প্রণয়িনী পর্ব -১৩

#প্রণয়িনী
#আফসানা_মিমি
|১৩তম পর্ব |

কিনে দে কিনে দেরে জামাই রেশমি চুড়ি,
নইলে করব জামাইয়ের সাথে আঁড়ি।

– এই ড্রামা কুইন। এনে দিবো আজ রেশমি চুড়ি। তাও আমার সাথে করো না আঁড়ি। তোমার বিরহে যে ক্ষণে ক্ষণে মরি।

হাতের চুড়ি খুলছিলাম আর গান গাইছিলাম। আমার কোন ইচ্ছে ছিল না সাদা বিলাইকে শুনানোর কিন্তু সে শুনে ফেলেছে। আজ সাদা বিলাইয়ের অফ ডে তারমানে সারাদিন জগাখিচুড়ি করা থেকে বিরত থাকতে হবে এবং সাদা বিলাইয়ের কাছ থেকে গুনে গুনে একশত হাত দূরে থাকতে হবে। নয়তো কখন যেন ঝাপটে ধরে বলা যায় না।

– চলো আজ লং ড্রাইভে যাই।
সাদা বিলাইয়ের কথা শুনে মনে মনে ফন্দি আঁটছি। কারন আমি জানি সাদা বিলাইয়ের সাথে এখন কোথাও যাওয়া মানে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা।

– বাসায় মেহমান আসছে। এই অবস্থায় কোথাও যাওয়া ঠিক হবে? তারউপর সামনে আমার পরীক্ষা। এখন এভাবে ঘুরতে যাওয়াও ঠিক হবে না।

আমার কথা শুনে সাদা বিলাই ভ্রু কুঁচকালেন। আমার কাছে এসে কিছুক্ষণ আমার পানে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলেন আমার ভাবভঙ্গি। কয়েক সেকেন্ড অনুধাবন করতে না পেরে ফোঁস করে শ্বাস ত্যাগ করে বললেন,

– তোমার মুড কখন কেমন হয় তা বুঝা মুশকিল। যাইহোক, আমি এক সপ্তাহের জন্য বাংলাদেশের বাহিরে যাবো। তুমি কি এখানেই থাকবে নাকি আম্মুর কাছে যাবে?

– এখানেই থাকবো, সতীনকে বিদায় করতে হবে না?
– আচ্ছা থেকো। সন্ধ্যায় আমার এক ভাই মানে আমার কলিজা আসবে। কোন দুষ্টুমি করবে না। আমি বাহিরে যাচ্ছি।

সাদা বিলাই চলে যাবে একথা শুনে খুশিতে লুঙ্গি ডান্স দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তা এখন করা যাবে না। শাড়ি পাল্টিয়ে সাধারণ পোশাক পরিধান করে নিয়েছি ঘরে এসেই। সাদা বিলাইয়ের সাথে সাথে ঘর বের হবো এমন সময় সাদা ফিলাই আমাকে টপকে গালে অধর ছুঁয়ে সামনে এগিয়ে গেল। আর আমি মূর্তির ন্যায় শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার কান্ড দেখে সাদা বিলাই মুচকি হেসে বলতে বলতে চলে গেল,

– সকালের অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করে দিলাম।

সাদা বিলাইয়ের কথা শুনে চিল্লিয়ে বললাম,

– বেটা খচ্চর, ব্রাশ করেছেন আজ? চল্লিশদিন হয় মুখ ধৌত করেন না। সেই মুখ দিয়ে চুমু খেলেন আমায়? অভিশাপ দিলাম ঐ ঠোঁট কেঁটে যাবে কোন একদিন আমার দাঁতে।

——-

রাদ চলে গিয়েছে ঘন্টা দুয়েক সময় হয়েছে। এই দুই ঘন্টা আমি হামির ঘরে বসে হামিকে ড্রয়িং করা শিখাচ্ছি। নিচে যাবার কোন ইচ্ছে নেই আপাতত। হামি একটা ঘর আঁকছে ছাঁদ ছাড়া ঘর। যার উপরে ফাঁকা। এতকরে বুঝাচ্ছি যে ছাঁদ ছাড়া ঘর হয় না সে শুনছেই না।

– মিষ্টি পরী, তোমারও কি এমন ছাঁদ ছাড়া ঘর হবে?
যেখানে তুমি আর ভাই থাকবে?

