নীলচে রঙের ভালোবাসা পর্ব ৫

#নীলচে_রঙের_ভালবাসা
#পর্ব_5

১০.
– এই মেয়ে এই তুই এতো ভাব দেখাস কেন বলতো?
– আমি তোমাকে কখন ভাব দেখালাম?
– তুই ভাব দেখাস না, না? শোন তোর এতো ভাব দেখার জন্য তোকে ফোন দেয় না বুঝেছিস?
– তুমি এভাবে কেন কথা বলছ?
– তো কিভাবে কথা বলব তোর সাথে? তুই যেমন তোর সাথে তেমন ভাবেই কথা বলতে হবে। তোর এতো ভাব কিসের রে? আমি ফোন দেয় দেখে? শোন তোর থেকেও সুন্দরী মেয়েরা সারাদিন আমার আগেপিছে ঘুরে। তাই মনে করিস না তুই ছাড়া আমার জীবন চলবে না। তুই একটা ন্যারো মাইন্ডের মেয়ে, আনকালচারড আনস্মার্ট মেয়ে আসছে আমাকে ভাব দেখাতে।

– এতো রাতে কল দিয়েছ কেন?
– দিয়েছি আমার মন চেয়েছে তাই। তুই কোন কল রিসিভ করলি?
– তুমি কল দিয়েছ তাই।
– তোরে যে কল দেয় তুই তার কলই রিসিভ করিস?
– হুম করিতো।
– কই আমার কল তো রিসিভ করিস না?
– রাত দুইটার সময় কল দিলে কিভাবে রিসিভ করব?
– তোকে তখনই করতে হবে কারন দিনে কল দিলে তো তোকে পাওয়া যায় না। তুমি খুব ব্যস্ত থাক। তাই তোকে রাতেই কল রিসিভ করতে হবে।
– আমি পারব না।
– পারবি না তাহলে এখন কেন রিসিভ করেছিস? তুই সালা মেয়ে ভাল না। রাখ ফোন রাখ। যত্তোসব মিডিলক্লাস মাইয়া কোথাকার!

বলে ঠুক করে ফোনটা কেটে দিল। আমি ফোনের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। এখন বাজে প্রায় রাত দুটো। কিন্তু এই রাতের বেলা বিহঙ্গ কল দিল কেন? আর কল করে কি সব উল্টো পাল্টা কথা বলছে। আমি ওর চোখে এতোটা নিচুতে অবস্থান করি জেনে নিজেকে মাটির সাথে মিশিয়ে নিতে ইচ্ছা করছে। এতোটা খারাপ ভাবে এর আগে আমাকে কেউ বলে নি। হ্যা আমি জানি আমি সুন্দরী না, বর্তমান সমাজ থেকে অনেক পিছিয়ে কিন্তু বিহঙ্গ এভাবে মুখের উপর বলবে ভাবি নি। আসলে প্রত্যেক মানুষ নিজের সার্থ দেখে। ওর যখন আমাকে দরকার ছিল তখন তো ঠিকই এই আনকালচারড মিডিলক্লাস মেয়েটার কথা মনে হয়েছিল কিন্তু আজ প্রয়োজন শেষ বলে এভাবে রাস্তায় ছুড়ে ফেলল। আমি প্রতিজ্ঞা করলাম আজকের পর থেকে ওর সাথে আর কোন দিন কথা বলব না।

বিহঙ্গের সাথে আমার কথা হয় না অনেকদিন। সেদিন সংযুক্তার গায়ে হলুদের দিন ও আমার কাছে সংযুক্তা আর সভ্য ভাইয়ার যুগল ছবি চেয়েছিল। ওদের একসাথে বসিয়েই গায়ে হলুদের প্রোগ্রাম হচ্ছিল তাই দুর থেকে কয়েকটা ছবি তুলে তাকে পাঠিয়ে বলেছিলাম সে যেন আমাকে আর ফোন না দেয় আর কোন হেল্প আমি ওকে করতে পারব না। বলেছিলাম বটে তবে ফোন দেওয়া বন্ধ হয় নি। কিন্তু তারপর আর কোন দিন আমি বিহঙ্গর ফোন ধরি নি, কোন টেক্সটের রিপ্লেও দেয় নি। আর ফোন ধরলেও এমন ভাবে কথা বলেছি যেন ও বোঝে আমি ওর সাথে কথা বলতে বিরক্ত। বুঝত হয়তো তাই আর কনভারসেশন বড় না করে তাড়াতাড়ি ইতি টানত।

