তোকে_দিয়েছি_মন❤
৯.১০
পর্ব – ৯
Writer: Sidratul muntaz
আমার ঘরের দরজার বাহিরে জড়ো হয়ে আছে সবাই। সবার চোখেমুখে ভেসে উঠেছে সদ্য বিছানা ছেড়ে উঠে আসার ক্লান্তি আর অস্বাভাবিক এই পরিস্থিতির আতঙ্ক। মা তো এলোমেলো চুল নিয়ে বুকে হাত রেখে দাড়িয়ে আছে। অগোছালো আচল টা মাটি ছুয়ে আছে। অয়ন্তি আপু সাফিন ভাইয়া আয়মান ভাইয়া বিচলিত কণ্ঠে কথা বলে যাচ্ছে। কথাগুলোর শব্দ কানে আসলেও খেয়াল করছি না আমি। তারিফ ভাইয়া ক্রমাগত দরজায় আঘাত করে দাদিকে ডাকছে। এতোক্ষনে আমি খেয়াল করলাম আমার ঘরের দরজা বন্ধ। কিন্তু আমি তো দরজা খুলে রেখে গিয়েছিলাম। তাহলে কি দাদিই দরজা বন্ধ করে দিয়েছে?? কিন্তু কেনো?? কপালের ঘাম মুছে নখে কামড় দিয়ে ধরলাম আমি। সবাইকে মাঝরাতে এইভাবে হয়রানি হতে হচ্ছে শুধুই আমার জন্য। নিজের চুল নিজের টেনে ছিড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। এখন বুড়িটা কি করবে কে জানে?? এমনিতেই তো সারাখন আমার দোষ ধরার জন্য ওত পেতে থাকে। আর এখন তো পেয়ে গেছে ঢোলের বাড়ি। কপালে কি আছে আল্লাহ মালুম। আজকে যে খুব বড়সড় একটা সিন ক্রিয়েট হতে চলেছে বাসায় এই ব্যপারে কোনো সন্দেহ নেই। ভয়ে আমার আত্মাটা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে যাচ্ছে।কোনোমতে ঢোক গিলে ঘরের সামনে গিয়ে দাড়ালাম আমি। হাত পা গুটিয়ে জড়োসড়ো হয়ে আছি আগে থেকেই। কারণ প্রত্যাশা ছিল ভাইয়া আর মা আমাকে দেখতে পেয়েই উড়াধুড়া ধোলাই শুরু করবে……. কিন্তু সেইরকম কিছুই হল না। বরং আমাকে অবাক করে দিয়ে মা আমার কাছে ছুটে এসে আমার কাধ ঝাকিয়ে খুব ব্যস্ত সুরে বলে উঠলেন–
তারু!! দেখ না তোর দাদি কেমন করছে। আমার মনে হয় তোর দাদিকে জ্বীনে ধরেছে।
মায়ের কথা শুনে মুখ কুচকালাম আমি। এসব কি বলছে মা?? ভাইয়ার দিকে তাকাতেই ভাইয়া বলে উঠলেন–
বুড়ি এইভাবে দরজা খুলবে না। দরজা ভাঙতে হবে।
ভাইয়ার কথা শুনে আমি তুমুল গতিতে মাথা নেড়ে উঠলাম। পাগল নাকি?? আমার ঘরের দরজা কেনো ভাঙবে?? ভাইয়ার হাত মুষ্ঠি করে ধরে বলে উঠলাম—
ভাইয়া দরজা কেনো ভাঙবে?? কোনোভাবেই আমি দরজা ভাঙতে দিব না।
ভাইয়া আমার দিকে ঘুরে মেজাজ দেখিয়ে বলে উঠলেন–
শুনতে পারছিস না ভেতরে কি হচ্ছে?? ভেতরে সাপ ঢুকেছে। দাদি ভাবছে সাপ ওকে মণি দিতে এসেছে। আর সেই লোভে দরজা বন্ধ করে বসে আছে। কি পরিমাণ লোভি একবার চিন্তা কর!! জীবনের মায়া নেই। সে মণি উদ্ধার করতে ব্যস্ত।
ভাইয়ার কথা শুনে আমার ব্রেইন সেল গুলো যেন তড়িৎ গতিতে ছুটোছুটি করতে লাগল। এসব কি অদ্ভুত কথা শুনছি আমি?? মা বলছে জ্বীনে ধরেছে…. ভাইয়া বলছে সাপ এসেছে…. কি হচ্ছে এসব?? আমার ভাবনার ছেদ পড়লো মায়ের ধমকে। আমাকে নয়….. ভাইয়াকে ধমকাচ্ছে মা। দাদিকে লোভি বলার অপরাধে। একসাথে এতো গুলো শক নিতে না পেরে কয়েক পা পিছিয়ে যেতেই কারো সাথে ধাক্কা খেলাম আমি। বুঝতে পারলাম এটা অয়ন্তি আপু। অয়ন্তি আপু পেছন থেকেই আমাকে ধরে বলে উঠলেন–
