বীরাঙ্গনা হইতে বারাঙ্গনা পর্ব -০৪

#বীরাঙ্গনা_হইতে_বারাঙ্গনা (৩য় পরিচ্ছেদ)
#মম_সাহা

পর্বঃ ৪

বাহিরে বৃষ্টির তুমুল শব্দ আর ঘরের ভেতর ফ্যানের ক্ষীণ শব্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। সাথে কত জানা-অজানা অনুভূতির মিশ্রণে একদম চুপ হয়ে গেলো বিজলি। রূপমাধুরী তখন আরামকেদারায় বসে দোল খাচ্ছে নিজ আনন্দে৷ আঁধার মাঝে কেদারার অদ্ভুত শব্দটা ঠিক শোনা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বিজলিই বললো,
“আপ্পা, পুনম চলে গিয়েছে আর সেটা আপনার ইচ্ছেতেই। কিন্তু কোথায় গেলো!”

রূপমাধুরী এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। বরং গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“সিগারেট দে তো একটা।”

বিজলি তৎক্ষনাৎ আঁধার হাতড়ে টেবিলের উপর দেখে সিগারেটের বক্স এবং দেশলাইয়ের বাক্সটা নিয়ে আসলো। রুমটার সব কিছু তার মুখস্থ তাই আঁধার টপকে জিনিস গুলো খুঁজে বের করতে অসুবিধা হয় নি।

আঁধার ঘরে ক্ষীণ আগুনের ফুলকি দেখা গেলো সাথে পাওয়া গেলো নিকোটিনের গন্ধ। বোঝা গেলো রূপমাধুরী তার পছন্দের কাজ করতে ব্যস্ত। বিজলিও কথা বললো না। কিছুক্ষণ এক নাগাড়ে ধোঁয়া উড়ানোর পর রূপমাধুরী রহস্য করে বললো,
“তুই ই তো বললি কার প্রতি যেন দুর্বল হয়ে গিয়েছে পুনম, তাহলে দুর্বলতার কাছেই যাবে।”

বিজলি অবাক হলো। বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
“তার মানে ঐ বাবুটার কাছে গেছে? যে রোজ রোজ আসতো?”

রূপমাধুরী উত্তর দেওয়ার আগেই টেলিফোন বেজে উঠলো। রূপমাধুরীর আদেশে বিজলি গিয়ে ফোনটা রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে কৃতজ্ঞতার কণ্ঠে একজন লোক বলে উঠলো,
“আপনাকে ধন্যবাদ সাহেবা। পুনমকে আমার বেশ ভালো লেগেছিল কিন্তু আপনার ভয়ে দুজনেই বলতে পারি নি। আজ আমার কাছে পুনমকে তুলে দিয়েছেন তাই আপনার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আমি ওর অযত্ন করবো না। আমি ভুলে যাবো ও কোথা থেকে এসেছে। ওর অতীত বলতে কিছু থাকবে না। ভালো থাকবেন।”

এত কথার বিপরীতে বিজলি উত্তর দিতে পারলো না। নিজের কথা শেষ হতেই অপর পাশ থেকে কলটা বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে ততক্ষণে। তবে বিজলি কণ্ঠের মালিককে চিনলো। এটাই সে ব্যাক্তি যে পুনমের সাথে ঘন ঘন থাকতে আসতো। তবে আপ্পাই আজ পুনমকে ওর হাতে তুলে দিলো!

বিজলির অবাক ভাবটা ছড়ানোর আগেই কাঠের দরজায় তুমুল শব্দ হলো, বাহির থেকে ক্ষীণ স্বরে একটা মেয়েলি কণ্ঠে ভেসে এলো কথা,
“বিজলি, আপ্পাকে বলিস আজ নাকি নতুন খদ্দের আসবে। অনেক টাকার মালিক। মিতালি মেম কল দিয়ে জানিয়েছেন। আপ্পাকে বলেছে বিশেষ ব্যবস্থা করতে।”

