#বসন্ত_বিলাস
#আমিনা_আফরোজ
#পর্ব:-৭
পরের দিন সকালে। সকালের কাঁচা সোনা রোদে ঘুম ভাঙ্গে অভির। চোখ মেলে অভি নিজেকে আবিষ্কার করে ছাদের দোলনার উপর। অভির মনে পড়ে যায় গতরাতে অভি মেহমুদের কথা ভাবতে ভাবতেই ওদের ছাদের দোলনার উপরেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঝটপট উঠে পাশের বাড়ির দোতলার বাম দিকের ঘরটায় তাকায় অভি। ঘরের দরজা তখনো ভেতর থেকে আটকানো। অভি আর সময় নষ্ট না করে ঝটপট চাঁদ থেকে নেমে চলে আসে নিজেদের বাসায়। ফ্রেশ হয়ে অভি আবারো যাবে মেহমুদের কাছে। এবার নিশ্চয়ই মেহুল ওকে চিনতে পারবে।
এদিকে আজ মেহুলের অবস্থা আগের থেকেও শোচনীয় হয়ে গেলো। সকালে ঘুম ভেঙ্গেই মেহুল চেঁচামেচি জুড়ে দিলো। নিজের আশেপাশে কাউকে আজ সহ্য করতে পারছে না সে। আগে তবু শুধুমাত্র অভিকে সহ্য করতে পারছিলো না মেহুল কিন্তু এখন তো অভিসহ অভির পরিবারের সাথে সাথে এই মেহুলদের বাড়ির পরিবেশও সহ্য করতে পারছে না সে। তাই আবারো মেহুলকে নিয়ে আসা হলো হাসপাতালে। মেহুলের পরিবারের সাথে অভিদের পরিবার গেলেও ডক্টরের চেম্বারে ঢুকতে দেওয়া হয়নি তাদের। করিডরে অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে অভিদের পরিবারের সবাইকে। অভি করিডরের এমাথা থেকে ওমাথা ঝটপটিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে লাগলো। সময় যত গড়াতে লাগলো অভির ভেতরের অস্থিরতা ততই বাড়তে লাগলো।
এদিকে, ডক্টর আফজাল হোসেন মেহুলের বাড়ির লোকজনের কথা শুনে মেহমুদের বেশ কিছু টেস্ট করালেন আবার। ঘন্টা তিন পর এলো সেসব টেস্টের রিপোর্ট। রিপোর্ট দেখে ডক্টর আফজাল বললেন,
–” দেখুন আপনার মেয়ের সব রিপোর্ট নরমাল এসেছে। তবে আমার মনে হয় নার্ভ জনিত কিছু কারনে ওনার মেমোরি লস হয়েছে। তবে এই মেমোরি কবে নাগাদ ফিরবে , আদৌও হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি মেহুল কখনো ফিরে পাবে কি না এ নিয়ে তেমন কোন কিছু আশানুরূপ বলতে পারছি না আমি। মেহুলের যে অবস্থা তাতে করে আমার মনে হয় আপনাদের হাওয়া বদল করা প্রয়োজন। এতে করে আশা করি মেহুল ভালো থাকবে কিছুটা। আর হ্যাঁ, আর একটা কথা। মেহুলের দিকে খেয়াল রাখবেন যেন মেহুল যেন কোনভাবেই উত্তেজিত না হয়। এতে করে ওর নার্ভের ওপর আরো চাপ পড়বে।”
মেহুলের বাবা অশোক সাতরা ডক্টরের কথায় ঘাড় নাড়লেন বটে তবে মুখ ফুটে কিছু বললেন না। ডক্টরের কাছ থেকে মেহমুদের ঔষুধ বুঝে নিয়ে বেরিয়ে এলেন কক্ষের বাহিরে। অভিরা সবাই অরিডরেই অপেক্ষা করছিল মেহুলদের জন্য। মৃন্ময় বাবু প্রাণ প্রিয় বন্ধুর মুখ দেখে কিছু আন্দাজ করে দ্রুত মেহুলকে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন।
