ভাগ্যের সীমারেখা পর্ব -০২

#ভাগ্যের_সীমারেখা [০২]
#ফারজানা_আক্তার

শালির চোখে দেখিনি কখনো আমি ইনাইয়াকে। সবসময়ই নিজের বোনের নজরে দেখে এসেছি ওকে। আর ও কিনা এভাবে চলে যেতে পারলো আমাকে না জানিয়ে। কষ্ট পেয়েছি আমি, ভীষণ কষ্ট পেয়েছি।”

কথাগুলো বলেই আব্রাহাম বিরক্তিকর চাহনিতে আফরোজার দিকে তাকিয়ে রইলো। আফরোজা কান্নার জন্য মুখ দিয়ে উচ্চারণ করতে পারছেনা একটি শব্দও। আব্রাহামের রাগ হওয়া স্বাভাবিক। নিজের বোন নেই বলে ইনাইয়াকে ছোট বোনের মতো স্নেহ করে সে। এর মাঝেই আব্রাহামের ফোনে রিং বেজে ওঠে। ফোন হাতে নিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নিজের রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে আব্রাহাম। ইনাইয়ার কল এসেছে। ইনাইয়া জানে এই সময় ওর দুলাভাই বাসায় থাকবে সেই হিসেবে কল করেছে সে।
তিনবার রিং হওয়ার পর কল রিসিভ করে আব্রাহাম।

“কেনো কল দিয়েছো? আমি কি কিছু হয় তোমার? চিনো আমাকে?”

“দুলাভাই প্লিজ আমাকে বুঝার চেষ্টা করুন। আমি আপনাকে কষ্ট দিতে চাইনি। আমার কলেজে যাতায়াত করতে বেশ অসুবিধা হয় তাই কলেজের কাছাকাছি চলে এসেছি।”

“তাইবলে আমাকে একবার বলাও প্রয়োজন মনে করোনি?”

“আসলে দুলাভাই বলার সুযোগ পাইনি। ভুল হয়ে গেছে দুলাভাই ক্ষমা করে দিন প্লিজ এই ছোট অবুঝ বোনটাকে।”

ইনাইয়ার এভাবে কথা বলাতে আব্রাহামের রাগ যেনো কমে গেলো কিছুটা। আফরোজা আব্রাহামের পাশে কান লাগিয়ে শোনার চেষ্টা করছে বোনের কণ্ঠস্বর, ভীষণ রকম মিস করছে যে বোন কে।
আব্রাহাম কিছুটা রাগ সংযত করে বলল “আচ্ছা বলো হোস্টেল ভাড়া কত?”

“আসলে দুলাভাই এই হোস্টেলে নাকি ভাড়া অনেক বেশি। এটা নাকি এই জায়গার সেরা হোস্টেল, সবকিছুর সুবিধা রয়েছে। মেয়েদের কোনো অসুবিধা এখানে হয়না, মেয়েদের প্রয়োজনীয় যাবতীয় সব জিনিস রাখা আছে এখানে। তাই খাওয়া দাওয়া থাকা মিলিয়ে সব মিলিয়ে ১০হাজার টাকা।”

“আচ্ছা টাকা নিয়ে চিন্তা করিওনা। একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। নাও তোমার আপার সাথে কথা বলে নাও, তোমার সাথে কথা বলার জন্য চাতক পাখির মতো হয়ে আছে।”
এটা বলেই আব্রাহাম আফরোজাকে ফোন দিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। আব্রাহাম মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। নিজের একার রোজগারে পুরো সংসার চালায় সে। ছোট ভাই আসিফের পড়ালেখার খরচও সে চালাই, আসিফও নিজের বার্তি খরচের জন্য দুই একটা টিউশনি করায়।

“হ্যালো আপা। কেমন আছো তুমি?”

“হ্যাঁ বোন ভালো আছি আমি আলহামদুলিল্লাহ। তোর কী অবস্থা? ওখানে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো তোর?”

“নাহ আপা। আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। একটু আগে ক্লান্ত থেকে হালকা মাথা ঘুরিয়েছিলো তুমি বিশ্বাস করবানা আপা আমার বান্ধবী রা কিভাবে আমার খেয়াল রেখেছে। শান্তা, বর্ণা, রিহা ওরা সবাই আমাকে খুব আপন করে রেখেছে রে আপা। তুমি একদম চিন্তা করিওনা কোনো।”

“তোর বান্ধবীদের আমার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ দিস।”

“আচ্ছা আপা। রাখি এখন। খেতে ডাকছে ওরা।”