তারিন তুমি আগে কেনো বলোনি তোমাদের এখানে সাপ আছে?? তাও আবার মাথায় মণিওয়ালা সাপ?? ওহ মাই গড!! আমার পক্ষে আর এখানে থাকা সম্ভব না। সকালের বাসেই চলে যাবো আমি। জীবন বাচানো ফরজ ভাই!! ( বুকে হাত রেখে)
অয়ন্তি আপুর কথার উত্তরে সাফিন ভাইয়া বললেন– যাওয়ার আগে সাপের মণি দেখে যাবিনা?? এতোবড় চান্স মিস করবি?? ( ঠাট্টার সুরে)
সাফিন ভাইয়ার সাথে তাল মিলিয়ে আয়মান ভাইয়াও কিছু একটা বলে উঠলেন। যা আমার কানে পর্যন্ত পৌছানোর আগেই ভাবনার সাগরে ডুবে গেলাম আমি। আমার জানামতে তো সাপের মণি টনি বলে কিছু হয়না। আর যদি সত্যিই থেকেও থাকে তাহলে দাদি ওইটা নেওয়ার আগেই তো সাপটা তাকে ছোবল দিয়ে মেরে ফেলবে। বুকটা ধক করে উঠল আমার। দরজা ভাঙা জরুরি। আসলেই খুব জরুরি। ভাইয়াকে ব্যপারটা বলতে যাবো তার আগেই ইশান ভাইয়াকে দেখে চমকে উঠলাম আমি। আমার চমকানোর মাত্রা এতোই বেশি ছিল যে সবাই এই অবাক করা পরিস্থিতিতেও আরো একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি ইতস্তত হয়ে তাকাতেই আবার যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তারিফ ভাইয়া ইশান ভাইয়াকে বললেন দরজায় জোড়ে লাথি দিতে। দু একটা লাথি দেয়ার পর দরজা নড়ে গেল। তারপর আচমকা আমার পেছন থেকে আয়মান আর সাফিন ভাইয়া তেড়ে এসে দরজায় লাথি দেওয়া শুরু করল। অবশেষে সবার অক্লান্ত প্রচেষ্টার অবসান ঘটিয়ে বাড়ি কাপানো শব্দ করে দরজাটা খসে পরল মেঝেতে। সবাই হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে পরল। ঘর থেকে অদ্ভুত একটা আলো আসছে। সেই আলোতে অন্ধকার ঘরটা ভরে উঠেছে। কিসের আলো এইটা?? তার মানে কি সত্যিই সাপের মণি??? হে আল্লাহ!! দেয়ালের সাথে পিঠ লাগিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাড়ালাম আমি। হাত পা কোনোকিছুই কাজ করছে না।মনে হচ্ছে সবকিছুর সেন্সর ড্যামেজ হয়ে গেছে। কিছুক্ষণের জন্য চোখ গুলো আমার রসগোল্লা শেপ ধারণ করল। ঘরের ভিতর চলছে হুলুস্থুল কান্ড। অয়ন্তি আপু দৌড়ে এসে আমার এক কাধ খামচে ধরল। এতে যেন আমার কিছুই লাগল না। কেউ যে আমাকে টাচ করেছে সেই উদ্দীপনাটাও হয়তো আমার মস্তিষ্কে ঠায় পায়নি। অয়ন্তি আপু চোখমুখ খিচে আমাকে ধরে আছে। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করছে—
সা….প!! মাথায় মণিও আছে। ওহ মাই গড!! ওই মাই গড!! আই এম গোন। আই এম ডায়িং।এবার কি হবে….. এ কোথায় ফেসে গেলাম……
বড় বড় নিঃশ্বাস ছাড়ছে অয়ন্তি আপু। তার এই অবস্থা দেখে আমার মায়ের কথা মনে হল। সাপ দেখে মায়ের কি অবস্থা এখন?? মা ঠিকাছে তো?? কৌতুহল মেটাতে ঘরের দিকে পা বাড়াতে যাব তার আগেই ইশান ভাইয়ার গলার আওয়াজ কানে আসল আমার–
হোয়াট দ্যা হেল!! এইটা কোনো সাপও না কোনো মণিও না!! এইটা ফ্লাশলাইটের আলো!!
