প্রণয়িনী পর্ব -১৫

#প্রণয়িনী
#আফসানা_মিমি
|১৫তম পর্ব |

এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি নিজের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছে ফায়রাজ রাদ। মুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। রাদের এখন ইচ্ছে করছে সব ধ্বংস করে দিতে। আজ পাঁচদিন হলো তুবার সাথে কোন যোগাযোগ নেই রাদের তাই মেজাজটা গরম হয়ে আছে। রাদের বাবা-মাকে যদি তুবার কথা জিজ্ঞেস করা হয় তো তাঁরা বলে যে বাবার বাসায় গিয়েছে। কিন্তু রাদের মন মানছে না। রাদের মন বলছে তুবার সাথে খারাপ কিছু হয়েছে। খুব খারাপ। নয়তো তুবার মত চঞ্চল মেয়ে নিজেকে রাদের কাছ থেকে গুটিয়ে রাখবে না। গাড়িতে উঠে রাদ আবারও তুবাকে কল করল। সেদিনের তুবার দেয়া ছবি দেখার পর রাদের ইচ্ছে করছিল, এখনই তার শুভ্রপরীর কাছে দৌঁড়ে চলে আসতে আর ইচ্ছেমত আদর করতে। পর পর তিনবার ফোন দেয়ার পরও অপরপাশে কেউ রিসিভ না করায় রাদ গাড়ির স্টিয়ারিং বরাবর নিজের হাত আঘাত করে। তুবার প্রতি কঠিন রাগ নিয়ে বলতে থাকে,

– ভালোবাসা পায় কজন, আর কজন’ই বা সেই ভালোবাসাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে পারে! তুমি আমার আসক্তি। ইচ্ছেকরে’ই হোক বা অনিচ্ছায় হোক। এই ফায়রাজ রাদের জীবনে যেহেতু এসেছো এত সহজেই ছাড়া পাবে না। আমার প্রণয়িনী তুমি, তোমাকে ছাড়া আমি শূন্য। আমার জীবনে রঙ ঢেলে দিয়েছো তুমি। তোমাকে ছাড়া বাঁচি কীভাবে?
যেখানেই থাকো না কেন ফিরে আসতে হবে আমার কাছেই।

রাদ বাসায় এসে কাউকে কিছু না বলে নিজের ঘরে চলে যায়। বিছানার উপর এখনও তুবার ফোন বিদ্যমান। তুবার ফোন এখানে দেখে রাদ ভ্রু কুঁচকায়। হাতের ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে বিছানা থেকে তুবার ফোন হাতে নিয়ে দেখে সেখানে হাজার হাজার টা মিসডকল রাদের। তুবার ফোনের সব কিছু চেক করে হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকতেই অচেনা নাম্বার থেকে সে অডিও ক্লিপ শুনতে পায়।
রাগে, কষ্টে রাদের চোয়াল শক্ত হয়ে গিয়েছে। রাদ ভাবতে পারেনি আবরার নামক ভাই রাদের এত বড় ক্ষতি করবে। আবরার যাকে কিনা রাদ নিজের জান প্রাণ ভাবতো সে রাদ আর তুবার মাঝে ফাটল তৈরি করেছে। রাদ চেয়েছিল রাদ আর তুবার সম্পর্কটা ঠিক করে তুবাকে ওদের বিয়ের সত্যিটা বলবে। কিন্তু এর আগে যে এমন হবে বুঝতে পারেনি।
নিজের ফোন দিয়ে আবরারকে আবারো কল দিলো রাদ। কিন্তু ফলাফল শুন্য। প্রতিবারের মতই আবরারের ফোন বন্ধ পেলো। সবকিছু ফেলে রাদ রওনা দিলো তুবাকে খুঁজবে বলে। রাদ জানে তুবা এখন কোথায়। তুবা সেদিন বলেছিল যে তুবা যদি কোথাও যায় তাহলে তার বান্ধবীর বাসায় যাবে নাহলে নিজের বাসায়। এ ছাড়া আর কোথাও যাবেনা।