হামির কথাটা অন্য সময় শুনলে হয়তো দুষ্টুমি করে উড়িয়ে দিতাম। কিন্তু আজ আমার মন সায় দিচ্ছে না।

হামিকে নিয়ে নিচে চলে আসলাম বাগানে যাবো বলে। নিচে এসে দেখি লিজা মানে আমার সতীন আর তাঁর মা বসে বসে আচার খাচ্ছে। আমাকে দেখে হয়তো সকালের কথা মনে পড়ে গেল তাই মা মেয়ে দুজনেই মুখে হাত দিয়ে ওয়াক ওয়াক করতে করতে দৌঁড়ে চলে গেল। মা-মেয়ের এই অবস্থা দেখে আমি আর হামি হাসতে হাসতে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার উপক্রম।

সন্ধ্যা ছয়টা বাজে। আমি আর শাশুড়ি মা মিলে নাস্তা বানাচ্ছি। রাদের সেই ভাই নাকি অনেক স্পেশাল রাদের জন্য। একেবারে জান-প্রাণ, রাদ নাকি তাকে জান বলেও ডাকে। এই কথাটা শুনেছি শাশুড়ি মায়ের কাছ থেকে। প্রায় আধা ঘণ্টা পর রাদের আগমন ঘটে তার ভাই নামক জানের সাথে। সোফায় বসে দুইভাই কথা বলছে।

রাদ আর আবরার মাত্রই বাসায় এসে সোফায় বসলো আর এমনিই লিজার আগমন সেখানে। লিজাকে দেখে আবরার রাদের উদ্দেশ্যে বলল,

– তা কোথায় তোর তুবা রাদ? আমার জন্য যাকে পেলি। এই মেয়েটা নাকি?

আবরারের কথা শুনে লিজা ভ্রু কুঁচকায়। আবরারের বলা কথাটা লিজাকে একটু ভাবাচ্ছে।
রাদ লিজার দিকে দৃষ্টিপাত না করে আবরারের উদ্দেশ্যে বলল,

– আরে সবুর কর ভাই! আমার তুবা হয়তো কোনো কোনায় গিয়ে লুকিয়ে আছে। সময় হলে চলে আসবে।

এরপর রাদ লিজার সাথে আবরারের পরিচয় করিয়ে দেয়।

আবরার এ হচ্ছে লিজা। রহিম আঙ্কেলের মেয়ে। তোকে বলেছিলাম না! বাবার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু রহিম আঙ্কেল ছিলেন। তিনি কয়েক বছর আগে স্ট্রোক করে মারা যান। তারই মেয়ে লিজা।

-হাই।
-হ্যালো।

আবরার লিজার সাথে কুশল বিনিময় করে রাদকে খোঁচাচ্ছে তুবাকে দেখার জন্য। রাদ আবরারের খোঁচানোতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠে যায় রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে।

মেহমানের জন্য আজ আমি নুডুলস রান্না করব। আমি সব রকমের রান্না পারি কিন্তু এই বাসায় আসার পর কিছুই রান্না করা হয়নি। যেহেতু মেহমান এসেছে তাই শাশুড়ি মাকে অনেক জোরাজুরি করে নুডুলস রান্না করার অনুমতি পেলাম।

কড়াইয়ে গরম তেলে পেঁয়াজ দেয়ার সাথে সাথে আগুন ধরে গেল। হয়তো তেল অনেক গরম ছিল তার জন্য আগুন ধরে গিয়েছে।
হাতে টান লাগায় কারোর বুকের উপর আছড়ে পড়লাম। তাকিয়ে দেখি সাদা বিলাই রাগান্বিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বুঝি না এই ছেলের এত রাগ আসে কোথায় থেকে।

– তোমাকে কে রান্না করতে বলেছে ইডিয়েট? মা এই মা! আয়মানকে রান্না করতে বলেছে কে?

সাদা বিলাইয়ের চিল্লানোতে বাড়ির সবাই এসে রান্নাঘরে উপস্থিত হয়। শাশুড়ি মা বিচলিত হয়ে আমার উদ্দেশ্যে বলল

– তুই ঠিক আছিস মা! একশত বার মানা করেছিলাম যে তোর কিছু করতে হবে না। আমি করি। শুনলি না আমার কথা। আজ যদি কিছু হতো আমার মেয়েকে আমি কোথায় পেতাম?