মেহুলদের বড়ো ড্রয়িং রুমের সোফায় বসেছে সবাই। মেহুলকে ওর ঘরে রেখে আসা হয়েছিল। অভিও মেহুলের সাথেই থাকতে চেয়েছিল কিন্তু মেহমুদের বাবা অশোক সাতরা বারণ করেছে অভিকে । বলা যায় না মেহুল যদি অভিকে দেখে আবারো উত্তেজিত হয়ে যায়। অভিও মেহুলের বাবার কথা মেনে নিয়েছে। মেহমুদের ক্ষতি হোক সেইটা অভি নিজেও চায় না। তাই বাধ্য হয়েই থেকে গেছে মেহুলদের ড্রয়িং রুমে।
পুরো ড্রয়িং জুড়ে চলছে পিন পতন নিরবতা। কেউ কোন কথা বলছে না। মেহমুদের বাবা অশোক সাতরা তার প্রাণ প্রিয় বন্ধুকে কি বলবে তাই বুঝতে পারছেন না। শুধু থেকে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন তিনি। মেহুলের বাবার এমন নিরবতা দেখে অধৈর্য হয়ে গেলো অভি। উৎকন্ঠায় অশোক সাতরার উদ্দেশ্যে কিছু বলতেই চাচ্ছিলো অভি কিন্তু তার আগে মৃন্ময় বাবু নিজেই বলে উঠলেন,
–” আরে এভাবে চুপচাপ বসে আছিস কেন? চুপচাপ বসে থাকলেই কি সমস্যার সমাধান হবে? ডক্টর মেহুলকে দেখে কি বলল , সবটা খুলে বল আমাদের।”
–” ডক্টর বলেছে রিপোর্ট নরমাল তবে দূর্ঘটতার কারনে নাকি মেহুলের নার্ভে চাপ পড়েছে। একারনেই ধীরে ধীরে স্মৃতি লোপ পাচ্ছে ওর।”
মৃন্ময় বাবুর প্রশ্নের প্রতিউত্তরে কথাগুলো বললেন অশোক সাতরা।
–” আর কিছু বলে নি?”
–” বলেছে মেহুলের লোপ পাওয়া স্মৃতি কখনো ও ফিরে পাবে কি না এ নিয়ে ওনারা কোন কিছু বলতে পারছেন না। সবটাই সময়ের ওপর নির্ভরশীল। আর বলছে আমাদের অতি সত্ত্বর হাওয়া বদল করা প্রয়োজন।”
–” হ্যাঁ , তো এতে এতো ভেঙ্গে পড়ার কি আছে বুঝলাম না। ”
–” বদলি কি মুখের কথা নাকি। তাছাড়া নতুন পরিবেশ!
–” দেখ ফালতু বকিস না তো। এখনো ছোটই রয়ে গেলি তুই। নতুন পরিবেশ তো কি হয়েছে? মানিয়ে নিবে। জীবন চলার পথে ওমন অনেক কিছু মানিয়ে নিতে হয়। আর শোন আমাদের সিলেটের শাখায় বদলি নিয়ে নে। ওখানে পোস্ট ফাঁকায় আছে। আচ্ছা থাক, আমিই আগামীকাল স্যারের সঙ্গে তোর ব্যাপারে কথা বলে নিবো।”
অভি আর থাকে নি সেখানে। মেহুলদের চলে যাবার কথা শুনেই ওর বুকের বা পাশটায় হঠাৎ নীলচে ব্যাথার উদ্রেগ হয়েছে। এ যে সে ব্যাথা নয়, একেবারে মরণ ব্যাথা। যার কারনে যে কোন সময় অভি ঠুস করে মরেও যেতে পারে। না এভাবে আর বসে থাকলে চলবে না। অভি মেহুলদের বাড়ির পিছনের পাইপ পেয়ে দোতলার প্যাসেজে এসে পৌঁছালো। যে করেই হোক মেহুলের সাথে একবার কথা বলতেই হবে ওকে। মামা বাড়ির আবদার পেয়েছে নাকি মেয়েটা যে, যখন খুশি তখন ওর হৃদয়ে ভালোবাসার উষ্ণতা ছড়িতে দিয়ে আবার হাওয়া হয়ে যাবে। অভি পা টিপে টিপে মেহুলের ঘরে এলো। দেখলো মেহুল বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে আছে। অভি এগিয়ে এসে মেহুলের মাথার কাছে বসে ধীর কন্ঠে বলল,
–” মেহু সত্যিই কি তুই আমাকে ভুলে গেছিস? আমাদের দুজনের এক সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলোও ভুলে গেছিস? ভুলে গেছিস আমাদের প্রথম চুম্বনের সেই উষ্ণতা? ভুলে গেছে জ্যেৎস্না বিধৌত সেই সন্ধ্যার কথা?”
