প্রণয়িনী পর্ব -১০

#প্রণয়িনী
#আফসানা_মিমি
|১০ম পর্ব |

ঝকঝকে খরগোশের ন্যায় দাঁত বসিয়ে দিয়েছি সাদা বিলাইয়ের হাতে। ছোট বেলা থেকেই মা আমাকে শিখিয়েছেন ছেলেদের মুখে ভালোবাসি শোনা ভালো না। যখন থেকে জেনেছি ভালোবাসা মানে পাপ বিশেষ করে ছেলেদের মুখে ভালোবাসা শুনলেই শুধুমাত্র পাল্টা আঘাত করতে হয়। মা তো আমাকে এটাই শিখিয়েছেন! এখন সাদা বিলাইয়ের মুখে ভালোবাসি কথাটা শুনে ক্ষিপ্ত বাঘিনীর ন্যায় হাতে কামড় বসিয়ে দিলাম। এদিকে আমার আক্রমণে সাদা বিলাই ভরকে গেল। আমি যে পাল্টা এভাবে আক্রমণ করব কল্পনাও করেনি। আমার কামড়ের পরিমাণ দ্রুত গতিতে বেড়ে যাচ্ছিল ঠিক তখনই সাদা বিলাই হালকা আওয়াজে চেঁচিয়ে উঠে,

– এই মেয়ে কামড়ে খেয়ে ফেলবে নাকি? আমার হাতের একটা হাড্ডিও রাখবে না এমনভাবে কামড়াচ্ছো। এই বাঘিনী কি এমন করেছি যে এভাবে কামড়াচ্ছো?

সাদা বিলাই প্রথম একটু শক্তভাবে কথা বলছিল। কিন্তু শেষের কথাটা হেসে হেসে বলছিল যা আমার মাথায় আগুন ধরাতে যথেষ্ট ছিল। সাদা বিলাইয়ের কথায় মাথা নেড়ে না করলাম যার অর্থ,”আজ বাবাজি তোমার হাত ছাড়ব না।”
সাদা বিলাই এবার অন্য হাতে আমার কোমড়ে চেপে ধরে সুড়সুড়ি দিতে শুরু করল যা আমার দুর্বলতা। ব্যস ছেড়ে দিলাম সাদা বিলাইয়ের হাত। সাদা বিলাই এবার সুড়সুড়ি দেয়া বাদ দিয়ে সেই হাতেই আমাকে চেপে ধরে রাখলেন যেন পালাতে না পারি। আর যেই হাতে কামড়ে ধরেছিলাম সেই হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,
– রাক্ষসী একটা। রক্ত বের করে ফেলেছে।
– আপনাকে আজ আমি মেরে তক্তা বানাবো। কত বড়ো সাহস আমাকে ভালোবাসি বলেন?
আমার কথা শুনে সাদা বিলাই শব্দ করে হাসলো। দুই হাতে আরো গভীরভাবে জরিয়ে ধরে জিজ্ঞেস করল,
– ভালোবাসি বলেই তো বলি ভালোবাসি। সারাজীবন এভাবেই বলবো ভালোবাসি। আমার প্রণয়ের প্রণয়িনী করে রাখব সবসময়ই এজন্যই এত ভালোবাসি।

সাদা বিলাইয়কে ভুতে ধরেছে যা বুঝলাম। একে তো উল্টা পাল্টা বকছে। আবার আজ কেমন লেপ্টে আছে আমার সাথে। হয়তো ভয় পাচ্ছে সে। আহারে! আমার জামাইটা, কতটুকুই বা বয়স! এই বয়সে ভুতে ধরেছে। আমার শাশুড়ির কি হবে! তার এমন ধবধবে সাদা বিলাইকে ভুতে ধরেছে এটা শুনলে তো পাগলই হয়ে যাবে। আমার ভাবনার মাঝেই সাদা বিলাই আবারও বলল,

– এই ভাবনার রাণী, কি ভাবো এত?

