না_চাইলেও_তুই_আমার পর্ব ২৫+২৬

#না_চাইলেও_তুই_আমার
[ সিজান ৩ ]
#লেখিকা_সারজীন_ইসলাম
#পর্ব- ২৫
দুপুরের কড়া রোদে মধ্যে মিরান কে ও আসতে হয়েছে ওর ছোট ভাই-বোনদের ঘোরাঘুরি করতে। এদিকে আজ মিরানের ছুটি শেষ। কাল থেকে আবার মিরানকে আগের নেয় হসপিটাল জয়েন করতে হবে। আগের মত হসপিটাল আর বাড়ি, আবার বাড়ি আর হসপিটাল, ফিরে যাবে আগের ব্যস্ত জীবনে। মিরানের মাম্মা পাপা মিরান ঢাকা চলে যাওয়ার এক দুই দিন পর তারাও ঢাকায় চলে যাবে। এসব ভাবনায় মশগুল যখন মিরান তখন ওর পাশের সিটের শান্ত হয়ে বসে বলল,

—-” কী ভাবছিস তখন থেকে এত উদাসীন কেন?”

মিরান ঘাড় ঘুরিয়ে শান্তর দিকে তাকায়। কিছু না বলে সামনের বটবৃক্ষের দিকে তাকায়। মিরানকে চুপ থাকতেন দেখে শান্ত আবারো বলল,

—-” এত উদাসীনতা কবিদের সাজে তোর মত ডাক্তারদের সাজে না।”

মিরান শান্তর কোন কথার উত্তর না দিয়ে মৃদু স্বরে বলল,

—-” কাছের মানুষগুলো দেওয়া কষ্ট, অবহেলা, দয়া বা করুণা সবকিছু সহ্য করা যায়। কিন্তু অপরিচিত বা অজ্ঞাত কেউ যদি করুণা করে তাহলে? পারবি তো সহ্য করতে?”

শান্ত মিরানের কথার মানে বুঝতে না পেরে বলল,

—-” মানে কী বলতে চাইছিস তুই?”

মিরান শান্তর দিকে এক নজর তাঁকিয়ে বলল,

—-” কিছু না! আমাকে একটু একা থাকতে দিবি? আজ খুব একা থাকতে ইচ্ছে করছে!”

শান্ত একনজরে মিরানের চোখ দেখে আঁতকে উঠে। এতক্ষণ সানগ্লাস পরা ছিল বিদায় মিরানের চোখ দেখতে পাইনি শান্ত। কিন্তু এখন মিরানের একনজর তাকানোতে? শান্ত কিছু বলতে গিয়েও না বলে উঠে দাঁড়ালো। শান্ত সামনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলল,

—-” একাকীত্ব জিনিসটা খুব খারাপ! তাড়াতাড়ি চলে আসিস। আমি অপেক্ষা করবো তোর জন্য।”

শান্ত আর কিছু না বলে ওখান থেকে চলে যায়। আর মিরান একদৃষ্টিতে বটবৃক্ষের টার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে গাইতে শুরু করে।

যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে
একলা চলো রে।
একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো রে॥
যদি কেউ কথা না কয়,
ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি সবাই থাকে মুখ ফিরায়ে সবাই করে ভয়—
তবে পরান খুলে ও তুই মুখ ফুটে তোর মনের কথা
একলা বলো রে॥

যদি সবাই ফিরে যায়,
ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি গহন পথে যাবার কালে কেউ ফিরে না চায়—
তবে পথের কাঁটা ও তুই রক্তমাখা চরণতলে
একলা দলো রে॥

যদি আলো না ধরে,
ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি ঝড়-বাদলে আঁধার রাতে দুয়ার দেয় ঘরে—
তবে বজ্রানলে আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে
একলা জ্বলো রে॥

______________________________

মিরা আর মিহান দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পরে ওদের রুমে বসে আছে। দু’জনেই সেই সকাল থেকে চিন্তায় ডুবে আছে। ওদিকে কী হচ্ছে কে জানে? মিরান কী তোহার প্রপোজ এ রাজি হবে? মেনে নিবে তোহা কে?নানা ধরনের প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে ওদের মাথায়। মিহান মিরার দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,

—-” তোমার কী মনে হচ্ছে মিরান তোহাকে মেনে নেবে? না কী?”