বিজলি পিছনে ফিরে আঁধারের মাঝেও রূপমাধুরীর অবয়বটার দিকে চাইলো। ততক্ষণে আগুনের ফুলকির আর দেখা মিললো না হয়তো সিগারেট টানা শেষ। বিজলির আলাদা করে আর কিছু বলতে হলো না কারণ রূপমাধুরী সব নিজ থেকেই শুনেছে। সে গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিলো,
“তুই তাহলে এখন যা, আমার গল্প পরে শোনাবো। আপাতত খদ্দেরের জন্য ব্যবস্থা করতে হবে। যা।”

বিজলি অনুমতি পেতেই দরজার ছিনকিনি খুলে ধীর পায়ে বেরিয়ে গেলো।

যুগ বদলের পৃথিবীতে কিছুটা উন্নয়ন চা বাগানেরও হয়েছে। আগের মতন সেখানে আর ছন, খড়,বাঁশের তৈরি ঘর দেখা যায় না। শান্ত, নিবিড় রাস্তাও দেখা যায় না। ছনের জায়গায় সিমেন্ট এসেছে, কুঁড়েঘরের জায়গায় দালান। তবে মানুষ গুলো আগের মতনই সহজ সরল জীবনে অভ্যস্ত। সকলের মাঝে কোমল একটা টান রয়েই গেছে।

চা বাগানের ঘন পরিবেশে রাত তখন শুরু। এত বছরের বন্ধ প্রজেক্ট টা শুরু করার জন্য শহর থেকে আবার লোক এসেছে। এখানে এলকোহলের ফ্যাক্টরি তৈরী করাই তাদের লক্ষ্য। আর এতে চা বাগানের সহজ সরল পরিবেশ এবং মানুষ দু’টোই তুমুল ক্ষতির সম্মুখীন হবে। কিন্তু ঐ যে চা বাগানের মানুষ বড্ড সহজ সরল, তাই তারা নিজেদের ক্ষতি জেনেও কিছু করতে পারবে না। ক্ষমতার কাছে সবকিছুই যে ফিঁকে।

চা বাগানের কটেজের বড় রুমটায় বসে আছে শহুরে লোকজন। আপাতত চারজন এসেছে এখানের হালচাল দেখতে। আর তাদের বেশ পছন্দ হয়েছে জায়গা খানা। সকলের বয়সই ত্রিশের এপাড়-ওপাড়। সকলে একসাথে বসে কার্ড খেলছে। বাহিরে তখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। প্রকৃতিতে বাতাসের বিচরণ। লোক গুলোর মাঝে সুঠাম দেহী লোকটা সিগারেট টানতে টানতে উঠে দাঁড়ালো। বাকিরা ভ্রু কুঁচকালো, অবাক কণ্ঠে বললো,
“কই যাচ্ছিস?”

“পেট খালি করতে৷ তোরা খেল, আমি আসছি।”

কথা শেষ করেই সিগারেট টানতে টানতে লোকটা কটেজ ছেড়ে বেরিয়ে এলো। কটেজের ভিতরে তখন তিনজন খেলায় মগ্ন। বাহিরে আসা লোকটার নাম সম্রাট। সম্রাট যখন বাগানের দিকে এগিয়ে গিয়ে নিজের কাজ সেরে ফিরে আসতে নিলো তখনই বাগানের গাছপালা কিছুটা নড়েচড়ে উঠলো। সম্রাট দাঁড়িয়ে গেলো। তার কপালে আপনা-আপনি ভাঁজ পড়লো। সে আবার পেছনের দিকে তাকিয়ে গাছপালাকে আরেকটি বার পরখ করে নিলো৷ নেই কেউ, তবে শব্দ কিসের হলো! সম্রাট আবার ফিরে আসতে নিলে আবার মনে হলো তার পেছনে কেউ আছে। আচমকাই শরীর শিরশির করে উঠলো সম্রাটের। ভীত দৃষ্টি নিয়ে সে পেছনে তাকালো কিন্তু এবারও ফলাফল শূন্য। সম্রাট পকেট থেকে মোবাইল বের করলো। কিন্তু ফোনের ফ্লাশ জ্বালানোর আগেই তার পিঠে কারো হাতের ছোঁয়া লাগলো। চমকে উঠার কারণে সম্রাটের হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেলো। সম্রাট পেছনে ফিরে দেখে লাল শাড়ি পরে বিশাল এক ঘোমটা টেনে দাঁড়িয়ে আছে একটা নারী। হাতের চামড়া কেমন কুঁচকে আছে। সম্রাট চিৎকার দিয়ে কটেজে ছুটে গেলো। সম্রাটের চিৎকারে ভয় পেয়ে গেলো বাকি তিনজনও। উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে? চিৎকার করিস কেন? কোনো পশু দেখেছিস নাকি?”