মায়ের বকা শেষ করে এবার বাবার শুরু করল,

– তোর কি কোনদিন আক্কলজ্ঞান হবে না রে? এই তো কাল আসলাম। ভেবেছিলাম যে অনেক সুখে শান্তিতে থাকব কিন্তু না তোর জন্য শান্তি নেই। কেন এসেছিলি রান্নাঘরে? আজ যদি তোর কিছু হয়ে যেত? আজ থেকে তোর রান্নাঘরে আসা নিষেধ।

– মিষ্টি পরী তুমি না আমার মত ছোট! তাহলে কেন রান্না করতে এলে? চলো আমরা খেলতে যাই।

বাবা-মা, দেবর, জামাই সবার কথা শুনে আমি হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছি। রান্না করে কত হাত-পা পুড়েছে তার ইয়ত্তা নেই কিন্তু এখানে তারা এমন ব্যবহার করছে যেন আমি রান্না’ই পারি না। একদম ছোট বাচ্চা। সাদা বিলাইয়ের কাছ থেকে নিজেকে ঝাড়ি দিয়ে দূরে সরে দাঁড়ালাম। কোমড়ে হাত রেখে সবার উদ্দেশ্যে বললাম,

– এই আমাকে কি ছোট বাচ্চা মনে হয়? আমি অনেক বড়ো বুঝলেন তোমরা? বিয়ে হয়েছে আমার। আমি রান্না সব পাড়ি। এমনভাবে তোমরা বলছ যেন আমি কিছুই পারি না। একদম ছোট খুকি! আরে এই যে সাদা বিলাই একটু বেশি রিয়েক্ট করেন সবসময়। গরম তেলের মধ্যে পেঁয়াজ ছাড়লে একটু আগুন ধরবেই সে জন্য কেউ মরে যাবে না। আর শাশুড়ি মা তোমার থেকে আমি এটা আশা করিনি। তুমি ভালো না। তুমি পঁচা। তুমি আমাকে বকা দিয়েছো।
আর শ্বশুর বাবার সাথে তো কোন কথাই নেই আজ থেকে তোমার সাথে আঁড়। হামি আমার মিনি সাদা বিলাই খুব ভালো তার সাথে আমি থাকব সর্বক্ষণ।

আমাদের কথার মাঝখানেই রাদের ভাই বলে উঠল,

– হাই ভাবি আমি আবরার। রাদে জান। চাইলে আপনিও জান ডাকতে পারেন।

আবরার নামক লোকটি রসিকতা করছে আমার সাথে যা আমি বুঝতে পারছি। আমাকে জান বলতে বলায় সাদা বিলাই আবরারের দিকে রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে বলল,

-কি বললি?

রাদের কথা শুনে আবরার শুকনো ঢুক গিলে বলল,

– আরে ভাই রাগ করিস কেন? আমি তো দুষ্টুমি করলাম। ছোট ভাবির সাথে একটু আকটু দুষ্টুমি করা’ই যায় তাইনা ভাবি? বাই দ্যা ওয়ে রাদ একটা কথা কি জানিস? তোর তুবা অনেক কিউট এবং ভালো আমার তুবা থেকে।

আবরারে কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। মনে মনে আবরারে কথাটা আওড়াচ্ছি আমার তুবা আর তোমার তুবা মানে কি? কিছু বুঝতে না পের কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করে বসলাম,

– আমার তুবা আর তোমার তুবা মানে কি?

