নীরবে তুমি রবে পর্ব -০৪

#নীরবে_তুমি_রবে
লেখনীতেঃ রিধিমা জান্নাত রূপা
পর্বঃ ০৪

.
অবাক হয়ে তাসফির দিকে দৃষ্টি ত্যাগ করলো বসার ঘরের প্রতিটি সদস্য। তাসফি যে বিয়ের জন্য এত তাড়াতাড়ি হ্যাঁ! বলবে সেটা সবার জন্যই ছিলো অকল্পনীয়। কিন্তু রূপা? রূপা কি মানবে? সকলের ভাবনায় এই প্রশ্নটাই এসে জমা পড়ে গেল। বড় বাবা তাসফির থেকে চোখ সরিয়ে রূপার দিকে তাকালো, বুঝতে চাইলে মেয়েটার মনোভাব। কিন্তু না, পারলো না। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা রূপার মনোভাব বুঝতে পারলেন না তিনি। রেহেনা ছেলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। হাতের বাহুতে হাত রেখে বলে উঠলেন,

“সত্যি বলছিস বাবা, তুই রাজি বিয়েতে।”

“হ্যাঁ! রাজি আমি। তোমরা বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে আমায় জানিয়ো, ভার্সিটি থেকে ছুটি নিয়ে আসবো।”

বলেই একটু থামলো তাসফি। সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে আবারও বলে উঠলো,

“আর হ্যাঁ! বিয়ের অনুষ্ঠান যেন খুব বড় না হয়, লোক জানাজানি করে অনুষ্ঠান করারই কোন প্রয়োজন নেই। শুধুমাত্র ‘কবুল’ বলেই রূপার প্রতি আমার অধিকার অর্জন করতে চাই।”

বলেই দরজার কাছে এসে রূপার সামনে দাঁড়ালো তাসফি। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দৃষ্টি ত্যাগ করলো রূপা পানে। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়েই হনহন করে চলে গেল সেখান থেকে।

তাসফির সিদ্ধান্তে সবাই ভীষণ খুশি। বিশেষ করে রূপার বড়মা ও ফুপি। সবাই খুশি হলেও রূপার বড় বাবা ও ফুপা যেন সন্তুষ্টি হতে পারলেন না। মেয়েটাকে নিয়ে চিন্তা রয়েই গেল। সকলের আনন্দের মাঝেই বড় বাবা রূপা কে নিজের কাছে ডাকলেন। ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো রূপা, বড় বাবার কাছে দাঁড়াতেই তিনিও দাঁড়িয়ে গেলেন। মেয়েটার মাথায় হাত রেখে বলে উঠলেন,

“তাসফি তোর ওর সিদ্ধান্ত দিয়ে দিয়েছে, কিন্তু তুই? তুই বিয়েতে রাজি তো মা?”

“আমাকে তো রাজি হতেই হবে বড় বাবাই। রাজি না হলেও তোমরা জোর করেই রাজি করাবে কি-না। সেই সময়টা শুধু এখন আর দু’দিন পর, এই যা। তাসফি ভাইয়া যেখানে নিজের ডিসিশন জানিয়েছে সেখানে আমার আর বলার কি আছে?”

বলতেই টুপ করে একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো রূপার গাল বেয়ে। আর দাঁড়ালো না সেখানে, ব্যাথাতুর পা নিয়েই যতটা সম্ভব দ্রুত চলে গেল বসার ঘর ছেড়ে। এদিকে রূপার কথায় হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইলো সবাই।