মেহুল অভির কথার প্রতিউত্তরে কিছু বলল না। শুধু ফ্যালফ্যালিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অভির দিকে। অভি ওর মুখটা মেহুলের আরো কাছে এগিয়ে এনে ফিসফিসিয়ে বলল,
–” মেহুল জানিস , তুই আমার জীবনে শেষ বিকেলের সেই গোধুলী রঙা কমলা রঙের আলোর মতো। যার রঙের ছটায় আমার একাকিত্ব মনটা রঙিন হয়েছে। যার রঙ তুলির আঁচড়ে রঙিন হয়েছে আমার বিবর্ণ ক্যানভাস। যার ছেলেমানুষী কথায় আমার মনে আন্দোলিত হয় হাজারো অবাধ্য নেশারা । যার দুচোখের মায়ায় আমি আমার আমিকে খুঁজে পাই । মেহুল, তুই আমার সেই বসন্ত যার বাহারি রঙে আমি আমার আমিকে হারিয়ে ফেলেছি। আমি হয়তো গুছিয়ে কথা বলতে পারি না । ব্যক্ত করতে পারি না আমার লুকানো অনুভূতিগুলোকে। তবুও অগোছালো শব্দে তোকে বলতে চাই, ভালোবাসি প্রিয়, খুব ভালোবাসি তোমায়।”
অভির ভরাট কন্ঠস্বর ছেয়ে গেছে পুরো ঘরজুড়ে। দুচোখ দিয়ে ছড়ছে নোনা পানির ফোঁটা। খোলা থাইগ্লাস দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে দুটো মানবদেহকে। সেই ছাঁট বৃষ্টির সঙ্গে মিলিয়ে যাচ্ছে অভির চিবুক বেয়ে গড়িয়ে পড়া পনির দল। বাহিরে বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ, ক্ষনে ক্ষনে শোনা যাচ্ছে কান ফাঁটা বিকট মেঘের ডাক। ঘরময় নিরবতা। নিস্তব্ধ সে ঘরে দুজন কিশোর কিশোরী তাদের মনে লুকানো কথা আদান প্রদানে ব্যস্ত। সময় বাড়ছে, বাড়ছে শ্রাবণের বৃষ্টির তেজ। শীতল থেকে শীতলতর হচ্ছে ধরনী। ধীরে ধীরে মেহুল এলিয়ে পড়লো অভির বুকে। অভি ওর উষ্ণ শরীরের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে নিলো মেহুলের শীতল দেহখানা। অন্তিম সে শীতল স্পর্শে প্রশান্তি মিলল অভির সারা শরীর জুড়ে। আর কোন অভিযোগ নেই অভির ,নেই কোন অভিমান।
চলবে
( আসসালামু আলাইকুম। গল্পটা বড়ো করার ইচ্ছে ছিল ভেবেছিলাম অন্তত পর্ব ত্রিশ লিখবো কিন্তু জুকার কাকুর জ্বালায় তার আর সম্ভব হলো না। যাই পোস্ট করি কাকু তাতেই ভায়োলেন্স দেখায়। এমন চললে হয়তো পেইজটা হারিয়ে যাবে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর দুই এক পর্বে শেষ করে দিবো গল্পটি। আপনাদের মতামত কি?)