বিহঙ্গের সাথে আমি এই কয়েকদিনে যথেষ্ট খারাপ ব্যবহার করেছি কিন্তু ও কোন দিন রিয়াক্ট করে নি। তবে আজ এই মাঝ রাতে ফোন দিয়ে এমন অসংলগ্ন ধরনের কথা বলার মানে কি?
এসব ভাবতে ভাবতেই আবার ফোন আসল। নিজের প্রতিজ্ঞাতে অটন থাকতে পারলাম না, কেন জানি না এই ছেলেটার সামনে আমি কখনও শক্ত হতে পারি না আর এই জন্যই এতোটা কষ্ট পেতে হয় আমাকে। এবার আমি ফোনটা নিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে আসলাম। রুমের মধ্যে সবাই ঘুমাচ্ছে এখন কথা বললে ওদের ডিসর্টাব হবে। ফোন ধরতেই বলল, এই আমি ফোন কেটে দিলাম তুমি আমাকে কল ব্যাক করলা না কেন?
– কেন কল ব্যাক করার কথা ছিল নাকি?
– আলবাত ছিল। আমি রাগ করে ফোট কেটে দিলাম তুমি আমার রাগ ভাঙ্গাবে না।

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, কিভাবে রাগ ভাঙ্গাতে হবে।
– চুমু খেয়ে
– বিহঙ্গ তুমি সেন্স আছ? কি বলছ এসব?

– যা বলেছি ঠিক বলেছি। তুমি জান তুমি আমাকে ইগনোর করায় আমার কত কষ্ট হয়েছে। কিন্তু এখন যদি তুমি চুমু খাও তাহলে আমি আর রাগ করে থাকব না।

আমি কি বলব বুঝতে পারছি না। তবে এটা বুঝছি যে কিছু ঠিক নেয়, বিহঙ্গ ঠিক নেয়। আর ও ঠিক থাকলে এভাবে কথা বলত না। পাশ থেকে ওকে কেউ কিছু বলল মন হচ্ছে। ও বেশ রেগে হিসহিসিয়ে বলল, সালা বলছি না চুপ থাকতে। তোর ভাবীর সাথে কথা বলছি। মাদারী তখন থেকে মাতলামী করছে আর আমাকেও জালাচ্ছে, মাতাল গুলা।

– বিহঙ্গ আর ইউ ড্রাংক?
– হ্যা ড্রাংক। আর ড্রাংক কি রে মদ খেয়েছি মদ। বাংলায় বলতে পারছিস না। আমি মদ খেয়েছি মদ।
– বিহঙ্গ তুমি এমন মাঝ রাতে মদ খেয়ে মাতলামী করার জন্য আমাকে ফোন দিয়েছ। আমাকে আর ফোন দিবা না।
– আমি ফোন দিব।
– ঠিক আছে আমি ধরব না।
– আমিও দেখব তুমি কতক্ষণ ফোন না ধরে থাকতে পারিস?

ফোনটা কেটে করিডোরে বসে থাকলাম। কেন যেন খুব কান্না পাচ্ছে। বিহঙ্গ কেন ড্রিংক করেছ? বিহঙ্গ সমানে ফোন দিয়ে যাচ্ছে। উনিশবার ফোন দেওয়ার পর ধরলাম।
– এই তুই ফোন ধরিস না কেন?
– বিহঙ্গ?
– বিহঙ্গ বলে ডাকবি না?
– কি বলব?
– জান, সোনা, কলিজা, হার্ট
– কিডনী, পাকস্থলী
– হ্যা তুই ব্রেনও ডাকবি বুঝেছিস?
– দেখ মাতলামী করবে না
– আরে আমি তো মাতলামী করছি না আমার নেশা চড়ে নি। তোকে যদি আমার বন্ধুদের কথা বলি তো তুই হাসতে হাসতে শেষ হয়ে যাবি। ওই সালা বলে কি জানিস, মামা আমার চশমা কই মামা চশমা কই? আমি বললাম কেন কি হয়েছে?চশমা তো তোর চোখেই আছে? ও বলে, তাহলে আমি শর্মিকে দেখি না কেন? চশমা পড়ে থাকলে তো শর্মিকে দেখার কথা।
জানিস ও জুতা পড়বে না বলে শর্মি এসে আমাকে জুতা পরিয়ে দেবে তারপর আমি জুতা পড়ব। জুতাগুলোকে ফিকে মারছে এখন তার শর্মিকে লাগবে।
অন্যজন জানিস গোসলে ঢুকেছে কিন্তু ওয়াসরুমের দড়জা লাগায় নি কারন তার ধারনা হয়েছে দড়জা লাগালে সে মারা যাবে।

