প্রেতপুরুষ পর্ব ৩

#প্রেত_পুরুষ
——————(৩য় পর্ব)
অবাক হয়ে চম্পাকে আচারটা হাত ইশারায় দেখালাম।সেও প্রচন্ড অবাক হয়ে হা করে তাকিয়ে আছে কারণ এই জায়গাতেই সে এতক্ষণ আচার খুঁজেছে।হঠাৎ মায়ের চিৎকার শুনতে পেলাম।নিশ্বাস আটকে ছুটলাম মায়ের ঘরে। মায়ের শাড়িতে আগুন লেগে গেছে।আমি থতমত খেয়ে আছি, মনে হচ্ছে আমার জ্ঞান বুদ্ধি লোপ পেয়েছে আমি আগুন নেভানোর চেষ্টাই করার কথা ভাবতে পারছি না।চম্পা ওয়াশরুমে ছুটলো পানি আনতে।
সে সময় সেই অচেনা ছেলেটি দৌড়ে এলো, মায়ের শাড়ির আগুন নিজে হাত দিয়ে চেপে চেপে কীভাবে যেন নিভিয়ে দিল।ঘটনাটা এত তাড়াতাড়ি ঘটলো যে কি ঘটছে বুঝতেই আমার কয়েক মুহুর্ত লেগে গেল।আমি তাড়াতাড়ি করে মাকে ধরে নিয়ে বিছানায় বসালাম।তারপর জিজ্ঞেস করলাম, কীভাবে আগুন লাগালে মা?
মা তখনও ভয়ে কুকড়ে আছে, আস্তে করে বললো, -বলছি,ছেলেটার হাতে কিছু হলো কি না দেখ।
আমি উঠে দাঁড়ালাম ছেলেটার হাত দেখার জন্য কিন্তু সে সাথে সাথে নিজের হাত পকেটে গুটিয়ে নিয়ে বললো, কিছুই হয়নি আমার, আপনি চাচিকে এক গ্লাস পানি খাওয়ান।
চম্পা মায়ের জন্য পানি নিয়ে এলো।পানি খেয়ে মা একটু স্বাভাবিক হলো।তারপর বললো,- আমি জানালার গ্রিলটা পরিষ্কার করবো ভাবছিলাম এখানটা অন্ধকার হয়ে আছে বলে একটা মমবাতি জ্বালিয়ে রেখেছি,আর অদ্ভুতভাবে মমবাতিটা আমার গাঁয়ের উপর এসে পড়লো।সাথে সাথে কাপড়ে আগুন ধরে এমন এক অবস্থা মনে হচ্ছে কেরোসিন দেয়া কাপড়ে আগুন ধরেছে।
আমি কাঁপাকাঁপা গলায় বললাম, এত আগুন দেখে আমি এতটা চমকে গিয়ে ছিলাম যে কি করবো বুঝতেই পারছি না।
মা ছেলেটার দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,অপূর্ব না থাকলে আজ যে কি হতো।তুই আর চম্পা তো বেহুশ হয়ে যেতিস আর আমি..
আমি মাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই বললাম,প্লিজ মা এসব আর বলো না।কিন্তু তুমি ওনাকে অপূর্ব নামে কেন ডাকছো?
মা মুচকি হেসে বললো, ওমা তুই নিজেই তো নাম দিলি,অপূর্ব আমাকে এসে বললো চাচি আজ থেকে আমাকে অপূর্ব নামেই ডাকবেন।মাত্র ছেলেটা আমার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল আর ঘটনাটা ঘটলো।
আমি অপূর্বের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে মাথা নিচু করে আছে।সেদিন থেকে ওকে আমরা অপূর্ব নামেই ডাকা শুরু করলাম।
অপূর্ব অনেক চুপচাপ থাকতো সারাক্ষণ। কিন্তু যখনই কথা বলতো আমি দূর থেকে তাকে খেয়াল করতাম ওর কথাগুলো মন দিয়ে শুনতাম।কিছু একটা ছিল তার কন্ঠে আর সেটা যেন আমাকে ওর কাছে টেনে নিয়ে যেতো।প্রতিরাতে আমি ভয়ংকর স্বপ্ন দেখতাম খুব চেনা একটা কন্ঠ বার বার আমাকে সাবধান করে দিচ্ছে।
এর মধ্যেই মধ্যেই আমার কলেজ খুলে গেল।চম্পা আর আমি একই সাথে একই কলেজে পড়তাম দুজনেই কলেজ যাওয়া শুরু করলাম।কলেজে যে কয়টা সময় থাকতাম আমি অপূর্বকে নিয়েই ভাবতাম কেন ভাবতাম হয়তো নিজেও জানি না।আর চম্পা সারাক্ষণ বলতো ছেলেটাকে একা মামীর সাথে বাসায় রেখে এলাম।এই ছেলেটাকে আমার ঠিক লাগে না রে ইরা কেমন যেন একটা।আচ্ছা ছেলেরা এতো সুন্দর হবে কেন বলতো?চম্পা সব সময় অপূর্বকে নিয়ে আমার কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করতেই থাকতো।
