#ভালোবাসার_প্রজাপতি
#পর্বঃ৩১
#মাহিয়া_মুন
গ্রামের নাম আনন্দপুর। সবুজ শষ্য শ্যামলে ভরপুর এই গ্রাম। প্রকৃতির মিলন খেলা যেন এই গ্রামের আনাচে কানাচে বসেই উপভোগ করা যায়। প্রকৃতি তার নিপুণ সৌন্দর্য্য দিয়ে গ্রামের সৌন্দর্য যেন দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
গ্রামের নামের মতই গ্রামের মানুষের জীবনযাপন। মানুষগুলোর মাঝে আনন্দের শেষ নেই। সুখে_দুঃখে_আনন্দে_কষ্টে সবসময় পরস্পর একে অপরের পরিপূরক হয়ে থাকে।
খুব একটা বড় নয় গ্রামটি। জনসংখ্যাও খুব একটা বেশি নয়। তাই হয়তো এই গ্রামে শিক্ষার আলো ততটা এসে পৌঁছায় নি।
তবে নগদে একজন শিক্ষিকা আপার নাম সকল গ্রামবাসীদের মুখেই শুনা যাচ্ছে। সকলেই তাদের ছোট ছোট ছেলমেয়েদের শিক্ষা অর্জনের জন্য শিক্ষিকা আপার নিকট পাঠিয়ে দেয়।
শিক্ষিকা আপা নিজ দায়িত্বে ছোট একটি টিনের স্কুল স্থাপন করেছে গ্রামের এক প্রান্তে। সবার মনে এই শিক্ষিকাকে নিয়ে আনন্দের শেষ নেই। ছোট ছেলেমেয়েদের পাশাপাশি তারাও চলে যায় মাঝে মধ্যে।
মোঃ সোহায়েব মুন্সী হাঁক ছেড়ে ডেকে উঠলেন তার বিবি সাহেবাকে।
“কিগো মহুর মা, আমারে চা দিবা না নাকি। জমিতে যাওন লাগবো তো।”
একজন চল্লিশ ঊর্ধ্ব বয়সের মহিলা চায়ের কাপ নিয়ে এসে সোহায়েব মুন্সীর হাতে দিলেন। শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখের ঘাম মুছে বলে উঠলেন,
“সবুর করন যায়না একটু। দু একদিন তো একটু দেরি হইবোই। মাইয়াডার চিন্তায় বাঁচিনা। এক কথা আপনারে এতবার কওন লাগে কেন। কয়বার কইরা কইতাম মাইয়াডারে এসব বাদ দিতে কন। মাইয়াডার শরীল গত্তর এমনি ভালা নাই। আপনে তো বাপ একটু বুজাই কন। আমার কথা তো দাম দেয় না।”
সোহায়েব মুন্সী চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে উঠলেন,
“মাইয়ারে কি আমি কম বুঝাইছি। এহন মহু না বুঝলে আমি কি করমু কও। মাইয়ার শরীল যে ভালা নাই হেইয়া তো আমিও জানি। তয় মহুর মা একখান কথা কও তো। মোগো গাঁয়ে তো শিক্ষার আলো মোর মাইয়াই ছড়াইছে। মোগো মাইয়া হইলো গিয়া এই গ্রামের শিক্ষিকা আপা। মোগো গর্ব করন উচিত। আর আল্লাহ্ মোর মাইয়ার শরীল ঠিক রাখবো।”
“হ্যা ঠিক বলেছো বাবা। গ্রামের সবার মাঝে শিক্ষার আলো কিছুটা ছড়াতে পারলেও আমার বাবা এবং মাকে মনে হয় কিছুই শিখাতে পারি নি। তোমাদেরকে কতো করে বলবো এভাবে কথা বলো না। তোমরা আমার বাবা মা হয়ে যদি এভাবে কথা বল তাহলে গ্রামের মানুষজন কি বলবে বলো?”
