ডায়েরি পর্ব ১১

#ডায়েরি_পর্ব_১১

জান্নাতুল জান্নাত

তনিমার আজকের কথাগুলো শুনে মাথা ঘুরতে লাগলো৷ এক মূহুর্ত আগেও বুঝতে পারিনি এসব ঘটতে যাচ্ছে৷ হে ভগবান কত লীলাই করো তুমি আমার সাথে৷ মানুষ বানাইলা, মন দিলা কিন্তু কর্ম করার সাধ্য দিলা না৷ সেই মানুষ নামের ঘুড়ি পৃথিবীতে ছেড়ে দিয়ে নাটাই রাখলে তোমার হাতে৷ যখন যেমন খুশি তখন তেমনি করে নাচাও মানুষ পুতুলরে৷ একটু আগেও ভাবতাম আমি নিজের খারাপ স্বত্বাটাকে আড়ালে রাখতে পেরেছি আমার সন্তানদের থেকে কিন্তু মাত্র কয়েকটা সেকেন্ড আমার সব ধারণাকে উলট পালট করে দিলো৷ তনু তুই এসব কি করে জানলি? তুই তাহলে আগেই জানতি তবে আমায় কেন বললি না? আমি এখন তোর চোখে কি করে চোখ রাখবো? কি করে তোর সামনে দাঁড়াবো? আর কত নিচে নামতে হবে আমাকে?

ডায়েরি কুঠুরিতে রেখে ঘুমের ঔষধ খেলাম৷ ঔষধ না খেলে এ চিন্তাগুলো সারারাত আমাকে কুড়ে কুড়ে খাবে৷ কাল থেকে আবার শহরের বাইরে থাকা শুরু হবে৷ তাই অাবার অনেকদিন ডায়েরি লেখাও হবে না৷ আর কিই বা লিখবো৷ প্রতিদিন একটু একটু করে ধ্বংস হচ্ছি এসব?

বারান্দায় গেলাম৷ আকাশে আজ চাঁদ নেই৷ হয়তো অমাবস্যা চলছে৷ আমার জীবনও তো এমনি আধারে ঢেকে রয়েছে৷ এতোদিন তাও নিজের ওদেরকে ছুঁতে সংকোচ হতো আমি অপবিত্র বলে আর এখন তো ভয় হবে৷ আচ্ছা তনিমা ঠিক কতটুকু জানে? সবটা? কিন্তু কি করে? ও কি আমার ডায়েরি পড়েছে? সেটা কি করে সম্ভব? সব তো আমার গোপন কুঠুরিতে থাকে৷ আমি না বললে কেউ এটা জানবে না৷ তাহলে কি বই গুছানোর সময় ও এসব ঘেটেছে? কিন্তু তাও তো অনেকদিন আগে গুছিয়েছে৷ আমি তো মাত্র কিছুদিন হলো লিখছি৷ তনুকে ডেকে জিজ্ঞেস করে দেখবো ঠিক কতটুকু জানে? যদি কেঁচো খুড়তে সাপ বেরোয়? ও যদি আমার আর তপুর সম্পর্কের বিষয়টা জেনে যায়? তাহলে আবার দু’জনকেই ভুল বুঝবে৷ থাক কিছু জানতে হবে না৷ যেমন আছি তেমনই থাকি৷ তনিমা কি অনিতা অর্ণবকে এসব বলে দিবে? ঠাকুর তুমি দেখো ওদের যাতে কিছু না বলে৷ ওদের কানে যাওয়ার আগেই যেনো আমি তিনজনকেই বিদেশে পাঠিয়ে দিতে পারি৷ আর দেরি করা সম্ভব নয়৷ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওদের এখান থেকে বের করতে হবে৷ তপু? তপু কি জানে আমার অন্য রুপের কথা? তাহলে তপুও তো আমাকে ঘৃণা করবে৷ তপুও যদি আমাকে ভুল বোঝে তাহলে আমি কোথায় যাবো৷ ঠাকুর তুমি চাইলে সব পারো৷ শুধু এ ক’টা দিন সব সামলে রাখার ক্ষমতা দাও আমায়৷ ছেলেমেয়ে তিনটিকে নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠাই আগে৷

