#দখিনা_হাওয়া
#মারিয়া_আক্তার
[০২]
বারান্দায় দেয়ালের সাথে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে বিন্দু। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। ওয়েদারটা মন্দ না। বিন্দুর বৃষ্টি খুব পছন্দের তবে আজ তাও ভালো লাগছে না।
– কিরে কি হয়েছে আজ মির্জা বাড়িতে? কখন থেকে কিছু জিজ্ঞেস করছি উত্তর দিচ্ছিস না কেন?
বিন্দুর কোনো ভাবান্তর হলো না। আসমা বেগম এবার বিরক্ত হয়ে গেলেন। অনেক্ষণ ধরে মেয়েকে জিজ্ঞেস করছেন কিন্তু উত্তরই দিচ্ছে না। আর ওইদিকে তার স্বামী খাটে শুয়ে আছেন, বলে দিয়েছেন ওনাকে যেন ডিস্টার্ব না করা হয়।
– সে কখন থেকে কিছু জিজ্ঞেস করছি তোকে কানে যাচ্ছে না তোর?
আসমা বেগমের ঝাঁঝাঁলো গলার আওয়াজে বিন্দু এবার চোখ খুলে। মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে ফ্লোর ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। রুমে যেতে যেতে বলে,
– আমার এ ব্যাপারে কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই আম্মু। প্লিজ এখন আমায় একা থাকতে দাও।
আসমা বেগমও বিন্দুর পিছন পিছন রুমে ঢুকলেন। বিন্দুর হাত ধরে বলেন,
– তোর কি শরীর খারাপ?
– না আম্মু। ভালো লাগছে না। এখন আমি তোমায় কিছু বলতে পারবো না পরে সব বলবো। এখন তুমি প্লিজ যাও।
আসমা বেগম এতে আর দ্বিরূক্তি করলেন না। ওনার মেয়েটা যথেষ্ট বাধ্য। কখনো বাবা-মায়ের অবাধ্য হয়নি। এখন ভালো লাগছে না বলেই হয়তো কিছু বলতে চাইছে না। পরে সব বলে দিবে মাকে। কিন্তু তার একটা চিন্তা থেকেই গেল। আজ কি এমন হলো মির্জাবাড়িতে যার জন্য বাপ মেয়ে মনমরা হয়ে আছে। বিন্দুর মা রুম থেকে বের হওয়ার দু’মিনিট পর বিন্দুর বোন ফারিন রুমে আসে। বিন্দু এখন বিছানার ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। ফারিন দৌঁড়ে গিয়ে বোনের গায়ের ওপর শুয়ে পড়ে। আকস্মিক আক্রমণে বিন্দু লাফিয়ে উঠে। বিন্দু জানে কাজটা কার।
– এসব কি হচ্ছে ফারু? নাম আমার ওপর থেকে। তোর জন্য কবে জানি আমার কোমরের হাড়গোড় সব ভেঙ্গে যায়। এত বড় হয়েছিস তাও তোর বাচ্চামো যায় নি।
ফারিন নামলোতো না-ই বরং বিন্দুর পিঠের ওপরে শুয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে তাকে।
– আমার বয়স আর কতই বল আপু? আমি কি এখনো বড় হয়েছি নাকি? তোর ছোট্ট একটা বোন আমি।
– তুই আগে নামবি? ছোট্ট বোন! ধামড়ি হয়েছে একটা।
বিন্দু ভেঙ্গিয়ে ভেঙ্গিয়ে বলে। ফারিন এবার নেমে গিয়ে বিন্দুর পাশে শুয়ে পড়ে।
– এগুলা কি ধরনের ভাষা আপু? ধামড়ি কি?
– ইন্টারে পড়ুয়া মেয়ে নিজেকে ছোট বলে দাবি করছে, তাকে ধামড়ি বলবো না তো কি বলবো?
ফারিন মুখটাকে ছোট করে ফেলে। তারপর কি ভেবে যেন বলে ওঠে,
– কি হয়েছেরে আজকে? আব্বুকে দেখলাম রুমে চুপচাপ শুয়ে আছে, কথা বলছে না। আবার তুইও মনমরা হয়ে বসে আছিস। কেইসটা কি?