———

অন্ধকার রাজ্যে একাই রাজত্ব করছি। এই শীতের মধ্যেও মাথার উপরে ফ্যান ঘুরঘুর করে ঘুরছে। বাহির থেকে প্রিয় মানুষটির আহাজারি এখনও শোনা যাচ্ছে কিন্তু সেই আওয়াজ আমার কর্নকুহরে প্রবেশ করছে না। পাখির কিচিরমিচিরের আওয়াজ শুনে বুঝতে পারলাম পূর্বাকাশে সূর্য্যিমামা উঁকি দিয়েছে কিছুক্ষণ পূর্বে। কিন্তু আকাশ মেঘালয়ে ছেয়ে আছে। আজ শীত যে প্রচুর। কুয়াশায় সূর্য্যিমামা চোখ বন্ধ করে রয়েছে নয়তো এতক্ষণ উত্তাপে বাহিরে বের হওয়া যেতো না। আমি জানি প্রিয় মানুষটা একটু পর’ই চলে যাবে নিজ গন্তব্যে। সন্ধ্যা নামলে আবারও চলে আসবে। আজ পনেরো দিন হয়েছে সেই বাসা থেকে এসেছি। মা অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে কেন এসেছি, কি হয়েছে, রাদ কোথায়? মায়ের প্রশ্নের কোন উওর দেইনি। কী উওর’ই বা দিবো! মা যদি শুনতে পারে যে তাঁর আদরের মেয়ের বিশ্বাস, ভরসা সব শেষ সয়ে গিয়েছে এক নিমেষে তাহলে মা যে ভেঙ্গে পড়েবে।
দরজার ঐপাশ থেকে প্রিয় মানুষটির কন্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। বিছানা থেকে নেমে দরজার কাছে এসে বসে রইলাম। আমি জানি ঐপাশের মানুষটিও এখন বসে আছে আমার মত। আজ পনেরোদিন একইভাবে আহাজারি করে যাচ্ছে। বলে যাচ্ছে নিজের করা ভুল আর সঠিক কাজ।

– শুভ্রপরী, কথা বলবে না আমার সাথে? তোমার এই চুপ করে থাকা যে খুব পোড়াচ্ছে আমাকে। মানছি আমার ভুল হয়েছে তোমাকে সত্যিটা না বলে। কিন্তু এটা সত্যি যে আমাদের বিয়ের পর তোমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছি। তোমার ঐ দুষ্টুমিগুলো আমাকে টেনেছে তোমাকে ভালোবাসতে। তোমার উদ্ভট কথাবার্তা আমাকে নেশার মতো টানতো তোমাকে ভালোবাসতে। নিজেকে আটকে রাখতে পারিনি শুভ্রপরী! ভালোবেসে ফেলেছি গভীরভাবে।
দরজা খুলো শুভ্রপরী, তোমাকে না দেখে আমি ভালো নেই।

মুখ চেপে কান্না করে যাচ্ছি আমি। আমিও তো ভালো নেই আমার সাদা বিলাইকে ছাড়া। আমি বুঝতে পেরেছি সাদা বিলাই আমাদের ভালোর জন্য আমাকে সত্যিটা জানায়নি। তাই বলে কী আমার মন নেই? ক্ষমা তো সেই প্রথমদিন করে দিয়েছি সত্যিটা জানার পর। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি সে আমার দেখা পাবে না কারন আমি মনে করি, রাদের প্রতিশোধের জন্য যেই পন্থা অবলম্বন করেছিল সেটা ভুল ছিলো। আজ আমি না হয়ে যদি আসল তুবা হতো আর রাদ রাগের বশে যদি বিয়ে করে নিতো তাহলে কি আবরার সেই তুবাকে মেনে নিতো! বা দুই ভাইয়ের সম্পর্ক ঠিক থাকতো? থাকতো না বরং ফাটল ধরতো। আমি অন্য মেয়েদের মত সম্পর্ক ছিন্ন করাটাকে সমর্থন করি না। সাদা বিলাইকে শাস্তি পেতে হবে। যেই শাস্তি আমি দিবো। কঠিন শাস্তি।

