নীরবে তুমি রবে পর্ব -০৫

#নীরবে_তুমি_রবে
লেখনীতেঃ রিধিমা জান্নাত রূপা
পর্বঃ ০৫

.
“আমি তো বললাম বড়মা, এই বিয়েতে রাজি আমি। তাসফি ভাইয়ার কথা মতো তোমরা আয়োজন শুরু করো।”

“তুই মন থেকে কথাটা বলছিস তো মা?”

রূপার বলা কথাটা যেন ঠিক বিশ্বাস করতে পারলো না শাহানা বেগম। আবারও জানতে চাইলো সে কি সত্যিই মন থেকে রাজি এই বিয়ে তে? জোর করে কোন সিদ্ধান্ত’ই ছেলে মেয়ের প্রতি চাপিয়ে দিতে চায় না কেউই, কিন্তু এখানেই যেন নিরুপায় তারা। দেবরের মতো ছোট ভাইয়ের শেষ কথাটা রাখতে ও মেয়েটাকে কিছু মানুষের থেকে বাঁচাতেই তাসফির সাথে রূপাকে জুড়ে দিতে হবে, একটা ভরসা যুক্ত মানুষের ছায়াতলে রাখতে হবে মেয়েটাকে। আর সেই ভরসা যুক্ত মানুষ তাসফি ছাড়া হয়তো আর কেউ’ই হবে না রূপার জীবনে।

সুপ্ত নিশ্বাস ছাড়লো রূপার বড়মা। তাকালো মেয়েটার দিকে। রূপা বলে উঠলো,

“আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না বড়মা, আমি মন থেকেই বলছি। অনেক দিন তো হলো তোমাদের সাথে আছি, এবার তো নিজের একটা গতি করতেই হবে। তাছাড়া পড়াশোনার জন্য সামনের মাসে তো ঢাকা যেতেই হবে আমার, না-হয় তাসফি ভাইয়ার বউ হয়েই যাই সেখানে।”

“এভাবে বলিস না মা। রিমি, রিফার মতো তুইও আমার মেয়ে। ধরে রাখতে পারলে তোকে সারাজীবন আমার কাছে বেঁধে রাখতাম, কিন্তু….. তোর ক্ষতি আমরা কখনোই চাই না, এত তাড়াতাড়ি বিয়ের কথাও ভাবতাম না। তোকে বিপদের হাত বাঁচাতেই এত তাড়াতাড়ি বিয়ের কথা ভাবতে হয়েছে আমাদের।”

ঠিক বুঝতে পারলো না রূপা, বড়মা ঠিক কোন বিপদের কথা বলছে তাকে। তাসফিও তাকে বলেছিলো তার সেফটির জন্যই এই বিয়েটা করতে হচ্ছে, ফুপিও এমন কিছু বলে থেমে গিয়েছিলো। তাকে নিয়ে ঠিক কি বিপদের আশঙ্কা করছে সবাই? জানতে চাইলে না রূপা, আর না জিজ্ঞেস করলো বড়মা কে। কিছু কথা অজানাই থাক তার মাঝে, ভেবে নিক নিজ মনে।
.
সকালে বাবা মায়ের রুম থেকে বেড়িয়ে তাসফির সাথেই দেখা করেছিলো রূপা। তাসফির রুমে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো কেন এই বিয়েটা করতে চায় সে? কেনই বা তাকে হঠাৎ এই বিয়েতে রাজি হলো সে। সহসায় উত্তর দেয় নি তাসফি। একটু সময় নিয়ে বলে উঠেছিলো,

“বয়স তো আর কম হলো না, সাতাশ পেরিয়ে আটাশ ছুঁই ছুঁই। বিয়ের বয়স তো হয়েছে না-কি? তাছাড়া দু’চারটা গার্লফ্রেন্ডও নাই যে সুন্দরী একটা কে ধরে এনে বলবো—একে বিয়ে করবো।”

তাসফির জবাবে কিছুটা অবাক হয় রূপা। এই গম্ভীর মানুষটা এভাবেও কথা বলতে পারে তা যেন সে কল্পনাও করে নি। আর গার্লফ্রেন্ড? এই মানুষটার যে গার্লফ্রেন্ড নেই সেটা জানার পরও রূপা আশ্চর্য! হলো। কিন্তু এই লজিক’টা দিয়ে যে তাকে বিয়ে করতে রাজি হবে, সেই ভাবতে পারে নি রূপা। তাসফি কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,

“এমন ফালতু লজিক দিয়ে কেন রাজি হয়ছেন ভাইয়া। গার্লফ্রেন্ড নাই, কিন্তু মেয়ের তো অভাব নাই, আমাকেই কেন?”