ভয়ে সম্রাটের শরীর কাঁপছে। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,
“বাগানে, বাগানে একটা মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। শরীরের চামড়া যেন কেমন। চা বাগানে লোক মুখে শুনেছিলাম একজন মহিলা নাকি অশরীরী হয়ে ঘুরে বেড়াতেন, সে-ই বোধহয়। ঐ যে বটগাছটার সাথে দেখ।”

সম্রাটের কথা শুনে বাকিরা কপাল কুঁচকালো। কথাটাকে তেমন গ্রাহ্য না দিয়ে বললো,
“আরে ওসব ভূয়া কথা। তুইও এসব ভূয়া কথা বিশ্বাস করিস? আচ্ছা দাঁড়া আমরা গিয়ে দেখি।”

সম্রাট তখনও অস্বাভাবিক কাঁপছে। বাকিরা চলে গেলো বাহিরে। ঠিক দুই তিন মিনিট পর ঘরের ভেতর থেকে আবার চিৎকার ভেসে এলো। ছেলে তিনজন ভেতরে গিয়ে দেখলো সম্রাট জ্ঞান হারিয়ে পরে আছে মাটিতে।

নিষিদ্ধ পল্লীর বিরাট আলিশান আঁধারীয়া রুমটার মাঝে নতুন কাস্টমারের অপেক্ষায় অপেক্ষারত সেখানের মালকিন, রূপমাধুরী। চুলের ভাঁজে থাকা তাজা বকুল ফুলের মালাটা থেকে মোহনীয় সুঘ্রাণ পরিবেশটাকে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি মায়াবি করেছে। স্লিভলেস ব্লাউজের উপর জড়ানো পাতলা টিস্যুর ন্যায় সাদা শাড়ি এবং ঠোঁটে লাগানো লাল টকটকে রঞ্জকে তাকে আবেদনময়ী কোনো অপ্সরা মনে হচ্ছে। রুমের চারপাশে নিভু নিভু আলোয় জ্বলতে থাকা মোমবাতির কারণে তার শরীরকে কোমল মাখনের সাথে নির্দ্বিধায় তুলনা করা যাবে। একটু পর পর সে তার শরীরে মিষ্টি সুগন্ধীটা মেখে নিচ্ছে। নিজেকে আকর্ষণ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা সে করেছে। আজকের খদ্দের টা বেশ পয়সাওয়ালা কিনা। একবার তার চোখে পরে গেলে টাকার বিছানায় দিবানিশি নিদ্রা যাপন করা যাবে। তাই তো সে অন্যান্য মেয়েদের কাছে না পাঠিয়ে নিজেই আদর-যত্নের ব্যবস্থা করেছে।

রূপমাধুরীর ভরা টসটসে আবেগের সমাপ্তি ঘটিয়ে নতুন খদ্দের টা রুমের ভেতর প্রবেশ করলো। চোখ-মুখে কামুক এক হাসি দিয়ে রমণী যখন তার খদ্দেরের দিকে তাকালো, অনাকাঙ্খিত মানুষটাকে দেখে সে নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। মোমের আবছা আলোয় বহু পরিচিত প্রেমিকের মুখটা ভেসে উঠলো চোখের সামনে। অনেকগুলো বছর পর, প্রিয় প্রেমিকের বিছানার সঙ্গী হওয়ার জন্যই বুঝি এত আড়ম্বর পূর্ণ আয়োজন ছিলো! রূপমাধুরী দু’পা পেছনে চলে গেলো। অবাক ভাব তার শরীরের শিরায় শিরায় বিদ্যুৎ এর বেগে ছুটে গেলো।

শুধু রূপমাধুরী নয়, তার সামনের মানুষটাও কম অবাক হয় নি। চোখ দু’টো যেন অক্ষিকোটর থেকে বেরিয়ে আসবে। কণ্ঠে শব্দ দের আন্দোলন। তবুও লোকটা কোনো মতে উচ্চারণ করলো,
“বীরাঙ্গনা!”