ল্যাপটপ নিয়ে বসলাম৷ কাজের সূত্রে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন লোকের সাথে পরিচয় ঘটে আমার৷ তাদের মধ্যে কেউ কেউ উচ্চ পর্যায়েরও আছে৷ আর আমি তো যে সে লোক না৷ নায়িকা অঞ্জনা৷ আমি কি যার তার মনোরঞ্জন করি? আমাকে পেতে হলে তাকেও উচ্চ পর্যায়ের হতে হয়৷ কয়েকজনের সাথে কথা বললাম৷ আমার জন্য তারা মোটামুটি তাড়াতাড়ি করতে পারবে৷ খুব বেশি জরুরী ভিত্তিতে চাইলে দু’মাসের মধ্যে ব্যবস্থা করতে পারবে৷ ভেবে দেখলাম তিনমাস পর অনিতার জম্মদিন তার কিছুদিন পর অর্ণবের৷ অনিতার সাথে অর্ণবের জম্মদিনটা পালন করেই যাওয়ার ব্যবস্থা করি আর কোনদিন সুযোগ পাবো কিনা ঠাকুর জানে৷ তাদের জানালাম চারমাস পরে যাওয়ার তারিখ পড়লেই হবে৷ এই চারমাস আমি ওদের কাছে রাখতে চাই৷ তারাও জানালো সেভাবেই তারা ব্যবস্থা করবে৷ আপাতত আমাকে পাসপোর্টগুলো তৈরি করে রাখতে বলেছে৷ তারা সময়মতো ওদের ডেকে নিবে৷ যাক মোটামুটি নিশ্চিন্ত হয়ে শুয়ে পড়লাম৷

২৪শে সেপ্টেম্বর ২০১৫
সাড়ে ন’টায় ঘুম ভাঙলো৷ অঞ্জনদা এখনও ফোন দেয়নি৷ তারমানে হাতে কিছু সময় আছে কিন্তু কি করবো? রুম থেকে বেরুলেই তনিমার সামনে পড়তে হবে৷ আমি তো ওর চোখে চোখ রাখতেই পারবো না৷ দরজা খুলে দেখলাম সামনে ফুল প্রসাদ রাখা৷ মেয়েটা আমার একেবারে সাক্ষাত মা লক্ষ্মী৷ অবশ্য এ অবদান তো তনিমারই৷ প্রসাদ নিয়ে বেরুতে গিয়ে ভাবলাম না থাক বেরুবো না৷ আগে বিন্তিকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম তনিমা বাসায় কিনা৷ এ সময়ে তনিমার কলেজে থাকার কথা কিন্তু বিন্তি বললো ও এখন বাসায়৷ ও বাসায় কেন? তাহলে আর বের হবো না৷ বিন্তি চলে যেতেই দরজা আটকালাম৷ এখানেই আজ স্নান করলাম৷

ওয়াশ রুম থেকে বেরুতেই তনিমার গলা শুনতে পেলাম
-মামনি দরজা খোল৷ তোমার খাবার নিয়ে এসেছি৷
ধুরর আমি রুম থেকে বেরুলাম না মেয়েটার সামনে পড়বো বলে কিন্তু ও নিজেই এখানে এসে হাজির হলো? যদি ঐ বিষয়ে আবার কথা বলে? আমি দরজা খুললাম না৷ কোন উত্তরও দিলাম না৷ তনিমা ডেকেই চলেছে৷
-মামনি তুমি না খেলে কিন্তু আমিও খাবো না৷ তুমি তো জানো না খেলে আমার গ্যাস্ট্রিকে খুব সমস্যা করে৷ এই আমি রুমের সামনে বসলাম৷ তুমি নিজ হাতে খাইয়ে দিলে খাবো নয়তো না খেয়েই থাকবো৷
আমার শ্বাশুড়ির গলাও শুনতে পেলাম৷
-মেয়ের ঢং দেখে আর বাঁচি না৷ তুই না খেলে অঞ্জনার কি হবে? অঞ্জনা তোর কি হয়? বন্ধুর মেয়ে তুই, অঞ্জনার প্রতি তোর এতো অধিকার কিসের? আশ্রিতা আশ্রিতার মতো থাক৷ ঘরের মেয়ে হতে চাস না৷ অঞ্জনার ভালো লাগলে খাবে না লাগলে না খাবে৷ এখানে বসে চিল্লিয়ে বাড়ি মাথায় করছিস কেন?
-তোমার সমস্যা কি ঠাম্মি? তুমি তো খেয়েছো আর তোমাকে খেতেও বলছি না৷ আমাদের মা মেয়ের বিষয় আমরা বুঝে নিবো৷ যাও তো একটু ঠাকুরের নাম জপো নইলে সিরিয়াল দেখো আমাকে বিরক্ত করো না৷
-এই মেয়ে মুখ সামলে কথা বল৷ আমাকে যেতে বলিস তুই? আমাকে যেতে বলার তুই কে? বুঝি না বাপু বন্ধুর মেয়েরে বাসায় এনে রাখছে কেন? কোন আশ্রমে দিয়ে দিলেই তো পারতো৷ খামোখা বাইরের জঞ্জাল এনে ঘর ভরে রেখেছে৷

