#প্রেত_পুরুষ
——————-( ষষ্ঠ পর্ব)
আমার মনে হলো চম্পা আর নেই, আমি চিৎকার করে উঠলাম, চম্পা রে..
চম্পাকে এক প্রকার জোর করেই জাগানোর চেষ্টা করতে লাগলাম কিন্তু চম্পা চোখ মেলছে না।আমি বিশ্বাস করতে পারছি না চম্পাকে আমি হারিয়ে ফেলেছি।
আলিফ আমার আমার পাশে বসে চম্পাকে দেখার চেষ্টা করলো।আমার চিৎকার শুনে ততক্ষণে বাবা- মা আর অপূর্বও এসে গেছে।
মা চম্পার এই অবস্থা দেখে কান্না শুরু করলো।
বাবা বার বার প্রশ্ন করছে, কী হয়েছে চম্পার!
আলিফ আমাকে একটু শান্ত থাকতে বলে চম্পার পাল্স চ্যাক করে দ্রুত বললো,ও বেঁচে আছে।এখনই হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে।
আলিফের কথা শুনে আমি যেন প্রাণ ফিরে পেলাম।
চম্পাকে জড়িয়ে ধরে বার বার ডাকতে লাগলাম কিন্তু মেয়েটা পুরোপুরি অবচেতন।
বাবা তাড়াহুড়ো করে একটা ভ্যানগাড়ি ম্যানেজ করলো।চম্পাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার জন্য সবাই প্রায় প্রস্তুত তখনই আলিফের এমন একটা কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম।
চম্পার সাথে আমাকে যেতে দিতে চায় না, আর সে নিজেও যাবে না।
এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে সবাই গিয়ে নাকি ঝামেলা বাড়ানোর মানে হয় না। এমন একটা কথা আমি স্বপ্নেও ওর থেকে আশা করিনি।
বাবা একটু অপ্রস্তুত হয়েই বললো,সেটাই ভালো সাইয়ারা বাসায় থাকুক কিন্তু তুমি গেলে মনে হয় ভালো হতো বাবা।তুমি তো একজন ডাক্তার আর আমার ভাগনীটার শরিরের অবস্থা তো খুবই খারাপ।
অপূর্ব এবার আগ বাড়িয়েই বললো,ডাক্তারে তো আমরা যাচ্ছিই চাচা, আর আমি তো আছি আশা করি ভালো ভাবেই চলে যেতে পারবো।এই ঝড়-বৃষ্টির রাতে আসলেই সবাই যাওয়ার দরকার নেই।
আলিফ মাথা নিচু করে বললো,আমি হসপিটালে যোগাযোগ করেছি, যতটা জায়গা নিয়ে আসা যায় ওরা এম্বুলেন্স নিয়ে আসবে আর আমার সাধ্যের মধ্যে যেটুকু চিকিৎসা ছিল আমি করে ফেলেছি।এখন আমি যাওয়া না যাওয়াটা সমানই।আর এদিকে একা বাসায় সাইয়ারা আর আন্টি থাকবে সেটাও তো হতে পারে না আজকে আপনাদের এলাকার যা অবস্থা দেখলাম।
মা আলিফের কথায় বাধা দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো,আমি চম্পার সাথেই যাবো।আমার বাপ,মা মরা মেয়েটার সাথে আমাকে তোমরা যেতে দাও।
বাবা আর মাকে বাধা দিলো না ওরা চম্পাকে নিয়ে বের হলো।
আমি আলিফের দিকে তাকিয়ে গর্জন করে উঠলাম, আমি চম্পার সাথেই যেতে চাই
কথাটা বলে আমি বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম আলিফ পিছন থেকে আমার হাত চেপে ধরলো।
আমি আলিফের থেকে হাতটা ছাড়ানোর জন্য ছটফট শুরু করলাম কিন্তু আলিফ আরও শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলো।
আলিফ আমাকে মায়ের ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা আটকে রেখে দিয়েছে।ওর এমন অদ্ভুত আচরণে আমি অবাক হবো নাকি কষ্ট পাবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।বার বার দরজায় নক করেও আলিফ দরজা খুলছে না।আমি কাঁদতে কাঁদতে অসহায়ের মতো মেঝেতে বসে রইলাম। ঘন্টা দু-এক পরে দরজা খুলার শব্দে তাকালাম, আলিফ ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে আবার।
আমার প্রচন্ড ঘৃণা হচ্ছিল ওর প্রতি, আমি মুখ ফিরিয়ে রাখলাম।আলিফ আস্তে আস্তে আমার পাশে এসে মেঝেতে বসে কিছুক্ষণ চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে রইলো তারপর ফিসফিস করে বললো,সাইয়ারা আজকে তোমাকে চম্পার সাথে যেতে না দেয়াটা তোমার ভালোর জন্যই ছিল বিশ্বাস করো।তুমি কী এখনও বুঝতে পারছো না তোমার আশেপাশে বিপদেরা কীভাবে দলবল নিয়ে ঘুরছে?
কথাটা বলে আলিফ আমার হাতটা শক্ত করে ধরলো।আমি সাথে সাথে ওর হাত সরিয়ে দিয়ে বললাম, কী বিপদ আর হবে আমার? আমার বোনের থেকেও আপন চম্পা ওর আজ এই অবস্থা,ঝড় বৃষ্টির মধ্যে আমার বাবা-মা বেরিয়ে গেল চম্পাকে নিয়ে, ওদের বিপদ হতে পারে না?আমি শুধু স্বার্থপরের মতো নিজেরটাই চিন্তা করবো?আপনি এতো স্বার্থপর আমি আগে কল্পনাও করতে পারিনি।আর আমি বুঝতে পারছি না আপনার মতো একটা মানুষকে কেন আমি বিয়ে করলাম!