রূপমাধুরী টান টান কণ্ঠে বললো,
“বীরাঙ্গনা না, আমি বারাঙ্গনা।”#বীরাঙ্গনা_হইতে_বারাঙ্গনা (৩য় পরিচ্ছেদ)
#মম_সাহা

অন্তিম পর্বঃ ১ম অংশ

ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মাঝে কাঁদা মাটিতে মাখামাখি রূপমাধুরী। মাটির বুকে কুড়ালের আঁচড় টেনে মাটির দলা উঠিয়ে নিচ্ছে। তার একটু দূরেই মাথায় ছাতা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বিজলি উৎকণ্ঠা নিয়ে বার বার বলছে,
“আপ্পা, আপনি চলে আসেন না, আমি করে দিচ্ছি কাজটা। আপনি ইশারা দিলেই যেখানে আপনার সব কাজ হয়ে যায় সেখানে আপনি কেন কষ্ট করছেন? আমি করে দেই।”

“একদম না, তোকে বলেছি আমার উপরে কথা বলতে? ছাতা ছেড়ে ভুলেও বের হবি না। তোর ঠান্ডার সমস্যা অনেক। তুই চুপ করে দাঁড়া।”

“ঠিক আছে দাঁড়াচ্ছি। কিন্তু আপ্পা, আপনি কী করবেন এই গর্ত খুঁড়ে?”

“কলঙ্ক ঘুচাবো।”

বিজলি রূপমাধুরীর হেয়ালি কথার অর্থ বুঝলো না। কিন্তু ততক্ষণে রূপমাধুরীর গর্ত খুঁড়ানো শেষ। মহিলা গর্ত খুঁড়তে খুঁড়তে ক্লান্ত হয়ে গেলো। অতঃপর কাঁদায় চিপচিপে মাটির মাঝেই বসে পড়লো। বিজলি তৎক্ষনাৎ ছাতা নিয়ে ছুটে আসতে নিলেই থামিয়ে দিলো রূপমাধুরী, গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“ভিজতে দে আমায় বিজলি, ভিজতে দে। অনেক গুলো বছর আমি ভিজি না মন খুলে। ধুয়ে নিতে দে আমার সকল পাপ, সকল কলঙ্ক।”

বিজলি থেমে গেলো আপ্পার আদেশে। পাশের কেটে রাখা গাছের মোটা অংশে বসলো। বৃষ্টি তখন অকৃপণ হাতে দান করছে তার সকল অশ্রুকণা। রূপমাধুরী মাথা নত করে গর্তের দিকে তাকিয়ে কোমল কণ্ঠে বললো,
“বিজলি, একটা জীবন কাহিনী শুনবি? একটা গা ছমছমে গল্প?”