কথাটা শুনেই অবাক হয়ে তাকালাম আমি। ইশান ভাইয়ার হাতে আলোটা জলজল করছে। কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই ধপ করে আলোটা নিভে গেল। সাথে আমার চোখটাও যেন বন্ধ হয়ে গেল। আরেকবার চোখ পিটপিট করে তাকাতেই দেখলাম ঘরের লাইট জালিয়ে দিয়েছে কেউ। আয়মান আর সাফিন ভাইয়া হাত মিলিয়ে হাসছে। তারিফ ভাইয়া কোমরে হাত গুজে বোকার মতো দাড়িয়ে আছে। ইশান ভাইয়ার চোখেমুখে বিরক্তি। হাতে আমার ফোনটা নিয়ে বিরক্তি ভরা চোখে তাকিয়ে আছে উনি। পরিস্থিতি যেন সম্পূর্ণ বিপরীত হয়ে গেল। এতোক্ষন যেটা ছিল একটা অবাস্তব ঘটনা মুহুর্তেই সেটা যেন হাস্যকর রুপ ধারণ করেছে। আমি আর অয়ন্তি আপু একবার চোখাচোখি করলাম। অয়ন্তি আপু আমাকে ইশারা করে বললেন ভেতরে চলতে। আমিও এগিয়ে গেলাম। আশেপাশে বুড়িটাকে খুজছি। হঠাৎ চোখ আটকালো খাটের কোণায়। যেখানে গুটিশুটি মেরে চোখমুখ লাল করে মায়ের হাত চেপে ধরে বসে আছে বুড়িটা। বোঝাই যাচ্ছে খুব ভয় পেয়েছে…..ভয়ে কপাল থেকে ঘাম ঝরছে। বুড়ির হাতে ছোটখাট একটা কঞ্চি। এই কঞ্চি দিয়ে কি সাপ মারার প্ল্যান করছিল?? সাপ মারার নাম করে আমার শখের মোবাইলটা ফাটিয়ে দেওয়ার ধান্দা। মানে এতোটা কমন সেন্সের অভাব কি করে হয় মানুষের?? মোবাইলের ফ্লাশলাইট দেখে মনে করেছে সাপের মণি। আবার ভেবেছে দরজা আটকে লাঠি দিয়ে সাপ মেরে মণি উদ্ধার করে ফেলবে। লাইক সিরিয়াসলি??? মানুষ এতোটাও বলদ হয়?? এসব মানুষের জন্যই আসলে গুজব নামক জিনিসটা ছড়ায়। অবশ্য দোষ আমারই। তাড়াহুড়ো করে ফোনটা ফেলে যাওয়ার সময় কখন যে ফ্লাশ অন হয়ে গিয়েছিল…… টেরও পাইনি। আর সেই ক্ষুদ্র ঘটনাকে টেনে এত্তো বড় বানিয়ে ফেলল বুড়িটা। যার ফলশ্রুতিতে সবাইকে ঘুম হারাম করে মাঝরাতে আমার ঘরের দরজা ভাঙতে হল৷ আর তারপর কি হলো?? কিছুই না! অবশ্য এই সবকিছুর আড়ালে আমার আর ইশান ভাইয়ার ছাদে যাওয়ার ব্যপারটা ধামাচাপা পড়ে গেল। ব্যাপারটা খুব মন্দ হয়নি। বরং বলা যায় আল্লাহর অশেষ রহমতে এ যাত্রায় বেচে গেছি। বুকে হাত রেখে লম্বা শ্বাস টানলাম আমি।
তোকে_দিয়েছি_মন❤
পর্ব – ১০
Writer: Sidratul muntaz
সকাল সাড়ে নয়টা। আমি ঝুড়িতে কাপড় নিচ্ছি ওয়াশ করার জন্য। অনেক কাপড় জমা হয়ে গেছে। বাসাভর্তি মেহমান আর আলসেমির কারণে দৈনন্দিন কাজকর্মে অনেক ব্যঘাত ঘটছে আমার। আজকে সব পুষিয়ে নিতে হবে। কাল ভাইয়ার বিয়ে। কাল থেকেই শুরু হবে ব্যস্ততা। তারপর তো আর সময়ও পাওয়া যাবে না। বিয়ে রিসিপশন ইত্যাদি ইত্যাদি কত আয়োজন। পুরো