-‘প্রাণোশ্বরী, এই আমি টা তোমাতেই উন্মাদিত পুরুষ। যার রন্ধে রন্ধে তুমি নামক নেশাটা বিষক্রিয়ার মতো ছড়িয়ে গেছো। এবার আমার হতে প্রস্তুত হও প্রিয়সী! প্রস্তুত হও!
উপরোক্ত কথাটা কানে বারংবার প্রতিধ্বণি হচ্ছে। মস্তিষ্কে কিলকিল করছে। আবারো সেই একই স্বপ্ন! একই বাক্য। সহ্য হয় না আর। কবে মুক্ত হবে? আদৌ কী তা সম্ভব? এই তিক্তপূর্ণ স্বপ্ন একদন্ড’ও শান্তি দেয় না। মনের মধ্যে সর্বদা কৌতুহল সৃষ্টি করে? কে সেই জেদি পুরুষ? কী বা তার পরিচয়? কেনই বা সে এতটা উদ্মাদ? তাছাড়া সে ধরা দেয় না কেন? স্বশরীরে প্রণয়বাক্যে অবহিত করে না কেন? তার মূখ্য উদ্দেশ্য কি? কেনই বা এত লুকোচুরি? সে কী আদৌও প্রণয়াসক্ত নাকি তার নিখুঁত ছল? দীর্ঘ আড়াইটা বছর ধরে প্রশ্নের উত্তরগুলোর খুঁজছে। কিন্তু ব্যর্থ সে। কোনো অজ্ঞাত কারণে তার শতচেষ্টাও বৃথা। বর্তমানে অবান্তর ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে উঠে দাঁড়াল সেই মানবী। কালো রঙ্গা শাড়ির আঁচলে মুছল তার ঘর্মাক্ত বদনখানা। রংচটা জানালার কপাট খুলে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এখন বাজে রাত দুইটা তিন। নিষুপ্ত রজনি। মাঘ মাসের মাঝামাঝি বিধায় কনকনে শীত। এবার শীতের প্রকোপ বেশি। বাইরে বইছে ঠান্ডা বাতাস। জনশূন্য রাস্তাঘাট। প্রগাঢ় তিমিরাচ্ছন্ন কুয়াশাময় স্তব্ধ চারিপাশ। এত শীতেও দোতলা বিশিষ্ট প্রাসাদের দক্ষিণের জানালা ঘেষে এখনো দাঁড়িয়ে আছে, সেই মানবী। নাম তার সু-নয়না। তার নির্লিপ্ত দৃষ্টি অদূরের দীঘিটিতে। অনেক বড় দীঘি। দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থও বিশাল। টলটলে দীঘির পানি। আর সেখানে প্রস্ফুটিত লাল ও সাদা শাপলা। সেগুলো দেখতেও বেশ। এর বিপরীতে বিস্তীর্ণ এক বাগান। বাগানটি কয়েকবিঘা জমিতে তৈরী। মোটা মোটা বেশ কিছু পুরনো গাছও রয়েছে সেখানে। তারা যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বছরের পর বছর। সেখানে বসেই করুণ সুরে ডাকছে নাম না জানা এক বিরহী পাখি। বিরহী বলার কারণ তার করুণ সুরের ডাক। কষ্টেমাখা বিষাদি সেই সুর। সুরটা কেন জানি হৃদয়ের মধ্যেস্থলে গিয়ে বিঁধে। তাতে ভয় হয়, প্রচন্ড ভয়। মনে হয়, এটা অশনি সংকেত। ঘোর সর্বনাশের আগাম বার্তা।
তখন স্বপ্ন দেখে সু-নয়নার ঘুমটা ভেঙে গেছে। আজ আর ঘুম ধরা দিবে না। নিগূঢ় রাত আরো গভীর হচ্ছে। আঁধারিয়া রাতকে বিভীষিকাময় করতে ঝিঁঝি পোকারা ডেকে যাচ্ছে। সুনয়নার দৃষ্টি দীঘির টলটলে পানিতেই নিবদ্ধ। তার দীঘল কালো উন্মুক্ত কেশ উড়ছে ঠান্ডা বাতাসে। শাড়ির আঁচলটিও অনবরত উড়ছে বাতাসের তোড়ে। হঠাৎ ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ভেসে আসল। কেউ একজন পানিতে নামছে। আবছা আলো আর শরীরের অবয়ে স্পষ্ট, মানুষটি পুরুষ। অচেনা মানবটি অনড় হয়ে কিছুক্ষণ পানিতে দাঁড়িয়ে রইল। তার দৃষ্টি কুয়াশায় আচ্ছাদিত আকাশে। পরক্ষণেই অনবরত ডুব দিতে থাকল সে। একের পর এক ডুব। একটুপর শব্দটা থেমে গেল। তবে মানবটি কোথাও নেই! তাকে দেখাও গেল না। ততক্ষণে দীঘির পানিও শান্ত হয়ে গেছে। চোখের সামনে থেকেই মানুষটি উধাও।