর হাত ধরলাম৷ তপু ঘুরে বললো
-কি করছো? হাতটা ছাড়ো৷
-কেন ছাড়বো? এ হাত ধরার পূর্ণ অধিকার আছে আমার৷ আমি তোমার স্ত্রী৷ মনে প্রাণে আমি তোমার স্ত্রী৷
-এ দিনগুলো আমাদের এখন আর নেই অঞ্জু৷ অনেক পিছনে ফেলে এসেছি সেসব দিন৷

এবার আমি তপুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম৷ এই প্রথম আমার শরীরে শিহরণ জাগলো৷ এই প্রথম কাউকে কাছে, খুব কাছে, আরো কাছে পেতে ইচ্ছে করছে৷
-কি করছো অঞ্জু ছাড়ো৷
-যা করছি ঠিক করছি৷ অনেক আগেই এটা করা উচিত ছিলো কিন্তু আমি করিনি৷ আচ্ছা তুমিই বলো আমি যে তোমার স্ত্রী তাতে তো মিথ্যে নেই৷ মা কালীর সামনে তুমি নিজ হাতে আমার সিঁথিতে সিঁদুর পড়িয়েছো৷ সেদিনই তো তোমার শরীরে মনে সবকিছুর উপর আমার অধিকার হয়েছে৷ আচ্ছা বলো তো আমি তোমার স্ত্রী হয়ে এ জীবনে কি পেয়েছি? একবারের জন্য তোমাকে কাছে পেয়েছি? আপন করে পেয়েছি? তাহলে এ বিয়েতে আমার কি লাভ হলো?

এবার আর তপু আমাকে ছাড়ানোর চেষ্টা না করে দু’বাহুতে আমাকে জড়িয়ে নিয়ে বললো
-কিসের লাভের আশা করো তুমি? আমি তো কোন লাভের আশা করে তোমাকে বিয়ে করিনি৷ তোমাকে ভালোবেসেছি বলে আমার কাছে বেঁধে রাখতে চেয়েছি৷ অঞ্জু তোমার মনে আছে তোমার সিঁথিতে সিঁদুর পড়িয়ে আমি কি বলেছিলাম?
-হ্যাঁ আছে৷ তুমি বলেছিলে “ভয় নেই অঞ্জু আমি তোমাকে ছোঁবো না৷ স্বামীর অধিকার ফলাতে আসবো না৷ শুধু একটা অদৃশ্য বন্ধন দিলাম তোমায়৷ তুমি যেমন ছিলে তেমনই থাকবে শুধু যদি অন্য কারো হতে যাও তখন তোমার মনে পড়বে আমি তোমার স্বামী৷ আমি যে তোমায় কালী মায়ের সামনে সিঁদুর পড়িয়েছি৷ অস্বীকার করার ক্ষমতা কি তোমার আছে?”
-তাহলে? তুমি কি মেনেছিলে আমার কথা? তুমি তো অন্য একজনকে বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি উঠলে৷ সেখানে আমার অস্তিত্ব কোথায়? তোমার কাছে কি এ বন্ধনের কোন মূল্য ছিলো?
-এভাবে বলো না তপু৷ হ্যাঁ ক্ষণিকের জন্য আমি ভুলে গিয়েছিলাম সত্যি কিন্তু তাও তো তোমার কারণেই৷ তোমার বন্ধু আমায় বলেছিলো তুমি বিবাহিত তোমার একটি মেয়েও আছে৷ একটা মেয়ে হয়ে অন্য একটা মেয়ের সংসার কি করে ভাঙি?
-মিথ্যে তো কিছু বলেনি সত্যিই আমি বিবাহিত ছিলাম৷
-আমি সব জানি তপু৷
-কি জানো তুমি?
-আমি জানি তৃপ্তি তনিমার বিষয়ে সবটা৷ সব জেনেই তো আমি ছুটে এসেছি তোমার কাছে৷

তপু আমায় ছেড়ে দিয়ে বললো
-কি করে তুমি জানবে? আমি তো কাউকে কিছু বলিনি৷
-আজ এয়ারপোর্টে তুমি দেখেছিলে তনু আমাকে কিছু একটা দিয়েছিলো? শুধু আমাকে দেখতে বলেছিলো৷
-হ্যাঁ৷
আমি ব্যাগ থেকে তনিমার দেয়া ডায়েরিটা থেকে চিঠিটা বের করে তপুর হাতে দিলাম৷
-পড়ে দেখো৷
তপু পড়ে বললো
-তনু? তনু কবে আমার ডায়েরি ঘেটেছে৷ কই কখনো তো আমাকে কিছু বলেনি৷
-মেয়েটা অনেক চাপা স্বভাবের৷ তুমি কখনো বুঝতেও পারোনি ওকে৷ অবশ্য আমিও পারিনি৷ আজ যাবার সময় এটা দিয়ে গেলো আমাকে৷