কথাগুলো বলে সে হাসতে শুরু করল। আর আমি এপাশে হাসছি ওর কথা শুনে। এক মাতাল অন্য মাতালকে দেখে হাসে।
– দেখ বিহঙ্গ আমরা সকালে কথা বলি তুমি এখন সেন্সে নেয়।
– এই কে বলল আমি সেন্সে নাই? আমি একদম ঠিক আছি।
– আচ্ছা তুমি কার সাথে কথা বলছ বলত?
– আমি! দাড়াও চেক করে নেই। হিমানী, আমার ক্রাসের বান্ধবী।
– মানে তুমি শিউর না তুমি কার সাথে কথা বলছ?
– না জানি তো হিমানী। তোমার ফোন নাম্বার পর্যন্ত আমার মুখস্থ। বলব, 017………………
– আচ্ছা বলছি এখন তো অনেক রাত।
– এই আমি গান বলি তুমি শুন। এই রাহাত গিটার বাজা আমি এখন গান গাইব। তোর ভাবীকে গান শোনাব।

সাথে সাথেই গিটারের টুংটাং আওয়াজ পেলাম। আর ওপাশে সবাই একসাথে চেচামেচি শুরু করল সাথে সাথে। বিহঙ্গ ওদের থামিয়ে গান শুরু করল। আমি কানে ফোন ধরে চুপচাপ বসে আছি। বিহঙ্গ গাইছে,

এখন অনেক রাত
তোমার কাঁধে আমার নিঃশ্বাস,
আমি বেঁচে আছি তোমার ভালোবাসায়!

ছুঁয়ে দিলে হাত
আমার বৃদ্ধ বুকে তোমার মাথা চেপে ধরে টলছি কেমন নেশায়!

এখন অনেক রাত
তোমার কাঁধে আমার নিঃশ্বাস,
আমি বেঁচে আছি তোমার ভালোবাসায়!

ছুঁয়ে দিলে হাত
আমার বৃদ্ধ বুকে তোমার মাথা চেপে ধরে টলছি কেমন নেশায়!

কেন যে অসংকোচে অন্ধ গানের কলি
পাখার ব্লেড-এর তালে সোজাসুজি কথা বলি!

আমি ভাবতে পারিনি, তুমি বুকের ভেতর ফাটছো,
আমার শরীর জুড়ে তোমার প্রেমের বীজ!
আমি থামতে পারিনি, তোমার গালে নরম দুঃখ,
আমায় দুহাত দিয়ে মুছতে দিও প্লিজ!

তোমার গানের সুর
আমার পকেট ভরা সত্যি মিথ্যে রেখে দিলাম
তোমার ব্যাগ-এর নীলে |

জানি তর্কে বহুদূর
তাও আমায় তুমি আঁকড়ে ধরো,
আমার ভেতর বাড়ছো তিলে তিলে!
কেন যে অসংকোচে অন্ধ গানের কলি
পাখার ব্লেড-এর তালে সোজাসুজি কথা বলি!

আমি ভাবতে পারিনি, তুমি বুকের ভেতর ফাটছো,
আমার শরীর জুড়ে তোমার প্রেমের বীজ!
আমি থামতে পারিনি, তোমার গালে নরম দুঃখ,
আমায় দুহাত দিয়ে মুছতে দিও প্লিজ!
এখন অনেক রাত
তোমার কাঁধে আমার নিঃশ্বাস,
আমি বেঁচে আছি তোমার ভালোবাসায়!
ছুঁয়ে দিলে হাত
আমার বৃদ্ধ বুকে তোমার মাথা চেপে ধরে টলছি কেমন নেশায়!
এখন অনেক রাত
তোমার কাঁধে আমার নিঃশ্বাস,
আমি বেঁচে আছি তোমার ভালোবাসায়!
ভালোবাসায় …

গান শেষ করে বিহঙ্গ আবার বলল, আর একটা শোনায়?
– না বিহঙ্গ কাল শুনব।
– তাহলে এখন কি করব?

বুঝলাম বিহঙ্গর এখন আর কোন সেন্স নেয়। এখন পুরোপুরি মাতাল হয়ে গেছে। তাই বললাম, তুমি এখন ঘুমাও। আমরা কাল সকালে আবার কথা বলব।
– কাল আবার কল ধরবা তো?
– হ্যা ধরব তো।
– তোমাকে আমি বিশ্বাস করি না। প্রমিস কর।
– হুম প্রমিস
– ওকে বাবু গুড নাইট
– গুড নাইট

বিহঙ্গ এবার নিজেই ফোনটা কেটে দিল। হয়তো আমার কথা শুনে ঘুমিয়ে পড়বে। কিন্তু আমার চোখে আর ঘুম আসবে না। আমি সেখানেই বসে থাকলাম। বিহঙ্গ যখন গান গাইছিল সেটা রেকড করেছিলাম। সারা রাত জেগে সেই রেকডিং শুনতে থাকলাম। বারবার শোনার পরও মনের খোরাক পুরন হচ্ছে। গান শুনতে শুনতে যে কখন রাত ভোর হয়ে গেল বুঝতে পারি নি।

চলবে,,,,

জাকিয়া সুলতানা

{ বি দ্রঃ ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ }

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here