বিভীষিকা পর্ব -০৩

-‘বিভীষিকা’-
-‘নূরজাহান আক্তার আলো’-
[০৩]

খুঁজো না আমায় পাবে না তুমি
আড়ালে রয়েছি আমি।
যেথায় যাবে সেথায় পাবে
প্রিয় রোমন্থনের রাণী।

আবারো একটা নীল চিরকুট। সুনয়না সেটা ছুঁয়েও দেখল না। অনাদরে পড়ে রইল কারো আবেগমিশ্রিত চিরকুট খানা।
মোড়ল ডাকার পর থেকেই সুনয়না গম্ভীর হয়ে বসে গেছে।
প্রস্তাবটা তার পছন্দ হয় নি। সে কেন অন্যের বাড়ি থাকবে?
তাকে নিয়ে এত টানাহেঁচড়াই বা কেন? সুনয়না কিছু ভেবে সরাসরি সবুর মিয়া কাছে গেল। সবুর মিয়া কেবল বাজার থেকে এসে দাঁড়িয়েছেন। সুনয়নাকে দেখে হাসি-মুখে কিছু বলার আগেই সুনয়না বেশ শান্ত মেজাজে বলল,

-‘আপনার স্যার আগামী তিনঘন্টার মধ্যে আমার সম্মুখে না আসলে, আমি গলায় দড়ি দিবো। মজা করছি না তাকে কথাটা জানিয়ে দিবেন।’

কথাটা বলে সে গটগট করে চলে গেল। সবুর মিয়া হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। ব্যাপারটা বুঝতে উনার কিছুটা সময় লাগল। বোধগম্য হতেই, উনি সুনয়নাকে বোঝানোর জন্য পিছু পিছু গেলেন। সুনয়না শাড়িতে ফাঁস বাঁধিয়ে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখল। তিনঘণ্টা পার হলে তাতে ঝুলে পড়বে।ততক্ষণ সময় কাটাতে একটা বই নিয়ে বসল। সবুর মিয়া জানলা দিয়ে পুরো ঘটনা দেখে চট করে ছবি তুলে নিলেন। প্রমাণসহ ঘটনাটা স্যারকে দেখানো অত্যান্ত জরুরি। তিনি ছবিটা আবেশকে পাঠিয়ে দিলেন, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই কল আসল। সবুর মিয়া বিস্তারিত ঘটনাটা জানাল। আবেশ চুপ করে শুনে কল কেটে স্থির হয়ে বসে রইল। পরক্ষনে মৃদু হাসল। মেয়েটা বড্ড জেদি। এটা পাগলামি না তাও নিশ্চিত।
দেরি না করে আবেশ অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ল। উদ্দেশ্যে রামচন্দ্রপুরের পরিত্যক্ত সেই প্রাসাদ। সেখানেই তার প্রিয়সী তারই অপেক্ষায়।

মোড়ল রাগান্বিত দৃষ্টিতে তার সহধর্মিণীর দিকে তাকিয়ে আছে। কারণ উনি মোড়লের পাতে ঘি দিতে দেরি করেছেন।
যেটা উনার একদমই পছন্দ নয়। দেরি হবেই বা কেন? উনি কী এ বাড়িতে নতুন? মহিলা মানুষের আবার কাজ কী? ওই খাওয়া আর শুয়ে থাকা ছাড়া। তবুও এমন করলে সহ্য হয়!
এটা অবশ্যই মস্ত বড় অন্যায়। রোজ যা করে তাতে কেনো ভুল হবে? মোড়লের সহধর্মিণী সাফিনা নতমস্তকে দাঁড়িয়ে আছেন। মোড়ল কিছু বলার আগে সেখানে আবেশ উপস্থিত হলো। ওকে দেখে মোড়ল নিজেকে ধাতস্থ করে খেতে বসল।
পরিবেশটা স্বাভাবিক করতে সাফিনা গিয়ে আবেশের সঙ্গে কুশল বিনিময় করল। ভালো-মন্দ খোঁজ নিলো। আবেশও হাসি মুখে প্রত্যুত্তর করল।মোড়ল কিছু বলার প্রয়োজনবোধ
করলেন না। উনি খেতে ব্যস্ত। একটুপরেই উনাকে বের হতে হবে। গ্রামের এক শালিশে যেতে হবে। অযথা কাজে সময় ব্যয় করেন না উনি। তখন আবেশ সাফিনার দিকে তাকিয়ে বলল,