মেয়ের কণ্ঠ পেয়ে সোহায়েব মুন্সী এবং রানি বেগম দুজনেই মেয়ের দিকে তাকালেন।
কালো থ্রি পিস পরা, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, কাধে ব্যাগ, হাতে কিছুসংখ্যক বই নিয়ে শ্যাম বর্ণের একজন মেয়ে ঠিক তাদের সামনেই দাড়িয়ে আছেন।
সোহায়েব মুন্সী দ্রুত উঠে গিয়ে মেয়ের কাধ থেকে ব্যাগ এবং হাত থেকে বই নিজের কাছে নিয়ে নিলেন।
মেয়েকে রোয়াকে রাখা চেয়ারে বসিয়ে বলে উঠলেন,
“আম্মাজান আইছো তুমি। দেহ দেখি ঘাইমা কি অবস্হা হইছে। এই মুহুর মা বইয়া রইছো কেন। যাও মাইয়ার লাইগ্যা শরবত লই আও।”
রানি বেগম মুখ গম্ভীর করে বলে উঠলেন,
“আপনে নিয়া আহেন আপনার মাইয়ার লাইগ্যা। আর নয়তো সূর্য্য উঠোনের আগেই যাগরে পড়াইতে যায় হেগোরে কন দিয়া যাইতে। আমি পারুম নাহ।”
মেহরুমা মেহু, বাবা মায়ের একমাত্র আদরের মেয়ে। আর সেই সাথে এই আনন্দপুর গ্রামের শিক্ষিকা আপা।
মেহু মায়ের দিকে তাঁকিয়ে হেসে উঠলো। তার মা আবারো তার শিক্ষকতা নিয়ে রেগে আছেন। মেহু বাবার দিকে তাঁকিয়ে মাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে উঠলো,
“দেখলে বাবা তুমি ছাড়া কেউ আমায় ভালোবাসে না। ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে আছি। তবুও কেউ শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘাম মুছে দিচ্ছে নাহ।”
রানি বেগম মেয়ের কাছে এসে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছে দিতে লাগলেন। মেহু হেসে মাকে জরিয়ে ধরলো। রানি বেগম হাসিমুখে বললেন,
“মা তুই মোগো কথাটা একটু বুঝ। এতো পরিশ্রম তোর শরীলের লাইগ্যা খারাপ হইবো।”
মেহু কিছুক্ষণ চুপ করে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছু একটা ভেবে বলে উঠলো,
“আচ্ছা ঠিক আছে রানি সাহেবা। আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এতে তোমার আর সবসময় আমার উপর রাগ করতে হবে না। যেহেতু আমি সকাল বিকাল তাদের পড়াই এখন থেকে নাহয় সকালে পড়ালাম। বিকালে আর পড়াবো না। খুশি এবার।”
রানি বেগম হেসে বলে উঠলেন,
“হ্যা খুব খুশি।”
“আচ্ছা এবার আমায় একটা কথা বলো তো। তোমরা খালি বলো আমি নাকি অসুস্থ্য। কিন্তু আমি নিজেই জানিনা যে কি অসুখ আমার। বছর দুয়েক থেকে দেখছি এই গ্রামেই আছি। কিন্তু তাঁর আগের কিছু আমার মনে কেন আসেনা । খালি বলো অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। কোথায় হয়েছে, কিভাবে হয়েছে তোমরা আমায় কিছু বলো ও না। ”
রানি বেগমের মুখ থমথমে হয়ে গেল।
কথা এড়ানোর জন্য বলে উঠলেন,
” আমি শরবত লোয়াই। তুই ব।”
এই বলে রানি বেগম টিনের দোচালা ঘরটির মধ্যে ঢুকে গেলেন।
“দেখলে বাবা মা আবারো কথা এড়িয়ে গেল। তুমিতো কিছু বলো।”
“ওইসব কথা এহন বাদ দে মা। আল্লাহ্ চাইলে নিজের থেকেই জাইনা যাবি। আমি অহন যাই। জমিতে যাওন লাগবো ঐহান থেইকা ঘাটে।”
এই বলে সোহায়েব মুন্সীও বাড়ির বাহির হয়ে গেলেন।