ফোন রেখে বান্ধবীর সাথে বসে পরলো রাতের খাবার খেতে। সাদা ভাত মুরগীর গোস্তো ভাজা আর ডিমের জোল। খাবার দেখে ইনাইয়ার আর বুঝতে বাকি রইলোনা এই হোস্টেলে এতো ভাড়া কাটে কেনো। ইনাইয়া ভাত মেখে মুখে তুলতে যাবে তখনই ওর চোখে ভেসে উঠলো আফরোজার চেহারা। অশ্রুচোখে খাওয়া শেষ করে উঠে ইনাইয়া। বেশ মন খারাপ হয় বোনের জন্য তবুও নিজেকে সামলে নেয় সে। প্রচুর স্ট্রং রাখতে চাই সে নিজেকে। সে চাইনা কেউ তাকে দূর্বল বলে আঘাত করুক।
শান্তা বর্ণা রিহা এক রুমে ছিলো এতোদিন একসাথে, আজ তাদের সাথে ইনাইয়াও যোগ হলো। চার বান্ধবী মিলে আড্ডায় বসেছে। রাত ১০টা ছুঁই ছুঁই। শান্তা খুব বড় লোকের মেয়ে। কুমিল্লার মেয়ে শান্তা। এতো বড় লোক হওয়া সত্বেও তার মাঝে নেই বিন্দুমাত্র অহংকার। বর্ণা আর রিহা মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। এতো বড় হোস্টেলে থাকা তাদের পক্ষে খুব টাপ ব্যাপার তাই তারা দুজনে একটা এক রুমের ভাড়া ঘর খোঁজতেছে। চাঁদপুরের মেয়ে দুজন। পাশাপাশি এলাকা তাদের। ইনাইয়ার এডভান্স হোস্টেল ভাড়া ৫হাজার শান্তা দিয়ে দিয়েছে। ইনাইয়া বিষয়টা মাত্র জানতে পেয়ে বেশ লজ্জা পাচ্ছে। ইনাইয়ার অস্থিরতা দেখে শান্তা বলে “আচ্ছা আমি কথা দিচ্ছি এই টাকা যেদিন তুই ফিরিয়ে দিবি সেদিন আমি মানা করবোনা। নিয়ে নিবো। ততদিন ঋণ হিসেবে থাক। আর হ্যাঁ এটা নিয়ে মন খারাপ করিসনা একদম।”
রিহা ইনাইয়াকে বলে ” শোন ইনু সোনা আমি আর বর্ণা একটা ভাড়া বাসা পেয়েছি। আগামীকাল দেখতে যাবো। একরুম একটা ওয়াশরুম আর একটা কিচেনের। ভাড়া ৫হাজার বলেছে প্রথমে কিন্তু পরে আমরা স্টুডেন্ট দেখে একহাজার কম রেখেছে। তুই কি থাকবি আমাদের সাথে।”

ইনাইয়ার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠে। মুহুর্তেই রাজি হয়ে যায় ইনাইয়া। ইনাইয়া বর্ণা রিহা মিলে ঠিক করলো আগামীকাল দেখে এসে তারপরদিনই চলে যাবে এখান থেকে তারা। অন্যদিকে শান্তা ভীষণ মন খারাপ করে রাখে, মুখ ফুলিয়ে রেখেছে। ইনাইয়া বিষয়টা খেয়াল করে বলে “কিরে শান্তা পাখি তোর মন খারাপ কেনো রে।”

“তোরা এতো বড় সিদ্ধান্ত নিলি অথচ আমাকে একবারও বললিনা। এখানে একা তোদের ছাড়া কেমনে থাকবো আমি।”

বর্ণা মন খারাপ করে জোরপূর্বক মুখে হাসির রেখা টানার ব্যর্থ চেষ্টা করে বললো “শান্তা তোর জীবন আর আমাদের জীবন একদম অন্যরকম। ওই বাসায় আমরা এতো ভালো খাবার পাবোনা। আমরা দুই একটা টিউশনি করে যা পাই তা দিয়ে কোনো মতে ভাত শাক ভর্তা দিয়ে খেয়ে দিন কাটাবো ওখানে, এখানের মতো মাছা ডিম মাংস ওখানে আমরা পাবোনা। আর ওখানে আমরা নিচে বিছানা পেতে থাকবো। তুই পারবিনা এতোসব মানিয়ে চলতে।”

“কে বলেছে পারবোনা। এতো চিন্তা কেনো করিস তোরা। ভারা যেহেতু চার হাজার সেহেতু একজন থেকে এক হাজার দিলেই হয়ে যাবে প্রতি মাসে। আর ৫/৬ হাজার দিয়ে মাসিক বাজার করে নিবো। তোদের সাথে আমি শুঁটকি খেয়েও থাকতে পারবো রে। আর একটা খাট একটা আলমারি একটা আলনা একটা রেখ আর টুকিটাকি যা লাগে সব আমি দিবো, চিন্তা করিসনা এগুলো সাময়িক সময়ের জন্য তোদের শেয়ার দিবো শুধু। সারাজীবনের জন্য দিয়ে দিবোনা তাই প্লিজ আর নাহ করিসনা।”

তিন বান্ধবী প্রায়ই অর্ধেক রাত অব্দি জেগে কথা বলেছে। ইনাইয়ার চোখে জল। শান্তার মতো বান্ধবী পাওয়া আসলেই ভাগ্যের ব্যাপার। জীবনটা কেমন জানি এক অদ্ভুত রকমের। কখন কী ঘটে যায় তা বলা বহু মুশকিল। বিচিত্র জগতের মানুষগুলোও যেনো বড্ড বিচিত্রময়।
জীবনের সমীকরণ মেলাতে মেলাতেই ১৭বছরের কিশোরী ইনাইয়া ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলো।
*********
সকালের ঘুম ভা’ঙ’লো মসজিদের মুয়াজ্জিনের কন্ঠে আজানের সুরে। আজানের সুর কর্ণকুহর হতেই আড়মোড়া দিয়ে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায় ইনাইয়া। ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ওজু করে এসে দেখে সে শান্তা বর্ণা রিহা এখনো ঘুমিয়ে আছে। ইনাইয়া ওদেরকে কয়েকবার ডেকেই নামাযে দাঁড়িয়ে যায়।
নামায শেষ করে ইনাইয়া মন খারাপ করে বসে থাকে। ওর বান্ধবীদের এমন আচরণে সে ভীষণ কষ্ট পেয়েছে। নামায না পড়েই ওরা ঘুমিয়েছে আজ যা ইনাইয়াকে কষ্ট দিয়েছে। ভালো লাগেনি বিষয়টি ইনাইয়ার।
শান্তা ইনাইয়াকে জড়িয়ে ধরে বলেছে আর কখনো সকালের নামায সে কাজা করবেনা। ওদের আশ্বাস পেয়ে ইনাইয়ার ঠোঁটে মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠেছে।

আজ তিনটা ক্লাস করেই তিন বান্ধবী কলেজ এরিয়া থেকে বেরিয়ে আসে। মাত্র ১০মিনিট হাঁটলেই সেই ভাড়া বাসায় পৌঁছে যাবে ওরা। মূলত গাড়ি ভাড়া বাচানোর জন্যই এতো কাছে ঘর নেওয়া। মধ্যবিত্তের জীবন বুঝি এমনই হয়?

একটা রুম, একটা ওয়াশরুম তাও ছোটখাটো, তেমন বিশালতা নেই আর কিচেনটা একদম চিকন আকৃতির একজনের বেশি দাঁড়াতে পারবেনা সেখানে। আর একটা ছোট বেলকনি আছে যেটাতে তারা চারজন একসাথে দাঁড়াতে পারবে এতটুকু জায়গা আছে, কিন্তু একদম চিকন বেলকনি বসার কোনো সুযোগ নেই। চার তলায় সিঁড়ি বেয়ে আসতেই যেনো ইনাইয়া হাঁপিয়ে গেলো।
বাসা টা দেখে বাড়িওয়ালার সাথে সব কথাবার্তা বলে নিচে নেমে আসে ওরা। শান্তা সাথে সাথে কল করে ওর বাবাকে বলে ও যে লিষ্টটা হোয়াটসঅ্যাপ করেছে সেসব আগামীকালের মধ্যে পাঠিয়ে দিতে।
ইনাইয়া ওদের সাথে পা মিলিয়ে বাড়ির গেটের দিকে হেঁটে যাচ্ছে তখনই ওর হাত থেকে ব্যাগটা পরে যায়। ইনাইয়া খুব যত্ন করে ব্যাগটা তুলে নিয়ে ভালো করে ময়লা ঝেড়ে নেয়। তারপর আবারও সবার সাথে পা মিলিয়ে চলে গেলো সেখান থেকে।
ইনাইয়া পাগলী খেয়ালই করলোনা যে তিন তলার পাশের বেলকনি থেকে একজোড়া চোখ ওকে অবাক হয়ে দেখেছে, মুগ্ধ হয়েছে। মুহুর্তেই সেই পুরুষটার বুকে শীতল হাওয়ার দোল দিয়ে ইনাইয়া চলে যায় সেখান থেকে। এক হাতে কফি আর আরেক হাত দিয়ে বুক চেপে ধরে সেই পুরুষের ঠোঁট নড়ে উঠে একটা শব্দে “অপূর্ব মনমাতানো নারী।”

#চলবে_ইনশাআল্লাহ

লেখার হাত ভীষণ কাঁচা। ভুলত্রুটি মার্জনীয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here