সুনয়না দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বিগত এক বছর যাবৎ সে এই ঘটনার সঙ্গে পরিচিত। তবুও বোধগম্য হয় না তার। প্রতিরাতে ঠিক এই সময়েই এটা ঘটে। আর সে দাঁড়িয়ে দেখে । এজন্য বিধায় তার মধ্যে ভয়ের রেশ কিংবা কৌতুহল কোনোটাই নেই। সুনয়না বিছানায় এসে ওর শরীর এলিয়ে দিলো। নিদ্রাহীন চোখজোড়াতে কতকাল প্রশান্তির ঘুম আসে না। প্রাণ খুলেও হাসে না। এই প্রাসাদ থেকে বের হতেও পারে না, অনুমতি নেই। সে বন্দী মানবী। কে করেছে? তাও অজানা। শুধু জানে, বিগত আড়াই বছর ধরে সে বন্দি।
বাবা-মা, ভাই-বোন কারোর সঙ্গেই যোগাযোগ নেই। উনারা জীবিত নাকি মৃত তাও অবগত নয়। হয়তো নিঁখোজের পর মৃত ভেবে এতদিনে ভুলেও গেছে। এসব ভেবে সুনয়না মৃদু হাসল। একা একা কত কী যে ভাবে তার আয়ত্তা নেই। তবে হাসির যথেষ্ট কারণও থাকে। এই যেমন, সে বন্দি হলেও প্রাসাদের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াতে পারে। ইচ্ছেমতোন কাজকর্ম করতে পারে। ছাদে ও বাগানে যেতে পারে। গ্রামের রাস্তাঘাট, মানুষের হাসি-খুশি, দুঃখ-কষ্ট দূর থেকে দেখতেও পারে। কোনো কিছুতে তার নিষেধাজ্ঞা নেই। আছে শুধু, তার মুক্তিতে। সে কোথাও যেতে পারবে না। তা কোনোভাবেই না। আর সেটা তার মৃত্যুর শেষ নিঃশ্বাস অবধি অবধারিত। এই প্রাসাদে ওর জন্য বরাদ্দকৃত ভৃত্যও রয়েছে। মোট চারজন মাঝবয়সী পুরুষ ও দু’জন মহিলা। তারা গ্রামের খবরাখবর ওকে জানায়। মূখ্য কথা, গল্পের ছলে মিশে ছায়ার মতো ওর সঙ্গে লেগে থাকা। যেন পালাতে না পারে। তবে তারা কে বা কার কথাতে ওকে সঙ্গ দেয়, একথা জানাতে বড্ড নারাজ। জিজ্ঞাসাও করা যায় না, করলে এড়িয়ে যায় নতুবা দৌড়ে পালায়। কখনো খুব বেশি জোর করলে পা ধরে কেঁদে বলে,
-‘কইলে ছ্যার আমগোরে মাইরা ফালাইবো। এসব কয়েন না আর মা-জননী। আফনার পাও দুইখান ধরি তাও আমগোরে জিগায়েন না। আমরা জানে বাঁচবার চাই মা-জননী। একটু দয়া করেন মা-জননী, আমগো লাইগা একটু রহম করেন।’
সুনয়না প্রথম প্রথম জানার আগ্রহ প্রকাশ করলেও এখন আর করে না। সে বুঝে গেছে, এতে লাভ হবে না। তাছাড়া ওর জন্য কারো প্রাণনাশ চাচ্ছে না। ছয়মাস আগে একজন ভৃত্য ওকে কিছু জানাতে গিয়েই প্রাণ হারিয়েছে। তাও ওর চোখেরই সামনে। সেই ভৃত্যের নাম ছিল, কুন্তি। চৌদ্দ বছর বয়সী মেয়েটা ছিলো ওর নেওটা। ওর দীঘল কালো কেশ আর দু’চোখের খুব প্রশংসা করত। মাঝে মাঝে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত। যখন যা বলতো তাই করত। বোকা কুন্তির বোকা বোকা কথাগুলো চুপ করে শুনতো সে। মন্দ লাগত না। সরল মেয়েটা সর্বদা ওর পিছু পিছু ঘুরত। কিন্তু কুন্তি ওর কান্না আর মন খারাপ সহ্য করতে পারত না। ওকে কাঁদতে দেখলে সেও বসে বসে কাঁদত। তার কান্নার কারণ জানতে চাইলে বলতো,
-‘আপনের চুখের পানি আমার সহ্য হইতাছে না আফা। এত্ত সুন্দর চুখে পানি দেইখা আমার পরাণখান জ্বলতাছে তাই মুইও কানতাছি।’
বোকা কুন্তির কথা শুনে সুনয়না মৃদু হাসত। ওর বাবাও ঠিক এই কথা বলতেন। ওর চোখজোড়া খুব সুন্দর এজন্যই নাম রাখা হয়েছিল, সুনয়না। কুন্তির এ কথা শুনে সুনয়না নিশ্চুপ হয়ে যেতো। বাড়ির সবার জন্য মন পুড়ত। ছোট্ট এক গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের জয়নুল কবিরের মেয়ে সে। ছোট ভাই সে, দাদী আর বাবা-মা নিয়ে তার পরিবার। জয়নুল কবির ছিলেন একজন চালের ব্যবসায়ী। ওর মা রুবা বানু গৃহিনী।