আমার কথাগুলো শুনে আলিফ মুচকি হেসে বললো,সাইয়ারা তোমার কী মনে হয় যদি বাবা-মায়ের বিপদের আশংকা থাকতো আমি ওনাদের যেতে দিতাম? বিপদটা এই মুহুর্তে তোমারই হবে তাই তোমাকে আটকে রেখেছি আমি।আর শুনো,তুমি আমাকে বিয়ে কেন করেছো সেটা তুমি বুঝতে পারছো না তারও কারণ আছে। যতক্ষণ আমি চাইবো না ততক্ষণ তুমি এর কারণ বুঝতেও পারবে না।
আলিফের কথাগুলো আমার কাছে কেমন যেন অদ্ভুত লাগলো।আমার মনে হলো ওর মাথাটাই খারাপ আর আমি না জেনে- বুঝে একটা পাগলকে বিয়ে করে ফেলেছি।
আলিফ আবারও আমার হাত টেনে ধরলো,তারপর আমার হাতে নীল রঙের একটা চকচকে পাথর দিয়ে বললো এটা রাখো তোমার কাছে।আর যাও নামাজ পড়তে বসো। এভাবে বসে থাকলে কিছুরই সমাধান হবে না সব খারাপ শক্তির ধ্বংস একমাত্র আল্লাহই করতে পারেন।
কিছুক্ষণ পর কলিংবেল বেজে উঠলো আমি তাড়াহুড়ো করে খুলতে যাবো তখনই আলিফ আমাকে বাধা দিয়ে নিজেই দরজা খুলতে গেল।বাবা মা আর অপূর্বের বিধ্বস্ত চেহারা দেখে আমার কলিজা কেঁপে উঠলো।আমি দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে চম্পা কোথায় জানতে চাইলাম।
মা টু-শব্দটি করছে না, কেমন যেন পাথরের মতো শক্ত হয়ে আছে।আমি বাবাকেও প্রশ্ন করলাম কিন্তু বাবাও কোনো জবাব দিচ্ছে না।এবার অপূর্ব কাঁপাকাঁপা গলায় বললো,আমরা চম্পাকে নিয়ে হসপিটালে যাচ্ছিলাম তখন প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি শুরু হয় এক পর্যায়ে চারিদিক ধোঁয়ায় ভরে উঠে আবছা অন্ধকারে আমরা কিছুই দেখতে পাইনি যখন ঝড় কমে সবকিছু পরিস্কার হয় তখন চম্পাকে আর আমরা পাইনি।চাচা -চাচীকে কোনমতে বাসায় নিয়ে এসেছি।
অপূর্বের কথা শেষ না হতেই আমি জ্ঞান হারালাম।জ্ঞান ফিরে নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করলাম। মা আমার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
আমার জ্ঞান ফিরেছে দেখে মা আমার দিকে ঝুকে এসে আমাকে বুকে টেনে নিলো।আমি আস্তে আস্তে কাঁদো কাঁদো গলায় জিজ্ঞেস করলাম, এসব কী হচ্ছে মা? কেন হচ্ছে?
মা কোনো জবাব না দিয়ে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে তারপর বললো,তোর বাবা মাওলানা ডাকতে গেছে অপূর্বকে নিয়ে।মিলাদ-মাহফিলের একটু ব্যবস্থা করতে হবে।আমার কিছুই ভালো লাগছে না রে মা।আমি একটা কথা বলতে চাই তোকে, যদি তুই নিজেকে শক্ত করতে পারিস তবেই বলবো।
আমি কৌতুহল নিয়ে হ্যাঁ সুচক মাথা নাড়ালাম।
মা ঢুক গিলে বলা শুরু করলো,যখন আমরা চম্পাকে নিয়ে হসপিটালে যাচ্ছিলাম তখন হঠাৎ ঝড় বৃষ্টি বেড়ে গিয়ে চারিদিকটা ধোঁয়াটে হয়ে যায়।
তখন আমরা কেউ কিছুই দেখতে পাইনি কিন্তু
আমি সেই ধোঁয়ার কাকে দেখেছি জানিস?
আমি দ্রুত বললাম,কাকে দেখেছিলে মা?
মা আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বললো,আলিফকে।আর এরপরই সবকিছু পরিস্কার হয়ে গেল কিন্তু চম্পাকে আমরা আর খুঁজে পেলাম না।
মায়ের কথা শুনে আমি উঠে বসলাম,আমার বুক ধড়ফড় করা শুরু হলো।মা এটা কী বলছে! কীভাবে সম্ভব এটা!
আলিফ তো আমার সাথেই ছিল আর যদি ও আমাকে যখন ঘরে আটকে রাখে তখন যায় তবে এতো তাড়াতাড়ি ওদের কাছে যাবে কীভাবে!
একটা সাধারণ মানুষের পক্ষে কী এসব কান্ড করা আদৌ সম্ভব!
আমি কিছুই ভাবতে পারছিলাম না শুধু মনে হচ্ছে চম্পার সাথে যা কিছু হয়েছে সব কিছুর জন্যই আলিফ দায়ী।আমি দ্রুত উঠে দাড়িয়ে হাটা শুরু করলাম, মা পেছন থেকে ডাকলেও শুনলাম না।
সারা বাসা খুঁজে আলিফকে না পেয়ে বাগানে ছুটলাম।বাগানে এসে আমি যা দেখলাম তাতে মাটির উপর দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটুকুও পাচ্ছি না।
আমার মাথাটা ভনভন করে ঘুরছে।এ আমি কী দেখছি!আলিফ তাহলে সত্যিই কোনো সাধারণ মানুষ না…
চলবে..
লিখা: উম্মেহানি মিম