“সবার আদরের মেয়ে তুমি, সেই তোমাকেই আমার জন্য ঠিক করলো সবাই। বড়দের কথা তো আর ফেলে দিতে পারি না? তাদের মনে কষ্ট দিয়ে কিছু করতেও পারবো না, তারা যখন চাইছে তখন এই বিয়ে তে আমার আপত্তি নেই।”

“কিন্তু আমি? আমি তো চাই নি এত তাড়াতাড়ি এমন সম্পর্কে জড়াতে। সময় চাই আমার অনেক অনেক সময় চাই। গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করতে চাই, আব্বুর কথা রাখতে সুশিক্ষিত হতে চাই…… ”

“আমাদের বিয়েটাও কিন্তু ছোট মামার শেষ ইচ্ছে ছিলো রূপা।”

তখন চুপ হয়ে গিয়েছিলো রূপা। সহসায় কোন কথা বলতে পারে নি। একটু চুপ থেকে তাসফি আবারও বলে উঠে,

“কিছুদিন পর তোমার ঢাকাতেই যেতে হবে, থাকতে হবে আমাদের সাথে। তখন তো মামাতো বোনের পরিচয়ে যেতে, আর এখন না হয় আমার বউয়ের পরিচয়ে যাবে।”

চমকে উঠলো রূপা। নিজেকে স্থির রেখে চোখ দুটো নিবদ্ধ করলো তাসফির পানে। ‘আমার বউ’ কথাটা যেন হালকা নাড়িয়ে দিলো রূপাকে। তাসফির থেকে এই কথাটা মোটেও আশা করে নি সে। তাসফি যেন তেমন কিছুই বলে নি, এমনি ভাব নিয়ে আবারও বলে উঠলো,

“আর সময়? সেটা তোমার কাছে এমনি অফুরন্ত থাকবে। তোমার পড়াশোনা আর আমাদের সম্পর্ক এগিয়ে নিতে যতটা প্রয়োজন ঠিক ততটাই সময় পাবে। বাঁধা দিবো না আমি, আর না জোর করবো আমাদের সম্পর্কে।”

“কিন্তু আমি……”

“এই বিয়েতে সবার খুশি জড়িয়ে আছে রূপা। মামা মামীরও শেষ ইচ্ছে ছিলো। তাছাড়া তোমার সেফটির জন্য এই বিয়েটা করতেই হবে।”

“মানে?”

“মানে এটাই, ছোট মামা মামীর কথা ভাবো। তোমাকে নিয়ে তাদের ভাবনার কথা ভেবেই নিজের সিদ্ধান্ত জানাও।”

.
তাসফি’র বলা কথা অনুযায়ী’ই সবটা ভেবেছিলো রূপা। তখনই তার মন জানান দিয়েছিলো নিজের কথা না ভেবে সবার ভালোবাসার কথা ভেবেও তার রাজি হয়ে যাওয়া উচিত, তাকে ছেড়ে যাওয়া বাবা মা’র কথা ভেবেও রাজি হওয়া উচিত। আর তাসফি ভাইয়ার কথাগুলোও তো ঠিক। কিছুদিন পর তো তাকে যেতেই হবে ওখানে, থাকতেই হবে তাদের সাথে। এখন না হলেও একসময় তাকে বিয়ে’টা তো করতেই হবে, হয়তো তাসফি নামক এই মানুষ’টাকে। তাহলে সমস্যা কোথায়? নিজ ভাবনায় ভাবলো রূপা। হঠাৎই যেন মন থেকে সায়ও পেল।

সন্ধ্যা গড়িয়ে যখন রাত তখনই রিফা আসলো তাকে খেতে ডাকতে। দু’বার ডাকার পরও যখন খেতে গেল না রূপা তখনই বড়মা আসে। সুযোগ বুঝে নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয় রূপা। বড়মা খুশি হলেও মনে মনে একটা কিন্তু রয়েই যায়। তাকে আশস্ত করে রূপা, মনে থেকে সে বিয়েতে রাজি সেটাও জানিয়ে দেয়। রূপার কথায় ব্যাপক খুশি হয় শাহানা বেগম। মেয়েটাকে তাড়াতাড়ি খেতে আসতে বলে বেরিয়ে যায় ঘর ছেড়ে। কথাটা বাড়ির সবাইকে জানানোর জন্যই তার এত তাড়া।