মেহু নিরাশ চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। যেই কয়বার এই প্রশ্ন করা হয় প্রত্যেক বারই কোনো না কোনোভাবে বাবা মা দুজনেই কথা এড়িয়ে যায়।
পেড়িয়ে গেছে জগৎ জীবন থেকে প্রায় বছর দুয়েক। বদলে গেছে অনেক কিছুই। চৌধুরী পরিবারে এখন আর আগের মত সেই হাসি আনন্দ নেই।
আদ্রিজ সেই বছর দুয়েক আগেই পুণরায় আমেরিকা চলে গেছে। সপ্তাহে দেখা যায় একবার পরিবারের সাথে কথা বলে।
আজিজ চৌধুরীও যেন বদলে গেছে। নাহ্ বদলায় নি। উপরের ভালোমানুষের পরা খোলস থেকে আসতে আসতে বেড়িয়ে আসছে।
আজিজ চৌধুরী নিহার নিজের নামে করা চৌধুরি পরিবারের অর্ধেক টা প্রপার্টি পেপার্স শত খুঁজেও পান নি। সেই সাথে কিছুতেই জার্মানি যেতে পারছে না তিনি। বারংবার এয়ারপোর্ট থেকে ফিরে আসতে হয় তাকে। বারংবার তার পাসপোর্ট এ লাল কালির দাগ দিয়ে দেওয়া হয়। এসব কিছু কে করছে আজিজ চৌধুরীর বুঝতে বাকি নেই।
ভালোমানুষির মুখোশ যেন তিনি আর পরে থাকতে পারছেন না। চৌধুরী পরিবারের সবাই এখন আজিজ চৌধুরীর ভয়ে জমে থাকে।
তিনি ছলনা করে মেঘের বাবার প্রপার্টিও নিজের নামে করে নিয়েছে।
মেঘা এখন মেঘের সাথে চৌধুরি বাড়িতেই থাকে। বর্তমান সে চার মাসের প্রেগনেন্ট।
নিহার আকস্মিক মৃত্যুতে যেন সব অদল বদল হয়ে গেছে। মেঘা এখন আর খুব একটা কথা বলে না চৌধুরী পরিবারের কারো সাথে। নিহার মৃত্যুর কিছুদিন আগেই নিহা তাকে আজিজ চৌধুরীর ব্যাপারে সবটা জানিয়েছে।
মেঘা এখন কিছুটা ভয়ে ভয়ে থাকে। কারণ সে চাইলেও নিহার মত হতে পারবেনা। যদি কিছু করতেও যায় তাহলে দেখা যাবে তারই ক্ষতি করে দিবে।
বিশাল এক আলিশান রুমে সোফায় চোখ বন্ধ করে বসে আছে আদ্রিজ। কিছু প্রহর যেতেই আদ্রিজের চোখের কোন বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো পানি। পাশেই তার প্রাণ প্রিয় বন্ধু জিসান বসে আছে।
জিসান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বন্ধুর কাধে হাত রাখলো। আজ দু বছর এসব দেখতে দেখতে জিসানের অব্যস্ত হয়ে গেছে। তার বন্ধুর নিদ্রাহীন রাতের সাক্ষী স্বরূপ হয়ে আছে সে। বেঁচে থেকেও মরার মতো হয়ে আছে।
সাহস করে একবার পূনরায় বিয়ে করার কথা বলেছিল সে। সে বলতে চাইনি মূলত আশা চৌধুরী তাকে দিয়ে বলিয়েছে। সেদিনের কথা মনে হলেও জিসানের শরীলের পশম দাড়িয়ে যায়। পুরো বাড়ি লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল।
কাধে হাত রাখায় আদ্রিজ দ্রুত চোখ মেলে তাকিয়ে চোখের পানি আড়াল করে মুছে নিলো।
জিসান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলো,
“চোখের পানি আড়াল করে লাভ নেই।”
আদ্রিজ কিছু না বলে ফোনের স্কিনে তাকালো। নিহার হাস্যোজ্বল মুখটা ভেসে আছে। যেন তাকে কিছু বলছে।
আদ্রিজ নিজেও মুচকি হাসলো।
জিসান অবাক হয়ে তাকালো আদ্রিজের দিকে। তার বন্ধু হাসছে।
আদ্রিজ জিসানের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“কাল দেশে ফিরছি। কাউকে বলবি নাহ। নিহার রেখে যাওয়া অসম্পূর্ণ কাজ যে আমাকেই সম্পূর্ণ করতে হবে। আর তার জন্য হলেও দেশে ফিরতে হবে। মিস্টার চৌধুরির থেকে এখনো অনেক হিসাব নেওয়া বাকি আছে।”