বুঝলাম শ্বাশুড়িকে এখন আমাকেই থামাতে হবে৷ নইলে তনুকে কাঁদিয়েই ছাড়বে আজ৷ মহিলাটাকে নিয়ে আর পারি না৷ দরজা খুলে বললাম
-তনু খাবার নিয়ে ভিতরে আয়৷ আর আপনার সমস্যা কি মা? তনু আপনার খায় নাকি পড়ে? আমার খায় আমার পড়ে৷ আমার খরচায় আমি যাকে খুশি বাসায় রাখবো আপনি এতো কথা বলার কে? বারবার ওকে আশ্রিতা কেন বলেন? আমি তো বলেছি ও আমার বড় মেয়ে৷ অনিতা আমার কাছে যা তনিমাও তাই৷ কেন মেনে নিতে পারেন না আপনি?
-বাইরের কোন মেয়েকে আমি আমার নাতনী ভাবতে পারবো৷ জাত পাতের খবর নেই এসেছে আমার নাতনী হতে৷
-মানতে না পারলে দরজা আটকে বসে থাকুন৷ তনু ভিতরে চল৷

তনুকে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে দরজা আটকে দিলাম৷
-কি দরকার ছিলো আমার জন্য খাবার নিয়ে বসে থাকার? তুই খেয়ে নিলেই তো পারতি৷ এখানে এমন করে চিল্লাচিল্লি না করলে তো উনি এতো কথা বলতেন না৷
-আরে তুমি ঠাম্মির কথা বাদ দাও তো৷ বুড়ো মানুষ কি বলতে কি বলেছে৷ অর্ধেক শরীর চিতায় উঠে আছে তার কথায় এতো মূল্য দিতে হবে না৷ এসো তুমি খাবে৷
-তুই খা৷
-তুমি খাবে না?
-ক্ষিধে নেই৷