– ভাবছি আপনাকে কী ভুতে ধরেছে। সাত ভাই চম্পা? নাকি রাক্ষুসে রানী কটকটি।

আমার কথায় সাদা বিলাই আমাকে তাঁর দিকে ফিরিয়ে আমার নাকে কুটুস করে কামড় বসিয়ে বলল,

– আমাকে আয়মান পেত্নীর রাণীর পাগল করেছে। তার দুষ্টুমিতে অতলে হারিয়ে যেতে বাধ্য করেছে।

– কিন্তু আমিতো আপনাকে ভালোবাসি না। আপনি যেভাবে চেপে ধরে আছেন আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।

– এখন থেকে এভাবে চেপে ধরাধরি অভ্যাস করে নাও সুন্দরী। এই ফায়রাজ রাদ প্রথম কাউকে ভালোবেসেছে। তাও আবার তিন কবুল বলা বউকে।

সাদা বিলাইয়ের কথার প্রত্যুওরে কিছু বলতে পারলাম না। কারন আমার মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। বেশি কথা বলা একমাস নিষেধ করেছেন ডাক্তার তারমধ্যে কত কথা বলে ফেললাম। অগত্যা সাদা বিলাইয়ের উদ্দেশ্যে বললাম,

– আমি ঘরে যাবো সাদা বিলাই। মাথা যন্ত্রণা করছে।

আমার কথা শুনে সাদা বিলাই আগের ন্যায় পাঁজা কোলে তুলে খাটে শুইয়ে দিলেন। জানালার গ্লাস, পর্দা টেনে আমার পাশে শুয়ে আলতোভাবে জরিয়ে ধরলেন যেন আমার মাথায় আঘাত না পাই।

– আপনি এতদিন কোথায় ছিলেন। রাগ করেছি আপনার সাথে।

– আমি প্রতিদিন’ই বাসায় আসি কিন্তু তুমি তখন ঘুমিয়ে থাকো। আর এভাবেই প্রতিদিন জরিয়ে ধরে শান্তির ঘুম দেই।

সাদা বিলাইয়ের কথায় আর কিছু বললাম না। এখন আমার ঘুমের প্রয়োজন। গভীর ঘুম। যেন মাথার যন্ত্রণা কমে যায় এত ঘুম ঘুমাতে হবে।

———-

কয়েকমাস পর,

এখন আমি সম্পূর্ণ সুস্থ। আগের মত লাফালাফি, দুষ্টুমি সব করতে পারি। ভালো কথা, সাদা বিলাই আমাকে ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। তিনদিন ক্লাস করতে হয় আমাকে। এখন আর মানুষকে মিথ্যা বলে বেড়াতে পারব না যে আমার গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট। কারন পুরো স্ট্যাম্প মেরে সাদা বিলাই ভার্সিটিতে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। আমার মত দুষ্টের রানীকে কাবু করতে এই সাদা বিলাই যথেষ্ট।
সাদা বিলাই আর আমার সম্পর্ক ঠিক আগের মত। একেবারে সাপ-বেজীর সম্পর্ক। আমি যদি হ্যাঁ বলি তো সাদা বিলাই বলবে না। এই পর্যন্ত সাদা বিলাই আমাকে যে ভালোবাসে তা কতবার বলেছে বা বুঝিয়েছে হিসেব নাই। কিন্তু আমি বুঝেও কিছু বলিনি কারন এটা তাঁর শাস্তি আমাকে এভাবে বিয়ে করার জন্য। কিন্তু আজ পর্যন্ত জানতে পারলাম না কেন সাদা বিলাই আমাকে এভাবে বিয়ে করেছে। যতবার জিজ্ঞেস করি ততবার’ই সাদা বিলাই এটা সেটা বলে এড়িয়ে যায়।

নিজের পড়াশোনা শেষ করে শাশুড়ি মাকে জ্বালাতন করতে চলে আসলাম। আমার শাশুড়ি মা আজ খুবই ব্যস্ত। এই রান্নাঘরে রান্না করছে তো এই সোফার রুমে এসে সব ঠিকঠাক করছে। আমি শুধু সোফায় বসে গোল গোল চোখে দেখছি। এর মধ্যে মিনি সাদা বিলাই স্কুল থেকে এসে ধপাস করে আমার কোলে শুয়ে পড়ল। এই দুই সাদা বিলাই আমার বসা সহ্য করতে পারে না। বসে থাকলেই আমার কোলকে বালিশ বানিয়ে ফেলে। মিনি সাদা বিলাইয়ের টাই খুলে দিতে দিতে প্রশ্ন করলাম,

– হামি বাবু, আজ দয়ার দরদি শাশুড়ির কি হয়েছে? আমাদের পাত্তা দিচ্ছে না যে? আমার কোন সতীন আসবে নাকি?