এই বলে আদ্রিজ বাঁকা হেসে উঠলো।
জিসান অবাক হয়েই তার বন্ধুর দিকে তাকিয়ে আছে। কি বলছে কিছুই তার মাথায় ঢুকছে নাহ।
*
*
*
#চলবে#ভালোবাসার_প্রজাপতি
#পর্বঃ৩২
#মাহিয়া_মুন
গ্রামের আঁকাবাঁকা পথে হাঁটতে কার না ভালো লাগে। পথের দুই ধারে সারি সারি গাছপালা মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। সূর্যের প্রখর তাপ থেকে যেন পথ দিয়ে হেঁটে চলা গ্রামবাসীদের রক্ষা করে।
মেহু আনমনেই হেঁটে হেঁটে বাড়িতে যাচ্ছে। পথের ধার গেসে অনেকেই দাড়িয়ে আছে। তারা মেহুকে দেখলেই শিক্ষিকা আপা বলে সালাম দিয়ে সম্মান জানায়। মেহুও হাসি মুখে তাদের ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে।
হাটতে হাটতে যখন প্রায় বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে ঠিক তখনই একটি বাচ্চা ছেলের গানের সুরে পিছনে ফিরে তাকালো।
ঘুম আসেনা…. ঘুমের সময়
………. তোমায় মনে পরে
তুমি মনে পরলে…… প্রিয়
……….. ঘুমাই কেমন করে
তোমায়……………
…….ভাবিয়া আপন
মিছামিছি স্বপ্ন …বুনে
……. আমার বোকা মন
মেহু ভ্রু কুঁচকে ছেলেটির দিকে তাঁকিয়ে রইলো। বারো বছরের ছেলের মুখে এরকম গান শুনে যে কেউ অবাক হয়ে যাওয়ার কথা। তবে মেহু বিন্দুমাত্র অবাক হয়নি। এই ছেলে তাকে দেখলে প্রতিনিয়ত এসব উল্টা পাল্টা গান গাইতে থাকে।
মেহু ছেলেটির কাছে গিয়ে ছেলেটির কান টেনে ধরলো।
“ফাজিল ছেলে, তোকে বলেছি না এসব করতে না এই বয়সে। আজকেও আমার পিছে পিছে আসলি। মার খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে নাকি।”
ছেলেটি কানে হাত দিয়ে নাকমুখ কুচকে বলে উঠলো,
“আফা ব্যাথা পাইতাছি তো…..…ছাড়েন।”
মেহু ছেলেটির কান ছেড়ে দিয়ে বললো,
“তো আজকে কি অজুহাত নিয়ে আমার পিছু করলি শুনি?”
ছেলেটি লাজুক হেসে বলে উঠলো,
“শুনলে আপনে রাগ করবেন নাতো?”
“নাহ্ করবোনা বল।”
“আফা আমি আপনের নতুন একটা নাম দিছি। তয় আমি কিন্তু নামটা শুনছি একখান থেইকা। এই নামের লাহানি আপনেরে দেহা যায়।”
“কষে একটা থাপ্পড় মারলে তখন মাথা থেকে এসব ফাইজলামি যাবে। কিছু বলছিনা বলে পশ্রয় পেয়ে গেছিস। আমি আজই তোর বাবার কাছে বিচার দিব।”
এই বলে মেহু সামনের দিকে হাঁটা ধরতেই ছেলেটি জোরে বলে উঠলো,
“এলোকেশী মায়াবতী।”
হাঁটার মাঝেই পা জোড়া থেমে গেল মেহুর। শরীল বয়ে যেন অদ্ভুত কিছু একটা বয়ে গেল। সেই সাথে চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো আবছা আবছা কিছু একটা।
মেহু মাথা এদিকসেদিক করে বারবার চাইছে মনে করতে তবে কিছুতেই চোখের সামনে ভেসে উঠা স্মৃতিগুলো স্পষ্ট হচ্ছে না।
মেহু মাথা ধরে নিচে বসে পড়লো। মাথা ব্যাথায় যেন ছিঁড়ে পরবে। চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পরতে লাগলো। চোখের সামনে সবকিছু ঘোলা দেখতে লাগলো। একপর্যায়ে রাস্তায় ঢলে পড়লো।