খাবার ঘরে আসতেই সবাইকে একসাথে নজরে পরে রূপার। বড়মা যে ইতিমধ্যে সবাইকে কথাটা জানিয়েছে সেটাও বুঝতে পারে রূপা সবার হাসিখুশি চেহারা দেখে। তাকে দেখে এগিয়ে আসে রেহেনা। আলতো ভাবে জড়িয়ে ধরে ভাতিজি কে। খুশি হয়ে অনেক কথায় বলে, সাথে দোয়াও করে। তারপর হাত ধরে টেনে নিয়ে বসিয়ে দেয় টেবিলে। সবাই মিলে আলোচনা করতে থাকে বিয়ে বিষয়ক নানান কথাবার্তা। গ্রামেই বিয়ের আয়োজনের কথা বলতেই বারণ করে উঠে তাসফি। বলে,

“এখানে কিছু করার প্রয়োজন নেই মামা। বগুড়াতেই ছোট খাটো করে বাসায় আয়োজন করো, আমি তো আগেই জানিয়েছি বড়সড় করে কিছু করার দরকার নেই।”

একটু ভেবে তাসফির বড় মামা সায় দিলেন। বাসাতেই নিজেদের আত্মীয়স্বজন নিয়ে ছেলে মেয়ে দু’টোকে এক করবেন, সেটাও বললো। বাড়ির সবাইও সায় জানালো। তবুও ভালোই ভালোই বিয়েটা করুক দু’জনে, মত না পাল্টে যায় আবার। কাজিন মহলের সবাই হৈ হৈ করে উঠলো। এতদিন পর কাজিন মহলের প্রিয় ভাই ও সবার আদরের বোনের বিয়ে বলে কথা, একটু আনন্দ উল্লাস তো হবেই। সবাই মিলে প্ল্যান করতে থাকলো নিজেদের মধ্যে। বড়রাও সিদ্ধান্ত নিলো আগামীকাল’ই ফিরে যাবে শহরে। ছোট হোক বা বড় বিয়ের একটা প্রস্তুতির ব্যাপারও আছে।
এর সবটাই নিরব ভূমিকা পালন করে দেখে গেল তাসফি ও রূপা। চোখাচোখিও হলো তাদের মাঝে। তবুও চুপিসারেই সবার উত্তেজনা উদগ্রীবতা দেখে গেল।

.
“খুব তো বলেছিলি ভাইয়া কে বিয়ে করবি না। এখন? দু’দিন কথা বলেই কি এমন জাদু করলো ভাইয়া তোকে? হু!”

রিফার কথার জবাব দিলো না রূপা, চুপ করেই দেখত লাগলো তার হাতে আঁকিবুঁকি করা মেহেদীর ডিজাইন। রূপার হয়ে তার ফুপাতো ভাই রাহাত রিফাকে উদ্দেশ্য বলে উঠলো,

“থামছিস কেন? আঁকা তোর এই জংলী লতাপাতা গুলো। দেখছিস না ভিডিও করছি?”

“এখন এসেছিস কেন এখানে? আমাকে এখানে আঁটকে এতক্ষণ তো খুব ছবি তুললি নিজেদের, এখন এখানে কেন?”

“ছোট বোন আগেই বিয়ে করে নিচ্ছে, এই দুঃখে কুল কিনারা খুঁজে পাচ্ছি না। মনে দুঃখ ভুলে একটু ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়েছি, আর তুই কি-না আমাকে খোঁটা দিচ্ছিস? যা, তোর একটা ছবিও আর তুলে দিবো না আমি।”

“রাহাত তুইইই…..”

“এই রিফাপু, রূপাপুর হাতে তাসফি ভাইয়ার নাম লিখবা না?”

হঠাৎ বলা রিমার কথায় রাহাত রিফা দু’জনেই থেমে গেল। রাহাতের বোন রিমা। কাজিন মহলের সবার ছোট’ই বলা যায়। রূপার দু’বছরের ছোট মেয়েটা। রিফা কিছুটা বিরক্ত হলো রিমা কে দেখে। বিরক্তির সুর তুলেই বললো,

“ওকে মেহেদী লাগাতে লাগাতে কোথায় গিয়েছিলি ফাজিল? ওই হাতের নিচে কে দিয়ে দিবে? এত ছবি তুলতে হয় কেন, পরে তুলতে পারবি না?”