তনিমা হঠাৎ পা ধরে বললো
-মামনি আমাকে মাফ করে দাও৷ গতরাতে কথাগুলো আমার ওভাবে বলা উচিত হয়নি৷ তুমি মা আমি মেয়ে৷ মেয়ের এসব কথা কোন মা সহ্য করতে পারে না৷ জানি তুমিও খুব কষ্ট পেয়েছো৷ আসলে আমি কথাগুলো ওভাবে বলতে চাইনি কিন্তু কিভাবে যেনো বেরিয়ে পড়লো৷ মামনি আমি সারারাত একটুও ঘুমাইনি আর জানি তুমিও ঘুমাওনি৷ প্লিজ আমাকে ক্ষমা করো৷
তনুর হাত ধরে উঠাতে উঠাতে দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললাম
-আমি ঘুমিয়েছি৷ তোকে ক্ষমা করে দিয়েছি রে মা৷ সত্যি কথা সবসময়ই তিক্তকর হয় তাই খুব সহজে আমরা তাকে গ্রহণ করতে পারি না৷ আমিও পারিনি৷ এটা এমন কোন বিষয় নয়৷ তুই কোন অন্যায় করিসনি৷ হয়তো সব জানলে তুই আর আমাকে ভুল বুঝবি না কিন্তু তোর সবকিছু জানার সময় এখনও আসেনি৷ বিদেশ থেকে বড় হয়ে আয় সব বলবো সেদিন বুঝবি তোর মা কোন অন্যায় করেনি৷
-না মা তোমার কোন অন্যায় নেই৷ মায়েদের কোন অন্যায় হয় না৷ যদিও ভুল কিছু করে থাকো তা তোমার সন্তানদের জন্য করেছো৷ আমি আর কখনো এ কথাগুলো তোমাকে বলবো না৷ আর হ্যাঁ এগুলো কিন্তু অনিতা অর্ণবকে কিচ্ছু জানাইনি আর জানাবোও না৷ এবার তো খেতে বসো৷
দু’জনে মিলে সকালের খাওয়া খেলাম৷
-আমি কয়েকজনের সাথে কথা বলেছি৷ চারমাসের মধ্যে তোদের যাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যাবে৷
-ও৷
-এ সপ্তাহে আমি শ্যুটিংএর কাজে ব্যস্ত থাকবো৷ আগামি সপ্তাহে তোদের পাসপোর্ট বানাতে দিবো৷ অনিতা অর্ণবকেও বলিস৷ তোদের ঠাম্মিকে কিছু বলার দরকার নেই৷
-আচ্ছা৷
-তোকে ডায়েরি আমি কিনে দিতে পারছি না৷ এই ধর টাকা৷ কষ্ট করে নিজে কিনে নিস৷ নিজের পছন্দ মতো৷
-আমি চেয়েছিলাম তুমি তোমার পছন্দমতো কিনে দিবে তাই বলেছিলাম৷ এমনিতে ডায়েরি কেনার টাকা আমার কাছে আছে৷
-জানি তো আছে৷ কিন্তু মামনি দিলে নিতে হয়৷ তুই এখন যা আমি তৈরি হবো৷ অঞ্জনদা মেসেজ করেছে৷
-হুম৷
বলে বেরিয়ে গেলো তনিমা৷

২৪শে ডিসেম্বর ২০১৫
আমি আমার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম৷ তার ফাঁকে ফাঁকেই ওদের বিদেশ যাওয়ার কাজগুলো করছিলাম৷ তিনমাসের মধ্যেই সব কাজ সম্পন্ন হয়ে গেলো৷ তিনদিন পর অনিতার জম্মদিন৷ তার বারো দিন পরই ওদের ফ্লাইট৷

প্রথমে ওদের কাউকে কিছু জানালাম না জম্মদিনের বিষয়ে৷ আমার ইচ্ছে ছিলো অনিতার দশম জম্মদিনটা অনেক বড় করে উদযাপন করবো কিন্তু ওদের বিদেশ যাওয়ার জন্য নবম জম্মদিনটাই উদযাপন করছি৷ আর মাত্র তিনদিন বাকি৷ আমার যাদের নিমন্ত্রণ করার কার্ড দিয়ে তাদের নিমন্ত্রণ করে ফেলেছি৷ অঞ্জনদার থেকে একটি দিন আমি চেয়ে নিয়েছি৷ আজ তিন ভাইবোনকেই কার্ড দিলাম ওদের বন্ধুদের ও তাদের পরিবারকে নিমন্ত্রণ করার জন্য৷ বাসায় অনুষ্ঠান করছি না৷ একটা বড় রেষ্টুরেন্ট বুক করেছি৷ অনেক বড় করে আয়োজন করছি৷ আমার মনে উত্তেজনা৷ অনিতার জন্য কেনা সেই লকেটটা বের করে দেখছি৷

২৭শে ডিসেম্বর ২০১৫
জমকালো আয়োজন জম্মদিনের৷ আজও সুব্রত বাবু আসতে পারলেন না৷ যদিও আমাকে বলেছেন তিনি কাজে ব্যস্ত কিন্তু আমি জেনেছি তিনি ফাইভ স্টার হোটেলে একজন মডেলের সাথে সময় কাটাচ্ছেন৷ থাকুক ভালোই হলো৷ এতো ভালো একটা দিনে ঐ লোকটার ছায়া পড়ার দরকার নেই আমার মেয়ের শরীরে৷ তিনি অবশ্য মেয়েকে জম্মদিন উপলক্ষ্যে একটি পাঁচলাখ টাকার চেক উপহার দিয়েছেন৷

