মধ্যরাতে নিজের ঘরে অপরিচিত কোন মেয়ের উপস্থিতি বুঝতে পেরে চমকে গেলো কায়ান। ক্লা’ন্তি দূর করার জন্য ধোঁয়া ওঠা কফির মগ নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিলো সে। তুষারপাত দেখতে দেখতে গরম কফি খাওয়ার অনুভূতিই অন্যরকম। কিন্তু বারান্দায় দাঁড়াতেই সে অনুভব করতে পারলো তার বারান্দায় কেউ আছে এবং সে একজন মেয়ে৷ কিন্তু সম্পূর্ণ ঘরে কায়ান একাই থাকে, তাহলে মেয়ে এলো কিভাবে? ঘাড় গুঁড়িয়ে তাকালো সে, দূর থাকা ল্যাম্পপোষ্টের হালকা আলোতে দেখতে পেলো বারান্দার কোণে গুটিসুটি মেরে বসে আছে মেয়েটা। কায়ান এক পা সামনে এগোতেই মেয়েটি নিজেকে আরো গুটিয়ে নিলো। কায়ান স্পষ্ট বুঝতে পারলো সেটি তাই আর সামনে এগিয়ে গেলোনা। কাঁপা কাঁপা গলায় ইংরেজিতে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলো,
” কে তুমি? এতোরাতে আমার বাড়িতে কি করছো?”
উওরের জন্য কয়েক মিনিট অপেক্ষা করলো কায়ান কিন্তু মেয়েটা কিছুই বললেনা। একইভাবে হাঁটুতে কপাল ঠেকিয়ে বসে রইলো।
” কি হলো কিছু বলছো না কেন? আমার বাড়িতে কি তুমি চু’রি করেতে এসেছিলে? উওর দাও নয়তো আমি এখুনি পু’লিশ ডাকবো।” বিরক্তিমিশ্রিত কণ্ঠে বললো কায়ান। পু’লিশের কথা শুনে মেয়েটি ভ’য় পেয়ে গেলো। নিচু স্বরে ইংরেজিতে মিনতি করে বললো, ” প্লিজ পু’লিশ ডাকবেন না। আমি চু’রি করতে আসিনি, বি’পদে পড়ে এসেছি। দয়া করে আমাকে সাহায্য করুন।”
মেয়েটির কণ্ঠ শুনে কায়ান বুঝতে পারলো মেয়েটি সত্যিই বি’পদে পড়ে এখানে এসেছে। কিন্তু তাও কায়ানের মনে অবি’শ্বাসের রেশ থেকে যায়।
” আচ্ছা আমি পু’লিশ ডাকবো না তবে আমাকে সব সত্যি করে খুলে বলো। সত্যি কথা বললে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারবো।”
মেয়েটি কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে অনুরোধ করে বললো, ” আমাকে কি কিছু দেওয়া যাবে? বাইরে খুব ঠান্ডা।”
মেয়েটির কথা শুনে কায়ান হতাশাভরা নিঃশ্বাস নিলো।
দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী এবং অন্যতম ব্যস্ত শহর সউল। বছরের শেষ সময় চলমান, ঠান্ডা হওয়ার সাথে মাঝে মাঝে দেখা মিলছে তুষারপাতের। বাইরে তুষারপাত কিছুটা কমে এলেও ঠান্ডাভাব এখনো বিদ্যমান। মেয়েটিকে রুমের মধ্যে এনে একটা চাদর দিলে তাকে। মেয়েটির যে প্রচুর ঠান্ডা লাগছে তা বুঝতে পেরে কায়ান তাকে এক কাপ কফি এনে দিলো। কফির কাপে চুমুক দিয়ে মেয়েটি যেন স্বস্তির নিশ্বাস নিলো।
কায়ান একটু দূরে দাঁড়িয়ে মেয়েটিকে একবার দেখে নিলো। বারান্দায় অন্ধকার থাকার কারণে চেহারা দেখতে না পেলেও এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছে। মেয়েটির মুখে একটা বিদেশি ছোঁয়া থাকলেও তা এই দেশীয় নয়। কায়ানের মনে হচ্ছে তার মুখে দেশী-বিদেশী দু’টোরই ছোঁয়া আছে।
” এবার বলো তুমি কে? এই মধ্যরাতে আমার বাড়িতে কি করতে এসেছো? আর কিভাবেই বা আমার বাড়িতে ঢুকেছো তুমি?”