প্রয়োজনীয় কিছু কিনতে গ্রামের বাজারের এসে আর ফিরে নি সে। মূলত ফিরতে দেওয়া হয় নি। আর তখন থেকেই এই প্রাসাদের বন্দিনী সে। তবে এতকিছুর মধ্যে অবগত, কোনো এক পুরুষ তার প্রতি আসক্ত। আর তা খুব প্রবল ভাবে। সে হয়তো এসব কর্মের রচয়িতা। যদিও তাতেও তার হেলদোল নেই। সেও দেখতে চাই, সেই অচেনা মানব কতদিন আড়ালে থাকে আর কতদিন ওকে আটকে রাখে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেও পরিস্থিতি মানিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন কুন্তি দুঃসাহস দেখিয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করেছিল। ওকে আড়ালে ডেকে গোপন কিছু কথা জানাতে চেয়েছিল। কিন্তু সে মুখ খোলার আগেই প্রাণ হারায়। আচানক বুলেট এসে বিঁধে ওর কপাল বরাবর। মুখ থুবড়ে পড়ে সঙ্গে সঙ্গেই প্রাণ হারায় প্রাণোচ্ছল কুন্তি। সুনয়না পুরো ঘটনাটা নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছিল। ভয় কিংবা আতঙ্কের রেশটুকুও ছিল না তার মুখশ্রীতে। বরাবরই কঠোর হৃদয়ের মানবী সে। ছোট থেকেই সহজ ভেঙে পড়া তার ধাঁচে নেই। যেখানে লাশ দেখে আট দশটা সাধারণ মেয়ে দৌড়ে পালায়। আতঙ্ক এবং ভয়ে কেঁদে দেয়। সেখানে সে গিয়ে লাশকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। বাইশ বছর বয়সী সুনয়না এহেন কাজ অসংখ্যবার করেছে। সেও নিশ্চিত, সেই অচেনা পুরুষটি নিষ্ঠুর, পাষাণ ও বর্বর। তার করা বোকামি অন্যের প্রাণনাশের কারণ। মূলত এজন্য সুনয়না কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করে না। চুপ করে সহ্য করে। দেখা যাক, নিয়তি ওকে কোথায় গিয়ে দাঁড় করায়। সেটারই অপেক্ষায় সে।
গাঢ় রাত পেরিয়ে ঝলমলে সকালের আগমন ঘটেছে। তখন সবে সকাল সাড়ে আটটা। আজ কুয়াশা নেই বললেই চলে।
সুনয়না চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে বাগানের গোলাপ গাছটার পাশে। কুন্তি খুব পছন্দ করত এই গাছটা।এখন গাছটা দেখে মেয়েটার কথা মনে পড়ছে। সুনয়না দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাছের গোড়ায় মাটি দিলো। দু’একদিনেই গোলাপ ফুটবে। টকটকে লাল রঙ্গা গোলাপ। বিদেশী জাত। দেখতেও তা নজরকাড়া।
কুন্তি থাকলে আহ্লাদে আটখানা হয়ে বারবার এই গোলাপের কথায় ওকে শোনাত। মেয়েটা বড্ড ফুল ভালোবাসত। তবে সুনয়নার বিশেষ পছন্দের কোনো ফুল নেই। সব ফুলই নাকি সুন্দর। যে যার রুপে, গুনে, সৌরভে, আকৃতিতে অতুলনীয়।
তাই সুনয়না তুলনা করে না। তখন সেখানে ভৃত্য সবুর মিয়া নিজের উপস্থিত জানান দিয়ে বলল,
-‘মা-জননী সব খাওন তৈয়ার কইরা দিছি, গিয়া খাইয়া লন।
মাঝ বয়সী সবুর মিয়া এখানকার বিশ্বাসী ভৃত্য। তিনি মানুষ হিসাবেও বেশ। সুনয়নাকে মা-জননী ডাকে সম্মোধন করে।
উনার দেখে বাকিরাও তাই ডাকে। এমন ডাক শুনতে তার মন্দ লাগে না। আর বারণ করলেও কেউ শুনবে না। সুনয়না প্রত্যুত্তর না করে গোলাপ গাছে পানি দিতে দিতে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ল,
-‘সবুর ভাই এত আওয়াজ কিসের?’