.
বাবা মায়ের রুমের মেঝেতে হাঁটু গেঁড়ে বসে আছে রূপা। মস্তিষ্কে বিচরণ করছে ছেড়ে যাওয়া মানুষগুলোর নানান স্মৃতি। এখানে আসার পর বাবা মা’কে যেন একটু বেশিই মনে পড়ছে রূপার, গতকাল থেকে যেন সেটা অধিক মাত্রায় রুপ নিয়েছে। বাবা মা আজ তার সাথে থাকলে এইদিন গুলো কি দেখতে হতো তার? এত তাড়াতাড়ি কারোর দ্বায়িত্বে যেতে হতো? উনিশ বছর বয়সেই কি বিয়ে নামক বন্ধনে আবদ্ধ হতে হতো? নাআআ…. কক্ষনো না।
নিজ ভাবনায় ভাবতে লাগলো রূপা, তার ভাবনায় আবারও তাসফি নামক মানুষটার ভাবনা এসে জেঁকে ধরলো। ওই মানুষটায় তার একমাত্র ভারসা ছিলো এই বিয়েটা আটকাতে। কিন্তু সে নিজেই মত দিয়েছে বিয়ে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়েটা সেরে নিতেও চায়। কিন্তু কেন? কেন হঠাৎ এভাবে রাজি হয়ে গেল তাসফি ভাইয়া? সে নিজেই বলেছিলো নিজ দায়িত্বে সবটা সামলে নিবে, সেই বিষয়ে আর যেন কোন কথা না উঠে সেটাও দেখবে। কিন্তু হঠাৎ রাজি হয়ে গেলেন কেন? প্রশ্নের উত্তর’টা খুঁজে পেল না রূপা। সুপ্ত নিশ্বাস ছাড়লো, ভাবতে লাগলো গতকাল সন্ধ্যায় বাবা মায়ের ক’বর থেকে আসার পরের ঘটনাগুলো।

.
তাসফির সাথে বাড়ি ফেরার পর ‘কোথায় গিয়েছিল?’ বলে কেউ কোন প্রশ্ন করে না রূপা কে। মূলত জিজ্ঞাসা করতে গেলে তাসফি’ই থামিয়ে দেয় সবাই’কে। গম্ভীর গলায় বলে উঠে,

“কেউ কিছু জিজ্ঞেস করো না ওকে, কিছু খাইয়ে ওষুধ খাওয়াও। আমি ফ্রেশ হয়ে এসে সবটার উত্তর দিবো।”

তাসফির বলা কথা’টার পর আর কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করে না রূপাকে। রুমে নিয়ে কিছু খাইয়ে ওষুধ খাওয়ায় রেহেনা। বিশ্রাম নিতে বলে রূপা’কে, রেহেনাও বসে থাকে মেয়েটার পাশে। মাথায় বিলি কে’টে এটা-ওটা নিয়ে গল্প করতে থাকে। একসময় বলতে লাগে রূপার বাবা মায়ের কথা। তার মা যে জা ও ননদের মতো বোনদের কাছে তাকে গচ্ছিত রেখে গেছে সেটাও বললো। তারপরই উঠলো তাসফির কথা, রূপার বাবার কথা। রেহেনা বলতে লাগলো,

“একটা মাত্র মেয়েকে নিজের কাছেই রাখতে চেয়েছি তোর বাবা। ভাইয়ের খুব আদরের ছিলি কি-না। ইনিয়ে বিনিয়ে যে তাসফির কথা বুঝাতো সেটা বেশ বুঝতে পারতাম আমরা। খুব ভালোবাসতো তাসফি কে। কিশোর বয়সে ভুল পথে পা দিতে গেলে ভাইয়া’ই বুঝিয়ে সুঝিয়ে সঠিক পথে আসে ভাই, যা আমরা কেউই পারি নি। তখন থেকেই যেন ভাই আর তাসফির বন্ধন গাড়ো হয়। বড়দের সিদ্ধান্তে সবাইকে অবগত রেখে অপেক্ষা করতে থাকি তোর বড় হবার। কিন্তু হঠাৎই ভাইয়ের অসুস্থতায় সব এলেমেলো হয়ে যায় যেন। ছয় মাসের ব্যাবধানে আমাদের ছেড়ে যায় ভাই। বলে যায়, তোকে যেন অন্য কোথাও নয় আমার কাছেই রাখি, তাসফির বউ করে। সময়ের সাথে সাথে ভাবীও দূর্বল হয়ে পরে, অসুস্থ হয়ে উঠে। কিন্তু তখনও তোর কথা আর ভাইয়ের শেষ কথা রাখার জন্য বারংবার বলে যায় আমাদের। এক বছরের ব্যাবধানে ভাবীও আমাদের ছেড়ে চলে গেল, রেখে গেল আমার এই মা’টাকে।”