-‘বড় মামী খাবার বাড়ো, ফ্রেশ হয়ে আসছি।’

সাফিনা মিষ্টি করে হেসে হন্তদন্ত পায়ে খাবার বাড়তে চলেও গেলেন। আবেশের উপস্থিতিতে মোড়ল বিরক্ত হলেও প্রকাশ করলেন না। একমনে খাচ্ছেন তিনি। সাফিনা হরেক রকমের খাবার পরিবেশন করেছেন। ছেলেটা অনেকদিন পর খেতে বসেছে। সে এখানে এসে খায়ও না, বসে না। অথচ মোড়ল
তার আপন মামা। তবুও ছেলেটাকে দু’চোক্ষে দেখতে অবধি পারেন না। আবেশের মা মোড়লের আপন ছোট বোন। আর ওর বাবা মোড়লের চাচাতো ভাই। আত্নীয়তার মধ্যে সম্পর্কে গড়েছিলো ওর বাবা-মা। এমনকি পালিয়ে বিয়ে করে শহরে সংসারও পেতেছিলেন।এজন্য জমিদার আলাওল ওর মাকে ত্যজ্য করে উপস্থিত সবার সামনে মৃত ঘোষণা করেছিলেন।
এরপর কিছুদিন সব ঠিকই ছিলো। কিন্তু আবেশের জন্মের পর ওর বাবা হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যান। তিনি ছাব্বিশ বছর ধরে নিঁখোজ। কেস কাচারি করেও লাভ হয় নি। আবেশও চেষ্টা করে ব্যর্থ। বিগতবছর ওর মা হঠাৎ হার্ট-এ্যার্টাকে মারা যান। বর্তমানে উনারা ছাড়া আবেশের কেউ নেই। বড্ড মায়া হয় ছেলেটার জন্য। ওই চাঁদমুখখানা দেখলে বুকটা হুহু করে উঠে। উনি কতদিন বলেছেনও,

-‘আবেশ বাবা এখানেই থেকে যাও। ‘

উনার কথা শুনে আবেশ মুচকি হেসে উত্তর দিয়েছে,

-‘যেখানে আমার বাবা-মায়েরই ঠাঁই হয় নি। সেখানে আমি পরগাছার ন্যায়।’

একথা শুনে উনি কিছু বলার শব্দ খুঁজে পান নি। এই মুহূর্তে
আবেশ মোড়লের পাশের চেয়ারে বসে খাচ্ছে। সাফিনা তার পাশে দাঁড়িয়ে খুশি মনে এটা ওটা তুলে দিচ্ছেন। হঠাৎ কারো ডাকে উনি ভেতরে গেলেন। তবে যাওয়ার আগে আবেশকে সব খাবার খাওয়ার আদেশ দিলেন। আবেশও হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়াল। উনি যেতেই আবেশ মোড়লকে বলল,

-‘সুনয়নাকে এখানে রাখার প্রস্তাব দেওয়ার আগে আমার অনুমতি নিয়েছেন?’

মোড়ল ভ্রু কুচকে আবেশের দিকে তাকাল। আবেশ একমনে
খেয়েই যাচ্ছে। যেন কিচ্ছু বলে নি সে। মোড়ল মুখের খাবার গিলে জবাব দিলেন,

-‘মেয়েটা রাত বিরেতে এখানে ওখানে বের হয়। যুবতী সুন্দরী একটা মেয়ে। কখন কী হয় বলা যায় না। প্রাসাদে একা সে সুরক্ষিতও নয় তাই এখানে রাখতে চেয়েছিলাম।’