আমার কথায় হামি শোয়া থেকে উঠে জোরে জোরে হাসতে লাগল। হামি কিছু বলবে তার আগেই আসল সাদা বিলাইয়ের আগমন। শার্টের হাতা ঠিক করতে করতে ভেতরে প্রবেশ করছে। আমাদের দুজনকে একসাথে দেখে বলে উঠে,

– দুই শয়তানের নানা-নানী একসাথে বসে কি খিচুড়ি পাকাচ্ছে শুনি?
রাদের কথা শুনে আমরা দুজনেই দাঁত কেলিয়ে তাকিয়ে রইলাম। যার অর্থ,’ আমরা খুবই ইনোসেন্ট। আমাদের দ্বারা কোন দুষ্টুমি হবে না। ভদ্র বাচ্চাদের মত চুপ করে বসে থাকব শুধু। রাদ আমাদের দু’জনের চেহারা দেখে ভ্রু যুগল কুচকে বলল,

-আজ যেন কোন দুষ্টুমি না হয় দুজনকে বলে দিলাম। আজ একজন স্পেশাল গেস্ট আসবে বাসায়। আরো একঘন্টা পর আসবে। সাবধান, কোন দুষ্টুমি করবে না।
আর আয়মান তুমি আমার সাথে ঘরে আসো। তোমার স্পেশাল ক্লাস নেব আমি। সকালে আজ যা করেছো তার জন্য তোমার খবর তেরোটা বাজাবো।

সাদা বিলাইয়ের কথা শুনে শুকনো ঢোক গিললাম। হয়েছে কি! সকালে সাদা বিলাই চেয়েছিল আমি যেন তাকে শুভ সকাল ভালোবাসা দেই। শুভ সকাল ভালোবাসার মানে সকালে ঘুম থেকে উঠে সাদা বিলাইয়ের গালে একটা ইয়ে দিতে হবে। কিন্তু আমি কীভাবে সাদা বিলাইকে দেই এসব। ইয়ে দিতে গেলে দেখা যাবে সাদা বিলাই অন্য কিছু চাইবে তাই ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক কথা বলে চলে এসেছিলাম মায়ের কাছে। তারপর আর যাইনি। এখন সাদা বিলাই প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছে কিন্তু আমিতো যাবো’ই না। সাদা বিলাই হাজারবার ডাকলেও ঘরে যাব না কারন। আমি জানি আজ ঘরে গেলে আমার কপালে শনি, রবি, সোম, মঙ্গল, সব’ই আছে।

সাদা বেলায় চোখ রাঙিয়ে উপরে চলে গেল যাওয়ার আগে বলে গেল,

– আয়মান জলদি উপরে আসো। আমি আসলে কিন্তু তোমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে।

– আমি যাবো’ই না যত কিছু করুক। আমি যাব না মানে যাব না যাব না।

হামির সাথে বসে খাতায় এক্কাদোক্কা খেলছি। কারণ, আজকে শাশুড়ি আম্মু খুবই সিরিয়াস সব কিছুর ব্যাপারে। এখন যদি দুজন মিলে দুষ্টুমি করি আর কিছু অগোছালো হয়ে যায় তো দুজনকেই ঘর থেকে বের করে বাগানে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে বলবে।

– হামি তুমি এখনো ফ্রেশ হওনি? যাও ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসো।

শাশুড়ি আম্মু রান্না ঘর থেকে চিল্লিয়ে হামিকে বলল। মিনি সাদা বিলাই ফ্রেস হতে চলে গেলে শাশুড়ি আম্মার সাথে একটু রসিকতা করতে ইচ্ছে হলো। দুষ্টুমিরস্বরে শাশুড়ির উদ্দেশ্যে বললাম,

– ওহে ঝাঁসি কি রানী! কেয়া বাত হে! আজকে কোন দিকে সূর্য উঠেছে শুনি? ঘরের মহিলা ঘরে শুয়ে বসে না থেকে বাহিরে দৌঁড়াচ্ছে যে?