সকাল আটটা বাজে। রাদ অফিসে চলে গিয়েছে এতক্ষণে। আমি এই কয়েকদিনে নিজের ঘর থেকে প্রয়োজন ছাড়া বের হইনি। আজ কুয়াশা ভরা সকালে বের হতে ইচ্ছে করছে। গায়ে মোটা শাল জড়িয়ে দরজা খুলে সোজা ছাঁদে চলে গেলাম। আমার বাড়ির ছাঁদটা আমার খুব প্রিয়। ছাঁদের একপাশে দাঁড়ালে সবুজে সমারোহ প্রকৃতি দেখা যায়। আর আরেকপাশে শহর সিমেন্টের তৈরি দালান। আমি গাছের পাশটায় দাঁড়িয়ে থাকতে বেশি পছন্দ করি। হাতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে দূরের আকাশের মেঘের খেলা দেখছ। কুয়াশার জন্য সবকিছু অন্ধকার হয়ে আছে তাই দেখছি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ গায়ে আলাদা বাতাস লাগায় বুঝতে পারলাম সে যায়নি এখনো।

– কেন এসেছেন এখানে? আর কি চাই আপনার?

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি দুর্বল হাসি হেসে আমার কথার প্রত্তুত্তরে বলল,

– তোমাকে চাই। আমাকে অনুভব করতে পারো তুমি? আমার নিস্তব্ধতাও কি তোমার মস্তিষ্কে জানান দেয় যে আমি তোমার আশেপাশেই আছি!

সাদা বিলাইয়ের কথার লম্বা শ্বাস ফেললাম। আপাতত সাদা বিলাইকে কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। কেননা তার কণ্ঠস্বর শুনে আমার হার্টবিট বেড়ে গিয়েছে। এখন কিছু বলা মানেই তাঁকে বুঝিয়ে দেয়া যে আমি রেগে নেই। ক্ষমা করে দিয়েছি তাঁকে।

মিনিট পাঁচেক পিনপতন নীরবতা আমাদের মাঝে। আমি চোখ বন্ধ করে রাদের নিশ্বাস শুনছি। অনুভব করছি আমার কাছে আসাতে তাঁর হৃদপিন্ডের দ্রুত চলন।

আচমকা সাদা বিলাই এক কান্ড করে বসলো। আমাকে এক টানে তাঁর দিকে ফিরিয়ে সোজা কোলে তুলে নিলো। হাজারবার নিষেধ করার পরেও ছাড়েনি। আমার ঘরে এনে দরজা লক করে কোন কথা না বলে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। রাদের জড়িয়ে ধরায় শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। চোখ বেয়ে অবাধ্য অশ্রুকণা অনবরত ঝড়ে যাচ্ছে। আর এদিকে রাদ কাঁদছে। রাদের চোখের পানিতে আমার কাঁধ ভিজে যাচ্ছে যা অনুভব করতে পারছি।

– আর কষ্ট দিও না শুভ্রপরী, তুমি এত নিষ্ঠুর কেন? আমাকে তোমার দহনে পুড়াতে কি খুব মজা পাচ্ছো? এই পনেরোটা দিন আমার কেমন কেটেছে জানো?
তোমাকে নিষেধ করেছিলাম অন্যের কথা না শুনতে। কিন্তু তুমি অন্যের কথা শুনে আমার কাছ থেকে দূরে সরে আসলে। এর শাস্তি তো তোমাকে পেতেই হবে শুভ্রপরী! ভালোবাসাময় শাস্তি।