” আমি পাইপ বেয়ে উপরে উঠে এসেছি। কিন্তু দরজা বন্ধ থাকার কারণে আমাকে বারান্দায় বসে থাকতে হলো।”
মেয়েটির কথা শুনে কায়ানের চোখ দু’টো বড়ো বড়ো হয়ে এলো। এই ঘরের বারান্দায় পুরো গ্রিল দেওয়া নেই তাই যে কেউ সহজে উপরে উঠে আসতে পারে আর দোতালায় হওয়াতে তেমন একটা অসুবিধাও হয়না।
” কিন্তু তুমি আমার বাড়িতে এভাবে কেন এলে? আর আমি আসার আগেই চলে গেলে না কেন?”
” আসলে আমি কিছু কারণে বাইরে এসেছিলাম কিন্তু বাড়ি ফেরার সময় মনে হলো কেউ আমার পিছু নিচ্ছিলো তাই ভ’য় পেয়ে তোমার বারান্দায় এসে লুকিয়ে ছিলাম। কিন্তু পরে যখন নামার চেষ্টা করেছি তখন ভয়ের কারণে আর নামতে পারিনি। উপায় না পেয়ে এই শীতেও বাইরে বসে ছিলাম।”
মেয়েটার কথা শুনে কায়ানের খা’রা’প লাগলো। কফির কাপটা পাশে থাকা টেবিলে রেখে মেয়েটি বললো,
” ধন্যবাদ কফির জন্য, এটার খুব প্রয়োজন ছিলো এখন। ভাগ্যিস তুমি বারান্দায় এসেছিলে না হলে আমি এতোক্ষণে বরফে মতো জ’মে যেতাম।” কথাটা বলে হালকা হাসলো মেয়েটি।
” কিছু মনে করোনা এই মধ্যরাতে তোমাকে অনেক বিরক্ত করছি। আচ্ছা তোমার নামটা তো বললে না।”
” কায়ান মল্লিক, পেশায় একজন জার্নালিস্ট। তোমার নাম কি? আর এখানে কি করছো?”
” হাই মিস্টার কায়ান। মাই নেইম ইস এনাক্ষী বসু এন্ড আই এম এ ফরেনার স্টুডেন্ট।”
” এনাক্ষী ইউনিক নেইম। হোয়ার আর ইউ ফ্রম?”
” ইতালি এন্ড ইউ?”
” বাংলাদেশ।”
বাংলাদেশ শোনার সাথে সাথে মেয়েটা লাফিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। আচমকা এরকম কাজে কায়ান কয়েক কদম পিছিয়ে গেলো।
” সত্যি! তুমি বাংলাদেশ থেকে এসেছো?”
এতোক্ষণ তারা দু’জন সম্পূর্ণ ইংরেজি ভাষায় কথা বললেও আচমকা এই বিদেশিনীর মুখে বাংলা ভাষা শুনে চমকে গেলো কায়ান।
” তুমি বাংলা জানো?”
” অবশ্যই, আমার জন্মস্থান বলে কথা।”
” কিন্তু তুমি যে বললে তুমি ইতালি থেকে এসেছো?”
” সে অনেক লম্বা কাহিনি তবে ছোট করে বলি। আমি কিন্ডারগার্টেন স্কুল শেষ করার পর আমার পরিবারের সাথে ইতালিতে শিফট হয়ে গিয়েছিলাম, বাকি পড়াশোনা সেখানেই করেছি। আর বর্তমানে কোরিয়াতে এসেছি আরো পড়াশোনার জন্য।”
” বাহ্ খুব ভালো।”
” তোমাকে আমি বলে বোঝাতে পারবো না এতোবছর পর মন খুলে কারো সাথে বাংলা কথা বলতে পেরে আমার কতটা ভালো লাগছে। ইচ্ছে করছে তোমার সাথে শুধু কথায় বলে যাই।”
এনাক্ষীর কথা শুনে কায়ান হালকা হাসলো।
” তুমি কি কিছু খাবে?”