যে ছেলে দেখতে সুন্দর তার নাকি চরিত্র ভালো থাকে না এই মহান বানী আমি চম্পার থেকেই শুনলাম।আমরা যেহেতু মফস্বল শহরে থাকি তাই কলেজ যাওয়ার পথে গাড়ি-ঘোড়ার এতো ঝামেলা থাকে না।কলেজ থেকে বেরিয়ে মোড়ের মাথা পর্যন্ত এসে রিক্সা নিতে হতো।তারপর রিক্সা করে বাসায় আসতাম।সেদিন স্যার একটা বিষয়ে এসাইনমেন্ট করতে দেয়ায় আমি কলেজ ছুটির পর লাইব্রেরিতে গেলাম। দপ্তরি চাচাকে বলে দশ মিনিটের জন্য লাইব্রেরিতে গিয়ে এসাইনমেন্ট করতে লাগবে এমন একটা বই খোঁজে নিয়ে এলাম।ততক্ষণে কলেজ ফাঁকা হয়ে গেছে।
রাস্তাও জনমানব শূন্য।চম্পা আমাকে চিমটি কেটে বললো,দেরী যে করলি এখন রাস্তাটা কেমন ফাঁকা দেখ ভয় ভয় লাগছে।
ওর কথা শুনে আমি হেসে বললাম, ভয়ের কী?সামনে দোকানপাট আছে,আর মোড়ের মাথায় গেলেই রিক্সা নিয়ে নিবো।একটু জায়গার ব্যপার।আজকে নতুন যাচ্ছিস এই রাস্তা দিয়ে?
-না সাইয়ারা তুমি বুঝতে পারছো না আজকের দিন অন্য দিনের মতো না।
চম্পার কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম আমার ঘাড়ের জন্মদাগটায় আগের মতোই ব্যথা লাগলো।ওর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললাম, কি বললি? তুই আমাকে পুরো নাম ধরে ডাকছিস তাও আবার তুমি করে বলছিস?
আমার কথা শুনে চম্পা স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিলো, কী বললাম?তুই আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?আজকে এই রাস্তা একটু বেশি জনমানব শূন্য লাগছে।অবশ্য মানুষ থাকলেই কি আর না থাকলেই কি। আচ্ছা ইরা চল আর দেরী না করে হাঁটি।
চম্পা হাঁটা শুরু করলো আমি অবাক হয়ে ওর পেছন পেছন হাঁটা শুরু করলাম। কিছুদূর যেতেই একটা চায়ের দোকান দেখলাম।দোকানে কয়েকটা ছেলে বসে চা খাচ্ছে।কিন্তু এই দোকান এর আগে দেখিনি।হয়তো নতুন করেছে ভেবেই আমি পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিলাম, চম্পা ডেকে বললো,এই আমার খুব পিপাসা পেয়েছে রে এক গ্লাস পানি খেয়ে আসি।আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম,চম্পা আমাকে টেনে নিয়ে গেল দোকানে, কয়েকটা ছেলে বসা ওর লজ্জা লাগছে।চম্পা পানি চাইতেই দোকানি বললো খাবার পানি শেষ হয়ে গেছে একটু দাঁড়াতে দুই মিনিটে নিয়ে আসবে।আমরা দাঁড়ালাম।ছেলে গুলো কেমন করে যেন তাকাচ্ছিল।হঠাৎ একজন বললো, ডান পাশের মেয়েটারে উঠা।আমি তাকিয়ে দেখলাম চম্পা ভয়ে ভয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে কারণ ওর ডান পাশের মেয়েটা আমি।কিছু বুঝে উঠার আগেই আমার আর চম্পার মুখে রুমাল চেপে ধরলো ছেলে গুলো।আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে একটা গাছের নিচে আবিস্কার করলাম। তখন রাত হয়ে গেছে আমি গাছের সাথে বাধা অবস্থায় শুয়ে আছি।কিছুতেই নিজেকে ছাড়াতে পারছি না।আমাকে ধরে আনা ছেলেগুলো আমার থেকে তিন-চার হাত দূরে বসে বসে গল্প করছিল।