সন্ধ্যে সাতটা আমাদের অনুষ্ঠান শুরু৷ আজ আমরা চারজন একই রকম পোশাক পড়েছি৷ ডিজাইনার দিয়ে তিনটি একই রকম ল্যাহেঙ্গা বানিয়েছি আর অর্ণবের জন্য শেরওয়ানি বানিয়েছি৷ দশ পাউন্ডের একটা বিশাল কেক আমার পরীর সামনে৷ আমার পরী মানে অনিতার সামনে৷ আজ প্রথম কোন জম্মদিনে আমি আমার মেয়ের হাত ধরে কেক কাটলাম৷ নিজের হাতে কেক খাইয়ে দিলাম৷ সকালেও কিন্তু নিজ হাতে পায়েস রেধে ওকে খাইয়েছি৷ কেক কাটার পরে সুন্দর একটি চেইনের সাথে লকেটটি পড়িয়ে দিয়ে বললাম
-জানি তোকে দেয়া সবচেয়ে ছোট উপহার এটা৷ এটা শুধু লকেট নয়, লকেটের চেয়েও বেশি কিছু৷ সময় হলে বুঝবি৷ তুই না বুঝলেও দিদি রয়েছে ও ঠিক বুঝবে৷
-এটা কি কারণে তোমার কাছে স্পেশাল আমি জানি না মাম্মাম তবে আমার কাছে এটা সবচেয়ে দামী কারণ এই প্রথম কোন উপহার তুমি নিজ হাতে আমায় দিলে৷
বলেই মেয়ে আমায় প্রণাম করলো৷
-মা গো তোমার সব ইচ্ছে যেনো আমি পূরণ করতে পারি সে আশির্বাদ করো৷
-বোকা মেয়ে৷ মায়ের থেকে আশির্বাদ চেয়ে নিতে হয়? আমি তো তোকে মন প্রাণ ভরে আশির্বাদ করি৷

তনিমা আর অর্ণবকেও স্পেশাল উপহার দিলাম৷
যেমন চেয়েছি তেমন করেই জম্মদিনটি উদযাপন করলাম৷ এখন ওদের যাওয়ার পালা৷ আগামি ৯ই জানুয়ারি ওদের ফ্লাইট৷

৮ই জানুয়ারি ২০১৬ রাত ১১টা ২০ মিনিট
তপুকে অনিতার জম্মদিনের পর আমাদের বাসাতেই থাকতে বলেছি৷ মেয়ে যাওয়ার আগে কয়েকটাদিন বাবাকে কাছে পাক৷ তিনজনের জন্যই সকল কেনাকাটা আর গোছানো সম্পন্ন৷

কাল আমার কলিজার ধন তিনটি চলে যাবে৷ এগারো বছরে পড়লো আমার চুক্তিপত্র৷ প্রতিটি দিন আমার কাছে নরক যন্ত্রণাসম কেটেছে৷ কখনো কাউকে মুখ ফুটে বলতেও পারিনি বুঝাতেও পারিনি৷ প্রথমে অনিতা পরে আমার জীবনে আসলো অর্ণব৷ সবার শেষে আসলো আমার ভালোবাসার মানুষটার আত্মজা তনিমা৷ ওদের দেখলে সকল যন্ত্রণা ভুলে যেতাম৷ ওদের জন্য আমার নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছে হতো৷ কাল ওরা চলে যাবে আমার পৃথিবী শূন্য করে৷ কিন্তু ওদের ভালোর জন্যই ওদের আমাকে দূরে পাঠাতেই হবে৷ না জানি কবে এদেরকেও এ পেশায় ঢুকিয়ে দেয় সুব্রত৷ তার আগেই সুব্রতের নাগালের বাইরে পাঠাচ্ছি ওদের৷ পরশু থেকে কেউ আমার স্ট্যাডি রুমের সামনে ফুল প্রসাদ রাখবে না, তনিমার মতো মিষ্টি শাষণে আমাকে খাওয়াবে না৷ কেউ আমার পায়ে শুয়ে বলবে না ” মামনি আজ তোমার পায়ে ঘুমাই?”
এর মধ্যে দরজায় করাঘাত৷ একসঙ্গে তিনজনেই ডাকছে
-দরজা খোলো? ভিতরে আসবো৷
ডায়েরিটা লুকিয়ে চোখের জল মুছে দরজা খুললাম৷