সপ্তাহ টাই কেটে যাবে এভাবে। আর তারপরের সপ্তাহ অনলি রেস্ট! ঝুড়িপূর্ণ কাপড় নিয়ে গুনগুন করে হেটে যেতেই বুড়ি সামনে এসে দাড়ালো আমার। বুড়িকে দেখে খানিকটা চমকে কোমরে হাত দিয়ে দাড়িয়ে পড়লাম আমি। কালরাতের ঘটনার পর থেকেই বুড়িটা মুখে কুলো পেতেছে। যাই জিজ্ঞেস করি যতই জিজ্ঞেস করি কোনো উত্তর পাওয়া যায় না। মুখটা অন্ধকার করে বসে থাকে শুধু। সদ্য বিবাহিত বধূর স্বামী বিয়ের পরে একলা রেখে ভিনদেশে পাড়ি জমালে সেই নববধূর মুখ খানা যেমন হয়….. এই বুড়িটার মুখ খানাও তেমনই মনে হচ্ছে। সত্যিই কালরাতের ঝামেলা নিয়ে বুড়ি অনুশোচনায় ভুগছে?? নাকি আবার মাথায় অন্য কোনো খিচুরি পাকাচ্ছে?? কে জানে?? বুড়ির বিশ্বাস নেই। ভাবলেশহীন ভাবে বুড়ির থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে আমি সামনে পা বাড়াতে যাব অমনি পেছন থেকে হাতটা ধরে নিল আমার। আমি একটু অবাক হয়ে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে বুড়ির দিকে তাকালাম। বুড়ি কেমন একটা ইমোশোনাল টাইপ লুক নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে তার পানের বাটার সব পান খেয়ে শেষ করে ফেলেছি আমি। এখন হয়তো পান কিনে দেওয়ার আবদার করবে। কিন্তু সেরকম কিছু হলোনা। মুখটা আরো একটু মলিন করে খুব ঠান্ডা গলায় দাদি বলল–
বয় তারিন বইন। তোর লগে দুইখান কতা কমু।
বুড়ির কথা শুনে আমি ভ্রু উচু করে তাকালাম। হঠাৎ এতো মধুর কণ্ঠে আমার সাথে কথা বলছে কেনো?? মতলবটা কি বুড়ির?? এমনিতে তো প্রত্যেকটা কথায় কথায় আমাকে খোচা মারার ধান্দায় থাকে। তার ঝাঝালো কথা শুনে গা আমার জ্বলে যায়। কিন্তু আজ সেইরকম কোনো ঝাঝ খুজে পাচ্ছি না বুড়ির কথায়। বিষয়টা মেনে নিতেও আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। হঠাৎ এতো পরিবর্তন? উহুম!! রহস্যময় গন্ধ পাচ্ছি।
আমি ঝুড়ি টা একপাশে রেখে বসে পড়লাম বুড়ির সাথে। চুল ঠিক করতে করতে বলে উঠলাম–
হ্যা বলো আমি শুনছি।
বুড়ি কিছুটা ইতস্তত হয়ে বলল– রাইতে যেইডা হইলো…… হেইডা কিন্তু সত্যি। সাপ কিন্তু সত্যিই আমি দেখসেলাম। এই মোডা সাপ আসিল। গায়ের মইদ্ধে কাডা কাডা দাগ। কালসাপের লাহান। আমার মুহের সামনে আইয়া সমানে ফুস…ফুস…. করতাসিল।( সাপের মতো অঙ্গভঙ্গি করে)
বুড়ির কথায় বিরক্ত চোখে তাকাতেই বুড়ি আমার কাধে হাত রেখে বলল–
বইন। আমার যেই ডর লাগসে তোরে কি কইতাম।
আমি রাগান্বিত হয়ে বললাম– তাই না?? শুধু তুমি একাই সাপ দেখেছো?? কই আমরা কেউ তো দেখলাম না!!
