তুই হৃদহরণী পর্ব ১৪

#তুই_হৃদহরণী
#সাদিয়া
পর্ব : ১৪

তুরফার টেবিলে আহরার একগাদা ফাইল রেখে আসার ব্যবস্থা করেছে। একজন সুন্দর মহিলা এসে তুরফার টেবিলে অনেক গুলি ফাইল রেখে গিয়েছে। মুচকি হেসে শুধু বলল “ম্যাম ফাইল গুলি দেখে দিন।” তুরফা শুধু মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ছিল। কিছু বলতে পারল না। শুষ্ক একটা ঢোক গিলল। এমনি তেই তার টেবিলে ১০ টার উপরে ফাইল জমে আছে। তুরফা নেকাবের ভেতরে ভেতরের ক্লান্তি ঝেড়ে দিল। মেয়ে টা কিছু বলল না। চলে গেল। তুরফা ফাইলের দিকে তাকাল বুকটা আবার ব্যথায় হাহাকার করে উঠল। ঠোঁট উল্টাল, কপাল কুঁচকে হাতের ফাইলের কাজে মন দিল। সাদা রেশমি পর্দার ওপারে ব্যস্ত “তুর” কে দেখছে আহরার। এক ধ্যানে তাকিয়ে এক টুকরো হাসল।

একটু পর কোট আর শর্ট স্কার্ট পরা একটা মেয়ে আসল। তুরফা বসে ছিল তাই মেয়েটার সাদা লোমহীন উরু চোখে পরল। তুরফা কাশতে শুরু করেছে। মেয়ে টা হাতের কয়েক টা ফাইল টেবিলে রাখতে রাখতে জিজ্ঞেস করল।
“ম্যাম ঠিক আছেন আপনি?”

“….
তুরফা মাথা তুলে তাকিয়ে মেয়ে টা কে দেখল। তারপর চোখ নামল টেবিলের ফাইলের দিকে। আরো এতগুলি ফাইল দেখে বিষম খেলো সে। জোরে জোরে কাশতে লাগল। নেকাব টানে নিচে নামিয়ে গ্লাসের বাকি সব টা পানি চুষে নিল। তবুও ভেতরটা শুকনো লাগছে তার। ফাইলের দিকে বড়বড় চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে সে।
আহরার তুরফার অবস্থা দেখে নিজের জায়গায় বসে এক গালে অল্প হাসল।
“হৃদহরণী আপনার বোধহয় কাজের কারণে আজ নিস্তার নেই।”
তুরফা রাগে ফেটে যাচ্ছে। দাঁত কিড়িমিড়ি করছে। ঘাড় ঘুরিয়ে আহরার কে দেখল। আহরার নিজের কাজে মন দিয়েছে ততক্ষণ। তুরফার রাগে শরীর উসপিস করছে। মনে মনে আহরারের দিকে চেয়ে বলল
“বজ্জাৎ লোক এই বুঝি প্রণয় উৎপীড়ন। গুলি মারি আপনার নিগ্রহ, প্রণয় উৎপীড়নে। আল্লাহ, আল্লাহ গো।”

পাঁচ মিনিট যেতে পারল না এই মুহূর্তে আরেকজন এসে হাজির। তুরফা মাথা তুলে তাকিয়ে মেয়েটির হাতে আরো একগাদা ফাইল দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। শরীর তার অসাড় লাগছে। চোখের পাতা পারছে না ফাইল থেকে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছে সেদিকে। কিছু ভাবতেও পারছে না। দেহ শূন্য লাগছে নিজের কাছে।

“ম্যাম ফাইল গুলি খুব দরকারি তাড়াতাড়ি করে স্যারের কাছে জমা দিবেন।”
এই বলে মেয়ে টা টেবিলের উপর অসমাপ্তি ফাইল গুলির সাথে নতুন অপূর্ণ ফাইল গুলি রেখে চলে গেল। তুরফার এবার হুশ এলো। হাত পা ছুড়ে কান্না করতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। চোখ টলমল করছে। আজ কেন? সারা রাতে করলেও বোধহয় শেষ হবে না এগুলি। তুরফা বিষণ্ণ মুখ নিয়ে মাথায় হাত দিল। চাকরি ছেড়ে দিতে ইচ্ছা হচ্ছে।
আড়চোখে আহরার তুরফা কে দেখতে দেখতে বলল
“আহরার চৌধুরীর প্রণয় উৎপীড়ন হৃদহরণী।”

কোট খুলে আহরার শার্টের হাতা কনুই অবধি তুলতে তুলতে পর্দা সরিয়ে তুরফার রুমে গেল। আহরার কে দেখে তুরফার শরীর জ্বলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে লোক টাকে টেবিলের নিচে বেঁধে ইচ্ছা মতো ঠাউনি দিতে। দাঁত কিড়িমিড়ি করছে সে। হাতের কাছে পেল আর এই বুঝি ধরল গলায়। চুপচাপ বসে আছে সে রাগি চোখ নিয়ে। চোখের আগুনেই যেন পুড়াবে বজ্জাৎ স্বভাবের লোক টাকে। ইং করা জামকালো শার্ট টের হাতা উপরে তুলতে তুলতে তুরফার কাছে এলো আহরার।

“গেট আপ।”

“….