একটানা কথা বলে জোরে শ্বাস ছাড়লো রেহেনা। স্মৃতি গুলো বলতে গিয়ে যেন গলার স্বর ভারী হয়ে উঠলো, চোখের কোণে একবিন্দু অশ্রুও জমা পড়ে গেল। রূপার আড়ালেই তা ওড়নার কোণা দিয়ে মুছে আড়াল করে নিলো রেহেনা, তাকালো রূপার দিকে। মেয়েটা তার দিকেই তাকিয়ে আছে, দেখে নিয়েছে আড়াল করা অশ্রু। কিছু বলতে চাইলো রেহেনা, কিন্তু তার আগেই রূপা বলে উঠলো,

“হু! এই মা’টাকে এতিম করে চলে গেছে, তাই না ফুপি?”

আশ্চর্য! হলো রেহেনা। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো রূপার পানে। কি বললো মেয়েটা? এতিম করে গেছে মানে, তারা কি ওর কেউ-ই নয়? রেগে গেল রেহেনা। রাগের আভাস নিয়ে বলে উঠলো,

“রূপাআ…. এসব কি ধরনের কথাবার্তা? এতিম মানে’টা কি? আমরা কি কেউ’ই নয় তোর?”

উত্তর দিতে পারলো না রূপা, চুপ করেই রইলো। আসলেই তো, এত এত ভালোবাসার মানুষ থাকতে এতিম হয় কিভাবে সে? ‘এতিম’ শব্দ’টা কি আদোও যায় তার সাথে? না…. একদমই না। তাহলে এই কথাটা কিভাবে ফুপিকে বলতে পারলো সে? তখন তাসফি ভাইয়াকে বলে ফেলেছিলো হুট করেই রাগের বসে, কিন্তু এখন?
নিজের ভুল বুঝতে পারলো রূপা, ছলছল চোখে তাকালো ফুপির দিকে। রেহেনা আবারও বলে উঠলো,

“কি হলো? বলছিস না কেন? বল, নিজেকে এতিম বলে কেন মনে হলো? আমরা কি তোর কেউই নয়?”

“তোমার ভাতিজি কে থাপড়াইয়া গাল লাল বানায় দিলে কিছু বলতে পারবা না কিন্তু আম্মু।”

হঠাৎ তাসফির কথায় সেদিকে তাকালো দুজনেই। ছেলের বলা কথাটার মানে হয়তো বুঝতে পারলো রেহেনা। রূপার কথাটা শুনেই হয়তো এমন রাগ। এমনটা হওয়া তো অস্বাভাবিক কিছু নয়, রেহেনা নিজেও ভীষণ রাগ রূপার প্রতি। মেয়েটার থেকে এই কথাটা যেন আশায় করতে পারেন নি তিনি।
তাসফি কে ও ফুপির রাগ বুঝতে পেরে আমতা আমতা করতে লাগলো রূপা। বলতে চাইলো কিছু একটা। তার আগেই তাসফি বলে উঠলো,

“তোমাকে আব্বু ডাকছে আম্মু।”

কথাটা কর্ণপাত হতেই আর থাকলো না রেহেনা। রূপাকে, “ভীষণ রেগে গেছি, এই মুহুর্তে কিছু শুনতে নারাজ আমি। বিশ্রাম নে, পরে আসবো। কিছু লাগলে ডেকে নিস।”

বলেই খাট থেকে নেমে দাঁড়ালো রেহেনা, তাসফি ‘যাচ্ছি’ বলে বলে বেড়িয়ে গেল। পিছন থেকে ‘ফুপি শোন’ বলে ডেকে উঠলো রূপা, কি কোন কথায় না শুনে চলে গেল রেহেনা।

রেহেনা যেতেই এগিয়ে এলো তাসফি। নিজের অপরাধে মাথা নিচু করে ফেললো রূপা। তা দেখে তাসফি বলে উঠলো,

“আম্মু’কে এতটা কষ্ট না দিলেও পারতে। আমাকে বলেছো, ঠিক আছে, কিন্তু আম্মুকে….. ”

“আমি ইচ্ছে করে বলি নি কথাটা, বেরিয়ে গেছে হঠাৎই।”

“তুমি এতটাও অবুঝ আর বাচ্চা নয় রূপা, যে কথাটা না বুঝে, হুট করেই মুখে ফুটে বলে ফেলবে। আম্মু আমার চাইতেও তোমাকে বেশি ভালোবাসে, সেটা নিশ্চয়ই জানো?”