বিজলি উত্তর দেয় না কিন্তু উপর-নীচ মাথা নাড়িয়ে তার সম্মতি জানান দেয়। আকাশে তুমুল বেগে বজ্রপাত ঘটে। চারদিক আলোকিত হয় সেই বজ্রপাতে। তুমুল শব্দে বিজলির বুক কিঞ্চিৎ দুরুদুরু করে উঠে। কিন্তু কোনো ভ্রুক্ষেপ দেখা যায় না সামনের গোলগাল নারীটার দিকে। বৃষ্টির ঝপঝপ শব্দ ছাপিয়ে রূপমাধুরীর কণ্ঠ শোনা গেলো,
“যে মেয়েটার কথা বলছি, তার বিয়ে যখন হয় বয়স তখন কমই কিন্তু তখনের যুগের তুলনায় সে বেশ বড়ো নারী। নিজের ভাগ্যকে সে মেনে নিয়ে ছিলো খুব স্বাভাবিক ভাবে। মা-বাবা ছিলো না, জেঠা জেঠির কাছে মানুষ হয়ে ছিলো। তার বিদায়ের দিন জেঠিমা বলেছিলেন, ‘এ বাড়ির থেকে যাচ্ছিস, আর মুখও দর্শন করবি না বাড়ির।’সে মেনে নিয়ে ছিলো সেই কথাটাও। আর মুখও দর্শন করে নি। তাছাড়া স্বামী ছিলেন দেবতুল্য মানুষ, তাকে আর ছেড়ে আসার সাধ্যি তার হয় নি। কিন্তু তখনও প্রেমিকের সাথে তার যোগাযোগ ছিলো কিন্তু প্রেমিক হিসেবে না, কেবল আর কেবল মাত্র শুভাকাঙ্খী হিসেবে। সে নিজের স্বামীকে কখনো সংশয় ঠেলে বলতে পারে নি নিজের এক কালীন প্রেমিকের কথা। বিয়ের পর দেবতুল্য স্বামী আর ননাস পেয়েছিলো। ননাস ছিলো বিধবা। তার সাথে ননাসের গলায় গলায় ভাব হয়ে যায়। বছর ঘুরতেই কোল আলো করে রাজকন্যা এলো। তার স্বর্গের মতন সংসার। সব ভালো ই চলছিলো। কিন্তু একদিন তার সব ভালো নিমিষেই চুরমার হয়ে গেলো। তার ননাসকে খুব আপত্তিকর অবস্থায় সে দেখে ফেললো আরেকজন বিবাহিত পুরুষের সাথে। তার ঘরের মাঝে যে লাগোয়া জানালা ছিলো, তা দিয়েই সেই অনাকাঙ্খিত ঘটনা দেখে ফেলে। অতঃপর তার মনে ননাসের প্রতি তুমুল ঘৃণা জন্মায়। প্রেম সবাই ই করতে পারে কিন্তু প্রেমের নামে পাপকে সে মানতে পারছিলো না কোনোভাবেই। এর কিছুদিনের মাথায় দেখে তার ননাসের দেহের পরিবর্তন হচ্ছে, উনি বমি করছেন, মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাচ্ছেন। সংসারের বেড়াকলে পড়ে সেই মেয়ে তখন পাঁকা গিন্নী। ওসব লক্ষণের কারণ বুঝতে তার তেমন কাঠখড় পোড়াতে হয় নি। যখন জানলো ননাস সন্তান সম্ভবা তার মাথায় তখন আকাশ ভেঙে পড়লো কারণ এই সন্তান যার সে রীতিমতো বিয়ে করে একটা পুত্র সন্তানের জনকও হয়ে গেছে। সেদিন রাতে পারিপার্শ্বিক অবস্থার কথা চিন্তা করে সে মেয়ে সিদ্ধান্ত নিলো ননাসের সাথে সরাসরি কথা বলবে। ততদিন অবশ্য ননাস জানতেন না যে তার ভাইয়ের বউ সব জানে। ননাসের সাথে সেদিন রাতেই নিবিড়ে সব কথা হলো। ননসকে শর্ত দিলো এ সন্তান রাখতে পারবে না কিন্তু তার ননাস তা মানতে নারাজ। বহু কথা কাটাকাটির পর ঠিক হলো তার কথা, সেই মহিলা মানবে শর্ত তবে তার পরিবর্তে সে মেয়ের কোলে যে সন্তান আসবে সেটা তার ননাসকে দিয়ে দিতে হবে। তারও তো ইচ্ছে করে ছেলেমেয়ে পালতে। সেদিন সে মেয়ে বুকে পাথর বেঁধে রাজি হয়। ঐ সন্তানের কোনো