“আই এম টেলিং ইউ টু গেট আপ তুরফা।”
ধমক শুনে তুরফা তিতিবিতি করে উঠে পরল। দৃষ্টির আগুন নিভিয়ে আনল। চুপ করে মুখ অন্য দিকে রেখে দাঁড়িয়ে রইল। মানুষটার মুখ দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে না তার।

“নেকাব টা খুলো।”

তুরফা বিস্ময় নিয়ে ভ্রুকুটি করে তাকাল আহরারের দিকে। ভূত দেখছে এমন। বলে কি এ?

“মনে হচ্ছে শুনতে পাও নি আমার কথা?”

“….

“কি হলো কথা কানে যাচ্ছে না?”

“বেশ যাচ্ছে তবে বোধগম্য হচ্ছে না ফালতু কথা।”

আহরার রেগে গিয়ে তুরফার কাছে চলে গেল। রাগে এক বাহুতে খুব শক্ত করে ধরল আহরার। মুখ আরো কাছে এগিয়ে নিয়ে গেল। দাঁত কিড়িমিড়ি করে বলছে।
“চুপচাপ খুলে ফেলুন তুরফা।”
তুরফা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। একটা পর্যায়ে রাগে তুরফা ঝাটকায় হাত সরিয়ে নিয়ে আসল।

“না হলে কি করবেন?”

আহরার রেগে মেগে দাঁত কুটতে লাগল। সিংহের মতো তুরফার ঘাড়ের পিছনে শক্ত করে হাত চেঁপে নিয়ে মুখ বাড়িয়ে দিল।
“আহরার চাইলে সব করতে পারে। ইউ নো আপনি হয়তো এত দিনে বুঝেছেন অফিসের ড্রেসআপ সম্পর্কে। আপনিই একমাত্র মেয়ে যে এখনো আহরারের সামনে পর্দার পোশাক পরে আছেন। থাকুন ইভেন আমি এটাই চাই। আপনাকে অন্য ছেলেদের চোখের আড়ালেই রাখতে চাই আমি। কারণ তুর শুধুই আমার নূর। আপনাকে পর্দা করতে না করছি না। নেকাব খুলে কাজ করবেন এখানে। এই রুমের বাহিরে আপনি নেকাব পরেই যাবেন এটাই বাধ্যতামূলক আপনার জন্যে।”

“আপনার কথা তেই নাকি? ছাড়ুন আমাকে।”

“হুম আমার কথাতেই তোকে সব করতে হবে। সব। যেটা বলেছি সেটা মানবি নাকি অফিস ড্রেসে চলতে হবে?”

আহরারের চোখ রাগে লাল হয়ে আছে। নাক, কপালের রগ ফুলে আছে। চোখের নিচ পর্যন্ত লাল হয়ে আছে এক ভয়ংকর রূপ। তুরফার শরীর নিস্তেজ লাগছে এই মুহূর্তে। আল্লাহ তাকে কোন মসিবতে রেখেছে তাই ভাবছে। মামা মামনির কাছে বড় হলেও জীবনে এমন পরিস্থিতির মুখে পরতে হয় নি তাকে। শরীর টা কাঁপছে। চোখ নিবু নিবু হয়ে আসছে। এই ছোট শর্ট স্কার্ট আর…. তুরফা আস্তে আস্তে ঢেলে পরল। আহরার হাত পেঁচিয়ে বুকের কাছে নিয়ে এলো তাড়াতাড়ি করে। সব টা মুখ আবরণে ঢাকা। শুধু ঘন কালো বুজে থাকা চোখ দেখা যাচ্ছে। কি মোহনীয় সৌন্দর্য যুগল সেই আঁখিপুট। এক দেখাতেই কাত হয়ে যাওয়ার মতো। এক পলক দেখাতে হৃদয়ে ঢেউ তুলে দেওয়ার মতো। শিরায় শিরায় শিহরণ জাগায়। আহরার পলক না পরা দৃষ্টি দিয়েছে তাতে। এই দৃষ্টি তে অপবিত্রতা নেই। সব টাই বিশুদ্ধ পানির মতো। স্বচ্ছ, সতেজ, প্রাণপূর্ণ। স্নিগ্ধ চোখ দেখে মন আবেশে ছেয়ে যায়, হাঁড় পর্যন্ত হিম শীতল করা সুস্নিগ্ধ চোখ। আহরার মন দিয়ে দেখছে। এক হাতে পেঁচিয়ে আবদ্ধে রাখা তুরফার দিকে মুখ ঝুঁকিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“হৃদহরণী দুঃখিত। আমি নিজে চাই না আপনায় কেউ দেখুক। আপনার ওমন মুখের নূর আমি উপলব্ধি করব তুরফা। শুধুই আহরার। আপনাকে আহরার আবরণে রাখবে আহরার।”