– কিছু হয় নি। এমনিই ভালো লাগছে না।
– আমি কিন্তু সব কথা তোকে বলে দিই আপু। তুই আমায় কখনো কিছু বলতে চাস না।
– আমার এই ব্যাপারটা নিয়ে এখন কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। পরে বলবো।
ফারিন মুখটাকে ছোট করে বলে,
– ঠিক আছে। ঘুমা এখন। আমার আবার কালকে কলেজে তাড়াতাড়ি যেতে হবে। ইশরার বার্থডে তাই সবাইকে ট্রিট দেবে ও।
– আচ্ছা ঘুমা।
______________
– দোস্ত তুই ভার্সিটিতে আসিস না কেনোরে? আরানটাও আসছে না। তোরা দু’জন না আসলে ভালোলাগে নাকি।
ফোনের ওপাশের নুশরাতের প্রশ্নে বিন্দু উত্তর দেয় না। সে আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠতে উঠতে বলে,
– এত ভোরে ফোন দিয়েছিস কেন? জানিস না এখন মানুষ ঘুমে থাকে?
– দোস্ত! এখন ভোর? পাগলি ঘড়ির কাঁটা দশটায় গিয়ে ঠেকেছে বহু আগে। আর মহারানীর ঘুমোনোর সময় এখন? এই আগে বলতো তুই ভার্সিটি আসিস না কেন?
– তুই আজ গেছিলি নাকি?
– হুম গেছিলাম তো।
– আরান যায়নি আজ?
– নারে, তুই এই তিনদিন ভার্সিটি আসিস নি। আরানটাও এই তিনদিন আসে নি, কেন বলতো? এই তোরা কি যুক্তি করে আসিস না নাকি? হ্যাঁ?
– আরে ধুর, আমি এখন ঢাকাতেই তো নাই। লক্ষ্মীপুরে নানুর বাসায় আসছি। আর শঙ্খের সাথে এই কয়দিন আমার যোগাযোগ ছিল না। ও কেনো যায়নি সে ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। ওই শুন কাল আমরা ঢাকায় ব্যাক করবো। আমি কাল ভার্সিটি যাবো। কিছুদিন পরইতো থার্ড ইয়ারের ফাইনাল এক্সাম। এখন ভার্সিটি মিস করা যাবে না।
– আচ্ছা আসিস। আমি বরং আরানকে ফোন দিয়ে দেখবো।
– আচ্ছা রাখ এবার। আমি এখন ঘুমোবো।
– আচ্ছা।
বিন্দু পুনরায় শুয়ে পড়ে। শুয়ে পড়ার দুই মিনিট পরই আবার তার ফোন বেজে উঠে। বিন্দু বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে ফেলে। কে ফোন করেছে তা না দেখেই ফোন কানে লাগায়।
– হ্যালো।
– বিন্দু আমি আরান।
বিন্দু চট করে চোখ খুলে শোয়া থেকে উঠে বসে। সেদিন আরানদের বাড়ি থেকে আসার পর একবারের জন্যও আরানের সাথে তার কথা হয়নি।
– তুই? কিছু বলবি?
– বিন্দু আমি সরি। আমি তোকে আগে বলেছিলাম বন্ধুত্বে নো সরি নো থ্যাংকস। কিন্তু আজ আমায় বলতে হচ্ছে। বিশ্বাস কর তোর আর আঙ্কেলের সাথে করা বড়ফুফুর ওইদিনের ব্যবহারটা আমি আজও ভুলতে পারছি না। এর জন্য আমি খুব লজ্জিত। তাই আমি তোর সাথে কোনোরকম যোগাযোগ করার সাহস পাই নি। প্লিজ পারলে ক্ষমা করিস আমাদের।
– সামনে পেলে থাপ্পড় মেরে দাঁত ফেলে দিতাম তোর। সরি কি হ্যাঁ? তোর কাছে সরি চেয়েছি আমি? অপমান করেছে তোর ফুফু সরি বললে উনি বলবেন, তুই কেন সরি বলছিস? নাকি মহান হতে চাইছিস?
– বিন্দু কি যা তা বলছিস তুই? আমি তোর কাছে মহান হতে চাইবো কেন?
– আরে ছাড়তো এসব ভালো লাগছে না। এবার বলতো তুই ফোন দিয়েছিস কেন? এই কারণ ছাড়া অন্যকোনো কারণ থাকলে বল, নাহলে ফোন রাখ। আমি এখন ঘুমাবো।
– বিন্দু তুই আগে বল আমাদের ক্ষমা করে দিয়েছিস?