বলার মতো কিছু’ই পেল না রূপা। ভুল তো তারই, কি বলবে আর। একটু থেমে তাসফি আবারও বললো,

“যাইহোক, নিজের ভুলের ক্ষমা চেও আম্মুর কাছে। মানুষটা তোমাকে অনেক ভালোবাসে, কাছে রানতে সময় নিবে না।”

বলেই আর দাঁড়াতে চাইলো না তাসফি, রুম ছেড়ে বেড়িয়ে যেতে লাগলো। মাথা তুলে তাকালো রূপা, ডেকে উঠলো তাসফি কে। বললো,

“আপনার সাথে কথা আছে আমার।”

সহসায় থেমে গেল তাসফি, বুঝতে পারলো ঠিক কি বলতে চায় রূপা। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

“বিয়ের ব্যাপার টা, তাই তো? চিন্তা করো না, আমি নিজ দায়িত্বে সবটা সামলে নিবো, এই বিষয়ে যেন আর কোন কথা না উঠে সেটাও দেখবো।”

.
সকাল বেলা বেশ দেরিতেই ঘুম ভাঙে রূপার। গতকালের তুলনায় আজকে শরীরটা একটু ভালোই লাগে। শরীর ও মন আরও একটু চাঙ্গা করতে বাড়ির পাশে নিজেদের পুকুর পাড়ে এসে দাঁড়ায়। ছোট বেলার কতশত স্মৃতি যে জমা আছে এই পুকুরটা নিয়ে। কথাগুলো ভেবেই আনমনেই হাসলো রূপা। কেটে গেল মিনিট পাঁচেকের মতো সময়। এর মাঝেই পাশে থেকে তার নামে ডেকে উঠে কেউ। সেদিকে তাকায় রূপা, দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার ছোট দাদীর পক্ষের ফুপির ছেলে রিফাত কে। এই ছেলেটাকে অকারণেই বিরক্ত লাগে রূপা, কিছুটা গায়ে পঠা স্বভাবের কি-না। আর সেটাও যেন রূপার সাথেই বেশি দেখায়। তবুও ভদ্রতার খাতিরে কথা বলতে হয়। রিফাত বলে উঠলো,

“কেমন আছো রূপা? শুনলাম পা পুড়ে গেছে। এখন কেমন?”

“এই তো আলহামদুলিল্লাহ!”

“ব্যাথা আছে? ওষুধ-টষুধ খাচ্ছো তো?”

“হু!”

“হাঁটতে পারছো তো? কষ্ট হচ্ছে না তো?”

“হু! একটু।”

মহা বিরক্ত রূপা, তবুও হু! হ্যাঁ! তে উত্তর দিচ্ছে রূপা। খাপছাড়া ভাবে কথা বলতে বলতে সামলে তাকালো রূপা, ঠিক তখনই তার হাত ধরলো কেউ একজন। রিফাত ভেবে হাত ঝামটা মে’রে ছাড়িয়ে নিতে চাইলো, কিন্তু কথা শোনানোর উদ্যোগ হলো। কিন্তু তাসফি কে দেখে থেমে গেল রূপা। বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলো। এই মুহুর্তে তাসফি কে যেন আশায় করে নি রূপা। বেশ শান্ত স্বরে রূপাকে,

“ভেতরে চলো, মামী ডাকছে তোমাকে।”

বলেই আর দাঁড়াতে চাইলো না তাসফি। রূপার হাত শক্ত করে চপে ধরে রিফাতের দিকে একবার কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। তারপর রূপাকে নিয়ে চলে গেল ভেতরে।

ভেতরে এসে সবাইকে খাবার ঘরেই পেল তাসফি। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো, খাবার পর যেন সবাই বসার ঘরে উপস্থিত থাকে। কিছু বলতে চাই সবাইকে। তারপরই নিজের মতামত জানিয়ে দেয় তাসফি। বিয়ে’টা খুব তারাতাড়ি আর সাধারণ ভাবে হওয়া চায় সেটাও বললো।

.
.
চলবে……

পরবর্তী পর্ব পরশু পাবেন। রি-চেক দেওয়া হয় নি, ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।🖤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here