তুরফা কে কোলে নিয়ে আহরার সোফায় শুয়িয়ে দিল। মুখের নেকাব টা খুলবে কি খুলবে না ভেবে পাচ্ছে না। দ্বিধায় পরেছে সে। এত চিন্তায় না পরে আহরার নেকাবের উপরেই পানির ছিটে দিল তুরফার মুখে। চোখে পরতে তুরফা নড়ে উঠে। আস্তে করে চোখ মেলে তাকাল। আহরার তখন তার দিকেই ঝুঁকে আছে। ভয়ে, আশংকায় তাড়াতাড়ি করে উঠে বসতে গিয়ে বারি খায় আহরারের কপালে। দুজনেই ‘আহ’ করে উঠল। আহরার রাগি মুড নিয়ে সোজা হলো।
“হোয়াট দ্যা..”

“….

“১মণ ওজনের পাথরের সাথে লেগেছে। জ্বলে যাচ্ছে কপাল টা।”

“আ আপনি কেন আমার দিকে ঝুঁ ঝুঁকে ছিলেন?”

“নিশ্চয় মধুর খাওয়ার জন্যে নয়।”

“ছিঃ। আপনার কি মাইন্ড, কথা..”

“শাট আপ ননসেন্স।”

“….
তুরফা চুপ বনে গেল।

“কথায় আছে যার জন্যে করি চুরি সেই বলে চুর। উপকারের ঘাড়ে লাথি এটাই তার প্রমাণ।”

“….

“তুমি সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলে তাই পানি দিচ্ছিলাম।”

তুরফা এবার খেয়াল করল তার নেকাব ভিজে আছে। মাথা ডলতে ডলতে আহরারের সেই কড়া কথা গুলি মনে পরল। আহরারের প্রতি রাগও হলো খুব। নেকাবের নিচে মুখ ভেংচি দিতে লাগল। এই এক স্বভাব তার। তেমন বকা না দিলেও মুখ ভেংচি দিতে পারে খুব।
আহরার কপালে হাত ডলতে ডলতে বলল,
“ননসেন্স গার্ল।”

“ঢং কতো। যেন উনি নিজেই ব্যথা পেয়েছে আমার কিছু হয়নি। আমার নরম মাথা কে এক মণ ওজনের পাথর বললে উনার টা কি? উনার টা তাহলে ইয়া বড় এক পাহাড়ের ইয়া বড় পাথর। যার ওজনও করা যায় না। কোথায় উনার হাতির মতো বিশাল দেহ আর কোথায় আমি। মাথা টা ব্যথা হয়ে গেল রে। ইসস যন্ত্রণা করছে গো। মাথার তার এই লোক টা ছিড়ে দিবে গো আমার। আল্লাহ কবে কন্ট্রাক্ট পেপারের সময় শেষ হবে? আল্লাহ কবে?”
নিজের সাথেই বিড়বিড় করে বলতে লাগল তুরফা।

তাড়াতাড়ি কাজ করার চেষ্টা করছে তুরফা। আজ কি আর এই ফাইল শেষ হবে? তুরফা মনে মনে ভাবছে, এত গুলি ফাইল না দিয়ে এভারেস্ট জয় করতে বললেও বোধহয় ভালো হতো। আশেপাশে কোনো দিকে তুরফার নজর যাচ্ছে না। ফাইলের মাঝেই চোখ রেখে কাজ করছে। ফাইল গুলি শেষ হবে কি না তাও চিন্তা করছে। পর্দা সরিয়ে আহরার এলেও বুঝল না সে। নিজের কাজ করে যাচ্ছে। টেবিলে কফির মগটা রাখলে তুরফা মাথা তুলল। আহরার কে দেখে মুখ বিষিয়ে তুলে। হাজার মুখ ভেংচি কাটে।

“কফি টা খেয়ে চাঙ্গা হয়ে নাও তুর। কারণ ফাইল শেষ না করে আজ বাসায় ফিরা হবে না তোমার। শেষ করতে যদি কাল হয় তবে রাত জেগে হলেও ফাইল শেষ করবে। ফাইল শেষ করেই এই অফিসের বাহিরে তুমি পা রাখবে হৃদহরণী। এর আগে নয়।”

তুরফা জানে এই ফাইল সারারাতেও শেষ হয় কি না সন্দেহ। উঠে দাঁড়াল। কন্ঠে মায়া আর আকুতি ঢেলে বলল,
“এ একা রাতেও অ অফিসে থাকতে হবে? প্লিজ রাতে আমি সবার সাথে ফাইল গুলি নিয়ে বাসায় চলে যাবো। যেভাবেই হোক আমি কাল ফাইল গুলি কমপ্লিট করে নিয়ে আসব। আপনার ফাইল কমপ্লিট পেলেই তো হবে।”

“উমহু। অফিসের কাজ অফিসে। যা বলার একবার বলে দিয়েছি আমি। বারবার এক কথা আমার বলতে ভালো লাগে না তুরফা। দরকার পরলে অফিসে একা থাকবে সারারাত।”

চলবে….
(কপি করা থেকে বিরত থাকুন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here