কথাটা বলে রাদের পানে তাকালাম।আমার কথা শুনে রাদ ভয় পেয়েছে যা রাদের চেহারা দেখে বুঝতে পারছি। রাদ একটু অস্থির কন্ঠস্বরেআমার উদ্দেশ্যে বলল,

– ছোট মানুষ ছোট মানুষের মতই থাকো। এত কিছু বুঝতে যাও কেন? যাও রান্না ঘর থেকে।

রাতে কথা শুনে ভেংচি কেঁটে চলে আসলাম। এই সাদা বিলাইকে এখন ইচ্ছে করছে মাথায় গরম তেল ঢেলে দিতে। সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি। এদিকে লিজা এবং লিজার মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি তাঁরা চোখে চোখে কি যেন কথা বলছে। যাই বলুক না কেন আমি তাদের উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়ব।

——–
হাসি-দুষ্টুমির মাঝেই রাত দশটা পার হয়ে গেল। আবরার ভাইয়া আজ আমাদের বাসায় থাকবেন। আবরার ভাই খুব মজার মানুষ। আজ আমি কোন দুষ্টুমি করিনি কারণ বাহিরের মানুষ এসেছে। এখন সে যদি আমাকে দুষ্টুমি করতে দেখে তাহলে রাদের মান সম্মান শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু লিজা এবং তাঁর মাকে আমার পছন্দ হচ্ছে না। তারা কোন না কোন কাণ্ড করে আমাকে খাটাতে চাচ্ছে কিন্তু প্রতিবারই কেউ না কেউ তাদের প্ল্যানে পানি ঢেলে দেয়।

রাত বারোটা বাজে যে যার রুমে ঘুমাতে চলে গেল।রাদ আমাকে টেনে হিঁচড়ে নিজের রুমে নিয়ে যাচ্ছে। আজও আমি বাহানা করেছিলাম মায়ের সাথে থাকার জন্য। অনেকদিন পর দুই ভাইয়ের দেখা হয়েছে তারা যেন একসাথে থাকতে পারে ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার এতো পরিকল্পনার মধ্যে রাদ এক বালতি পানি ফেলে আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে রুমে।

এদিকে আবরার একা ছাদে রয়ে গেল। রাদ অনেক বলেছে নিচে যেতে কিন্তু আবরার হাতের ইশারায় বলেছে যে, দু’একটা সিগারেট খেয়ে তারপর নিচে চলে যাবে। অগত্যা রাদ তুবাকে টেনে ঘরে নিয়ে চলে গিয়েছে।

রাদ চলে যেতেই লিজার আগমন ঘটে ছাঁদে। ছাঁদের এক কোনায় মোবাইলের ক্যামেরা অন করে সেট করে রেখে আবরারের কাছে আসে লিজা। লিজার আগমন দেখে আবরার ভ্রু কুঁচকায়। আবরার লিজাকে কিছু বলবে তার আগেই লিজা নিজের পরনের শার্ট খুলতে থাকে। লিজার এই অবস্থা দেখে আবরার অন্যদিকে ফিরে গেল। আর যাই হোক একজন নারী নির্লজ্জ হলে তো আর একজন পরুষ নির্লজ্জ হবে না। যদি সে ভালো মানুষ হয় তো।

– আপনি কি করছেন। দয়া করে কাপড় পরিধান করুন। আমি এমন ছেলে নই যেমনটা আপনি ভাবছেন।

আবরারের কথা শুনে লিজা অট্টহাসি হাসে। পেছন থেকে আবরারকে জড়িয়ে ধরে। লিজার এহেন কান্ডে আবরার সরে যেতে চাইছে বারবার কিন্তু লিজা এমনভাবে ধরে রেখেছে যে এখন আবরার সরে গেলে লিজা পড়ে যাবে। লিজা আবরারের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,

– আপনার আর আমার সব কর্মকাণ্ড ক্যামেরাবন্দি হচ্ছে যেখানে আপনার চেহারা দৃশ্যমান। আমি এমনভাবে ক্যামেরাবন্দি করছি যেন যে কেউ দেখলে বুঝে আমি না আপনি আমাকে ইশারা করেছেন, বাধ্য করেছেন কোন কাজ করার।

লিজার কথা শুনে আবরার মুখ ফিরিয়ে নেয়। আবরারের এখন ইচ্ছে করছে লিজার গালে কয়েকটা থাপ্পর বসিয়ে দিতে। আবরার ছিকটে সরে এসে পিছনে না তাকিয়েই বলে,

– কেন করছেন এসব? কি চান আপনি?

আবরারের কথা শুনে লিজা বাঁকা হাসে। নিচে পরে থাকা শার্ট গায় জড়িয়ে নিতে নিতে বলে,

– আপনার সন্ধ্যার বলা কথা, তোর তুবা আমার তুবা মানে কি?

চলবে……

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here