এবার তপু খাটে বসলো৷
-জানো অঞ্জু কিভাবে যে কি ঘটেছিলো আমি কিছু বুঝতেই পারিনি৷ মেয়েটা আমাকে বাবা ডাকতো৷ তৃপ্তি বহুবার বারণ করেছিলো কিন্তু আমারও ওর মুখে বাবা ডাকটা শুনতে ভালো লাগছিলো৷ এ ডাকটাই যে একদিন কাল হয়ে দাঁড়াবে বুঝিনি৷ আমি তোমাকে বারবার তৃপ্তির বিষয়টা বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু তুমি কিভাবে নিবে ভেবে আর বলতে পারিনি৷ তারপর তো হুট করে গ্রামের লোকেরা আমাদের বিয়ে দিয়ে দিলো৷ কি করতাম বলো তখন? পরিস্থিতি তো সামলাতে হতো৷ তোমার বাবার সাথে দেখা করার দিনও পার হয়ে গেলো৷ তোমার খবর নিয়ে জানতে পারলাম নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছো৷ আমার এই অপরাধী মুখ নিয়ে তোমার সামনে কিভাবে দাঁড়াবো ভাবতে ভাবতে তোমার বিয়ে হয়ে গেলো৷ তারপর জানলাম নায়িকা হলে৷ ভালোই আছো তুমি৷ দুই সন্তানের মা হলে৷ সেলিব্রেটি হওয়ার কারণে খুব সহজেই খবরগুলো পেতাম৷ তনুকেই নিজের মেয়ে ভেবে মানুষ করতে লাগলাম৷ হঠাৎ করে তৃপ্তি মারা গেলো৷ দু’বছর কোনরকম রাখার পর ভাবলাম ওকে হোস্টেলে দেই৷ তারপর তো তোমার সাথেই দেখা হলো৷
-এতোদিন তোমার সাথে আমার দেখা হয়েছে এর মাঝেও তো সব খুলে বলতে পারতে?
-পারতাম কিন্তু তা হতো তোমার সুখের সংসার ভেঙে দেয়া৷ এমনিতেই মেয়েটাকে নিয়ে তুমি আমায় ঋণী করে রেখেছো৷ এ ঋণ শুধবো কি করে তাই জানিনা৷ এর মাঝে আবার দুই সন্তানের মাকে কেড়ে নিবো কি করে?
-তপু আমি তোমাকে ভালোবাসি৷
-তুমি অভিনয় শিল্পী আমি জানি তাই বলে আমার সাথেও অভিনয় করোনা অঞ্জু৷
-আমি অভিনয় করছি না৷ আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি৷
-যদি বলি ঠেকে ভালোবাসছো আমাকে?
-তপু? এসব কি বলছো?
-হ্যাঁ, তুমি হয়তো বিবাহিত জীবনে সুখী নও৷ তাই হয়তো আমার কাছে শরীরের জ্বালা জুড়োতে এসেছো৷ এতোদিন ভালোবাসতাম তোমাকে আজ তোমাকে দেখে আমার করুণা হচ্ছে৷ অবশ্য করুণার চেয়েও বেশি ঘৃণা হচ্ছে আর হচ্ছে অনুশোচনা৷ শেষ পর্যন্ত আমি এমন একটা মেয়েকে সারাজীবন ধরে ভালোবেসে আসছি? যার নামে আমি দিন শুরু করি সে কিনা শরীরের প্রশান্তির জন্য ছুটে এসেছে আমার কাছে?
-তপু এবার থামো৷ অনেক বলে ফেলেছো৷ কথা বলার আগে সীমারেখাটা জানা উচিত৷ করুণা তো এখন আমারও হচ্ছে তোমার প্রতি৷ একটু আগেও যে মানুষটাকে ভালোবেসে আমি এতোদূর গাড়ি চালিয়ে এসেছি সে মানুষটা এতোটা নিচু মনের তা আমার জানাই ছিলো৷ আবারও ঠাকুর আমাকে কঠিনভাবে বুঝিয়ে দিলো আমি ভুল মানুষকে ভালোবেসেছিলাম৷ এই আমার প্রতি তোমার ভালোবাসা? ছিহ্৷
বলে দরজা খুলে বেরিয়ে আসলাম৷