বুড়ি কিছুক্ষন বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে উঠল–
তোরা দেখবি কইত্তে?? তোরা আইতে আইতেই তো সাপ জানালা দিয়া বাইর হইয়া গেসে।( একটু থেমে) আমার কি মনে অয় জানোস?? সাপটা কেউ চালান দিসে!( আমার মুখের কাছে এসে ফিসফিস করে) তাবিজ তুম্বা কইরা চালান দেয়না?? হেমনে। বেশিদিন বাচুম না বইন। সময় মনে অয় আমার শেষ। ( বুকে হাত দিয়ে করুন স্বরে) হারাডা রাইত ঘুমাইতো ফারি নাই বইন। কেমন জানি আউশফাউশ লাগে। বুকডাত চিলিক চিলিক বেতা করে। চোখ বন্ধ করলেই মনে অয় কেডা জানি জাতা দিয়া দরতাসে। বাতাস আহে না। মুখ হা কইরা চায়া থাকি। কথা কইতে হারি না।
উফফ!! আচ্ছা ভাইয়াকে বলবো তোমাকে ডক্টরের কাছে নিয়ে যেতে। ভাইয়া এখন বাসায় নেই। আগে ভাইয়া আসুক।
বলেই ঝুড়িটা তুলে নিয়ে চলে যেতে চাইলাম আমি। এবার বুড়ি আমার ওরনা চেপে ধরল। গলায় টান অনুভব করে আবার বিছানায় বসে পড়লাম আমি। ধমকের সুরে বলে উঠলাম–
উফফ সমস্যা কি তোমার??
বইন! ( আমাকে বুড়ির দিকে ঘুরিয়ে) আমি জানি তুই আমারে পছন করোস না। আমি তোরে অনেক দুক্কু দিসি। শেষ বয়সে আইসা অহন আমারে মাফ কইরা দে। আফনা দাদি না দেইক্কা এমনে ফেলায় দিবি?? আমি যে তোগো কত ভালবাসি তোরা জানোস না?? আমার মনডা তো হারাদিন তোগো ভাইবোনের কাছেই পইড়া থাহে। এল্লিগাই তো কয়দিন পর পর ছুইট্টা আহি। আমার চান মুখ খানা দেখতাম। আমার বইন!!
বলতে বলতে আমার কপালে চুমু দিল বুড়িটা। বুড়ির আচরণে আমার মস্তকের সব তারগুলো যেন জটলা পাকিয়ে গেল মুহুর্তেই। কোথা থেকে কি হচ্ছে কিছু ভাবতে গেলেও মাথাটা ঝিম মেরে আসছে। এই বুড়ি হঠাৎ উল্টো সুরে গান ধরল কেন?? কি চলছে বুড়ির মনে?? এই মাত্র যেই ঘটনা টা ঘটল সেটা ইতিহাসে এর আগে কখনো ঘটেনি। ১৭ বছরের রেকর্ড ভেঙে এই প্রথমবার বুড়িটা আমার সাথে আহ্লাদী গলায় কথা বলছে। আবার কপালে চুমুও দিচ্ছে!! আমার যে এখনো হার্টঅ্যাটাক হয়নি এইতো অনেক। কিন্তু মনে হচ্ছে কিছুক্ষনের মধ্যে সেটাও হয়ে যাবে।কারণ বুড়ি এবার আমার দুই হাত নিজের কোলের উপর রেখে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল–
আমার লক্ষী বইন। আমার একটা কথা রাখবি??
এইতো এইবার লাইনে এসেছে বুড়িটা। এখন নিশ্চয়ই উল্টা পাল্টা কিছু আবদার করবে। আমি তো আগে থেকেই “না”। এই বুড়ির ফাদে কিছুতেই পা দিচ্ছি না আমি।
আচ্ছা বলো।
আগে ক রাখবি??
রাখার মতো হলে রাখব।
আইজকা আমি আমার কেশবতীর মাতায় তেল দিয়ে চিলি পাকায় দিবার চাই। দিবি??
চিলি পাকানো বলতে উনি বিনুনি গেথে দেওয়ার কথা বলছে সেটা বুঝতে পারলাম। কিন্তু এতে আমি আরো এক দফা শক খেয়ে স্ট্যাচু হয়ে রইলাম। সকাল সকাল কি শুরু করেছে বুড়িটা আমার সাথে?? নাকি সত্যিই সাপের বাড়ি খেয়ে বুড়ির মতিভ্রম হয়েছে। হতেও পারে। শত হলেও মানুষ তো!