তিনটিতে একসাথে জড়িয়ে ধরলো৷
-আজ আমরা তোমার সাথে ঘুমাবো৷
আজ নিজেকে সত্যিকারের মা মনে হচ্ছে৷ তিনজনকেই চুমু খেয়ে পায়ে শোয়ালাম৷ অনেক কথা বললাম তিনজনে৷ রাতে আর ঘুম হলো না কারোরই৷ ভোরেই রওনা দিতে হবে৷ ছ’টায় ওদের তৈরি হতে পাঠালাম৷ নিজেই হালকা নাস্তা তৈরি করে নিজ হাতে খাইয়ে দিলাম৷ কতদিন পর যে হেসেলে ঢুকেছি তা ভুলে গেছি৷ ওদের নিয়ে আটটায় বেরুলাম৷

এয়ারপোর্ট কাছেই৷ বারোটায় ফ্লাইট৷ এগারোটা বেজে ওভার হতে ওরা ইমিগ্রেশন পার হচ্ছে৷ তখন তনিমা একটা কিছু সুন্দর করে প্যাকেট করা আমার হাতে দিয়ে বললো
-মামনি এটা বাসায় গিয়ে খুলবে৷ তোমার স্ট্যাডিরুমে বসে৷ দরজা আটকে নিবে৷ আর কেউ যেনো না দেখে৷
-কি আছে এতে?
-খুললেই বুঝবে৷ আমরা যাচ্ছি৷ কথা দিচ্ছি আমরা তিন ভাইবোন তোমার মনের মতো হয়েই ফিরবো৷ তার আগে নয়৷

ওখানেই তিনজনই প্রণাম করলো৷ প্রাণভরে ওদের আশির্বাদ করলাম৷ ওরা চলে গেলো৷ আমি বাসায় ফিরলাম৷ বারবার প্যাকেটটা হাতে নিচ্ছিলাম কিন্তু তনিমা নিষেধ করেছে বলে খুলিনি৷ বাসায় গিয়ে পোশাকও বদলালাম না৷ দরজা আটকে প্যাকেটটা খুলতে লাগলাম৷ রঙিন কাগজ খুলতে দেখলাম একটা সুন্দর ডায়েরি৷ পৃষ্ঠা উল্টালাম কিন্তু ডায়েরির পৃষ্ঠাগুলোতে কিছু লেখা নেই৷ মাঝের দিকটাতে লেখা পেলাম৷ চিঠির মতো করে লেখা৷

প্রিয় মামনি,
যখন তুমি এটা পড়ছো তখন আমি তোমার থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছি৷ আমাদের দেহগুলো দূরে চলে যাচ্ছে কিন্তু অস্তিত্ব নয়৷ আমি আসলে আগে বুঝতে পারিনি এতো তাড়াতাড়ি আমরা দূরে সরে যাবো কিন্তু বাসায় যে পরিস্থিতি তাতে এটার দরকার ছিলো নয়তো আমরা যে কোন সময় বিপদে পড়তে পারতাম৷ তুমি মা বলেই আমাদের সুরক্ষার কথা ভেবেছো৷

মামনি তোমার মনে অনেক প্রশ্ন সেসব প্রশ্নের উত্তর আছে আমার কাছে৷ বলতে পারো তোমার মনের প্রশ্ন আমি কি করে জানি৷ ষোলো বছরের মেয়েরা কতকিছু জানে আর আমি এটুকু জানতে পারবো না? আমি জানি তুমি বাবাকে ভালোবাসো৷ তুমি আমার বাবার সেই অঞ্জু৷ যার নাম ছাড়া এখনও বাবার দিন শুরু হয় না৷ ভাগ্য তোমাদের আলাদা করেছে কিন্তু বাবার মন আজও তোমার কাছেই পড়ে আছে৷ মামনি বাবা তোমাকে কোনদিন ঠকাতে চায়নি৷ বাবা নিজেই তো বুঝতে পারেনি সেদিন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে৷

