গল্পঃ পূর্ণতায় তুমি ( দ্বিতীয় পর্ব )
রাত্রি দ্বিপ্রহর, অবনী শুভর বুকে মাথা রেখে অঝোরে কাঁদছে! অবনী মনে মনে চাইছে এই রাত যেন ভোর না হয়! এই রাত এমন থাক মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত, এবং তার ভালোবাসার মানুষটা একান্ত তার হয়ে থাক।
সময় তো চলমান, প্রকৃতির নিয়ম মেনে সবই চলবে ঠিকঠাক, প্রিয় মানুষটাকে ছাড়া জীবনও হয়তো চলবে তবে গতিহীন, গন্তব্যহীন! একটা সুন্দর জীবন মানে গাছের ঐ সবুজ পাতা, ঝড় এসে ডাল থেকে সেই পাতা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেমন গন্তব্যহীন হয়ে পড়ে, প্রিয় মানুষটা ছাড়া জীবনটা তেমনই।
শেষ রাতে ক্লান্তি ও টেনশনে অবনীর চোখের পাতায় ঘুম জড়ো হয়েছে, হয়তো এটাই প্রিয় মানুষটার বুকে মাথা রেখে শেষ ঘুম। অবনী কখন ঘুমিয়ে পড়লো নিজেই টের পায়নি। যখন ঘুম ভাঙলো তখন প্রায় সকাল আটটা, শুভ রুমে নেই। অবনী জলদি করে উঠে ফ্রেশ হয়ে শেষবারের মতো শুভর জন্য এককাপ চা বানিয়ে নিয়ে ড্রইং রুমে আসলো, শুভ চুপচাপ সোফায় বসে আছে। শুভর সামনে কাপটা রাখলো অবনী।
অবনীর ঠোঁটে বিষাদের ছায়া, বুক ভারী হয়ে আসছে কান্নায়, শুভ যদি একবার বলতো থেকে যেতে!
টেবিলের ওপর একটা কাগজ দেখিয়ে শুভ অবনীকে বললো,– কাগজ রেডি আছে, তুমি একটা সাইন করলেই হয়। রাতে তোমার ইচ্ছেটা আমি পূরন করেছি, এবার তোমার কর্তব্য তুমি পালন করো।
অবনীর চোখে জল ছলছল, এগিয়ে গিয়ে টেবিলের ওপর থেকে কাগজটা তুলে হাতে নিয়ে ভাঙা গলায় অবনী বললো,– সাইনটা নাহয় পরে করে নিবো, কাগজটা আমার কাছে থাক! তবে প্রমিজ করছি আপনার সামনে আর স্ত্রীর অধিকার নিয়ে আসবো না কোনদিন।
রুমে গিয়ে অবনী ব্যাগে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে বেরিয়ে ড্রইং রুমে এসে চোখের জল মুছে শুভকে বললো, চলে যাচ্ছি, তবে যাবার আগে আপনাকে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে থাকতে চাই, আপনার কাপালে অনেকগুলো চুমু খেতে চাই, শেষবারের মতো আপনার ঠোঁটের ভালোবাসার পরশ মেখে নিতে চাই।
শুভ বিরক্তির ভাব করে বললো,– ন্যাকামি বাদ দেবে অবনী! এসব একদম ভালো লাগেনা আমার।
অবনী শুকনো ঠোঁটে অনিচ্ছাকৃত হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো,– আপনার জীবনে হিমি আশার আগে আমার এই ন্যাকামি গুলোই আপনার কাছে সবথেকে প্রিয় ছিল! হঠাৎ ভীষণ বদলে গেলেন, অথচ আপনার প্রতি আমার ভালোবাসা, বিশ্বাস যেমন ছিল তেমনি রয়ে গেছে। গ্রামের মেয়ে তো, হিমির মতো মডেল হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়! তাই হয়তো আপনার ভালোলাগাটা ধরে রাখতে পারিনি।
শুভ আরও বিরক্ত হয়ে বললো,– যাবার বেলায় এত কথা বলে বিরক্ত কেন করছো! ড্রাইভারকে বলে দিয়েছি, ও তোমাকে গ্রামে পৌঁছে দিয়ে আসবে।
অবনী চোখের জল মুছে বললো,– থাক যাবার সময় এই দায়টুকু যদি দেখান, তাহলে আপনাকে ছেড়ে আমি যেতে পারবো না, আমার মৃতদেহ যাবে।
অবনীর সোনার সংসারে ঝড় হয়ে এসে সবকিছু তছনছ করে দেয় হিমি। হিমি বর্তমান সময়ের একজন জনপ্রিয় মডেল, শুভর কোম্পানির একটা এড করার জন্য হায়ার করা হয়েছিল হিমিকে, সেখান থেকেই শুভর সাথে হিমির পরিচয়, তারপর যত দিন যায় দুজনের ভেতর একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
অবনী কোনকালেই মর্ডান হতে চায়নি, গ্রামীণ জীবনধারায় অভস্ত্য সে, আর হিমি তো মর্ডান মেয়ে, ভীষণ স্মার্ট সেই সাথে এত নামডাক! পাশাপাশি দাড় করালে কেউ কাউকে সৌন্দর্যে হারাতে পারবে না, তবুও অতিরিক্ত মর্ডান না হতে পেরে হেরে যেতে হলো অবনীকে!