আমি একটু ভাব নিয়ে বললাম– আমার তেল টেল দিতে ইচ্ছে করছে না।
এমন করে না বইন। বইন না ভালা?? যা তেলে ডিব্বা লইয়া আয়। যাহ ( আরেকবার চুলে হাত বুলিয়ে)
এই বুড়ির সাথে তর্ক করে জীবনে কোনোদিন বিজয়ী হতে পারিনি আমি। এইবারও যে তার ব্যতিক্রম হবে না এইটা বুঝেই তেলের বোতল এনে দিলাম বুড়িকে। বুড়ি বোতল হাতে নিয়ে খুশিতে গদগদ হয়ে আমাকে মাটিতে বসতে বলল। আমিও বাধ্য মেয়ের মতো কথা না বলে বসে পড়লাম আসন পেতে। বুড়ি আমার মাথায় তেল মালিশ করতে করতে একবার ঝুড়িটার দিকে তাকাল। তারপর বলে উঠল–
গোসল যাইতাসিলি??
আমি গম্ভীর হয়ে বললাম — হুম
আইজকা গোসল কইরা একখান লাল টুকটুক শাড়ি পিনবি। না না…… লাল না…. ( কিছু একটা চিন্তা করে) গোলাপী শাড়ি পিনবি। তোর ফরসা গতরে গোলাপী বেশি ফুটব।
আমি মাথা ঘুরিয়ে বুড়ির দিকে তাকালাম। চোখ বাকা করে বললাম–
তোমার মতলব টা কি বলো তো?? হঠাৎ এতো লা লা লা মুডে আছো কেন??
কি কস!! আমার মন চাইসে আমার নাতনি রে আজকা একটু সুন্দর কইরা সাজামু। হেনে আবার মতলবের কি হইল?? শোন বইন আজকার থেকা তোর কোনো বিষয়ে আমি একডাও কতা কমু না। তোর যেইডা ইচ্ছা তুই হেইডা করবি। আমি লাউ করুম না। খালি আমার একটা কতা শুন! ( মিষ্টি হেসে)
জানিনা বুড়ির মাথায় কি চলছে। কিন্তু এই প্রথম বুড়ির কথাগুলো আমার বেশ ভালোই লাগছে। শুনে একটুও রাগ হচ্ছে না। বরং মজা লাগছে। কেমন একটা দাদি দাদি ভাব আসছে বুড়ির থেকে। আমি শাড়ি পড়তে রাজি হয়ে গেলাম।
ভেজা চুল শুকাতে ছাদে এসেছি। সকালের হালকা রোদে আলোকিত হয়ে আছে ছাদটা। কার্নিশ ধরে দাড়াতেই হঠাৎ টান অনুভব করলাম গোলাপী শাড়ির আচলে। কয়েক মুহুর্তের মধ্যে আন্দাজ করে নিলাম এইটা কার কাজ৷ পেছন ফিরে তাকাতেই ভেসে উঠল সেই প্রত্যাশিত মুখ। ইশান ভাইয়াকে দেখে চোখ প্রসারিত হয়ে উঠল আমার। আজকে উনাকে একটু বেশিই সুন্দর লাগছে। অফ হোয়াইট টি শার্টের সাথে সাদা প্যান্ট। মাথার চুলগুলো অগোছালো হয়ে আছে তবে হালকা ভেজা। মনে হচ্ছে কিছুক্ষন আগেই গোসল করেছেন। খোচা খোচা দাড়ি গুলো রোদে ঝলমল করছে সেইসাথে গোলাপী ঠোট গুলো যেন এক অন্যরকম সৌন্দর্য্য সৃষ্টি করেছে উনার স্নিগ্ধ চেহারায়। চোখের ঘন পাপড়ি গুলো প্রতিটা পলকে পলকে দুলছে। আহা কি অপুর্ব!! এক কথায় অসাধারণ! ক্রাশ খাওয়ার জন্য এর থেকে বেশি আর কি লাগে?? আমি যে দিনে প্রতিটা মুহুর্তে আলাদা আলাদা ভাবে ক্রাশ খাচ্ছি উনার সৌন্দর্যে। যেই সৌন্দর্য্যের বর্ণনা দিয়েও শেষ করা যায়না। মানুষ এতো সুন্দর হয়?? উনি সত্যিই মানুষ তো?? নাকি কোনো স্বর্গীয় দূত আমার সামনে দাড়িয়ে? আমার ভাবনার টনক নাড়িয়ে মুচকি হাসলেন উনি। উনার সেই হাসির সাথে সাথে যেন আমার মনের মধ্যেও ঘণ্টি বেজে উঠল। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে একটু ভাব দেখিয়ে বলে উঠলাম– কি ব্যপার?? শাড়ির আচল ধরে রেখেছেন কেনো?? এইটা কি ধরণের অসভ্যতা??