সামনে দাড়িয়ে থাকা ছেলেটি মেহুকে এরকম করতে দেখে অনেকটাই ভয় পেয়ে গেছিলো। মেহুর জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেই ছেলেটি ভয়ে চিৎকার করে উঠলো। রাস্তায় থাকা লোকজন ছেলেটির চিৎকার শুনে দৌড়ে এদিকটায় চলে আসলো। তাদের শিক্ষিকা আপাকে এভাবে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে তারাও অনেকটাই ভয় পেয়ে গেল।
তাদের মধ্য থেকে একজন মেহুর কাছে এসে মেহুর মাথা নিজের কোলে তুলে নিল।
গ্রামবাসীরা অবাক হয়ে তাদের শিক্ষিকা আপার পাশে বসে থাকা মেয়েটির দিকে তাঁকিয়ে রইলো। কারণ মেয়েটিকে যে শহুরে তা মেয়েটির পোশাক দেখেই বুঝা যাচ্ছে।
মেয়েটি কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে মেহুর দিকে তাঁকিয়ে রইলো।
মুখ থেকে অস্পট সুরে বেরিয়ে আসলো,
“মিস নিহা খান।”
লোকজনের চেচামেচিতে মেয়েটির হুস আসলো। মেয়েটি নিজেকে সংযত করে একটা ছেলের দিকে তাঁকিয়ে বলে উঠলো,
“ওনাকে কোলে তুলে ওনার বাসায় নিয়ে যান। আমি আসছি।”
ছেলেটি সম্মতি জানিয়ে মেহুকে কোলে তুলে মেহুর বাড়ির দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। সেই সাথে উপস্থিত সকলে লোকটির পিছু পিছু আসতে লাগলো।
জার্মানীর বার্লিন শহরের তরুণ সমাজের মাঝে আজ আনন্দের শেষ নেই। আজ দু বছর পর তাঁদের প্রিয় সিঙ্গার মিস্টার নিহান খান মঞ্চে গান হইছে।
চারদিকে হই হুল্লোড় পরে গিয়েছে।
নিহানের সাথে সাথে সকলেই স্লো ভয়েজে গান গাইছে।
গান শেষ হতেই চারদিক থেকে করতালির আওয়াজ ভেসে আসতে লাগলো।
নিহান সকলের উদ্দেশ্যে কিছসংখ্যক কথা বলে মঞ্চ থেকে বেরিয়ে আসলো। গার্ড রা সকলের মাঝ থেকে গার্ড দিয়ে নিহানকে গাড়ির কাছাকাছি নিয়ে গেল।
নিহান গাড়ির দরজা খুলে যখনি গাড়িতে বসতে যাবে ঠিক তখনি ঊর্মি দৌঁড়ে এসে নিহানের সাথে ধাক্কা খেল।
নিহান বিরক্ত ভঙ্গিতে পিছে তাকিয়ে ঊর্মিকে দেখে কিছুটা অবাক হল। কারণ ঊর্মির সাথে আজ দুই দিন কোনো কথা হয় নি।
নিহান ভেবে রেখেছিল কাল গিয়ে ঊর্মির রাগ ভাঙ্গাবে। অবশ্য সে যা করে তাতে রেগে যাওয়াই স্বাভাবিক।
গার্ড রা সবাইকে সরিয়ে দিয়ে তারাও কিছুটা দূরত্বে গিয়ে দাঁড়াল। কারণ ইতোমধ্যে সবাই জেনে গেছে যে ঊর্মি মিস্টার নিহান খানের ফিয়ন্সি।
নিহান কিছু বলতে যাবে তার আগেই ঊর্মি উচ্ছাশিত কণ্ঠে নিহানের বাহু ধরে বলে উঠলো,
“নিহান নিহান নিহান ম্যাম বেঁচে আছে।”
নিহান কিছু বুঝতে না পেরে ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো,
“মানে?”
“উফফ তুমিও। আরেহ তোমার বোন আমার ম্যাম মিস নিহা খান বেঁচে আছে।”
নিহান চমকে ঊর্মির দিকে তাকালো। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ঊর্মির দিকে। চোখে অজস্র অশ্রু কণা জমা হতে লাগলো।
মাথা নাড়িয়ে ঊর্মিকে জিগ্যেস করল সত্যি কিনা।।
ঊর্মি হেসে মাথা নাড়িয়ে বললো,
“হ্যা।”
নিহানের শরীল অদ্ভুত ভাবে কাপতে লাগলো।
কাপাকাপা কণ্ঠে বলে উঠলো,
“তুমি কিভাবে জানলে?”