সবুর মিয়া ওর কথা শুনে আশেপাশে তাকাল। কেউ নেই দেখে সতর্ক কন্ঠে বলল,
-‘ওহ, আমাগো মোড়লের ছুডু পুলাডা বিলেত থেইকা লেহা পড়া কইরা আইজ আইছে। হের লাইগ্যা ঢাক ঢুল বাজাইয়া বরণ করতাছে।’
সুনয়না হাতে থাকা মাটি পরিষ্কার করে কিছু বলার আগেই সবুর মিয়া প্রস্থান করতে উদ্যত হলো। কিন্তু সুনয়না উনাকে পিছু ডেকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করল,
-‘মোড়লের ছেলেটার নাম টা যেন কি? আর সে কতবছর পর গ্রামে ফিরলো?
সবুর মিয়া ঢোক গিলে ঘুরে তাকাল। বলা ঠিক হবে কী না তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্ধে ভুগছেন। উনাকে নিশ্চুপ দেখে সুনয়না প্রাসাদের দিকে পা বাড়াল। উত্তর পাবে না সে তাই দাঁড়িয়ে থাকার মানেও নেই। তাছাড়া, জমিদার বাড়ির খবর গোপন রাখাই শ্রেয়। আগ বাড়িয়ে কিছু তথ্য ফাঁস করে যেচে কে বা মরতে চায়? প্রাণের মায়া তো সবারই আছে। একথা ভেবে সুনয়না আর জোর করল না। কিন্তু সুনয়নাকে অবাক করে দিয়ে সবুর মিয়া উত্তর দিলেন,
-‘হের নাম হইল অভিরাজ রওশান। আড়াইডা বচ্ছর পর হেতে গেরামে আইল।’
সুনয়না কথাটা শুনে প্রস্থান করল। মুখে তার মুচকি হাসি।
এই প্রাসাদের পাশেই গ্রামের জমিদারদের বিশাল বড় বাড়ি। সেখানে জমিদারের ছেলে এবং নাতিপুতিরা বসবাস করেন, এই প্রাসাদটা তাদেরই। তবে এখানে কেউ থাকেন না। উনারা আধুনিকতার ছোঁয়া লাগিয়ে অদূরে বাড়ি তৈরী করেছেন।
সেটাই তাদের বর্তমান বাসস্থান। আর এই প্রাসাদটা বর্তমানে পরিত্যক্ত।এটা মূলত তৈরী করেছিলেন, জমিদার আলাউল। বর্তমানে তিনি বেঁচে নেই। তবে উনার দুই সন্তান জমিদারী
রক্ষা করছেন। তাও প্রবল দাপটের সাথে। আর উনাদের এ দাপট পুরো গ্রামে বিরাজমান।
এমনকি সুনয়না এখানে বন্দি তাও উনারা অবগত। আর তা খুব ভালো ভাবেই। সুনয়নার ধারণা, জমিদার বাড়ির কেউ’ই ওকে বন্দি করেছে। কিন্তু কথা হলো; সে কে?
To be continue……!!
-‘বিভীষিকা-‘
-নূরজাহান আক্তার আলো-
[০১]