আমার কাছ থেকে এইরকম উত্তর হয়তো প্রত্যাশা করেনি উনি। তাই উনার মুচকি হাসিটা মিলিয়ে গেল সাথে সাথে। উপরের ঠোট দিয়ে নিচের ঠোটটা চেপে ধরে এক টানে আমাকে মিশিয়ে নিলেন উনার সাথে। আমি তাল সামলাতে না পেরে উনার পিঠ ধরে দাড়িয়ে পরলাম। উনি আমার গালে টাচ করে বললেন–
অসভ্যতার কি দেখেছো তুমি? সেরকম তো কিছুই দেখালাম না এখনো। বাট একবার যদি দেখানো শুরু করি….. তাহলে সেটা কোথায় গিয়ে শেষ হবে আমি নিজেও জানিনা। ( এক ভ্রু উচু করে)
উনার কথার সুর শুনে মনে হচ্ছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। আমি ঢোক গিলে নিজেকে ছাড়াতে যাব তার আগেই আমার কোমরে হাত রাখলেন উনি। কিন্তু এবার হাতটা গিয়ে পরল কোমরের একদম খালি জায়গায়। যেখান থেকে শাড়ির কাপড় হালকা সরে গিয়েছিল। ঠিক সেই জায়গা টায়। আমি একশ ভোল্টের একটা শক খেয়ে কেপে উঠলাম। মুখে বিরাট হা নিয়ে চিৎকার করতে চাইলাম। কিন্তু সেটাও আর হল না। তার আগেই শব্দ করার সমস্ত উপায় বন্ধ হয়ে গেল আমার। এইভাবে কতটা সময় কেটে গেছে জানিনা….. কিন্তু হঠাৎ কারো পায়ের শব্দে আলোর বেগের মতো ছিটকে সরে পড়লাম দুজন দুদিকে। আমি ছাদের এক প্রান্তে দেয়াল ধরে দাড়ালাম। উনি আরেক প্রান্তে গিয়ে পকেটে হাত গুজে উল্টো দিকে মুখ করে দাড়িয়ে পরলেন। যেন কিছুই হয়নি। আমার হাত পা এখনো খানিকটা কাপছে। বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছি আমি। আড়চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলাম মা এসেছে। সাথে বড়সড় একটা বালতি। বুঝলাম কাপড় নাড়তে এসেছে। আমাদের দুজনকে দেখেই মা বলে উঠলেন–
ইশান……( ইশান ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে) তারু……( আমার দিকে তাকিয়ে) তোরা এখানে কি করছিস?? ( কনফিউজড হয়ে)
মায়ের কথায় আমরা একজন আরেকজনের দিকে এমন ভাবে তাকালাম যেন কত ইনোসেন্ট বাচ্চা আমরা! মা না বললে হয়তো জানতেই পারতাম না যে উনি এখানে আছে কিংবা উনিও জানতো না যে আমি এখানে আছি। এমন একটা ভাব। মা আমাদের চোখাচোখি তে কি বুঝলেন জানিনা….. কিন্তু হুট করে ভ্রু কুচকে মা বলে উঠলেন–
তারু! একবার এদিকে আয় তো মা!
আমি অপ্রস্তুত হয়ে মায়ের সামনে গেলাম। কেমন জানি একটা লজ্জা লজ্জা লাগছে আমার মায়ের কাছে যেতে। মনে হচ্ছে আমাকে কাছ থেকে দেখলেই মা সব বুঝে ফেলবে। সেই ধারণা আরো প্রখর হলো যখন দেখলাম মা খুব মনোযোগের সাথে আমাকে পর্যবেক্ষন করছেন। আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মা বলল–
ঠোটে কি হয়েছে তোর?? এরকম ফুলে আছে কেন?? ব্যথা পেয়েছিস?