আমার কথা শুনে শাশুড়ি আম্মু তরকারী নাড়ার কাঠি নিয়ে বের হয়ে বলল,

– এটা দেখেছো তুমি? এটা দিয়ে তোমাকে পিটাবো এখন দাঁড়াও।

বুঝতে পারলাম শাশুড়ি আম্মুর মন মেজাজ ভালো না। হাতের কাছে পেলে সত্যি সত্যি মাইর দিবে। অগত্যা শাশুড়ি আম্মুর মাইরের ভয়ে বাহিরে চলে গেলাম বাগানবিলাস করতে।

মেইন গেট দিয়ে কালো রঙের গাড়ি ঢুকছে। আমাদের বাড়িতে মূলত একজনই গাড়ি দিয়ে চলাচল করে আর সে হচ্ছে আমার সাদা বিলাই। মিনি সাদা বিলাইয়ের স্কুল এখান থেকে খুবই কাছে তাই সে হেঁটে ব্যায়াম করতে করতে স্কুলে চলে যায়।

গাড়ি থেকে একজন লোক নেমে আসলো হাতের ভাজে কোর্ট রেখে টাই ঠিক করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিল তখনই আমি লোকটাকে ডেকে বললাম,

– এই যে ভুঁড়ি ওয়ালা আঙ্কেল। আপনার ঐ তেলের মত চকচকে টাক মাথা নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?

আমার কথা শুনে আঙ্কেল অবাক হয়ে আমার পানে তাকিয়ে রইল। হয়তো আমার মত ছোট ছোট মাথার চুল ওয়ালা মেয়েকে সে কখনও দেখেনি। আঙ্কেলের আরেকটু কাছে গিয়ে আঙ্কেলের ভুঁড়ির দিকে হাতের আঙ্গুলের ইশারা দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

– ঐ ফুটবলের মত পেটটা কিভাবে বানিয়েছ আঙ্কেল? আর তোমার পেটে কত শের ভাত নিতে পারে? আচ্ছা! আস্ত মুরগি খাও নাকি আস্ত খাসি খাও? আর তোমার ওই চকচকে তালুতে কিছু ব্যবহার করো না? কয়দিন পর তো তোমাকে মানুষ বলবে,
“টাক মাথা, বেল মাথা তার সাথে ইয়া বড়ো ভুঁড়ি ওয়ালা।”

ভুঁড়ি ওয়ালা আংকেলটা আমাকে কিছু বলতে নেবে এমনি সাদা বিলাই চলে আসে। সাদা বিলাই এসে ভুঁড়িওয়ালা আঙ্কেলকে বাবা বলে জড়িয়ে ধরে।
তারমানে এই ভুঁড়িওয়ালা আংকেল আমার শশুর আব্বা। আর আমি এতক্ষণ উল্টা পাল্টা কতকিছু বললাম। শাশুড়ি আম্মাকে দেখলাম সাদা বিলাইয়ের পিছনে এসে শ্বশুর আব্বার হাত থেকে কোর্ট নিয়ে মিষ্টি কন্ঠে বললেন,

– কেমন আছেন রাদের বাবা?

প্রত্যুওরে শ্বশুর বাবা শাশুড়ি মাকে কিছু বলল না। বরঞ্চ আমার দিকে ইশারা করে বলল,
– এই মেয়েটা কে?

শাশুড়ি আম্মাকে কিছু বলতে না দিয়ে আমি মায়ের উদ্দেশ্যে বললাম,

– ও আমার শাশুড়ি মা! আমার হ্যান্ডসাম শ্বশুর আব্বাকে বলে দিও যে আমি তার একমাত্র পুত্রবধূ। এবারের জন্য যেন ক্ষমা করে দেয়। আর কোনদিনও দুষ্টুমি করব না।

বলে সেখান থেকে এক ভোঁ দৌঁড়ে চলে আসলাম। আমি জানি আজ এখানে থাকলে তিন রাক্ষসের কবলে পড়তে হবে। সাদা বিলাই তো আমাকে পেলে ধরে বেঁধে বলবে,

” আজ তোমাকে কে বাঁচাবে সুন্দরী!
তুমি যে করেছো আমার মনটা চুরি।
বলেছ আমার বাবাকে যা না তা!
তৈরী হয়ে নাও এবার করতে ঘষামাজা!

চলবে…….

[]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here