আমাকে উঠে বসার চেষ্টা করতে দেখেই বললো, ওই মাইয়ার জ্ঞান আসছে রে চল ওরে খবর দেই।আমি অবাক হয়ে শুধু দেখছি।কীভাবে এখানে এলাম কিছুই মনে পড়ছে না।মুহূর্তেই সব মনে পড়ে গেল আমার।আমি চারিদিকে চম্পাকে খুঁজলাম কিন্তু কোথাও নেই।যে দিকেই তাকাচ্ছি শুধু খোলা মাঠ আর কিছুই চোখে পড়ছে না।হঠাৎ লক্ষ্ম করলাম কেউ একজন আসছে। আমার প্রচন্ড মাথা ঘুরছিল মনে হচ্ছে আবার আমি জ্ঞান হারাচ্ছি।আবছা অন্ধকারে দেখলাম অপূর্ব ছুটে আসছে আমার দিকে।হাপাতে হাপাতে আমার পাশে বসলো সে,আমার হাত পায়ের বাধন খুলে আমাকে দাঁড় করালো। আমি কোনরকম উঠে দাঁড়িয়েই অচেতন হয়ে অপূর্বের গায়ের উপর ঢলে পড়লাম।
জ্ঞান ফিরে নিজেকে আমার বিছানায় আবিস্কার করলাম।চোখ মেলে তাকাতেই দেখলাম আমার পাশে বসে আছে মা আর চম্পা, উদ্ধিগ্ন হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।আমি চোখ খুলেছি দেখেই মা আর্তনাদ করে উঠলেন,ইরার জ্ঞান এসেছে, আমার মেয়ের জ্ঞান এসেছে।মা চম্পাকে পাঠালেন বাবাকে ডেকে আনার জন্য।চারিদিকে কেমন হট্টগোল শুনা যাচ্ছে।আমাদের বাসার এদিকটা সব সময় নিরিবিলি থাকে আজ এতো হইচই কেন! আমি বিস্ময় নিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করলাম,এতো হইচই কিসের মা?
মা কিছু বললো না,চুপচাপ মাথা নিচু করে রইলো।আমি খেয়াল করলাম মা কাঁদছে।আমি উঠে বসার চেষ্টা করলাম তখনই চম্পা ঢুকলো আর আমাকে ধরে আবার শুয়ে দিয়ে উঠতে নিষেধ করলো।আমি চম্পাকে ইশারায় জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে?
চম্পা আমাকে চুপচাপ থাকতে ইশারা করলো।আমি আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম,আমি এখানে কীভাবে এলাম,কি হয়েছিল আমার?
এবার চম্পার চোখেও জল।আশ্চর্য এরা সবাই কেন কাঁদছে।আর আমি যে বিপদে ছিলাম সেখান থেকে কীভাবে এখানে এলাম সেটাও তো মনে করতে পারছি না।আমি উঠে বসার জন্য চম্পাকে জোর করে ছাড়ালাম।হুংকার করে বললাম, আমি ঠিক আছি উঠতে দে আমায়।বাবা আর অচেনা একটা ছেলে ঢুকলেন।তিনি আমার বিছানার পাশে চেয়ারে বসতে বসতে বললেন,সাইয়ারা ঠিক আছেন আপনি?আমি চমকে উঠে তাকালাম। কন্ঠটা মনে হচ্ছে আমার খুব চেনা।তাকাতেই দেখলাম ছেলেটি বেশ সুদর্শন।চেহারা সুন্দর।চোখ দুটি নীলাভ।এই চেহারাটা আমার অচেনা কিন্তু খুব পরিচিত।পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছে এদের দেখলেই চেনা চেনা মনে হয় তিনিও হয়তো এরকমই একজন।কিন্তু কন্ঠটা তো আমার খুব পরিচিত। আমি ঢুক গিলে আস্তে করে বললাম, আপনি?
তিনি উত্তর বললেন,আমি আলিফ,ডাক্তার আলিফ রহমান। আমি এতক্ষণ আপনার ট্রিটমেন্ট করছিলাম। ঠিক আছেন আপনি?
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম।
সে মুহুর্তে অপূর্ব রুমে ঢুকলো, ওর চোখ দুটিতে আজকে যেন কোন মায়া নেই কেমন রক্তলাল হয়ে আছে।আলিফ সাহেবের দিকে রক্তলাল চোখে তাকিয়ে রইলো সে।অপূর্বের এই ক্ষুব্ধ দৃষ্টি আমার বড্ড অচেনা।বাসার বাইড়ে হট্টগোল আরও বেড়ে যাচ্ছে…
চলবে..
লিখা: উম্মেহানি মিম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here