দোষ ছিলো না কিন্তু এই সন্তান যে সমাজ মেনে নিবে না। তখনের সময়ে সমাজ তো আরও পিছিয়ে ছিলো। এরপর সে খুব বুদ্ধি করেই সদরে পাঠিয়ে দেয় তার ননাসকে। তার প্রাক্তন প্রেমিক সাহায্য করেছিল এ কাজে। সেই প্রেমিক অনেক গুলো দিন মেয়েটার ননাসকে শহরে রাখে। মেয়েটা স্বামীর কাছে বলেছিলো তার বাবার বাড়ি বেড়াতে পাঠিয়েছে ননাসকে। খুব ঝুঁকি নিয়ে অনেক গুলো মাস লাগিয়ে ছোট্টো প্রাণটা শেষ করে তারা। তারপর থেকেই মনের মাঝে অপরাধ বোধে মেয়েটা ক্ষণে ক্ষণে পুড়তো। তখন থেকেই কেমন একটা মানসিক সমস্যা শুরু হয় মেয়েটার। নরম, সহজ মেয়েটাই আর সহজে সব নিতে পারতো না। উচ্চস্বরে কথা বলতো, কর্কশ কথা বলতো, রেগে যেতো। তবে বরাবরই মেয়েটা সাহসী ছিলো। তার প্রেমিক তাকে সাহসী কন্যা ডাকতো। সে নাকি বীর কন্যা। সেই বীর কন্যাই সংসারের চাপে হয়ে যাচ্ছিলো নেতানো ফুলের মতন। তারপর তার আর তার ননাসের মাঝে ঝামেলা লেগেই থাকতো এসব নিয়ে। মেয়েটা নিজের ননাসকে সব ছেড়ে দেওয়ার কথা বলতো বার বার অথচ সেই মহিলা সবকিছুতেই জড়িয়ে পড়তো বেশি। এরপর মেয়েটার কোল আলো করে আরও দু’টো যমজ কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। নিজের কথা অনুযায়ী তাদের মাঝে একজনকে তুলে দেয় ননাসের হাতে। ননাস সব দিক দিয়ে খারাপ হলেও সন্তান পালনে কখনো কার্পন্য করেন নি। কিন্তু মেয়েটা মানতে পারতো না সেসব আহ্লাদ, তার মন তো জানতো সে ননাসের কী কী দেখেছে দু’চোখে। এরপর কিছুটা রাগ ফেলতো নিজের সন্তানের উপরও কারণ সে সহ্য করতে পারতো না তার ননাসের সাথে নিজের সন্তানের চলাফেরা। মেয়েকে আকারে ইঙ্গিতে না করতো ননাসের সাথে মিশতে অথচ সে শুনতো না। অবশেষে কেমন বিরক্ত, খিটখিটে মেজাজের হয়ে উঠলো সে। আর ননাস তার বেচারি চেহারা নিয়ে প্রিয় স্থান চা বাগানে করে গেলো নানান রকম কাজ যা মানতে কষ্ট হতো মেয়েটার, কিন্তু চুপ করে মেনে নিতো সব। তার স্বামীও ততদিনে কিছুটা ধারণা করেছিলেন কিন্তু সব তাদের হাতের বাহিরে ছিলো তখন। সময় নিজের মতন গড়িয়ে যেতে থাকে, সাথে মেয়েটার বেশ পরিবর্তন ঘটে। ঐ যে নিষ্পাপ শিশুকে মেরেছে, সেই অপরাধবোধ তাকে ধীরে ধীরে মানসিক ভাবে অসুস্থ করে তোলে। যার ফলস্বরূপ সে নিজের তিন মেয়ের মাঝে একজনকে দেখতে পারতো না। আর তার ননাস যখন ওকে আদর করতো তখন তার সেই অপরিপক্ক ভ্রূণটার কথা মনে পড়তো যার জন্য সে নিজের মেয়ের থেকেও দূরে দূরে থাকতো। কেটে গেলো এমন করে অনেক গুলো বছর। তার মেয়েরা সব বড়ো হয়ে উঠে। সেও তখন তেরো চৌদ্দের নব বধূ থেকে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের প্রাপ্তবয়স্কা ঘরণী। সংসারের হাল ধরে রেখেছে শক্ত হাতে। তারপর তাদের চা বাগানে আমদানি হয় শহুরে একদল ছেলের, আর সেখানে দ্বিতীয় বারের মতন রচিত একটি মেয়ের হৃদয়হীনা হওয়ার গল্প।”