আবেশ এক ভ্রু উঁচু করে কিঞ্চিৎ হাসল। শিয়াল ভাবছে মুরগির নিরাপত্তা! বাহ, চমৎকার ব্যাপার। কথাটা বিরবির করে বলল সে। মোড়ল শুনেও না শোনার ভান করে খেতে থাকলেন। এই ছেলেটা উনাকে এভাবে প্রতিনিয়তই অপমান করে। দিনকে-দিন সেটা সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। নেহাৎ কিছু কারণে উনি চুপ করে আছন। নয়তো কবেই তাকে তিন হাত মাটির নিচে রেখে আসতেন। এই কাজটা করতে উনার একটুও বুক কাঁপতো না। বরং প্রশান্তি মিলতো। মনে মনে এ কথা গুলো ভাবলেন মোড়ল। তখন আবেশ হাত ধুতে ধুতে বলল,

-‘এসব ভাবার কোনো অধিকার দেয় নি আমি। তাই নিজের অবস্থানটা আগে স্মরনে রাখুন নয়তো হিতে বিপরীত হবে।’

কথাটা বলে সে বেরিয়ে গেল। মোড়ল খাবারের প্লেটটা ছুঁড়ে মারলেন মেঝেতে। ঝনঝন শব্দ তুলে ভাতগুলো সব ছড়িয়ে গেল মেঝের এদিক-ওদিক। রাগে উনার শরীর কাঁপছে।যেন
আবেশকে নিঃশেষ করেই ক্ষান্ত হবেন।কয়েকজন ভৃত্য ভীতু চাহনিতে তাকিয়ে আছে। সাফিনা এসে আবেশকে পেলেন না। তবে মোড়লের রাগ দেখে সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়লেন।
এটা নতুন কিছু নয় বরং প্রায় রোজকার ঘটনা। তাই ধীর গতিতে সেখান থেকে সরে গেলেন।

সুনয়না একপলক ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আবার বইয়ে মন দিলো। ঘড়ির কাটাগুলো টিকটিক করে এগিয়ে যাচ্ছে। তিন ঘন্টা হতে আর মাত্র নয় মিনিট বাকি। তবুও তার দেখা নেই।
এরমধ্যে সবুর মিয়াকয়েকবার দরজা ধাক্কিয়ে চলে গেলেন।
রমেলাও খেতে ডাকল। কারো ডাকে সাড়া দেয় নি সে। আর যখন দুই মিনিট বাকি তখন সে উঠে বাইরে গেল। না কেউ আসে নি। তারমানে লোকটা তার কথা গুরুত্ব দেয় নি। মজা হিসেবেই ধরেছে। আশেপাশে কারো দেখা মিললো না। অথচ কিছুক্ষণ আগেও রমেলার কথা শোনা যাচ্ছিল। ব্যাপার না এবার মারাত্মক কিছু করবে সে। তবুও আর এখানে থাকবে না সে। এসব ভেবে সুনয়না পিছনে ঘুরতেই কেউ ওর গলায় কিছু পুশ করল। ইনজেনশন জাতীয় কিছু। গলায় হাত দিয়ে
কে সে দেখার আগেই চোখজোড়া বন্ধ হয়ে আসল তার। সে ঢলে পড়ল কারো শক্ত বাহুডোরে। নিকষ কালো রাত কেটে যখন ভোরের আলো ফুটল, তখন সুনয়নার জ্ঞান ফিরল। সে নিজেকে আবিষ্কার করল সুসজ্জিত এক বিছানায়। চোখ বুলিয়ে নিলো বিলাশ বহুল রুমটাতে। স্বচ্ছ কাঁচের জানালা ভেদ করে একফালি আলো এসে পড়েছে ওর নয়নজোড়ায়।
সুনয়না আস্তে করে উঠে বসল।সে এখন কোথায় তা বোঝার ব্যর্থ চেষ্টায় ব্যস্ত। তখন দরজা খুলে কারো আগমন ঘটল। একজন সুদর্শন পুরুষ এসে দাঁড়াল ওর সম্মুখে। হাতে তার শুভ্র রঙের তোয়ালে। ঘমার্তমুখখানা মুছছে ব্যস্ত ভঙ্গিতে।
সুনয়না ভ্রু কুঁচকে তাকে পরখ করে আগে মুখ খুলল,

-‘রাজনীতিবিদ আবেশ মুনতাসীর! তা আমাকে ধরে আনার কারণ?’

To be continue…….!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here