মিরা চিন্তিত কন্ঠে বলল,

—-” আমারও তো সেই একই বিষয়ে চিন্তা হচ্ছে গো। ছেলেটা মেনে নেবে ওকে? তোহার চোখেমুখে আমি মিরানের জন্য সমুদ্র সমান ভালোবাসা দেখেছি। কিন্তু মিরান?”

মিহান ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

—-” সেটাইতো চিন্তার!”

মিরা আফসোস করে বলল,

—-” কেন যে ওকে সেদিন ওমন কথা দিতে গিয়েছিলাম?”

মিহান ধীর গলায় বলল,

—-” যা হয়ে গেছে তা নিয়ে ভেবে কী হবে? ভবিষ্যতে কী হবে সেটা নিয়ে চিন্তা করো!”

কয়েক বছর আগে মিরান কোন কারনে ওর মাম্মা পাপা নিজের কসম দিয়ে দেয়, ওর বিয়ে নিয়ে কেউ কখনো আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে পারবে না। এখন যে মিরা মিহান বলবে তোহা কে মেনে নিতে কিন্তু মিরিনের কসমের জন্য তাও পারছে না। এই বিষয়ে মিরান যে সিদ্ধান্ত নিবে তাই ওদের মেনে নিতে হবে।

______________________________

শান্ত এসে দাঁড়ায় মিরানের থেকে কিছুটা দূরে। এখনো ষ্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এক দৃষ্টিতে বটবৃক্ষের দিকে তাকিয়ে আছে মিরান। হঠাৎ করে তোহা এসে শান্তর পাশে দাঁড়িয়ে বলল,

—-” কী হলো ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছেন কেন এখানে?”

শান্ত ছোট করে বলল,

—-” ওকে দেখছিলাম!”

তোহা ছোট ছোট করে বলল,

—-” কাকে দেখছেন?”

এই বলে তোহা শান্তর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকায়। মিরান কে বিষন্ন অবস্থায় দেখে তোহা তাড়াতাড়ি করে বলল,

—-” কী হয়েছে ওর এভাবে বসে আছে কেন?”

শান্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

—-” জানিনা আমি, কিন্তু এটুকু বুঝতে পারছি কোন কারনে মিরানের মন খারাপ।”

তোহা শান্তর দিকে তাকিয়ে বলল,

—-” আমি গিয়ে কথা বলব ওর সঙ্গে?”

শান্ত কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

—-” দেখতে পারো কথা বলে।”

শান্তর কথা শুনে তোহা ওখান থেকে ধীর পায়ে মিরানের দিকে যায়।

______________________________

তোহা মিরানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মিরান এক পলক তোহার দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল,

—-” কিছু বলবেন।”

তোহা মৃদু স্বরে বলল,

—-” কিছু কী হয়েছে তোমার?”

মিরান কৃত্রিম হেসে বলল,

—-” ধুর, আমার আবার কী হবে? কিন্তু আপনাকে দেখে মনে হয় আপনি আমাকে কিছু বলতে চাইছেন।”

তোহা মাথা নাড়িয়ে বলল,

—-” হুম।”

মিরান মৃদু হেসে বলল,

—-” বলুন না তাহলে!”

তোহা মিরানের সামনে দুই হাঁটু গেড়ে বসে ওর আঙুল দিয়ে একটা আংটি খুলে মিরানের সামনে ধরে বলল,

—-” তুমি হয়তো এতদিনে বুঝে গেছো আমি ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলতে পারিনা। তাই এখন যা বলছি একদম মন থেকে বলছি। আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। কখন? কীভাবে? তা আমি নিজেই জানিনা। কিন্তু ভালোবাসি….