দীর্ঘ কথার পর বিরতি নেয় রূপমাধুরী কিন্তু সবটা শোনার উত্তেজনায় তুমুল বৃষ্টির মাঝেও ঘেমে-নেয়ে একাকার বিজলি। রূপমাধুরীকে থামতে দেখেই ব্যস্ত কণ্ঠে বলে,
“তারপর? তারপর?”

রূপমাধুরী হাসে মাথা নিচু করে। দ্বিতীয় দফায় বজ্রপাত হয়। চারদিকে রাত তখন গভীর হয়ে আসে। কেঁপে উঠে বিজলির শরীর। আশপাশে কেমন গম্ভীর আবহাওয়া। কিন্তু সবটাকে আরও গম্ভীর করে দিয়ে রূপমাধুরী আবার বলা শুরু করলো,
“তার বড়ো মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়, সব ঠিকই চলছিল কিন্তু অনাকাঙ্খিত ভাবে বিয়ের আগের দিন বর পালিয়ে যায় যার ফলস্বরূপ থেমে যায় বিয়ে। অন্যদিকে চা বাগানকে বিধ্বস্ত করতে প্রস্তুত একদল শহুরে হায়েনা। তার মানসিক রোগটা তখন আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। কিছু ভয়ঙ্কর করে ফেলার আকাঙ্খা জাগে। সে আবার নিজের পরিবারের সবাইকে নজরে রাখা শুরু করে। নিজের বড়ো মেয়ে আর মেঝো মেয়ের মাঝেও সে পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছিলো। এর মাঝে একদিন সাংসারিক কলহ হয়, আর মানসিক ভাবে তখন বিপর্যস্ত ছিলো মেয়েটা। তাই অনাকাঙ্খিত ভাবেই নিজের মেয়েকে মারতে গিয়ে ভুল বশত ননাসের শরীরে হাত লেগে যায় তার। তাকে আঘাত করার কোনো ইচ্ছে মেয়েটার কোনো কালেই ছিলো না। আঘাত করতে হলে তো অনেক বছর আগেই করতে পারতো তাই না? পিসিভক্ত মেয়ে ততদিনে নিজের মাকে অপছন্দ করতো যা তার রাগে আগুনে ঘি ঢালার মতন কাজ করতো।
সেদিন দুপুরের পরের ভাগই তার ননাসের লাশ পাওয়া যায় পুকুর পাড়ে। সবাই ভাবলো আত্মহত্যা কিন্তু তার চোখ তো দেখেছে অন্যকিছু, অন্যরকম কিছু। কিন্তু সে তা প্রকাশ করতে পারলো না কারণ সে ছিল নিরুপায়, প্রমাণ ছাড়া ছিলো। তারপরেই ননাসের প্রেমিকের ছেলের লা/শ পাওয়া গেলো। পচা গলা লা/শ। তার খটকা তখন পরিষ্কার হলো। তার মাঝেই তার এক মেয়ে ছড়ালো সে নাকি মৃত দু’জন ব্যাক্তিকেই দেখতে পাচ্ছে। নিজের মেয়ে গুজব ছড়ালেও সেটাকে সত্যি করে দিলো সে। মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন করার জন্য সাজলো তার ননাসের সাজ। সবাইকেই ভয় দেখাতে থাকলো। এমনকি সে এমন ভাবে সবটা উপস্থাপন করেছিলো যে সবাই ভেবেছে অস্বাভাবিক কিছু ঘটছে চা বাগানে। এটা সাহায্য করলো,চা বাগানকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতেও। যে ধ্বংসাত্মক প্রজেক্টের কাজ হওয়ার কথা ছিলো তা থেমে যায়। সে নিজেও বলেছে সে ননাসের আত্মাকে দেখেছে কিন্তু সেটা একদমই বানোয়াট ছিলো। এসব কিছুর মাঝে তার বড়ো মেয়ের প্রেমের তথ্য ফাঁস হলো। আর ততদিনে সে কলঙ্কের বীজ বপন করে ফেলেছিল তার শরীরে কিন্তু এবার আর অপরাধ করলো না সেই নারী, নিজের মেয়েকে একটা সঠিক হাতে তুলে দিলো। কিন্তু ততদিনে তার মানসিক রোগটা ধীরে ধীরে বাড়ছিলো। প্রথম ভয় দেখাতে গেলো সে ননাসের প্রেমিককে কিন্তু ভুল বশত তাকে দেখে ফেলে ননসারে প্রেমিকের বউ এবং সে অসুস্থ হয়ে যায়। মেয়েটা ততদিনে ননাসের ঘর হাতড়ে বেরিয়েছে কিছু পায় কি-না সেজন্য। পরে ননাসের একটা ডায়েরিতে হরেক রকমের আশ্চর্য জনক তথ্য মেয়েটা পায়। সেকালের পড়াশোনা জানা মেয়ে ছিল তার ননাস। আর সে ডায়েরি পড়েই জানতে পারলো মেয়েটা তার ননাসের প্রেমিক নিজের ছেলেকে খু/ন করেছে যা তার ননাস মানতে পারেন নি। সে নিয়ে তাদের এত বছরের প্রেমের মাঝে কলহ সৃষ্টি হয়েছে। তখন মেয়েটার মস্তিষ্কের অস্বচ্ছ ধারণা পরিষ্কার হলো। যেদিন তার ননাস মারা যায়, সেদিন ঠিক দুপুরের কিছুক্ষণ আগে সেখান থেকে সে ননাসের প্রেমিককে বেরুতে দেখে ছিলো। তার একটু পরই নিজের মেয়ের চিৎকার শুনে। সে বুঝতে পারে, তার মানে কিছু তো একটা গন্ডগোল আছেই। অতঃপর নিজের ননাসের প্রেমিকের সামনে সে গেলো ননাসের অবয়ব হয়ে, লোকটা কী বললো জানিস? লোকটা বললো, ‘আমায় ক্ষমা করো। তোমাকে আমি ইচ্ছে করে মারি নি। গলায় চাপ দিয়ে ছিলাম রাগের বশে কিন্তু কখন যে তোমার জান চলে গেলো বুঝি নি।’ মেয়েটা মুহূর্তেই চমকে গেলো এ কথা শুনে। নিজের ননাসকে সে হয়তে বড্ড বেশিই ভালোবাসতো না-হয় এমন কথা শুনে তার রাগ এত বেড়ে যাওয়ার কথা ছিলো? যে মেরেই ফেলবে লোকটাকে।”