মায়ের কথাটা হজম হল না আমার। সঙ্গে সঙ্গে গলা দিয়ে অদ্ভুত শব্দ বেরিয়ে আসল। আমি হাত দিয়ে ঠোট ঢেকে নিলাম। এতে যেন মায়ের কৌতুহল আরো বেড়ে গেল। মা আবার জিজ্ঞেস করলেন–
কিরে কি হয়েছে??
আমি কি বলব কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। মাথার সিস্টেম নষ্ট হয়ে গেছে। কয়েকবার আমতা আমতা করে হঠাৎ বলে ফেললাম–
মৌমাছি।
কথাটা বলেই থেমে গেলাম আমি। এই কথা আমি কেন বললাম নিজেও বুঝতে পারছি না। ছোটবেলায় একবার মৌমাছির কামড়ে আঙুল ফুলে গিয়েছিল। সেই কানেকশন টেনে এনে এইখানে জুরে দিয়েছি। কে কি ভাবছে জানিনা। ইশান ভাইয়ার মুখের এক্সপ্রেশন টা দেখতে ইচ্ছে করছে খুব। কিন্তু আপাতত উনার দিকে তাকানোও হারাম। মা অবশ্যই সন্দেহ করবে। মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছি। মা বলে উঠলেন–
মৌমাছি??
হ্যা…… মৌমাছি কোথা থেকে এসে কামড়ে দিল।
হারামি মৌমাছি আর কোনো জায়গা পেল না কামড়ানোর?? ঠোটেই কামড় টা দিতে হবে?? কি বিছরি দেখাচ্ছে।
পেছন থেকে ইশানের বিষম খাওয়ার শব্দ শোনা গেল। মা তো কথাগুলো খুব স্বাভাবিক ভাবে বলছে…..কিন্তু মিনিং কতটা বাজে দাড়াচ্ছে সেটা তো মা নিজেও জানেনা।
মা আবার বললেন– তারু তুই রান্নাঘরে যা। আমি এসে হলুদ গুলিয়ে লাগিয়ে দিব। তাহলে যদি ব্যথা কিছুটা কমে। যা জলদি যা।
আমি আর এক মুহুর্তও অপেক্ষা না করে ছুট লাগালাম। দরজার সামনে গিয়ে আরেকবার পেছনে তাকিয়ে ইশানের রিয়েকশন টা দেখে নিলাম। বেচারার সাদা ফকফকা মুখটা কেমন লাল টুকটুকা হয়ে গেছে। কি কিউট লাগছে দেখতে!! দাত বের করে হেসে দিয়ে আবার ছুটতে লাগলাম আমি। হাসি যেন থামতেই চাইছে না। বেচারাকে শেষ মেষ মৌমাছি বানিয়ে দিলাম। আর মায়ের কাছে হয়ে গেল হারামি মৌমাছি! ভাবা যায়?? আমার হাসি থেমে গেল যখন বুড়িটাকে দেখলাম বড়সড় একটা ডিশ হাতে রান্নাঘর থেকে বের হচ্ছে। ডিশের মধ্যে জুস…. মিষ্টি…. ভাজাপোড়া আর অনেক রকমের নাস্তা। আমি বুড়িকে জিজ্ঞেস করলাম–
এসব কোথায় নিয়ে যাচ্ছো দাদি??
বুড়ি মুখে হাসি নিয়ে বলল– মেহমান আইসে।
কে আসছে??
দাদি আমার কথার উত্তর না দিয়ে আমাকে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত একবার দেখে নিল। ভারি ডিস টা আমার হাতের উপর তুলে দিয়ে বলে উঠল–
যা তুইই লইয়া যা।
আমি নিয়ে যাব মানে??
আরেহ তোরেই তো দেকতে আইসে হেরা??
কারা??
ওইযে ওই পোলায় আর পোলার মা বাপ। বিদেশ থেকা সাই পাশ করসে যে পোলায়!
আমি এতোক্ষনে বুঝতে পারলাম সব রহস্য। তাহলে এইজন্যই সকাল থেকে আমাকে এতো তুলুতুলু করছিল বুড়িটা?? শয়তানি বুড়ী!! এই ছিল তোর মনে??
চলবে