তোহার কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে মিরান তোহাকে হাত দিয়ে থামিয়ে দিয়ে ওর দিকে একটা খাম এগিয়ে দেয়। তোহা বিস্ময় নিয়ে খাম টার দিকে তাকায়। মিরান চোখের ইশারায় খাম নিতে বললে। তোহা কাঁপা কাঁপা হাতে খাম টা নিলে মিরান হনহনিয়ে ওখান থেকে চলে যায়।#না_চাইলেও_তুই_আমার
[ সিজান ৩ ]
#লেখিকা_সারজীন_ইসলাম
#পর্ব- ২৬
অবাক হচ্ছেন তাইনা? আমি আপনার কথার উত্তর না দিয়ে উল্টো একটা এনভেলাপ আপনার হাতে ধরিয়ে দিয়ে এলাম। এতে অবাক হবারই কথা। আমি মনে হয় এই পৃথিবীতে প্রথম ব্যক্তি যে আমাকে কেউ প্রপোজ করল উল্টো আমি তাকে একটা এনভেলাপ দিয়ে এলাম। যাগ্গে সেসব কথা। এখন আমার লেখা কথাগুলো মন দিয়ে পড়ুন। আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করি? উত্তরটা না হয় নিজেকেই দিয়েন। জানেন কাছের মানুষগুলো দেওয়া কষ্ট, অবহেলা, দয়া বা করুণা সবকিছু সহ্য করা যায়। কিন্তু অপরিচিত বা অজ্ঞাত কেউ যদি করুণা করে তাহলে? পারবি তো সহ্য করতে? আমি জানি আপনি পারবেন না। না পারার ই কথা! তাহলে আমি কিভাবে পারব বলতে পারেন? আমি এই ‘করুণা’ শব্দটাকে খুব ঘৃণা করি। কেন করি প্লিজ তা জানতে চাইবেন না কখনো। অনেক তো কথা হল এবার মূল কথায় আসি। আমি আপনার প্রস্তাবে না এখন আর না কখনো, রাজি নই। আপনি হয়তো এখন বিস্ময় হচ্ছেন তাই না? বিস্ময় হওয়ার ই কথা। আমি জানি এখন আপনার মনে হাজারো প্রশ্নের আনাগোনা। আপনি যে আমাকে প্রপোজ করবেন তা আমি কিভাবে জানলাম? আর আমি আপনার জন্য চিঠি টাই কখন বা লিখলাম? একে একে আমি আপনার সবগুলো প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। মনে আছে সকালবেলা আপনি আমার মাম্মা পাপার রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন? তখন আমি আমার রুমে বসে কিছু কাগজপত্র ঘাটাঘাটি করছিলাম। হাতের কাছে কলম না থাকায় আমি মাম্মাদের রুমে আছি পাপার কাছ থেকে তার কলম টা নিতে। কিন্তু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আপনাদের কিছু কথা শুনে দাঁড়িয়ে জাই আমি।

এইটুকু চিঠি পড়ে থামে তোহা। সকালবেলার ওই সময়কার ঘটনা মনে করতে শুরু করে। তোহা মিরানের মাম্মার কাছে গিয়েছিলো মিরান কে প্রপোজ করার বিষয়ে কথা বলতে। তাহলে কী ঐ সময় মিরান শুনে ফেলেছে ওদের কথা? আর না ভেবে আবার পড়তে শুরু করে চিঠিটা তোহা।

আপনাদের সব কথা শুনে আমি রুমে চলে আসি। দুপুরের পরে গিয়ে পাপার কাজ থেকে কলম নিয়ে এই চিঠিটা লিখে ফেলি। চিঠি লেখার কারণ হলো, আপনি যেন আমার কথাগুলো বুঝতে পারেন। এই কথাগুলো যদি আমি আপনার সামনে দাঁড়িয়ে বলতাম তাহলে আপনি আমার একটা কথা শুনতেন না উল্টো আরো আমার শার্টের কলার চেপে ধরে আমার সঙ্গে রাগারাগি করতেন। যাই হোক আর কথা বাড়াতে চাইনা। ভালো থাকবেন আপনি আপনার কাছের মানুষগুলোর সঙ্গে।

ইতি
আপনার অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি!

