বিভীষিকা পর্ব -০২

-‘বিভীষিকা’-
-‘নূরজাহান আক্তার আলো’-
[০২]

জমিদারের ছেলে আসার উপলক্ষে পুরো গ্রামের লোকদের
খাওয়ানো হচ্ছে। দলে দলে মানুষরা এসে খেয়ে যাচ্ছে। বেশ
হইহট্টগোলও হচ্ছে। সুনয়না জানালা দিয়ে মানুষ দেখছে আর হাসছে। এই মানুষগুলো বড্ড সরল। তারা অনেক কিছু বুঝেও আজ অবুজ। সবই ওই অঢেল টাকা আর ক্ষমতার জোর। ওর দোতলা থেকে জমিদার বাড়ির কিছু অংশ দেখা যায়। সেখানে দাঁড়িয়েই সে জমিদার বাড়ির বউদের দেখতে পাচ্ছে। উনারা রাজকীয় চেয়ারে বসে পান খাচ্ছেন। তাদের নামীদামী শাড়ি আর স্বর্ণের গয়নাতে ঝলমল করছে সারা অঙ্গ। সুনয়নার হঠাৎ একটা প্রবাদ মনে পড়ে গেল, ‘চকচক করলেই সোনা হয় না।’ প্রবাদটার মর্মার্থ নবরুপে বিশ্লেষণ করল সে, ‘নামীদামী শাড়ি আর গয়নাতেই মানুষ সুখী হয় না।’ যদি হতো তাহলে সুখও বাজারে বিক্রি হতো। মানুষজন বাজার থেকে ব্যাগভর্তি সুখ কিনে আনত। এমনও তো হতো, সুখ বিক্রেতারা হাক সারত, ‘সুখ নিয়া যান ভাই সুখ। টাটকা তরতাজা একরাশ সুখ আছে, নিয়া যান।’ নয়তো ধনীরা সব সুখ কিনে সংরক্ষরণাগারে রেখে দিতো। আর গরীবরা এর ছিঁটেফোঁটাও পেতো না।অথচ প্রকৃতপক্ষে বিত্তবানদের চেয়ে গরীবরাই বেশি সুখী। এটা বার বার প্রমাণিত।এসব অবান্তর ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে সুনয়না পুনরায় সেদিকে তাকাল। তার মনের কোণে একটা কথায় ঘুরপাক খেতে লাগল, সুখ কেনা গেলে জমিদার বাড়ির বউরাই আগে সমস্ত সুখ কিনতো। এত ধন-দৌলতের ভিড়ে সুখ যে তাদের বড়ই প্রত্যাশিত।

সুনয়না সেখান থেকে সরে গিয়ে রান্নাঘরে উঁকি দিলো। ভৃত্য রমেনা রান্না করছে। সুনয়নার মর্জিমতো পাতলা ডাল, শাক, আর কয়ের পদের ভর্তা তৈরীতে ব্যস্ত সে। সুনয়না গোসলটা সেরে বসল কাঁচা সোনা রৌদ্দুরে। ওর ভেজা লম্বা চুলগুলো শুকাতে আঙুল চালালো চুলের গোড়ায় গোড়ায়। হঠাৎ ওর মনে হলো কেউ ওকে দেখছে। আর তা সূক্ষভাবে। সে মনের
কথাকে সায় দিতে উঠে চলে গেল নিজ কক্ষে। ষষ্ঠ ইন্দ্রীয়ও জানান দিচ্ছে ওর ধারণা সঠিক। তাছাড়া সে আজও একটা
চিরকুট পেয়েছে। হয়তো সেই অচেনা মানবের। সেখানে গোটা গোটা অক্ষরে চমৎকার হাতের লিখা,

‘তোমার প্রণয়ে তৃষ্ণার্ত প্রেমিক আমি।
তাই স্বযত্নে করেছি তোমায় আমার রাজ্যের বন্দিনী।’

নীল রঙ্গা কাগজে সাদা কালিতে লিখা উপরের দু’টো লাইন।
কারো আবেগমিশ্রত প্রণয় বাক্য। ভালোবেসে বন্দিনী! এই লাইন পড়ে সুনয়না হাসল। আহা, তার ভালোবাসা কী ধরণ!
এত ভালোবাসে যে বন্দিনী করে শান্তি কেড়ে নিতে বিবেকে বাঁধে নি। মনে হয় নি, আঁটকে রাখলেই ভালোবাসা সৃষ্টি হয় না। এটা একান্ত মনের ব্যাপার। হৃদয়ের অন্তঃস্থলের নিজস্ব কারবার। এখানে কারো জোর খাটে না। একথা সেই উন্মাদ পুরুষটি হয়তো বুঝবেও না, সে প্রণয়ে অপারগ। সুনয়না পূর্বের ন্যায় একটা কাজ করল। সে চিরকুটের উল্টো পিঠে লিখল,