“আরেহ মনে আছে তোমাকে বলেছিলাম যে সেখানে আমার একজন মেয়ে ফ্রেন্ড হয়েছিল। সে দুই দিন আগে নাকি আনন্দপুর গ্রাম নামে কোনো একটা গ্রামে ঘুরতে গিয়েছিল। আর আজকে রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় ম্যাম কে দেখতে পেল। ম্যাম নাকি কোনো কারনে রাস্তায় সেন্স হারিয়ে ফেলেছিল। এই দেখ সে আমার কাছে ছবি পাঠিয়েছে।”
এই বলে ঊর্মি ফোনের স্কিনে মেহুর ঘুমিয়ে থাকা একটা ছবি দেখালো।
নিহান অবাক চোখে ফোনের স্কিনে তাকিয়ে রইলো। এটা তো তাঁর বোন। ফোনটা হাতে নিয়ে স্কিনে চুমুতে ভরিয়ে দিতে লাগল।
কান্না মাখা কন্ঠে বলে উঠলো,
“আমি বলেছিলাম না আমার বোন বেঁচে আছে। দেখলে ঊর্মি আমার বোন।”
ঊর্মি নিজেও চোখের পানি মুছে বলে উঠলো,
“হ্যা এবার চল। আমরা কালই যাচ্ছি আনন্দপুর গ্রামে। আমি আজ রাতের টিকেট কেটে ফেলেছি অলরেডি।”
নিহান খুশিতে ঊর্মিকে জড়িয়ে ধরলো।
চৌধুরী বাড়িতে যেন আজ খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে সবার মনে। শুধু মাত্র একজন ব্যাক্তি বাদে।
আদ্রিজ মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। আজ সকালেই সে আর জিসান দেশে এসে পৌঁছেছে। আসার পথে সবটাই জিসানকে বলেছিল।
আদ্রিজ লক্ষ্য করলো সে আসায় সকলে খুশি হলেও তার বাবা খুশি হতে পারে নি। আর এটা দেখেই আদ্রিজ হাসলো। সেতো এভাবেই সব খুশি কেড়ে নিতে এসেছে
তার বাবা নামক এই খারাপ মানুষটির জীবন থেকে।
আদ্রিজ হেসে মায়ের কোল থেকে মাথা উঠিয়ে মিস্টার আজিজ চৌধুরীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
স্বাভাবিক ভাবেই হেসে বলে উঠলো,
“বাবা আমি আসাতে কি তুমি খুশি হও নি?”
আজিজ চৌধুরী জোরপূর্বক হেসে বলে উঠলো,
“আরেহ কি বলছো বাবা খুশি হবো না কেন, খুব খুশি হয়েছি।”
“আমার কাছে কেন যেন মনে হচ্ছে না। বাদ দেও শুনলাম তুমি নাকি ভীষন রাগি হয়ে গেছো, সবাইকে রাগের উপর রাখো?”
“নাহ্ নাহ্ কে বলেছে তোমায় বাবা এসব আজগুবি কথা?”
আদ্রিজ হেসে আজিজ চৌধুরীর কানের কাছে গিয়ে বলে উঠলো,
“শুধু এসবই নয় আরো অনেক কিছুই জানি।”
আজিজ চৌধুরী চমকে আদ্রিজের দিকে তাকালো। মুখের হাসিও উধাও হয়ে গেলো।
আদ্রিজ হেসে আশা চৌধুরীর উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
“মা আমার কফিটা রুমে পাঠিয়ে দেও।”
এই বলে আদ্রিজ নিজের রুমে চলে গেল।
জ্ঞান ফিরার পর থেকেই মেহু চুপচাপ রানি বেগমের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে।
এতক্ষন গ্রামের সবাই এখানে ছিলো। তাদের শিক্ষিকা আপার কি হয়েছে সবাই সেটাই জানতে চাওয়ায় আগ্রহী ছিল। সোহায়েব মুন্সী গ্রামের শেষ মাথা থেকে একজন ডক্টর নিয়ে এসেছিল।
ডক্টর জানিয়েছে মাথায় কোনো বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত চাপ পড়ায় সেন্সলেস হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলে ঠিক হয়ে যাবে।
রানি বেগম কেঁদে কেটে একাকার করেছেন। তার একটা মাত্র মেয়ে যদি তাঁর থেকে দূরে চলে যায় তিনি কি নিয়ে থাকবে।
মেহু মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো তার মা তার দিকে তাকিয়ে থাকলেও মন অন্যদিকে। চোখ বেয়ে পানি পরছে।
মেহু রানি বেগমের চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে উঠলো,
“কি ভাবছেন রানি সাহেবা?”