আবারও পিনপতন নিরবতা। বিজলি চোখে মুখে উপচে পড়া বিস্ময়, কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,
“মেয়েটা, মেয়েটা খু/ন করেছে!”

“করেছে, তাও একটা না, দু’টো। আরে না ভুল বললাম, তিনটে।”

বিজলির কথা থেমে গেলো। অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো সামনের মানবীর দিকে। গলা শুকিয়ে গেছে তার। রূপমাধুরী নতুন উদ্যমে বলা শুরু করলো,
“একে একে আরও নতুন খবর ছড়ানো শুরু হলো। চা বাগান বিপর্যস্ত হলো সাথে মেয়েটার পরিবারও। তার স্বামীকে পঙ্গু করা হলো। তার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হলো। সেও মনে মনে ভাবলো, ওদের ছাড়বে না। কিন্তু তার মাঝেই আশ্চর্য রকমের একটা জিনিস মেয়েটা জানতে পারলো। তার ননাসের সন্তান টা,,,”

কথাটা বলেই ছলছল করে উঠলো রূপমাধুরীর চোখ। আকাশে তখনও অফুরন্ত বৃষ্টির ছাঁট। নতুন কিছু শোনার জন্য মুখিয়ে আছে বিজলি নামের মেয়েটিও।

#চলবে

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here