– তুই আমার সাথে এমন কিছুই করিস নি যার জন্য আমি তোর ওপর আমি রেগে থাকবো।তবে হ্যাঁ আমি আর কখনো তোদের বাড়িতে যাবো না।
– বিন্দু!
– হ্যাঁ আরান। তোর ফুফুর করা ওইদিনের অপমান আমি কোনোদিন ভুলবো না। তবে চিন্তা করিস না এসবের জন্য আমাদের বন্ধুত্বে কোনো ধরণের আঁচ আসবে না। আমাদের বন্ধুত্ব অটুট থাকবে।
ফোনের ওপাশ থেকে আরানের তৃপ্তির হাসি শোনা যায়।
_____________
প্রবাদে আছে সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। তেমনি নদীর স্রোতের মতই বিন্দুর সময়গুলোও চলে যাচ্ছে। বিন্দুর তৃতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষাও সন্নিকটে। আর মাত্র এক সপ্তাহ আছে। বিন্দু পুরোদমে পড়াশোনা শুরু করেছে। বিন্দুর স্বপ্ন সে একজন প্রফেসর হবে। বাবার মত এই শিক্ষকতা পেশাটাকে সে বেচে নিতে চাইছে। দেখা যাক কি হয়। বিন্দু একবার হাত ঘড়ি তো একবার রাস্তার দিকে তাকাচ্ছে। ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে সে এখন রাস্তায়। কিন্তু এই ভরদুপুরে রিক্সা পাওয়া যাচ্ছে না। বিন্দুর ভার্সিটি থেকে বাড়ি অনেকটা দূর। সে হেটে যাবে কিভাবে? আবার বিকেলে টিউশনিও আছে। বিন্দুর টিউশনিতে তার মায়ের আপত্তি আছে। তার মায়ের অভিমত তাদের মাত্র দুইটা মেয়ে, দুটো মেয়ের ভরণপোষণের জন্য যতটুকু সম্পদ প্রয়োজন তাদের ততটুকু সম্পদ অবশ্যই আছে, এসব টিউশনি ফিউশনির প্রয়োজনটা কি? কিন্তু বিন্দুর বাবা বলেন অন্যকথা, তার অভিমত মেয়ে যদি টিউশনি করে তাহলে মাস শেষে মেয়ের হাতে কিছু টাকা আসবে। অনেকসময় দেখা যায় মেয়ে বড় হলে বাবা-মায়ের কাছে টাকা চাইতে লজ্জা পায়। তবে নিজে টিউশনি করলে নিজের হাতেই মাস শেষে টাকা আসে। আর অন্যকে পড়ালে নিজেরও এতে কিছু শিখা হয়ে যায়। তাই তিনি সবসময় বিন্দুকে টিউশনি করতে উৎসাহিত করেন। বিন্দু অন্যমনষ্ক হয়ে হাঁটছিল। তাই সামনে কি আছে সেসবে খেয়াল করেনি সে। হাঁটতে হাঁটতে কারো সাথে ধাক্কা খায় বিন্দু। তার মনে হচ্ছে কপালটা দুই ভাগ হয়ে গেছে। বিন্দু কপাল ঢলে সামনে তাকিয়ে দেখে একটা ছেলের পিঠের সাথে ধাক্কা খেয়েছে সে। ছেলেটা পিছনে তাকাতেই বিন্দু ঝটকা খায়। আরে এতো আরাধ। আরাধের সামনে একটা গাড়ি দাঁড় করানো। এটা আরাধের গাড়ি। এটা আরাধের অফিস থেকে দিয়েছে, আরান বলেছিল একদিন। আরাধ বিরক্তি নিয়ে বিন্দুর দিকে তাকায়।
– এই আপনি চোখগুলো রেখেছেন কেন বলুনতো। একবার আমার গায়ের ওপরে এসে পড়েন, আবার আমার সাথে ধাক্কা খান। চোখ থাকতেও যেহেতু চোখে দেখেন না তাহলে এই চোখগুলো রাখার মানে কি?