রাহাতও ধমকে উঠলো রিমা’কে। তাড়াতাড়ি শেষ করতে বললো মেহেদী দেওয়া, মেয়েটা আর কতক্ষণ এভাবে হাত মেলে বসে থাকবে? এটাও বললো। সাহিল, সাগরও তাড়া দিয়ে গেল তাদের। ভাই-বোনদের দেখে নিজ মনেই হাসলো রূপা। এরা সবাই তাকে একটু বেশি’ই ভালোবাসে, কেয়ার করে। আর এই ভালোবাসার মানুষগুলোর কাছে তার ‘না’ শব্দ’টা যেন তুচ্ছ।
আজকে তাসফি ও রূপার গায়ে হলুদ। গ্রাম থেকে আসার পর দুই সপ্তাহের বেশিই কে’টে গেছে। সন্ধ্যায় হলুদের অনুষ্ঠান বাসার ছাঁদেই আয়োজন করা হয়েছে। তাসফির কথামতো সাধারণ ভাবে আয়োজন করলেও তা বেশ বড়ই হয়ে গেছে। সন্ধ্যায় হলুদের অনুষ্ঠান হওয়ায় কাজিন মহলের সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয় সকালের দিকে রূপাকে সহ তারা সবাই মেহেদী পরবে। ছোটখাটো করে মেহেন্দির অনুষ্ঠান করবে, ফটোসেশান করে আনন্দ করবে। আবার কবে জানি বিয়ে হয় কাজিন মহলে। কিন্তু রূপার তাতে মত ছিলো না কোন মতোই, মেহেদীও পরতে চায় নি। কিন্তু সবার জেদের কাছে আর টিকতে পারে নি, রাজি হতে হয়েছিলো তাকে। তারপরই হৈ হৈ করে ছাঁদে এসে সবকিছু গুছিয়ে যেন ভাইরা মিলে। বাড়িতেই এত ভালো মেহেদী আর্টিস্ট থাকতে আর পার্লারেও ছুটতে হয় না।

এর সবটা এখন কেন জানি ভালোই লাগছে রূপার কাছে। বিয়ে নিয়ে তার কিছু ইচ্ছে ছিলো সেগুলোও যেন পূরণ হয়েছে। কথাগুলো ভাবতেই নিজের অজান্তেই হাসলো রূপা। সেই হাসিটা কারোর নজরে না পড়লেও রাহাতের চোখে ঠিকই পড়লো। রূপা কে খোঁচা দিতে বলে উঠলো,

“কি রে? কার কথা ভেবে এমনে মুচকি মুচকি হাসছিস? নিশ্চয়ই তাসফি ভাইয়ের কথা। তা কি কথা ভাবছিস ভাইয়াকে নিয়ে? আমাদেরও বল, আমরাও এক্টু শুনি।”

হাসি থেমে গেল রূপার, কপাল কুঁচকে তাকালো রাহাতের দিকে। এতক্ষণে রাহাতের বাকি সবার দৃষ্টি তার উপরেই পড়েছে সেটাও খেয়াল হলো রূপা। বলে উঠলো,

“আশ্চর্য! ওনাকে ভাবতে যাবো কেন? আমি তো তোদের….. ”

“জানি জানি, এখন তো তোর মন প্রাণ, ধ্যান জ্ঞান সবটা জুড়েই শুধু একজনের নাম। আর সেটা হলো আমাদের তাসফি ভাই।”

রাহাত কথাটা বলতেই সুর তুলে সবাই হৈ হৈ করে উঠলো। সবাই মিলে খোঁচাতে লাগতো রূপাকে। ব্যাপক বিরক্ত হলো রূপা, বিরক্তির রেশ ধরেই বলতে লাগলো,

“তাসফি ভাইয়া…… ”

“সাহিল আমার মোবাইলটা কই?”

হঠাৎ তাসফির কণ্ঠস্বর কর্ণপাত হতেই চুপ করে গেল রূপা। বাকিরা তাসফির আগমনে আগের চেয়েও অধিক শব্দে হৈ হৈ করে উঠলো। এর মাঝে চট করে রিমা বলে উঠলো,

“বাহ! নতুন বউ বরের নাম নিলো, আর বর সাথে সাথে এসে হাজির হলো।”

.
.
চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here