জল মাখা চোখে শেষবার শুভর দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অবনী বাসা থেকে বের হতেই সাদা একটা প্রাইভেটকার এসে থামলো বাসার সামনে। প্রাইভেটকার থেকে নেমে চোখের চশমা খুলে হিমি অবনীকে বললো,– অবশেষে বিদায় নিচ্ছো তাহলে, একটা কথা কি জানো? এরকম একটা গেঁয়ো মেয়েকে বিজনেসম্যান শুভর সাথে এমনিতেই মানায় না! স্মার্ট হবার চেষ্টা করো অবনী, এবং নতুন করে জীবন শুরু করো অন্য কারো সঙ্গে, গুড লাক!
অবনী অনিচ্ছাকৃত হাসি হেসে বললো,– স্মার্টনেস মানে যদি হয় মেয়ে হয়ে অন্য মেয়ের সংসার নষ্ট করা, স্বপ্ন ভেঙে গুড়িয়ে দেয়া, বেহায়াপনা, তাহলে এমন স্মার্ট আমি কোনকালেই হতে চাইবো না, ইজ ইট ক্লিয়ার হিমি?
হিমির ড্রাইভার মজনু গাড়ি থেকে নেমে এসে হিমির কানে ফিসফিস করে বললো,– ম্যাডাম গালে কি বেশি জ্বালাপোড়া করতাছে?
হিমি অবাক হয়ে বললো,– মানে?
মজনু বললো,– ঐ যে অবনী ভাবী ভদ্রভাবে ঠাস করে আপনার গালে কথার থাপ্পড় মেরে দিলো।
হিমি রেগে গিয়ে মজনুর গালে একটা থাপ্পড় মেরে বললো,– সবসময় অতি চালাকি, এমাসে তোর বেতন থেকে এক হাজার টাকা কাটা যাবে।
অবনী এক হাজার টাকার একটা নোট বের করে মজনুর হাতে দিয়ে বললো,– এক হাজার টাকা কেটে তোমার বড়োলোক ম্যাডাম আরও বড়োলোক হোক মজনু, আমার কারণে তোমার সর্বনাশ হোক সে আমি চাইনা!
টাকাটা হাতে নিয়ে মজনু বললো,– ভাবী এ যুগে সত্য কথার ভাত নাই, তাই এই টাকা দিয়া বিরিয়ানি কিন্না খামুনে!
মজনুর কথা শুনে অবনী হেসে ফেললো।
শুভ বাসা থেকে বেরিয়ে এলো, শুভকে দেখে অবনীর মনে আশার সঞ্চার হলো, ক্ষনিকের জন্য চোখ মুখে আনন্দের ছায়া, এই বুঝি শুভ ডেকে বলবে তোমার কোথাও যেতে হবেনা অবনী, ফিরে এসো।
কিন্তু শুভ এগিয়ে গেল হিমির দিকে, হিমিকে জড়িয়ে ধরে হেসে শুভ বললো,– তোমার আসতে কোনো কষ্ট হয়নি তো?
এই দৃশ্য দেখে অবনীর হৃদয়ে আবার রক্তক্ষরণ। চোখের জল গাল বেয়ে টপটপ করে মাটিতে ঝরে পড়ছে।
অবনী এক মূহুর্ত আর দেরি না করে দ্রুত পায়ে এগিয়ে চললো, আর মনে এখনও আশার প্রদীপ জ্বলছে, শুভ যদি কোনদিন এক মুহূর্তের জন্যও অবনীকে ভালোবেসে থাকে, তবে অবশ্যই পেছন থেকে ডেকে বলবে অবনী যেওনা!
পা ফেলছে আর অপেক্ষা করছে পেছন থেকে শুভর একটি ডাকের…
যার নাম থেকে গল্পের নামকরণ, তার লেখা চার লাইন–
❝অবনী নিশি রাত,
শুভ্রতার প্রেমী–
তবুও আমার গল্পের,
পূর্ণতায় তুমি।❞
চলবে…
লেখাঃ আবীর হোসেন।