তোহা বটবৃক্ষের সাহায্যে নিজেকে আড়াল করে রেখেছে অনেকক্ষণ। চিঠিটা বটবৃক্ষের শিকড়ে আটকে আছে। তোহার চোখ লালচে আকার ধারণ করেছে। হয়তো অনেকক্ষণ অশ্রু বিসর্জন করার ফলে। এই প্রথম কাউকে ভালোবেসেছিলো, আর তার ভালোবাসার মানুষটি তাকে বুঝলো না। এসব ভেবে তোহা বটগাছে সঙ্গে মাথা হেলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকে।

______________________________

শান্ত আর অনন্যা তোহা কে খুঁজতে খুঁজতে বটগাছের দিকে এসে ডাকতে শুরু করে। কখন থেকে খুঁজে যাচ্ছে ওরা তোহা কে। শান্ত ওখানে এসে বেশ উঁচু গলায় বলল,

—-” তোহা, তোহা কোথায় তুমি?”

অনন্যা এদিকে ওদিকে তাকিয়ে বলল,

—-” ভাবি, ও ভাবি।”

অনন্যা তোহা কে খুঁজতে খুঁজতে বটগাছের কোনা দিয়ে তোহা কে দেখে দৌড়ে ওখানে গিয়ে বলল,

—-” ভাবি তুমি এখানে কী করছো? তোমাকে সেই কখন থেকে খুঁজছি।”

তোহা অনন্যার কথা শুনে চোখ খুলে তাকায়। তোহার চোখে পানি দেখে অনন্যা তাড়াতাড়ি করে ওর পাশে বসে বলল,

—-” ভাবি কী হয়েছে কান্না করছো কেন?”

তোহা কিছু না বলে পড়ে থাকা চিঠি টার দিকে তাকায়। অনন্যা তোহার দৃষ্টি অনুসরণ করে চিঠিটার দিকে তাকায়। অনন্যা হাত বাড়িয়ে চিঠি টা নেয়। চিঠিটা পড়ে ছলছল চোখে তোহার দিকে তাকায়। অনন্যা আর কিছু না বলে তোহা কে জড়িয়ে ধরে বলল,

—-” ধুর ভাবি এসব কিছু না। আমি বলছি তুমি আমার ভাবি হবে।”

এরমধ্যে শান্ত এসে ওদের পিছনে দাঁড়িয়ে বলল,

—-” কী রে তোহা কান্না করছে কেন?”

অনন্যা শান্তর দিকে তাকিয়ে বলল,

—-” বলছি একটু পরে ভাইয়া। তুমি গাড়িটা এখানে নিয়ে আসো। আমরা এখনি বাড়ি যাবো।”

শান্ত আর কিছু না বলে অনন্যার কথা মত চলে যায় গাড়ি নিয়ে আসতে।

______________________________

মিরা মিহান মন খারাপ করে বসে আছে। ওরা ভাবতে পারেনি মিরান এইভাবে তোহা কে প্রত্যাখ্যান করবে। তোহার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। আর মিরান? তার তো খোঁজ নেই সন্ধ্যার পর থেকে। মিহান মিরার দিকে তাকিয়ে বলল,

—-” আচ্ছা, মিরান এমন টা করলো কেন তুমি বলতে পারো?”

মিরা মৃদু স্বরে বলল,

—-” আমিও বুঝতে পারছি না।”

মিহান খানিক চুপ থেকে বলল,

—-” তুমি থাকো, আমি খোঁজ নিয়ে দেখি ছেলেটা কই গেলো আবার!”

মিহান রুম থেকে বেরিয়ে গেলে মিরা একা একা বিড়বিড় করে বলল,

—-” না আমি গিয়ে তোহা কে সামলাই। মেয়েটা চোখ মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না।”

চলবে…..

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here