আরাধের কথায় বিন্দুর মেজাজটাই বিগড়ে গেল। তাও নিজের রাগটাকে দমন করে বিন্দু নিঃশব্দে জায়গা ত্যাগ করতে যাচ্ছিল। আরাধ বিন্দুর পথ আটকে দাঁড়ায়। বিন্দুর এতে ভ্রুঁ কুঁচকিয়ে যায়। বিন্দু কোনো রকম ভনিতা ছাড়াই বলে,
– এসবের মানে কি? পথ আটকাচ্ছেন কেন?
বিন্দুর প্রশ্নে তেতো মুখে আরাধ বলে,
– ভুল হলে সরি বলতে হয় জানেন না আপনি? নাকি কোনো কিছুই শেখেন নি?
– ভুলের কথা আসছে কেন? আপনার সাথে আমার এক্সিডেন্টলি ধাক্কা লেগেছে। আর তাছাড়া রাস্তার মধ্যে এভাবে খাম্বার মত দাঁড়িয়ে ছিলেন কেন? এভাবে থাকার মানে কি? যদি সরি বলতে হয় তাহলে সেটা আপনি বলবেন।
– আমার গাড়িটা খারাপ হয়ে গেছে ড্রাইভার গাড়ি ঠিক করছে। গাড়ি থেকে নেমে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলাম মাত্র। তারপরেই আপনি এসে ধাক্কা মারলেন আমায়। আমিতো উল্টো দিকে ফিরে ছিলাম তাই আপনাকে দেখতে পাইনি কিন্তু আপনারতো আমায় দেখতে পাওয়ার কথা। তাহলে ধাক্কাটা লাগলো কেনো?
আরাধের যুক্তিসঙ্গত কথার বিপরীতে বিন্দু কথা খুঁজে পেলো না। আসলে দোষটা তারই। অন্যমনষ্ক ছিল বলে আরাধকে খেয়াল করে নি সে। কিন্তু বিন্দু নিজের দোষটা স্বীকার করতে নারাজ। সেখানে যদি আরাধ থাকে তাহলেতো নয়-ই। বিন্দু একটা কথা ভেবে অবাক হয়ে যায় আরাধ তার সাথে এমনভাবে কথা বলছে যেন সেদিনের ঘটনার কথা তার মনেই নেই। অবশ্য আরাধ প্রথম থেকেই এই বিয়ের ব্যাপারটাতে তেমন কোনো ইন্টারেস্ট দেখায় নি। হ্যাঁও বলেনি নাও বলেনি। বিন্দু এবার হাতঘড়িটায় একবার চোখ ভুলিয়ে আরাধের পানে চেয়ে বলে,
– আমার দেরি হচ্ছে। আমায় প্লিজ যেতে দিন। পথ থেকে সরে দাঁড়ান।
– সরি না বলে পালাতে চাইছেন?
বিন্দু এবার বেশ চটে যায়।
– কিসের সরি বলবো আমি? ব্যথা পেয়েছি আমি কিন্তু আপনাকে সরি বলতে কেন হবে শুনি? রাস্তা থেকে সরে দাঁড়ান আপনি। আপনার সাথে কোনো কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই আমার। আপনাকে দেখলে রাগে আমার শরীর রি রি করে উঠে। আপনাকে আমি বিন্দুমাত্র সহ্য করতে পারি না। আপ..।
আরাধ বিন্দুর কথার মধ্যেই বিন্দুর পথ ছেড়ে দাঁড়ায়। মুখটা তার থমথমে হয়ে রয়েছে। বিন্দুকে সম্পূর্ণ ইগনোর করে গাড়িতে উঠে বসে সে। সাঁ সাঁ করে গাড়িটি বিন্দুকে পাশ কাঁটিয়ে চলে যায়। বিন্দু হ্যাবলার মত আরাধের গাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে। গাড়িটা দৃষ্টিসীমার বাহিরে গেলে বিন্দু বিরবির করা শুরু করে দেয়।
– হুহ্ ভাব, এটিটিউড দেখাচ্ছে। আমার কথাকে ইগনোর করে চলে গেল। যত্তসব। এর এত এটিটিউড কোত্থেকে আসে আল্লাহ ভালো জানে? শাপলা বেগম বিয়েতে না করলে আমি নিজেই নাকোচ করে দিতাম। এত এটিটিউডওয়ালা একটা মানুষকে আমি বিয়ে করতাম না। এধরনের মানুষগুলো দেখলে আমার গা পিত্তি জ্বলে উঠে।
চলবে…