রানি বেগম হকচকিয়ে গেলেন। মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে বলে উঠলেন,
“কিচ্ছু না মা। আইচ্ছা মা তোরে একখান কথা কই। যত যাই হউক তুই কোনোদিন মোগোরে ছাড়ি যাইবি না।”
“কি কও আমি তোমাদের ছেড়ে কই যামু হুম।”
“তুই আগে আরে কথা দে যত যাই হই যাউক তুই আরে আর তোর বাপরে ছাড়ি কোথাও যাইবি না।”
“আচ্ছা রানি সাহেবা এই আপনায় কথা দিলাম আপনাদের ছেড়ে কোথাও যাবো না। এইবার খুশি তো? এখন আমারে এক কাপ চা করে দেওতো। মাথা এখনো ব্যাথা করতেছে।”
“আমি অহনি আনতাছি।”
এই বলে রানি বেগম দ্রুত পাক ঘরে চলে গেলেন।
রানি বেগম যেতেই সোহায়েব মুন্সী রূমে ঢুকে মেয়ের পাশে বসলেন।
মেহু বাবাকে দেখে উঠে বসতে নিলেই সোহায়েব মুন্সী দ্রুত বলে উঠলেন,
“আরেহ মা শুইয়া থাহ তুমি। উঠোন লাগবোনা।”
মেহু হেসে বলে উঠলো,
“আমার এমন কিছু হয়নাই যে ঊঠতে পারবনা বাবা।”
“মা একখান কথা জিগামু তোমায় হাচা কথা কইবা কিন্তু।”
“আমি তোমায় মিথ্যে বলেছি বুঝি কিছু।”
“না মা হেইয়া তো কও নাই তয় এহন ও হাছা কথাই কইবা। মা তোমার কি কিছু মনে পরছে দুই বছর আগের কিচ্ছু।”
মেহু কিছুক্ষণ তার বাবার দিকে অপলক তাকিয়ে রইলো। হেসে বাবাকে জরিয়ে ধরে বলে উঠলো,
“হ্যা কিছু কিছু স্মৃতি মনে পড়েছে বাবা।”
সোহায়েব মুন্সী মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
“কি মা?”
“আদ্রিজ নামে কেউ একজন কে। তার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। অনেক বড় পরিবার , অনেক লোকজন। এসবই মনে পড়ছে। কিন্তু কোথায়, কিভাবে কিছুই মনে পড়ছে না। আচ্ছা তোমরা আমায় বিয়ে দিয়েছিলে ওই আদ্রিজ নামক কারো সাথে নাকি এইগুলা আমার স্বপ্ন ছিল?”
সোহায়েব মুন্সী বারকয়েক আদ্রিজের নামটা উচ্চারণ করলো।
মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
“নাহ্ মা এইরাম কিচ্ছু না। এইগুলা মনে অয় তোমার স্বপ্নই ছিলো।”
মেহু মুখ অন্ধকার করে বলে উঠলো,
“ওহ্ আচ্ছা আমিতো ভাবলাম আরো সত্যি।”
সোহায়েব মুন্সী আর কিছু না বলে মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন। তিনি ভাবছেন অন্য কথা।
তার মেয়ে তার মানে বিবাহিত। আর তার স্বামীর নাম আদ্রিজ। তার মানে আস্তে আস্তে তার মেয়ের সব কিছুই মনে পড়ে যাবে।
সোহায়েব মুন্সী মেয়ের মাথায় চুমু দিয়ে বলে উঠলেন,
“মা তুমি মোগরে ছাইড়া কোথাও যাইও না।”
*
*
*
#চলবে
(“