” হুম খাবার পেলে ম’ন্দ হয় না। সেই সন্ধ্যাবেলা একটা স্টোরে ডোনাট খেয়েছিলাম এখন তো পেটে তোমার সাইজের হাতি দৌড়াচ্ছে।”
কায়ান হেসে রান্নাঘরে ঘরে চলে গেলো কিছু বানাতে। এনাক্ষী ঘরটাকে দেখছে, ছোটখাটো গোছানো রুমটা।
” এই নাও আপাতত এগুলোই পেয়েছি।”
রামেনের বাটিটা নিয়ে এনাক্ষী খাওয়া শুরু করে দিলো, প্রচুর খিদে পেয়েছে তার। কিছুক্ষণর পর খাওয়ার বিরতি নিয়ে মাথা তুলে তাকালো।
” তুমি খাবেনা?”
” না, আমি খেয়ে এসেছি। তুমি তোমার সুবিধামতো ধীরে সুস্থে খেতে পারো।”
” তুমি তো জার্নালিস্ট তাহলে এতো রাত করে ফিরলে যে? তুমি কি প্রতিদিন এতো রাত করেই ফেরো?”
” না সবসময় নয় তবে আজ কলিগদের সাথে বাইরে ডিনার করতে গিয়েছিলাম৷ তাই দেরি হয়ে গেলো। কিন্তু তুমি এতো রাতে বাইরে কি করছিলে?”
এনাক্ষী মুখে বড় একটা হাসি ঝুলিয়ে রেখে বললো,
” সেটা তো বলা যাবে না। আচ্ছা আমাকে আরেকটা সাহায্য করতে পারবে? প্লিজ।”
” আরো সাহায্য? যদি না করি তবে?”
” তবে? তবে আমি এখুনি তোমাকে ব’ন্দি বানিয়ে তোমার সব জিনিস নিয়ে দৌড় দেবো।”
” তাই নাকি? পারবে আমাকে ব’ন্দি করতে? শক্তি আছে তোমার গায়ে।”
” শুনুন মিস্টার আমি দেখতে চিকনা হলেও কি হবে আমার অনেক শক্তি।” কথাটা বলে হালকা মুখ ভেঙালো এনাক্ষী। কায়ান হালকা শব্দ করে হেসে উঠলো।
” আচ্ছা বলো কি করতে পারি আমি তোমার জন্য।”
” তোমার ফোনটা একটু দেবে? একটা ফোন করবে?”
” তোমার ফোন নেই?”
এনাক্ষী মন খারাপ করে নিজের ফোনটা কায়ানের চোখের সামনে ধরলো।
” দৌড়ানোর সময় হাত থেকে পড়ে গিয়েছে এখন আর খুলছেনা। প্লিজ দাও, বেশি কথা বলবো না।”
কায়ান বালিশের নিচে থেকে এনাক্ষীকে ফোনটা বের করে দিলো। তারপর সে কাউকে ফোন করে কিছু কথা বলে আবারো ফোনটা ফেরত দিয়ে দিলো।
” কাকে ফোন করলে? তোমার ক্রা’ইম পার্ট’নারকে নাকি?”
” বলেছি তো আমি চো’র নয়, বিপ’দে পড়ে এসেছি।” আড়চোখে কায়ানের দিকে তাকিয়ে বললো এনাক্ষী। ” আমি আমার রুম মেইট ইন জু কে ফোন করেছিলাম, না হলে সে চি’ন্তা করবে আমাকে নিয়ে।”
কথার মাঝে কায়ান খেয়াল করলো এনাক্ষী কাঁ’পছে।
” তোমার কি খুব শীত করছে?”
” হুম এতোটা সময় বাইরে ছিলাম। কত বরফ যে পড়েছে গায়ে।”
কায়ান উঠে সব জানালা, দরজা বন্ধ করে দিলো এবং একটা কম্বল এগিয়ে দিলো এনাক্ষীর দিকে।
কথা বলতে বলতে একসময় এনাক্ষী ঘুমিয়ে পড়লো। এনাক্ষী ঘুমিয়ে গিলে কায়ান নিঃশব্দে রুম থেকে বেরিয়ে অন্যরুমে চলে গেলো।
রাত বাড়তে লাগলো, একই বাড়িতে অবস্থা করছে একজোড়া অপরিচিত মানব-মানবী। কেউ জানেনা সামনে কি হতে চলেছে, কার জীবনের মো’ড় পরিবর্তন হয়ে যাবে কোন এক অজানা নিশির প্রহরে।
চলবে…….
#নিশির_অন্তিম_প্রহরে
#পর্বঃ০১
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি