#ভালোবাসাটা_ঘৃণার (সিজন ২)
#Only_Love
#Anisha_Sabiha
পর্ব ১৭
ঘুরে ঘুরে আশেপাশের সাজানো দেখছি আমি। চারিদিকে সাদা কালোর বাহার! আয়াশও এসেছিলেন আমার জীবনে এমনই সাদা-কালো হয়ে। আস্তে আস্তে মানুষটা রঙিন হয়ে উঠেছিলেন। ফিরে পেতে ইচ্ছে করে সেইসব রঙিন দিন। যেখানে ছিল শুধুই ভালোবাসা। সাদা আর কালো রঙের লাইট পড়ছে ওপর থেকে। দেওয়ালের চিকচিকে সাদাকালো। তার ওপর কাপড় দেওয়া। পেছন ফিরে তাকিয়ে অহনাকে দ্রুত এদিকে এগিয়ে আসতে দেখে কপালে ভাঁজ পড়ে আমার। সরু চোখে তাকাই আমি। অহনা আদ্রিতাকে নিয়ে এসে আমার কাছে দাঁড়িয়ে ক্ষ্যান্ত হলো। বড় বড় শ্বাস ফেলতে থাকল সে। যেন কত বড় যুদ্ধই না ও করে এসেছে!
মৃদু গলায় জিজ্ঞাসা করলাম….
–“কি হয়েছে অহনা? এমন নার্ভাস দেখাচ্ছে কেন তোমায়?”
চমকে তাকায় অহনা। আদ্রিতাকে আমার কোলে দিয়ে কপাল আর নাকের আশেপাশের ঘাম মুছতে মুছতে বলে….
–“না কিছু না। নার্ভাস লা…লাগবে কেন? এতো ভীড় চারিদিকে তাই একটু সমস্যা হচ্ছে।”
–“তুমি ঠিক আছো তো? শরীর খারাপ করলে আলাদা রুমে গিয়ে রেস্ট নিতে পারো। এখানে অজস্র রুম রয়েছে।”
অহনা যেন অমূল্য কিছু পেল। দ্রুততার সঙ্গে বলল….
–“হ্যাঁ আমি বরণ অন্য রুমে যাই। এতো ভীড়ে অস্বস্তি লাগছে।”
কথাটা বলেই হাওয়ার বেগে ভীড়ের মাঝে হারিয়ে গেল অহনা। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম আমি। এই মেয়েটার হঠাৎ কি হলো?
সামনে একটা রুম দেখতে পেয়ে সেখানে ঢুকে পড়ল অহনা। দরজা আলতো করে ভিড়িয়ে দিলো সে। ছোটখাটো একটা বেড রয়েছে ঘরে। কাঁপতে কাঁপতে ফ্যান ছেড়ে দিয়ে সেখানে বসে পড়ে অহনা। তার চিকন ঠোঁটজোড়া আলতো কাঁপছে। নিজেকে শান্ত করতে চেয়েও যেন পারছে না। কি করে পারবে? যেই অতীতকে ও ধামাচাপা দিয়েছিল। সেই অতীত যদি আবার সামনে আসে তাহলে ঠিক থাকবে কি করে? অহনা বিরবিরিয়ে বলে….
–“ভালোই তো ছিলাম। সব অনুভূতি, টান হৃদয়ের কোণে চেপে রেখে খুশিতে ছিলাম। কেন ফিরে এলেন আবার? ফিরে আসা কি খুব জরুরি ছিল? আপনি কি আমাকে ভালো থাকতে দেবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেছেন?”
অহনার শেষ কথাগুলো বেশ জোরালো শোনালো। ওর প্রত্যেকটা কথায় লুকিয়ে আছে রাগ, কষ্ট আর কিছু না পাওয়ার যন্ত্রণা!
আদ্রিতাকে সোফায় বসিয়ে পানি খাচ্ছিলাম আমি। তখনই আমার সামনে ভূতের মতো কেউ দ্রুত হাজির হতেই বিষম খেলাম। গ্লাসের থেকে ঠোঁট সরিয়ে কেশে উঠে লোকটার দিকে অগ্নিশর্মা হয়ে তাকালাম। আয়াশ বেশি কিছু করলেন না। নিজের মোহময় হাসি দেখিয়ে আমার মাথায় কয়েকটা আলতো করে থাবা দিলেন। কাশি থামতেই সরিয়ে দিলাম উনার হাত। রাগ মিশ্রিত সুরে বললাম….
–“এভাবে কেউ ভূতের মতো সামনে আসে?”
–“কি করব নিশাপাখি? এমনভাবে গ্লাসে ঠোঁট লাগিয়ে ছিলে মনে হচ্ছিল গ্লাসটা তোমার প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। আমি সেটা কি করে হতে দিই বলো? তাই আঁটকে দিলাম।”
ছোট ছোট করে তাকালাম আমি। উনাকে ভালোভাবে দেখে নিলাম।
আদ্রিতার মি. হ্যান্ডসাম রাখা নামটা খাপে খাপ মিলে গিয়েছে। ব্ল্যাক প্রিন্স লাগছে আজকে আয়াশকে। গায়ে সব কালো বস্ত্রের আবরণ। উনার কালো মনি ঘোলাটে হয়ে গিয়েছে। ফুল কালো ব্ল্যাক সুট, ব্ল্যাক বুট জুতো, গাল ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, সেই দাঁড়ির ভাঁজে একদম থুতনিতে একটা কালো বর্ণের তিল। চুলগুলো ওপর দিকে তুলে রাখা। নিঃশব্দেহে মি. হ্যান্ডসাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে চুটকি বাজাচ্ছেন আয়াশ। ভাবনার থেকে বেরিয়ে অন্যদিকে তাকালাম আমি। আয়াশ আহত সুরে বললেন….
–“ওগো, ভয়ানক মায়ার রানী! এভাবে তাকালে তো এই পুরুষের প্রাণ চলে যাবে।”
মুখ ফুরে হাসি বেরিয়ে এলো আমার। কি সুন্দর উনার কথাবার্তা! তাও গলা খাঁকারি দিয়ে সিরিয়াস হয়ে বললাম….
–“আপনি আমাকে ঠিকঠাক পানি খেতে না দিয়ে মোটেও ঠিক করেননি। তারমধ্যে আপনি আমার আশেপাশে একদম থাকবেন না অন্তত রিক রায়জাদা আর মাহতাব রায়জাদা যতক্ষণ এই পার্টিতে আছে। তার ওপর মারহাব রায়জাদাকেও দেখলাম একটু আগে।”
–“লিসেন, আই ডোন্ট কেয়ার এবাউট ইট। ব্যাস…ওদের একটা ব্যবস্থা করে কোণঠাসা করে ফেলি একবার। গুনে গুনে হিসেব-নিকেশ নেব।” (দাঁতে দাঁত চেপে)
আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম…..
–“ওহ রিয়েলি? সেটা কি করে করবেন শুনি?”
আয়াশ রহস্যময় হাসি দিয়ে উঠলেন। আমার থুঁতনি ধরে হালকা ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন…..
–“কোণঠাসা প্লানিংয়ে সাহায্য করার মানুষ তো এসে গেছে নিশাপাখি!”
আমি হতবাক হয়ে গেলাম। কার কথা বলতে চাইছেন উনি?
–“কে সে?”
আয়াশ হাসি প্রসারিত করে সামনের দিকে ইশারা করলেন। আমি উনার ইশারা অনুযায়ী তাকালাম। চোখ কপালে উঠে গেল আমার। সেই সঙ্গে অবিশ্বাস্য হাসি দিলাম। অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে এলো….
–“ইমনাত দাদাভাই!”
দাদাভাই মুচকি হেসে পকেটে হাত গুঁজে এসে আমার আর আয়াশের সামনে দাঁড়ালেন। একহাত বের করে আমার মাথায় হাত রেখে প্রশান্তির সুরে বললেন….
–“বউমা! কতবছর পর তোমাদের আবার একসাথে দেখছি। প্রাণটা জুড়িয়ে গেল যে।”
আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছি আমি। দেশে আসার পরই উনার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি আমি। তবে ফলাফল জিরো এসেছে। কারণ দাদাভাইয়ের কোম্পানি বা উনার সম্পর্কে এমন কিছু মনে ছিল না যার মাধ্যমে যোগাযোগ করা সম্ভব! আয়াশের দিকে তাকালাম। উনি ভ্রু নাচিয়ে চলেছেন আমার দিকে তাকিয়ে। তারপর বললেন….
–“এবার বুঝেছো? কেন আমি বিয়ের তাড়াহুড়ো করছিলাম? আর কেনই বা বেশ বড় করে পার্টির আয়োজন করতে বলছিলাম?”
আমি হতভম্বতা কাটিয়ে মাথা নাড়ালাম। দাদাভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আলতো হাসি দিয়ে বললাম….
–“কেমন আছেন দাদাভাই? আমি তো ভাবতেও পারিনি আপনার সঙ্গে আবারও দেখা হবে।”
–“আই এম গ্রেট নাউ। আমার সব থেকে কাছের একজন হচ্ছে আয়াশ। ওর সঙ্গে এতোবছর পর দেখা হলে কার না ভালো লাগবে বলো? তার ওপর আছে তোমার মতো মিষ্টি একটা বউমা! এই তিন বছরে আয়াশের খোঁজ করেই গেছি বার বার। ওর হদিস পাইনি। হুট গায়েব হয়ে যায় সাড়ে তিন বছর আগে। হতাশ হয়ে পড়ি আমি ওকে ছাড়া। সব জায়গায় খোঁজ করেছি। কিছু জানতাম না কারণ আমি দেশেই ছিলাম না। কয়েকদিন আগে হঠাৎ আয়াশের ফোনকল পাই। সেদিন মনে হচ্ছিল ভরসার আরেক হাত পেলাম। ও আমাকে সবটা খুলে বলে। আরো বলে যে, তোমাদের হাতে কিচ্ছু নেই। আমার সাহায্য লাগবে তোমাদের। তাই দেরি না করে চলে এলাম। আয়াশ ডাকবে আর আমি আসব না এমনটা খুব কমই হয়েছে।”
আয়াশ চুপ থাকার পর চোয়াল শক্ত করে বলেন….
–“আজকেই ওদের শেষ করব আমি। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। ওদের সাথে একই ছাঁদের তলায় থাকা সম্ভব নয়।”
কথাটা বলতেই দাদাভাই আয়াশের কাঁধে হালকা থাবা দিয়ে জোর গলায় বললেন….
–“তোর এই এক অভ্যাস। খুব একগুঁয়ে তুই। সব কাজে তাড়াহুড়ো। কাজটা করবি মানে তখনই করবি। এই অভ্যাসটা পাল্টাতে পারলাম না আমি। তোকে বার বার বলেছি না? তাড়াহুড়ো করলে কোনো কাজ মনমতো হয় না? এবার তাড়াহুড়ো করলে কোনোরকম হেল্প করব না আমি।”
আয়াশ এতোক্ষণ সিংহের মতো গজরাচ্ছিলেন। কয়েক সেকেন্ড পরেই শান্ত হলেন উনি। আমি আশপাশ দেখে বললাম….
–“আমি এখন যাই। আমাদের আলাদা থাকায় শ্রেয়। এই রিক রায়জাদার চোখ সবসময় আমার ওপর।”
দাদাভাই আর আয়াশ সায় দিতেই চলে এলাম আমি আদ্রিতার কাছে। কিছুক্ষণ পরেই আগমন হয় অধরার পরিবারের। স্বাগতম জানাই আমি নিজে। এর দায়িত্বও আমাকে গছিয়ে দিয়েছে ওই রিক রায়জাদা। ওরা এসে এক সাইডে বসে পড়ে। সেন্টারের অন্য পাশে একটু উঁচু স্টেজে নাচগান হচ্ছে। কিছু নামি-দামি ড্যান্সার কে নিয়ে আসা হয়েছে। হঠাৎ সেখান থেকে নাচগান থেমে যায়। লাইট ওফ হয়ে যায়। সেকেন্ডের মাঝে সফট লাইট অন হয়। যেটা ঘুরাঘুরি করছে সবার ওপরে। স্টেজে ওঠে রিক রায়জাদা। মাইক হাতে নিয়ে বলে ওঠে….
–“লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলম্যান, গুড ইভিনিং! আমরা সবাই জানি এখানে কেন আমরা একসঙ্গে পার্টিতে এসেছি। আই মিন ইউ নো দ্যাট, কি কারণে এই পার্টির অ্যারেঞ্জমেন্ট করা হয়েছে। আজকে দুটো মানুষের এঙ্গেজমেন্ট। পার্টির মূল দুটো মানুষ হচ্ছে আয়াশ এবং অধরা।”
সফট ড্রিংকস হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আয়াশের ওপর লাইট পড়ে। বসে থাকা অধরার ওপরেও লাইট পড়ে। অধরা শুকনো হাসি দেয়। আয়াশ কোনো ভঙ্গি ছাড়াই আগের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছেন। আস্তে আস্তে নিঃশ্বাসের গভীরতা বাড়ছে আমার। এই নিঃশ্বাসের কারণ আমি জানি। যতই হোক না কেন নকল সব কিছু। নকল বিয়ে। মন সায় দেয় না। সব যেন একটু একটু করে তিক্ততায় ভরে গেল। চারিদিকে শুধু আগুন দেখতে পাচ্ছি। মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করছি আবার খুলছি। এতো আগুন কেন চারিপাশে? এরা কি তবে আমার মনের ভেতরে লেগে থাকা দাবানল? যারা নিশ্বায়ের সঙ্গে বেড়িয়ে আসছে?
রিক রায়জাদার ঘোষণায় ড্যান্স শুরু হলো। একেক জন কাপল ড্যান্সের ভীড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে আমার। আকাশ ভাইয়াকেও দেখতে পাচ্ছি না। বিরক্ত নিয়ে হাঁটতে গিয়ে অসাবধানতা বশত হুট করেই আমার হাতে থাকা কোল্ড ড্রিংকস গিয়ে পড়ল দাদাভাইয়ে সুটের ওপরে।
জ্বিহ্বাতে কামড় গিয়ে বলে উঠলাম….
–“এমা! সরি দাদাভাই। আমি খেয়াল করিনি।”
–“নো প্রবলেম। এসব হয় একটুআধটু। যখন নিজের প্রিয় জিনিস অন্য কারো হাতে দেখা যায় তখন খুব রাগ লাগে তাই না? তোমারও ঠিক তেমন লাগছে রাইট।”
দাদাভাই ধরে ফেলেছেন আমার ভেতরটা হিংসায় জর্জরিত হয়ে যাচ্ছে। তবে আমার হিংসা করাটা কি যৌক্তিক নয়? নিজের রাগ ধামাচাপা দিয়ে বললাম….
–“আপনি বরণ এক কাজ করুন। একটা রুমে গিয়ে সুট শুকিয়ে নিন।”
–“কোনদিকে সেই রুম?”
–“এখান থেকে বামে গিয়ে চার-পাঁচটা রুম দেখতে পাবেন। তার মধ্যে যেকোনো একটাতে গেলেই হবে।”
দাদাভাই একটু হেসে বললেন….
–“ওকে। আমি আসছি।”
কথাটা বলে চলে গেল দাদাভাই।
আমি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে সামনে তাকাতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল আমার। চোখ থেকে আগুনের লাভা বের হতে লাগল। দাঁতে দাঁত চেপে হুট করেই গ্লাস ফেলে দিলাম আমি। গ্লাস পড়ে শব্দ হওয়াতেও ভাবান্তর হলো না আমার। আয়াশ অধরার সঙ্গে কাপল ড্যান্ড করছেন? অবিশ্বাস্য! আয়াশ হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে আবার ড্যান্সে মনোযোগ দিলেন। মানে কি এসবের? হৃদয় ফুটো হয়ে যাচ্ছে উনি দেখতে পাচ্ছেন না? রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে ধুপধাপ করে হেঁটে গিয়ে খুঁজতে লাগলাম আকাশ ভাইয়াকে। একটা চেয়ারে বসে থাকতে দেখে তার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি। সেখানে সেঁজুতি মা সঙ্গে আদ্রিতাও ছিল। হালকাপাতলা কথা বলতে ব্যস্ত ছিল তারা। আমি সোজাসুজি বলে দিলাম….
–“আকাশ ভাইয়া, আমার সঙ্গে এসো কাজ আছে।”
আকাশ ভাইয়া আপত্তি না করে উঠে আসতেই তাকে সবার মাঝে নিয়ে এসে ঘুরিয়ে দিলাম আমি। তারপর হাত ধরে একে একে স্টেপ করতে লাগলাম। আকাশ ভাইয়া হা হয়ে তাকিয়ে থাকল। একটু পরে সব বুঝতে পেরে একটু হেসে নিজেও তাল মেলাতে লাগল। ঠাট্টা করে বলল….
–“আমি জীবনে কতশত ভালোবাসার মানুষ দেখেছি কিন্তু সিরিয়াসলি বলছি, তোমার আর আয়াশের মতো এমন সাপ আর নেউলে সম্পর্কের প্রেম জীবনেও দেখিনি।”
কথাটা বলেই নিঃশব্দে হেসে দিল সে। আমি গাল ফুলিয়ে বললাম….
–“ভাইয়া, তোমরা কি সব ছেলেরা এমন কেন বলো তো? অদ্ভুত পারসোনালিটি তোমাদের।”
–“ইউ আর রং সিস্টার! আমরা অদ্ভুত পারসোনালিটির নই। কোনো কবি বলেছে, পৃথিবীর সব থেকে কঠিন কাজ হলো, মেয়েদের মন বোঝা। ওদের মনে কখন কি চলে সেটা ওরা নিজেই বোঝে না।”
নাক ফুলিয়ে অন্যদিকে তাকালাম আমি। হঠাৎ মনে হলো আমার কোমড়ে ঠান্ডা হাত দিল কেউ। চমকে ফ্লোরের দিকে তাকালাম আমি। আকাশ ভাইয়া তো এমন করতে পারে না। আর এই স্পর্শটা তার নই। হেঁচকা টেনে নিল কেউ। পিঠ ঠেকে গেল কারো প্রশস্ত বুকের সঙ্গে। ঢোক গিলে তাকাতেই আমার পেছনের চুল সরিয়ে দেওয়া হলো। আমার গলায় কারো গভীর ঠোঁটজোড়া ছুঁইয়ে দিল। আস্তে আস্তে ক্ষীণ যন্ত্রণা অনুভব করলাম আমি। কামড় দিচ্ছেন আয়াশ। আমাকে ঘুড়িয়ে নিলেন উনি। রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালেন। আমি সরু চোখে তাকালাম। রাগের কারণ বুঝতে বেশি সময় লাগলো না আমার। তাই নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার বৃথা চেষ্টা করলাম আমি। কিন্তু ছাড়াতে পারলাম কোথায়? আরো জাপ্টে ধরলেন আমায়। চোখ রাঙিয়ে বললেন….
–“তোমার মনে হয় না? তোমার সাহস দিন দিন একটু একটু করে আকাশে উঠছে?”
আমি না জানার ভান করলাম।
–“সরি? আমার সাহস বরাবরই বেশি?”
–“ওহ রিয়েলি?”
–“এনি ডাউট?”
আয়াশ মাথা দুলালেন। ঠোঁট বাঁকিয়ে ঘাড় কাঁত করে বললেন….
–“তাহলে, আজ তোমার সাহসের পরিক্ষা নেওয়া যাক। লেটস গো।”
এক ঝটকায় আমাকে কাঁধে তুলে নিলেন আয়াশ। চোখ কটোর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল। উনার পিঠে থাবা দিয়ে ভয়ার্ত সুরে বলে উঠলাম…..
–“আপনি পাগলামো শুরু করেছেন কেন? কেউ দেখে ফেললে সব শেষ হয়ে যাবে। নামিয়ে দিন।”
কে শোনে কার কথা? সেন্টারের এক কোণে থাকা চিকন আর পেঁচানো সিঁড়ি দিয়ে আমাকে নিয়ে উঠে চলে এলেন উনি।
থরথর করে কাঁপছে অহনা। সামনের মানুষটাকে বোধগম্য হচ্ছে না তার। সামনের মানুষটাও অবিশ্বাস্য আর ছলছল চোখে তাকিয়ে আছেন। মাঝে মাঝে মৃদু কেঁপে উঠছেন উনি। অস্পষ্ট সুরে বললেন….
–“অ…অহনা! তুমি এখানে?”
অহনা আওয়াজ দিল না। সব ঝাপসা লাগছে। আবারও এই মানুষটা কেন ওর সামনে এলো? সব অনুভূতি একসঙ্গে চিরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ইমনাতের দৃষ্টি এলোমেলো। ও নিজের সুট শুকানোর জন্য এই রুমেই এসেছিল। কিন্তু এসে এমন একটা মানুষের সামনা সামনি হবে সে ভাবতে পারেনি। যেই মানুষটাকে দেখে দুর্বল হয়ে পড়ে সে। যাকে শুধুমাত্র নিজের বয়সের কারণে নিজের মনের কথা জানাবার সাহস অবধি পায়নি। চলে এসেছে দূরে। ঘুরেফিরে আবারও এই পিচ্চি মানুষের সামনে?
অহনার ফ্যাকাশে চেহারা বলে দিচ্ছে। ইমনাতকে একদমই এক্সপেক্ট করেনি ও। কাঁপা কাঁপা গলায় সে বলে….
–“আ…আমি বাইরে যাব। বাইরে যাব।”
অহনা বাইরে যেতে উদ্যত হয়। ইমনাত অসহায় গলায় বলে ওঠে….
–“প্লিজ যেও না। একটু দাঁড়াবে?”
না চাইতেও থেমে যায় অহনা। এই মানুষটার কথা উপেক্ষা করার মতো সাহস নেই ওর।
#ভালোবাসাটা_ঘৃণার (সিজন ২)
#Only_Love
#Anisha_Sabiha
পর্ব ১৮
–“এই শাড়ি চেঞ্জ করো।”
আয়াশের এহেন কথায় মুখটা হা হয়ে গেল আমার। নিজের সাদা রঙের শাড়িটা ভালোভাবে দেখতে লাগলাম। সব তো ঠিকঠাকই আছে। উনার দিকে তাকিয়ে চোখ ছোট ছোট করে বললাম….
–“হোয়াট? শাড়ি চেঞ্জ করব কেন?”
–“আমি বলেছি তাই।”
আয়াশের অস্থির ভাবভঙ্গি। কন্ঠ গম্ভীর। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম….
–“আচ্ছা, আপনি কি উল্টোপাল্টা কিছু খেয়েছেন আবার? মানে আপনার উল্টোপাল্টা কথা শুনে তো তাই মনে হচ্ছে। আমি এখানে কোথায় পাব? আর আজকে অনুষ্ঠানের সাদা-কালো থিম।”
আয়াশ আমার বাহু ধরে আমাকে ওপরনিচ পর্যবেক্ষণ করলেন। তারপর দ্রুত এদিক-ওদিক মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললেন….
–“না না। এই শাড়ি পড়া যাবে না। সাদা রঙে ভয়ানক লাগছে তোমাকে। কয়েকজন তোমার দিকে তাকিয়েও ছিল আমি দেখেছি। এই সাদা রঙে আমি শুধু দেখব তোমাকে। নাউ চেঞ্জ দিস!”
–“আপনি পাগলামো করছেন বলুন তো? দেখি সরুন। আমি নিচে যাব।”
কথাটা বলে উনার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম আমি। পাশ কাটাতে নিতেই আমার আঁচল টেনে ধরলেন আয়াশ। দাঁত কটমট করে পেছন দিকে তাকালাম। উনি অলরেডি আঁচল ধরে টানাটানি শুরু করে দিয়েছেন। শ্বাস ফেলে আমাকেও পেছাতে হচ্ছে। আমার হাত ধরে ঘুরিয়ে নিয়ে একেবারে দেয়ালে ঠেকিয়ে দিলেন উনি। আমার কপাল থেকে গাল পর্যন্ত তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে বুলাতে লাগলেন উনি। অবশেষে আমার ঠোঁটের কাছে এসে থামলেন।
–“হেই, তোমাকে আমি এই রুমে কেন যেন এনেছিলাম? ওহ ইয়েস, তোমার সাহস পরিক্ষা করার জন্য রাইট?”
সূক্ষ্ম নজরে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম যে উনি আসলে কি করতে চাইছেন। আমার কাছে নিজের মুখটা এগিয়ে আনলেন আয়াশ। আমি দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে দিতেই উনি আমার গালের সঙ্গে গাল ঠেকিয়ে দিলেন। উনার ওষ্ঠদ্বয় আমার কান বরাবর রাখলেন। উনার খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির কারণে আমার গালে সুরসুরি লাগছে। মাঝে মাঝে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠছি আমি। আয়াশ শীতল গলায় বললেন….
–“ঠিক এমন এভাবে, তুই থেকে যা স্বভাবে।
আমি বুঝেছি ক্ষতি নেই!
আর তুই ছাড়া গতি নেই।”
শীতল আর সুরেলা কন্ঠ মাতিয়ে দিল আমার। আবেশে চোখ বন্ধ করে হেঁসে দিলাম আমি।
আয়াশ আমার হাসি দেখে আমার ডান হাত উনার হাতের ওপর নিয়ে চুমু খেলেন।
–“তোমার এই হাসি আমার হার্টবিট মিস করে দেয় নিশাপাখি। ইচ্ছে করে তোমার এই রাগিনী চোখে ঝলসে যেতে। প্রতি মূহুর্তে তোমার ভালোবাসায় মেতে উঠতে ইচ্ছে করে। মাততে দেবে আমায়?”
আমি কিছু না বলে হ্যাঁবোধক মাথা নাড়ালাম। আমার হাত এবার বেশ শক্তপোক্ত করে ধরলেন উনি। চোখ খুললেন ফেললাম। এবার উনি বেশ দৃঢ় গলায় বললেন….
–“ওই আকাশের সঙ্গে কি করছিলে তুমি? আমি বলেছিলাম না? তুমি ওর থেকে দূরে থাকবে? ওর হাতে হাত রেখে ড্যান্স করার সাহস কোথা থেকে পাও?”
অবাক চোখে তাকালাম। তারপর ঠোঁট বাঁকিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম….
–“ওহ হো! নিজে অন্য মেয়ের হাতে হাত রেখে সফটলি, সুন্দরভাবে, হাসি হাসি মুখ করে নাচতে পারবেন। আমি কিছু করলেই দোষ? ইউ নো? আপনি শুধু মানুষের ভুলটাই দেখতে পান। নিজের টা কখনোই দেখতে পান না।”
আমার দিকে কটাক্ষ করে তাকালেন আয়াশ। যেন আমি ভয়ানক প্রকারের ভুল করে ফেলেছি। কিন্তু আমি উনার দিকে না চেয়ে থাকার ভান করেই দাঁড়িয়ে থাকলাম। আয়াশ এবার একটা আচানক কাজ করে বসলেন। আমার ঠোঁটে উষ্ণ চুমু দিয়ে সরে গেলেন উনি। আমি ঠোঁটে এক আঙ্গুল দিয়ে বেকুব হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। কিছুক্ষণ পরেই লজ্জায় মিইয়ে গেলাম আমি। দৌড়ে যেতে নিলে এবারও বাঁধ সাধলেন আয়াশ। আমি এবার ঠোঁট উল্টে অসহায় গলায় বললাম….
–“এবার যেতে দিন। সবাই সন্দেহ করবে আয়াশ।”
–“আই ডোন্ট কেয়ার। ওই বাস্টার্ড, ব্লাডি রায়জাদা দের জন্য আমি আমার ওয়াইফের সঙ্গে মন খুলে সময় কাটাতে পারব না তা হতে পারে না। তুমি এখন এখানেই থাকবে। আর আমার বুকে থাকবে। দ্যাটস ফাইনাল।”
–“আপনার পাগলামো ইচ্ছেগুলো এই মূহুর্তে মানতে পারছি না। ছাড়ুন।”
আয়াশ আগের মতোই দাঁড়িয়ে থাকলেন। আমিও সেভাবেই চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে থাকলাম।
অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। অহনা বা ইমনাত কারোর মুখেই কথা নেই। যেন মৌনব্রত পালন করার প্রতিজ্ঞা করেছে ওরা। ইমনাত কিছু একটা বলার জন্য হাসফাস করছে বার বার। কিন্তু মুখ থেকে একটা শব্দও বের করতে পারছে না সে। অহনা মাথা নিচু করে তাকিয়ে আছে। দরদর করে ঘামছে সে। ফ্যান চলছে ফুল স্পীডে। তবুও ঘাম ঝড়ছে। ইমনাতের এমন হওয়ার কারণ সে নিজেই জানে না। ও যথেষ্ট সাহসী আর বরাবরই স্ট্রেটকাট কথার মানুষ। এই মেয়েটার সামনে এলে হুট করে কি হয়ে যায় তার? এই পিচ্চি মেয়েটার সামনে কেন তার সাহস গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায়?
নিরবতার সুতো ছিঁড়ে ইমনাত বলে উঠল….
–“কে…কেমন আছো অহনা?”
অহনা হালকা কেঁপে ওঠে। কম্পন ধরা কন্ঠে বলে….
–“জ্বি ভালো। আপনি কেমন আছেন?”
–“ভালো।”
আবারও নিরবতা। এবার অহনা নিজে থেকেই মুখ খুলল।
–“আ…আপনাকে দেখে তো ম…মনে হয় না।”
–“কেন?”
ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকায় ইমনাত।
–“আগের থেকে শুকিয়ে গেছেন। আপনার শ্যামজ্জ্বল চেহারায় উজ্জ্বলতা ভাব নেই। চোখটা বসে গেছে।”
দ্রুততার সঙ্গে জবাব দেয় অহনা। অতঃপর নিজেই হতভম্ব হয়ে যায়। ও কি করে এতোসব জানলো? তারমানে ও নিশ্চয় আগে থেকে লোকটাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করত। ইমনাতের গম্ভীর মুখে হাসি আর চোখ চকচক করে ওঠে।
–“আমার চেহারার পরিবর্তন বেশ ভালোই ধরতে পেরেছো। আমার মনের পরিবর্তন আদোও কি ধরতে পেরেছো পিচ্চি?”
‘পিচ্চি’ নামটা শুনে ঘনঘন চোখের পাপড়ি ফেলা শুরু করে অহনা। এই নামটা ওর কাছে প্রিয়। খুব বেশি প্রিয়। কেননা, ইমনাত ওকে এই নামে ডাকে। এই নামটাতে আলাদা অনুভূতি মিশে রয়েছে।
অহনার মৌনতায় দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে ইমনাত। তারপর বলে….
–“এখন কোথায় থাকছো? নিজের হাজবেন্ডের কাছে নিশ্চয়?”
অহনা জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকায়। অতঃপর বুঝতে পারে ইমনাতের ধারণা তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। মাথা নাবোধক নাড়িয়ে বলে….
–“উহু, আমার বিয়ে হয়নি এখনো। আমি একজন ভাইয়ার সঙ্গে থাকি।”
–“বিয়ে কর নি কেন? এখনো কারো অপেক্ষায়?”
অহনার দৃষ্টি ইমনাতের দিকে স্থির হয়। চোখে চোখ রেখে বলে….
–“হয়ত বা! জানি না।”
ইমনাতের কপালে ভাঁজ পরে। অতীতগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
ইমনাত আর অহনার পরিচয় বেশ কয়েকবছর আগে থেকে। অহনার বয়স তখন ১৭। দুই মাস পর ১৮ তে পড়বে। ইমনাত তখন নিজের কাজে বেশ ব্যস্ত। তার বয়স তখন ৩৪ বছর। এই ব্যস্ত জীবনের ফাঁকে ফাঁকে অনাথ আশ্রম আর বৃদ্ধা আশ্রমে আর্থিক সাহায্য করতে পছন্দ করত সে। যাকে এক কথায় বলা হয় ডোনেশন।
হঠাৎ একদিন এক অনাথ আশ্রম থেকে ইনভাইটেশন আসে। ইমনাতের ব্যস্ত জীবনের ফাঁকে এসবে দাওয়াত রক্ষা করার খুব কম সুযোগই হয় তার। তবে এই ইনভাইটেশন রক্ষা করতে সুযোগ পায় সে। সেই অনাথ আশ্রমেই তার চোখটা যায় একটা ছোট মেয়ের ওপর। খুব ছোট নয়। বয়সটা আন্দাজ করতে পারছে ইমনাত। মেয়েটা তার চোখজোড়াকে মুগ্ধ করে। সেই মেয়েটা আর কেউ নয় অহনা ছিল।
অহনা তখন চোখ বন্ধ করে কানামাছি খেলায় মগ্ন ছিল। এই পিচ্চি মেয়েটার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি আকৃষ্ট করেছিল ইমনাতকে। অহনার চোখে কাপড় বাঁধা ছিল। হাতিয়ে ধরতে ধরতে হুট করেই এসে জড়িয়ে ধরেছিল ইমনাতকে। বাচ্চাদের মতো লাফিয়ে উঠে বলেছিল…
–“এই ধরেছি ধরেছি। আমি ধরে ফেলেছি।”
তখনই অহনা অনুভব করে মানুষটা বেশ বড়। প্রশস্ত উনার দেহ। সরে যায় অহনা। ইমনাত এখনো তার ঘোর কাটাতে পারেনি। নিজের চোখের কাপড় খুলতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় তার। লজ্জায় চোখজোড়া নিয়ে তাকাতে পারে না মানুষটার দিকে। অহনা মাথা চুলকে বলে….
–“আই এ..এম সরি। দেখতে পাইনি।”
কথাটা বলেই ভোঁ দৌড় দেয় মেয়েটা। চোখে পলকেই গায়েব হয়ে যেতেই রেশ কাটে ইমনাতের। নিজের গালে দুটো আলতো করে থাপ্পড় মারে সে। এই ছোট্ট মেয়েটাকে কি নজরে দেখছিল সে? ছি!
সেদিন দ্রুত চলে আসে ইমনাত। তবে অহনা তখন লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিল ইমনাতকে। সেটা ছিল ইমনাতের অজানা। সেদিনকার মতো চলে এলেও ওই আশ্রমের প্রতি টান চলে আসে ইমনাতের। অস্থির অস্থির করতে শুরু করে তার মন। প্রত্যেক সপ্তাহে এক দিন করে ইমনাত সেখানে যাতায়াত শুরু করে শুধু ওই মেয়েটাকে একটু দেখার জন্য। আস্তে আস্তে দুই-একটা কথা হয় তাদের মাঝে। তবে অহনা স্বভাবতই লাজুক। পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতো সে। লোকটাকে লুকিয়ে দেখে যেতো শুধু। এভাবে কাটে দুটো মাস। অহনা বুঝতে পারে ইমনাতের প্রতি তার মনে গভীর অনুভূতির জন্ম হয়েছে। ইমনাতও বুঝতে পারে তার মনের কথা। তবে মনে মনে ধিক্কার জানায় নিজেকে। এতো ছোট মেয়ের প্রতি তার মন কি করে টানল তার? জীবনে এতো মেয়ে দেখেছে। কিছু মেয়ে তাকে আকৃষ্ট করার চেষ্টাও করেছে। শেষমেশ অহনার প্রতি তার মন বসল? এভাবে কেউ কাউকে নিজের মনের কথা জানাতে পারেনি।
অহনার ভাবনা, সমাজ কি বলবে? এতো বছরের বড় একটা মানুষকে সে ভালোবাসা আর রুপের জালে ফাঁসিয়েছে। আর মানুষটা তাকে ভালোবাসে কি না সেটাও সে জানে না।
ইমনাতের ভাবনা, সমাজ ভালোবাসা বোঝে না। তারা সব সময় এসব জিনিসকে ছোট চোখে দেখে। লোকে বলবে, নিজের চাহিদা পূরণ করার জন্য আর মনোরঞ্জন করার জন্য একটা ছোট মেয়েকে সে বিয়ে করে এনেছে।
এভাবেই চলতে থাকে দিন। হুট করে বিদেশ যেতে হয় ইমনাতকে। সাতদিন পর ফিরে অনাথ আশ্রমে এসে অহনার খোঁজ পায় না সে। পাগল পাগল লাগে নিজেকে। হাজার চেষ্টা করেও অহনার টিকিটা খুঁজে পাওয়া যায় না। কতো রাত যে নির্ঘুম কাটে ইমনাতের! মনে হাজারো যন্ত্রণা নিয়ে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে সে। ধীরে ধীরে মেনে নেয়, অহনা হারিয়ে গেছে। তার জীবনে অহনার চলন এতটুকুই ছিল।
কিন্তু আজ ৫ বছর পর আবারও সামনে পড়ল কাঙ্খিত মানুষটি। ইমনাতের ধ্যান ভাঙে অহনার মিনমিনে কথায়।
–“আর কিছু বলবেন?”
–“না। জাস্ট অতীত ভাবছিলাম। কত সুন্দর ছিল তাই না?”
অহনা মাথা ঝাঁকায়। কিছু একটা বলবে তখনই বাইরে থেকে চিল্লাপাল্লার আওয়াজ আসে।
–“আগুন! আগুন! পালাও এখান থেকে। আগুন লেগেছে। তাড়াতাড়ি বের হও সবাই।”
বাইরে আগুন লেগেছে কোনোভাবে। তা আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ছে। সবাই দৌড়াদৌড়ি করতে ব্যস্ত। ইমনাত অহনার দিকে তাকায়। অহনা ভয়ে কাঁপা-কাঁপি শুরু করে দিয়েছে। প্যানিক করছে ও। ইমনাতের মনে পড়ে, অহনা এসবে প্রচন্ড রকমের ভয় পায়। দুর্ঘটনাতে ফোবিয়া আছে ওর। আগুন লাগা, এক্সিডেন্ট, ওপর থেকে নিচে পড়ে যায় এসব বিষয় দেখতে পারে না ও।
অহনার গলায় স্বর অস্পষ্ট হয়ে আসে। মাথায় হাত দেয় ও। কোনোরকমে বলে ওঠে….
–“আ…আগুন! আমি বাঁচব না। আ…আমাকে বাঁচান প্লিজ।”
ইমনাত এগিয়ে আসে কয়েকধাপ। অহনা মাথা ঘুরে পড়তে নিলেও ইমনাত অহনাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখে। অহনা অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। চিন্তিত হয় ইমনাত। এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বের হতে হবে। অহনাকে পাজকোলে তুলে রুম থেকে বের হয় ইমনাত।
–“আগুন আগুন! পালাও পালাও।”
অনেকক্ষণ হয়ে গিয়েছে আমরা ওপরের রুমে রয়েছি। আয়াশ নিজের বাহুডোরে এমন ভাবে রেখে দিয়েছে যেন নিজের তৃষ্ণার্ত মেটাচ্ছেন উনি। কখন জানি আমিও উনার দৃষ্টিতে ডুবে গিয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করে নিচ থেকে চিৎকার করে চমকে উঠলাম আমি। চোখমুখের রঙ পাল্টে গেল আমার। ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আয়াশের উদ্দেশ্যে বললাম….
–“আয়াশ! আগুন লেগেছে মনে হচ্ছে। তাড়াতাড়ি নিচে চলুন।”
বের হতে নিলাম আমি। কিন্তু বের হতে আদোও পারলাম না! হতাশা-নিরাশা নিয়ে তাকালাম আমি পেছন ফিরে। বুকটা ভয়ে দুরুদুরু করছে। উনি কি বুঝতে পারছেন না আগুন লেগেছে? ঢক গিলে উনাকে টানতে টানতে বললাম….
–“আয়াশ, আপনি কি বুঝতে পারছেন? নিচে কত ভয়ানক কান্ড ঘটে গেছে? সময়মতো বের হতে না পারলে ভয়ানক কান্ড ঘটবে। আমরা জীবিত বের হতে পারব না।”
–“বের হবো না আমি।”
–“You’ve gone completely crazy…! প্লিজ চলুন।”
আয়াশের ভাবান্তর হলো। ভাবুক হয়ে বললেন….
–“ওকে। যেতে পারি। বাট ওয়ান কন্ডিশন নিশাপাখি!”
–“কি? কি কন্ডিশন? সব মানব। আপনি শুধু চলুন।”
এই শক্তিশালী মানবকে এক চুল পরিমাণও নড়াতে পারছি না আমি। সেকারণে আমি নিজেও বের হতে পারছি না।
–“ভেবে বলছো তো? সব মানবে?”
–“হ্যাঁ হ্যাঁ বললাম তো।”
আয়াশ আমার কানে ফিসফিসিয়ে বললেন….
–“আজ রাত আমার ঘরে আসবে। আমার সঙ্গে সারা রাত কাটাবে।”
আমি কিছু না ভেবেই বলে দিলাম….
–“হ্যাঁ যাব। এখন দোহাই লাগে আপনি আসুন।”
আয়াশ তৃপ্তির হাসি দিলেন। আমার সঙ্গে হেঁটে হেঁটে এলেন উনি। বাইরে বেরিয়ে সিঁড়িতে নামতেই ওপর থেকে তৎক্ষনাৎ সাদা রঙের পর্দা পড়ে গেল। পর্দায় আগুন ধরানো। এখনো কয়েকজন দৌড়াদৌড়ি করতে ব্যস্ত। আয়াশ পর্দা আমার ওপর পড়ার আগেই সরিয়ে নিজের বুকে মিশিয়ে নিলেন। ভয়ে কুকিয়ে গেলাম আমি। আরো কয়েকধাপ নামতেই আমার পায়ের কাছে পড়ল বড়সড় কাঠ। লাফিয়ে আয়াশের গলা ধরে ঢোক গিললাম। চারিপাশে আগুন বেশ ছড়িয়ে পড়েছে। আয়াশ আমার হাত শক্ত করে ধরে লাগালেন ছুট। আমরা বের হওয়ার আগ মূহুর্তে থেমে গেলাম। আয়াশ আমার থামা দেখে থেমে গেলেন। বড় বড় শ্বাস নিতে নিতে বললেন….
–“থামলে কেন? তাড়াতাড়ি চলো।”
–“আ..আদ্রিতা। আমাদের আদ্রিতা কোথায় আয়াশ? অহনা? সে বেরিয়েছে তো?”
আয়াশের মুখেও দেখা গেল ভয়ের ছাপ। সবাই দৌড়াচ্ছে। দরজার দিকে তাকিয়ে আমাকেও ইশারা করে আদ্রিতাকে দেখালেন উনি। ওরা বাইরে গিয়েছে। আগুনের ওপর বড়সড় লাফ দিয়ে আমরাও বাইরে চলে এসে দুজনেই ছিটকে গেলাম। আমাকে টেনে তুলল অধরা। ক্লান্ত সুরে ওকে বললাম….
–“থ্যাংক ইউ।”
অধরা কিছু না বলে মলিন হাসি দিল। আদ্রিতার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ও আমাকে দেখেই কেঁদে দিল। আমিও ছলছল চোখে তাকিয়ে ওকে সেঁজুতি মায়ের থেকে নিলাম। ও আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল….
–“আগুল মা..মাম্মা আগুল।”
আমি আদ্রিতার সারা মুখে চুমু খেয়ে জড়িয়ে ধরলাম। এরই মাঝে রিক রায়জাদা প্রসঙ্গ তুলল।
–“আয়াশ, কোথায় ছিলি তুই? তোকে এঙ্গেজমেন্টের জন্য কত ডাকলাম মাইক্রোফোন দিয়ে। তোর তো পাত্তায় ছিল না। এর মাঝে লাগল আগুন। কোথা থেকে লাগল কে জানে!”
আয়াশ এক রাশ বিরক্ত নিয়ে বললেন….
–“ছিলাম একা একা। ভালো লাগছিল না। পার্টিতে ইনজয় করছিলাম না।”
–“কিন্তু তোমাকে তো মিসেস. মায়াবিনীকে সঙ্গে বেরিয়ে আসতে দেখলাম।”
মাহতাব রায়জাদা আমাদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে কথাটা বলল। এবার চোয়াল শক্ত করলেন আয়াশ। উনার মুখ আস্তে আস্তে লাল হয়ে আসছে। নিজেকে খানিকটা দমিয়ে বললেন….
–“তো কি করব? রেখে আসব? তাকে ছোটাছুটি করতে দেখতে পেয়েছি নিয়ে এসেছি। সিম্পল ব্যাপার এতো জটিলতা করার মানে কি?”
মাহতাব রায়জাদা চুপ হয়ে গেল। আকাশ ভাইয়া একটু জোরেশোরে বলে উঠে….
–“ফায়ার সার্ভিস ডাকা হয়েছে?”
রিক সম্মতি জানায়। কনফিউজড হয়ে বলে….
–“আগুন কোথা থেকে লাগল কে জানে!”
কিছুক্ষণের মাঝে ফায়ার সার্ভিস এলো। আগুন নিভাতে লেগে পড়ল ওরা। এদিকে অহনাকে অজ্ঞান অবস্থায় দাদাভাইয়ের গাড়িতে দেখে একটু অবাক হলাম। তারপরেই ওর জ্ঞান ফেরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। রিক রায়জাদা আয়াশের উদ্দেশ্যে আবার বলে….
–“অনুষ্ঠান তো ঠিকঠাক হলো না। এঙ্গেজমেন্ট রিং তো সবার কাছেই আছে। সো এখানেই আংটি অদলবদল হয়ে যাক। কি বলো সবাই?”
সবাই সায় দিল। অধরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকালো রিক। আমি জানি ও এটা কেন করতে চাইছে। আমি কোনো রিয়েকশন দিলাম না। আয়াশ অন্যপাশ ফিরে কারো সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ফোন রাখতেই আয়াশকে বলা হলো রিং বের করে পড়িয়ে দিতে। আমি একটু ভারাক্রান্ত মন নিয়ে তাকালাম। যেই হাতে আমাকে নিজ হাতে রিং পড়িয়ে দিয়েছেন সেই হাত দিয়ে কি এখন অধরার আঙ্গুলেও রিং পড়াবেন?
আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। আয়াশ একটু পর নিজের থুতনিতে হাত বুলিয়ে বললেন….
–“ওহ রিং পড়াতে হবে তাই না? হ্যাঁ আছে আমার কাছে রিং।”
কথাটা বলে পকেট থেকে রিং বক্স বের করলেন উনি। বক্স খুলে রিং হাতে নিতেই সবাই হা হয়ে গেল। এতো ছোট রিং? একেবারেই ছোট। মাহতাব রায়জাদা আমতা আমতা করে বলল….
–“এতো ছোট রিং?”
আয়াশ ভাবলেশহীন হয়ে বললেন….
–“ওহ ছোট হয়ে গেছে? কি করব? আমার কাছে এটাই ভালো লেগেছিল।”
আয়াশ আদ্রিতার কাছে এগিয়ে গিয়ে এক পা ভাঁজ করে নিচু হয়ে আদ্রিতার ছোট ছোট আঙ্গুলের একটা আঙ্গুলে পরিয়ে দিলেন রিংটা। সবাই আশ্চর্য হলো। এ কেমন কান্ড? আদ্রিতা রিং দেখে নাচতে শুরু করে দিয়েছে। অধরার কিছুক্ষণ আগে হাসি হাসি মুখটা কালো হয়ে গিয়েছে। সেই সঙ্গে তার পরিবারেরও। আমার বুঝতে সময় লাগলো না এসব আয়াশের ইচ্ছেকৃত কাজ। আয়াশ কনফিডেন্সের সঙ্গে বললেন….
–“হলো এঙ্গেজমেন্ট। কার সঙ্গে হলো সেটা বড় বিষয় নয়। আমি আংটি পরিয়েছি সেটাই বড় কথা।”
এ কেমন অদ্ভুত এঙ্গেজমেন্ট?
চলবে…..🍂🍂
বি.দ্র. প্রথমেই কয়েকজনের ভুল ধারণা ক্লিয়ার করি। অনেকে বলেছে, আপু ইমনাতের সঙ্গে অহনা কেমনে হবে? ইমনাত যেহেতু আয়াশের ভাই তাহলে তো অহনারও ভাই তাই না?
আমার উত্তর হচ্ছে, আপনাদের ধারণা ভুল। ইমনাত আয়াশের নিজের ভাই নয়। সম্পর্কেও কেউ হয় না তারা। শুধু আয়াশকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে নিজের কাছে রেখে বড় করেছে ইমনাত।
আর যারা ইমনাত আর অহনার বয়স ডিফারেন্স মানতে পারছেন না তারা বিষয়টা স্কিপ করতে পারেন। কেননা, আমি এখানে বয়সের ডিফারেন্সের ভালোবাসা কেমন হয় সেটাই দেখাতে চেয়েছি। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
চলবে…..🍂🍂
বি.দ্র. অনেকেই ভেবেছিল অহনা যাকে দেখে চমকেছিল সে রিদ্ধির ভাই আসিফ হবে। আবার অনেকে ভেবেছিল আয়াশের ছবি আঁকা বন্ধু ইফাজ হবে। মাত্র কয়েকজন আয়াশের বড় ভাই হবে এমনটা ধারণা করেছিল। আজকে ক্লিয়ার করলাম। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।