তোমার তপু মানে আমার এই বাবা আমার বায়োলজিক্যাল বাবা নয়৷ আমার বায়োলজিক্যাল বাবা আমার পরিচয় দেয়নি৷ তুমি জানোতো হিন্দু রীতিতে সিঁদুরদানই বিয়ে৷ সেভাবেই আমার মা তৃপ্তি রায়ের সাথে বিয়ে হয়েছিলো সাধন দত্তের৷ তাদের বিয়ে হয়েছিলো ভালোবেসে৷ পরিবার জানতো না৷ কিন্তু মা যখন প্রেগন্যান্ট হলেন তখন আমার বাবা মাকে অস্বীকার করে৷ মায়ের কাছে তেমন কোন প্রমাণও ছিলো না৷ তোমার প্রেমিক মানে তপু বাবা ছিলো মায়ের খুব কাছের বন্ধু৷ মায়ের প্রেগন্যান্সির কথা জেনে মায়ের পরিবার তাকে নষ্টা বলে বের করে দেয়৷ মা উপায় না পেয়ে বাবার কাছে আসে৷ তপু বাবা আমার মায়ের দেখাশোনার ভার নেয়৷ সেখানেই আমার জম্ম হয় কিন্তু বাবার নিয়মিত যাতায়াত লোকজন ভালো চোখে দেখতো না৷ আমিও নাকি ছোটবেলায় বাবাকে বাবা বলেই ডাকতাম৷ সবাই ধরেই নিয়েছিলো বাবা ও মায়ের সাথে অবৈধ সম্পর্ক আছে৷ সে এলাকার লোকেরা বলে ‘হয় মাকে বাবা বিয়ে করবে নয়তো মাকে তারা একঘরে করে দিবে৷’ বাবা আর মাকে তারা আটকে রাখে বেশ কয়েকদিন৷ পরে বাবা মা দু’জনেই বাধ্য হয়ে রাজি হয়৷ গ্রামের লোকজনই তাদের বিয়ে দিয়ে দেয়৷ বেশ কিছুদিন পর বাবা খোঁজ নিয়ে জানতে পারে তোমারও বিয়ে হয়ে গেছে৷

বাবা কখনোই আমার মাকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে পারেনি তবে আমাকে মেয়ের মতোই ভালোবাসতেন৷ বাবা ভেবেছিলেন তুমি ভালো আছো সুখে আছো৷ তাই আর তোমার সুখের জীবন তছনছ করতে কখনো আসেনি৷ মামনি বাবা শুধু তোমাকেই ভালোবাসে৷

আমি এসব জেনেছি বাবার ডায়েরি পড়ে৷ বাবার খুব ডায়েরি লেখার শখ ছিলো৷ আমি লুকিয়ে বাবার ডায়েরি পড়েছিলাম৷ প্রথম যখন আমাদের দেখা হয় তখন তোমাকে অঞ্জু বলে ডেকেছিলো৷ আমি তখনই বুঝেছিলাম এই অঞ্জুই সেই অঞ্জু৷ আর মজার বিষয় হলো ঘটনাক্রমে আমার নাম তনিমা৷ সেটা মা রেখেছিলেন৷ তখন কি আর মা জানতেন এটা বাবার তার মেয়ের জন্য রাখা নাম?

তোমার বিয়ে হয়েছে৷ নিজের দু’টি সন্তানও আছে কিন্তু বাবার কি আছে? বাবা তো সারাজীবন শুধু অঞ্জুকেই ভালোবেসেছে৷ তার সেই অঞ্জুকে৷ বাবাকে ভুল বুঝোনা মামনি৷ লোকটার জীবনটাই ধ্বংস হয়ে গেলো৷ মূলত এর জন্য দায়ী আমি৷ আর কেউ নয়৷ পারলে আমাকে ক্ষমা করো৷ কথাগুলো আরো পরে তোমায় বলতাম কিন্তু চলে যাচ্ছি৷ আবার কবে দেখা হয় জানিনা৷ এটা জানা তোমার অধিকার৷ তৃপ্তি কখনোই অঞ্জুর স্থানটা নিতে পারেনি৷
ইতি তোমার মেয়ে,
তনু
চিঠিটা পড়ে আমার মাথা ঘুরছে৷ কি লেখা এসব? সব সত্যি? তাহলে তো তপু আমাকে ঠকায়নি৷ চোখ দু’টো ঝাপসা হয়ে এলো৷
চলবে…….

#

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here