অখণ্ডিত এক স্বপ্নমালা
সুখ রাজ্যেও পড়বে ভাটা।
রাঙা তরল শরীর বেয়ে
আত্মা কাঁপুক দর্শনেতে।

লিখা শেষ করে চিরকুটটা একটা পাথর চাপা দিয়ে রেখে দিলো। চিরকুট পেলে সে এহেন কাজই করে। সে জানে, এই চিরকুট সেই পুরুষটির কাছে ঠিকই পৌঁছাবে। তাই সে ধাঁধার মাধ্যমেই চিরকুটের উত্তর জানিয়ে দেয়। কিন্তু সেই পুরুষটি বোঝে কী না কে জানে। হয়তো সে ওর ধাঁধার উত্তর খুঁজেই পায় না। নয়তো সব জেনে বুঝেও নিশ্চুপ থাকে। সুনয়না ওর হাতের কলমটা রেখে উঠে দাঁড়াল। দুপুরবেলা খেয়ে বই পড়া তার বহু দিনের অভ্যাস। মর্জিমতো বই নিয়ে আধশোয়া হয়ে বসল সে। ধীরে ধীরে মনোনিবোশ করল বইটির অভ্যন্তরে। ঠিক তখন আগমন ঘটল ভৃত্য তারা বেগমের। সে মেঝেতে বসে রোজকার মতো গল্প জুড়ে দিলো। তার আজকে গল্প, জমিদাররা গ্রামের মানুষদের কী খেতে দিয়েছেন, খাবারের স্বাদ কেমন ছিল, কে বা কারা বেশি খেয়েছে, কে খাবার নষ্ট করেছে, কার মেয়ের ভাতের প্লেট উল্টে গেছে এসব। তারা বেগমের কথা শুনে সুনয়না বলল,

-‘জমিদার আলাউলের বড় ছেলের ছেলে মেয়ে কয়জন?’

সুনয়নার সঙ্গে গল্প করার লোভে তারা বেগম অতি আগ্রহের সাথে জবাব দিলো,

-‘দুইডাই পোলা। কুনো মাইয়া নাই। কুন্তু জুমিদারের মেজো পোলার একখান মাইয়া আছে। তাও আবার পাগলি। জ্বিনে নাকি হেরে পাগলি কইরা দিসে।’

শেষের কথাটা ফিসফিস করে বলল তারা বেগম। যেন অতি গোপন কথা বলে ফেলেছে। সুনয়না গভীর মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে। তার আর কিছু জানার আগ্রহ নেই। সুনয়নাকে
পড়তে দেখে তারা বেগম আর কিছু বলার সাহস পেলো না।গাইগুই করে উঠে চলে গেল। সময় গড়িয়ে বিকালের দিকে সূর্য অভিমান করে মুখ লুকিয়েছে। ঠান্ডা বাতাস কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে সর্বাঙ্গে। ধীরে ধীরে আঁধার নামল। তিমিরাচ্ছন্ন হলো ধরণি। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খাওয়ার পর্বও চুকালো সুনয়না। শীতের রাত বিধায় ভৃত্যরা কাজ সেরে নিজ নিজ রুমে চলে গেছে। মাঝরাতে হঠাৎ সুনয়নার মনে একটা ইচ্ছে জাগ্রত হলো। মেরুন রঙ্গা শাড়ির উপর একটা শাল জড়িয়ে বেরিয়ে পড়ল। ভৃত্যরা ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। প্রাসাদের বিপরীতে একটা দরজা আছে। সেই দরজা দিয়ে অনায়াসে যাওয়া- আসা করা যায়। সে অসংখ্যবার বেরিয়েছিও। তবে তার পালাতে ইচ্ছে হয় নি তাই যায় নি। নয়তো কবেই উড়াল দিতো। বর্তমানে সে স্ব-ইচ্ছায় এখানে থাকছে। এর যথেষ্ট কারণও রয়েছে। নয়তো এত সহজে পোষ মানা মানবী সে নয়। একথা সেই অদেখা মানবও অবহিত। এমনকি সে বের হয় তাও জ্ঞাত।সুনয়না দরজা ঠেলে বেরিয়ে মেঠো পথ ধরে হাঁটতে লাগল। একা একা সুনশান রাস্তাঘাট জনমানব কেউ নেই। অদূরের পাইন গাছের ডালে বসে একটা পেঁচা ডাকছে। কী অদ্ভুত সেই ডাক! সুনয়না পাত্তা না দিয়ে কিছুদূর হেঁটে সেই দীঘিটির পাড়ে পৌঁছাল। একটা একটা করে সিঁড়ি বেযে
শেষ সিঁড়িতে গিয়ে বসল। পা দু’খানা ডুবালো দীঘির শীতল জলে। পায়ে পানির স্পর্শ হতেই শরীরে শিরশিরে অনুভূতি হলো। দীঘিটির চারপাশে লাইট থাকায় শাপলাগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বাতাস বইছে। তাতে দীঘির পানি টলমল শব্দ তুলেছে। সুনয়না নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মাঝ দীঘিতে।
গভীর ভাবনায় মগ্ন সে। ঘন্টা খানিক সেখানে বসেই সুনয়না উঠে দাঁড়াল। আর পিছু না ফিরে ধীর গতিতে হেঁটে পুনরায় ফিরে গেল প্রাসাদের দিকে।