সামনে অনেক মানুষজন৷ আমাকে সামনে দেখে সবাই আসছে একনজর দেখার জন্য কিন্তু আমার চোখে সমুদ্রের ঢেউ৷ মানুষের ভীড় ঠেলে কোনোমতে গাড়িতে উঠে স্ট্যার্ট দিলাম৷ যদিও দু’হাতে গাড়ি চালানোর শক্তি নেই তবুও চালাচ্ছি৷ অনর্গল চোখ বেয়ে পানি পড়ছে কিছুতেই সামনের রাস্তাটা স্পষ্ট দেখতে পারছি না৷ বাসায় এসে পৌঁছালাম রাত ১১টে বেজে ৪০ মিনিটে৷ তপুর প্রতি থাকা আমার অবশিষ্ট ভালোবাসাটুকুও আজ শেষ হয়ে গেলো৷ সারা রাস্তা কাঁদতে কাঁদতে এসেছি৷ এখন আর চোখে জল ঝড়ছে না৷ আজ এমনিতেও বাসা খালি৷ আমার ছেলেমেয়ে তিনটি নেই৷ সব কষ্টগুলো আজ আকড়ে ধরেছে আমায়৷
ডায়েরি বন্ধ করে রেখে কাঁদতে লাগলাম৷

অঞ্জু কষ্ট পেও না৷ আজ দু’জনের দু’টি পথ আলাদা৷ এইটুকু কষ্ট যদি আজ না দিতাম তোমাকে ফেরাতে পারতাম না৷ তোমারও সন্তান আছে আর আমারও আছে৷ এই সমাজে আমরা কি করে মুখ দেখাতাম? এ সমাজ আমাদের সম্পর্ককে মেনে নিতো না৷ সুখী বা অসুখী যাই হও না কেন তোমার একটা সংসার আছে, স্বামী আছে তাদের ফেলে তুমি আমার কাছে আসতে পারো না আর আমিও নির্লজ্জের মতো তোমাকে গ্রহণ করতে পারি না৷ আমরা না চাইলেও আমাদের মধ্যে এইটুকু দূরত্ব বজায় রাখতেই হবে৷

এইটুকু লিখে ডায়েরিটা রাখতে গিয়ে অঞ্জুর হাতের ডায়েরির মতো আরেকটা ডায়েরি আমার এখানে দেখি৷ একই রকম ভাবে ডায়েরির মাঝের পৃষ্ঠাতে একটা চিঠি
প্রিয় বাবা,
অনিচ্ছাকৃতভাবে তোমার জীবনে আমার আগমন হয়েছে৷ এর জন্য আমি দায়ী নই৷ কিন্তু আমার আগমনই তোমাকে আর মামনিকে আলাদা করে রেখেছে৷ তুমি যে মামনিকে কতোটা ভালোবাসো তা আমি জানি৷ মামনিও তোমাকে ভালোবাসে৷ এতোদিন ঐ বাসায় থেকে এটুকু বুঝেছি অনিতার বাবা শুধু ওদের বাবাই হয়েছেন মামনির স্বামী হতে পারেননি৷ মামনি কখনো সিঁদুর পড়ে না৷ আমি সিঁদুর কৌটো সামনেই রাখি৷ হাতে শাখা পলা নেই৷ কোন পূজো অর্চনাও করে না৷ কিন্তু সেদিন আমার বিষয়ে তোমার সাথে কথা বলার পর থেকে মামনিকে আমি সিঁদুর পড়তে দেখেছি৷ বুঝেছি মামনি এখনও তোমাকেই ভালোবাসে৷ আর হ্যাঁ মামনি শুধু অভিনয় করে তা নয়৷ আরো কিছু হয়তো করে সেটা কি আমি জানিনা৷ যতটুকু ফোনে কথা বলতে শুনেছি খারাপ কিছুই৷ হয়তো তুমি বুঝতে পেরেছো৷ কিন্তু মামনিকে দিয়ে কেউ এগুলো করায়৷ মামনি ওখানে অনেক কষ্টে আছে৷ ঐ বাসাটা একটা নরক৷ আমার আর অনিতার যাতে কোন ক্ষতি না হয় তাই তো আমাদের বিদেশ পাঠাচ্ছে৷ তুমি পারলে মামনিকে তোমার কাছে রেখো৷ আমার কোন আপত্তি থাকবে না৷ তোমরা আবার সংসার করো৷ আমরা তিন ভাইবোন দেশে ফিরে যেনো তোমাদের স্বামী-স্ত্রী রুপে দেখি৷ প্লিজ বাবা তোমার এ তনুর কথাটা রেখো৷ মামনির অনেক কষ্ট৷ সবটা আমি জানিনা৷ তুমি আর নতুন করে তাকে কষ্ট দিয়ো না৷
ইতি
তোমার তনু৷
তনু এসব কি লিখলো? তাহলে কি আমি আজ অঞ্জুকে ফিরিয়ে দিয়ে ভুল করলাম? ও আমার কাছে একটু আশ্রয়ের জন্য এসেছিলো আর আমি ওকে ফিরিয়ে দিলাম?
চলবে……

(গল্পটা উত্তম পুরুষে লেখা৷ তাই লেখার নিয়মানুযায়ী সবটুকুই উত্তম পুরুষে লিখতে হবে৷ তাই তপুর কথাগুলোও উত্তম পুরুষে লেখা৷)

#
/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here