সাদা বিলাই মানে সাদা বিলাই জঘন্য সাদা বিলাই। এই না কান্না করছিল? কিন্তু মিনিটেই যে সে পরিবর্তন হয়ে যাবে কে জানতো! কোথায় ভেবেছিলাম তার কর্মের শাস্তি আমি তাঁকে দিবো। কিন্তু হচ্ছে এখন উল্টোটা। সে আমাকে শাস্তি দিতে চায় অন্যের কথা শুনে তাঁকে ছেড়ে চলে এসেছি তাই। বিষয়টা বুঝতে আমার মিনিট পাঁচেক সময় লেগেছে।
যখন বুঝতে পারলাম সাদা বিলাই কি করতে চাচ্ছে ততক্ষণে দেরি হয়ে গিয়েছে। সাদা বিলাই বেশ জোড়েই আমাকে বিছানায় ফেলল যার কারণে আমার পিঠে ভালোই ব্যথা পেয়েছি।

– সাদা বিলাই একদম কাছে আসবেন না বলে দিলাম। মিথ্যা নাটক করে আমাকে বিয়ে করেছেন আবার এখন ভাব ধরছেন? মানি না এই বিয়ে। আমার তো মনেই পড়ছে না বিয়ের দিন কবুল বলেছেন কখন! আপনি মিছিমিছি বিয়ে করেছেন। আমাকে। আমার কাছে অসবেন না বলে দিলাম। আমি আপনার জন্য আর আপনি আমার জন্য হারাম। দূর হোন মিয়া!

সাদা বিলাইয়ের সিরিয়াস অবস্থা দেখে মুখে যা আসছে তাই বলে যাচ্ছি। আর হাতের কাছে যত কিছু আছে সব নিক্ষেপ করছি সাদা বিলাইয়ের দিকে। কিন্তু বেটা থামছে না। পরিহিত শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে উওর দিলো,

– ময়না পাখি! বিয়ের সময় তো আমাকে দেখেই বেহুশ হয়ে গিয়েছিলে। বড়ো বড়ো চোখ করে শুধু গিলেই যাচ্ছিলে। কবুল যে বলেছিলে তাও ঘোরের মাঝে। তোমার কীভাবে মনে থাকবে?
আমাকে কষ্ট দেয়ার শাস্তি আগে পেয়ে নাও তারপর সব সমাধান করব।

অতঃপর আর কি! শত চিল্লানো চিল্লিয়েও সাদা বিলাইয়ের ভালোবাসা নামক শাস্তি থেকে রক্ষা পেলাম না।
এখন তো আমার চিল্লিয়ে গাইতে ইচ্ছে করছে এখন,

” ও টুনার মা তোমার টুনা কথা শুনে না।
দিনে রাইতে আমায় জ্বালায় ভয় করে না।”

গোসল করে শীতে ঠকঠক করে কাঁপছি। ও আল্লাহ কী শীত! এমনিতেই সূর্য্যিমামা আজ রাগ করেছে। তাইতো কুয়াশায় ঢেকে রেখেছে সব। এর মধ্যে ঐ ভয়ংকর সাদা বিলাইয়েরজন্য গোসল। মনে হচ্ছে বরফের রাজ্যে কেউ আমাকে বসিয়ে রেখেছে। এতো শীতে ইচ্ছে করছে আগুনের ভেতর বসে থাকি। ইয়া আল্লাহ নিয়ে যাও আমাকে।

– আয়মান, গেস্টরুমে আমার ব্যাগ আছে নিয়ে আসো।

ওয়াসরুম থেকে সাদা বিলাই চিল্লাচছে আর আমি বিছানায় লাফাচ্ছি শীতে। আমার ঠেকা পরেছে তাঁর কাপড় এনে দিতে! আমি রাগ করেছি যে খুব ভয়ংকর সাদা বিলাইয়ের সাথে।

– আয়মান, শীত করছে অনেক। বাসায় তোমার আম্মু নেই। প্লিজ নিয়ে আসো।

আজ আমি সাদা বিলাইয়ের জন্য কাপড় আনবো না। এই যে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুইলাম, আমাকে আমার জামাইও উঠাতে পারবে না আজ।

” শীতে কাঁপছে ঠকঠক,
জামাই করবে বকবক।
ঘুমাবো আমি আরামে,
কম্বল মুড়ি দিয়ে।

চলবে……….

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here