জমিদার আলাউলের বড় ছেলে জমশেদ রওশান বারান্দায় দাঁড়িয়ে সবটা দেখল। ঘুম না আসায় বারান্দাতে হাঁটাহাঁটি করছিলেন তিনি। উনার বয়স ছাপান্ন পেরিয়েছে। বর্তমানে এই গ্রামের প্রধান তিনি। যাকে গ্রাম্য ভাষায় মোড়ল বলে। উনার বাপ-দাদারা ছিলেন মস্ত জমিদার তাই উনাদের বংশের নাম জমিদার বংশ। এই নামেই সবাই চিনে, জানে। তবে উনাকে কেউ নাম ধরে ডাকেন না। সবাই মোড়ল সাহেব ডাকে। আর বিগত চৌদ্দ বছর ধরে উনি এই গ্রামেই মোড়ল হিসাবে আছেন। প্রতিপক্ষ এসেও টিকতে পারেন নি। মূলত টিকতে দেওয়া হয় নি।মোড়লের বারান্দার গ্রিল দিয়ে দীঘির এক পাশ দেখা যায়। সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে হঠাৎ উনার দৃষ্টিতে যায় দীঘির পাড়ে। শেষ সিঁড়িতে বসে আছে সুন্দরী এক মানবী। উনি ভ্রু’তে ভাঁজ ফেলে পুরো ঘটনা অবলোকন করলেন। এ মেয়েটির কথা উনি অবগত। আর উনিই হুকুম দিয়েছেন তাকে প্রাসাদে রাখার। এর বিনিময়ে অনেক কিছু হাতেও পেয়েছেন। বর্তমানে এই মেয়েটি প্রাসাদে থাকা মানে কাউকে বশে রাখা।

তবে এতরাতে সুনয়নাকে দেখে উনি একটা সিধান্ত নিলেন। সুবাহ সাদিকের পর পরই সিধান্তটা বাস্তবায়ন করবেন।ধীরে ধীরে রাত পেরিয়ে ভোরের আগমন ঘটল। কুয়াশাতে কিছু দেখা যাচ্ছে না। প্রচন্ড শীতে মানুষজনের নাজেহাল অবস্থা।
তবুএ খুব ভোরে মোড়ল একজন ভৃত্যকে পাঠাল সুনয়নাকে ডেকে পাঠাতে। কিন্তু উনাকে অবাক করে দিয়ে সুনয়না আসল না। বরং ভৃত্যের মাধ্যমে মোড়লকে জানাল,

-‘যার দরকার তার আসায় শ্রেয়, ধন্যবাদ।’

ওর দুঃসাহস দেখে অভিরাজ রাগে ফেটে পড়ল। মোড়ল সাহেব ছেলেকে শান্ত করলেন। যা করতে হবে ঠান্ডা মাথায় নতুবা খেলার মোড় ঘুরে যাবে। আর অনেক কিছুই বেহাত হয়ে যাবে। অভিরাজ বাবার মুখের উপরে কথা না বলতে পারে না। তাই মনে মনে সুনয়নাকে বিশ্রী কয়েকটা গালি দিলো। মোড়ল সাহেব মৃদু হেসে ছেলের কাঁধে চাপড় মেরে পাশে বসালেন। বাবাার এহেন শান্ত রুপ অভিরাজের পছন্দ হচ্ছে না। তাই সে কিছু বলতে উদ্যত হলে মোড়ল বললেন,

-‘মেয়েটির ছত্রছায়া আবেশ মুনতাসীর। এখন মেয়েটার কিছু করা মানে আবেশকে খোঁচানো। যেটা আমাদের জন্য
সুখকর হবে না। তাছাড়া…! ‘

বাবাকে থেমে যেতে দেখে অভিরাজ উনার দিকে তাকাল। বাবাকে চিন্তিত দেখে সে কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইল,

-‘তাছাড়া কী আব্বা?’

মোড়ল রাগকে দমন করে শান্ত কন্ঠে বলল,

-‘মেয়েটিকে এখানে রেখে আবেশ একটা দলিলে আমার সই নিয়েছে। সেখানে স্পষ্টভাবে লিখা, মেয়েটার কিছু হলে সে আমার কলিজা কেটে নিয়ে যাবে।’

To be continue……….!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here