#ভ্যাম্পায়ার_বর (সিজন ২)
#পার্ট_২_৩
#M_Sonali
ছাদের রেলিং ধরে আনমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে চাঁদনী। দু চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে তার। মনটা যেন আজ অসম্ভব খারাপ। কোনভাবেই মনকে শান্ত করতে পারছেনা সে। ঘুরেফিরে শুধু বারবার মনে পড়ছে নিশংস ভাবে নিজের পরিবারকে হারানোর ঘটনা গুলো। কি থেকে কি হয়ে গেলো! সেদিন তো ও সহ ওর পরিবারের সবাই অসম্ভব খুশি ছিল ওর বিয়ে নিয়ে। তাহলে কেন হঠাৎ করে এভাবে সবকিছু বদলে গেল? সব আপন মানুষকে কেন হারিয়ে ফেলল সে এভাবে? যে চাঁদনী সব সময় হাসি খুশি এবং আনন্দে উল্লাসে থাকতে ভালবাসত, আজ সে হয়ে গেছে একদম নিরব নিস্তব্ধ। কথা বলতেও যেন অনেক বেশি কষ্ট হয় এখন তার। হাসিটা না হয় বাদই দিলাম। সব সময় মাথার মধ্যে ঘুরে বেড়ায় তারা কারা ছিলো? কেনইবা এভাবে সবাইকে মেরে ফেলল তারা? তবে তারা যে মানুষ কখনই নয় এটা চাঁদনী ভালো করেই বুঝে গেছে। তারা মানুষ রূপে অন্য কিছু ছিল। যারা এভাবে ওদের সুখের সংসার টা ধ্বংসস্তূপে পরিণত করল।
গত তিন দিন হল হাসপাতাল থেকে ঐ নার্স মেয়েটির সাথে ওনার বাসায় এসে থাকছে চাঁদনী। এই তিন দিনের মাঝে মেয়েটির সাথে তেমন কোনো কথাই বলে নি সে। সব সময় গোমরা মুখ করে কান্না করেছে। ওকে দেখে ভীষণ মায়া হয়েছে ওই নার্স মেয়েটির। সেও একদম একা তার আপন বলতে কেউ নেই। বাসায় সারাদিন একাই এতোদিন থাকতো সে। তাই চাঁদনী কে নিজের ছোট বোন ভেবে নিয়ে এসে নিজের কাছেই রেখে দিয়েছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনে বসে এসবই ভাবছিল চাঁদনী। তখন পিছন থেকে ঐ মেয়েটি এসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে ওঠে,
— কি ভাবছ এতো মনোযোগ দিয়ে? একি কাঁদছো কেন তুমি? তোমাকে আমি বলেছি না একদম কাঁদবে না। শুধু শুধু কান্না করে কি লাভ বল? যেটা জীবনে ঘটেছে সেটা তো আর ফিরবে না। আর তাছাড়া তুমি কিন্তু এখনো আমাকে কোন কিছু বলনি তোমার সাথে ঠিক কি হয়েছে? আমি জানতে চাই তোমার জীবনের ঘটনা গুলো।
মেয়েটির কথায় নিজের চোখ দুটি মুছে নিয়ে উদাস ভঙ্গিতে মেয়েটির দিকে ফিরে তাকাল চাঁদনী। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে শুরু করল,
— আপু আপনি সত্যি জানতে চান আমার জীবনের ঘটনা? তাহলে শুনুন, আমি সিলেটের একজন সিক্রেট সাইন্টিস্ট আহসান শিকদারের একমাত্র মেয়ে। আমার মা নেই, শুনেছি আমার যখন তিন বছর বয়স তখন তিনি মারা গেছেন কোনো এক অজানা কারণে। তারপর থেকে বাবা’ই আমায় বড় করেছেন। বাবা আমার কখনো মায়ের অভাব বুঝতে দেননি। আমি ছিলাম বাবা কলিজার টুকরা। তবে কোনো এক অজানা কারণে বাবা আমায় নিয়ে সিলেটের একটি দুর্গম এলাকায় একদম একা থাকতেন। আর আমাকে সব সময় অনেক বেশি সিকিউরিটি দিয়ে রাখতেন। সন্ধ্যার পর থেকে নিয়ে সকাল ৭ টা পর্যন্ত কোনো ভাবেই আমায় জানালার ধারে বা ছাদে যেতে দিতেন না। নিজের রুমের মাঝে একদম বন্দি করে রাখতেন বললেই চলে। আমি বাবার এমন আচরণের কারণ কোন কিছুই বুঝতে পারতাম না। তবুও হাসি মুখে সবকিছু মেনে নিতাম। কেননা বাবা আমাকে যতটা ভালবাসা দিয়েছেন এমন ভালোবাসা হয়তো পৃথিবীর কোন বাবা’ই তার মেয়েকে দেয়না। বাবা আমাকে পড়াশোনা করিয়েছেন অনেক, কিন্তু তার পরেও আমি বাসা থেকে বাইরে বের হতাম না। বরং কলেজের স্যার-ম্যাডামদের নিয়ে এসে আমাকে বাসায় পড়ানো হতো। এমনকি আমার পরীক্ষা গুলোও আমি বাসা থেকেই দিয়েছি। সবকিছুই বাসাতেই করতাম। আমি বুঝতে পারতাম না কেন আমার সাথে এত সিকিউরিটি থাকে? যদিও আমি বাবাকে অনেক বেশি ভরসা করতাম তাই ওনার কথা মেনে নিয়ে কখনো তাকে প্রশ্ন করিনি কেন এমন করেন আমার সাথে। আর বাবা আমার গলায় এই বিশেষ লকেটটা অনেক ভালবেসে আমার দশ বছর বয়সের সময় গলায় পরিয়ে দিয়েছিলেন। আর সেইসাথে বলেছিলেন এই লকেটটা জীবনে কখনো গলা থেকে না খুলতে। যে কোন বিপদের সময়ে এই লকেটটা নাকি আমায় রক্ষা করবে। যদিও জানি না এ লকেটটা আসলে কিসের। তবে বাবার এই উপহারটা আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছিল। আর আমি এটা ভালোবেসে নিজের গলায় পরে নিয়ে ছিলাম। আজ অব্দি কখনো এটা আমি নিজের গলা থেকে এক মুহূর্তের জন্যও সরাইনি। তবে প্রতি পূর্ণিমা রাতে জানিনা বাবার কি হতো! বাবা ভীষন ছটফট করতেন আর আমাকে সারাদিন সারারাত ঘরের মধ্যে বন্দি করে রাখতেন। সাথে নিজেও এক মুহূর্তের জন্য ঘর থেকে বের হতেন না। আমাদের বাসাটা এমন ভাবে বানিয়েছিলেন বাবা, যে কোন দিক দিয়ে কোন আলো-বাতাস ঢোকার মতো জায়গা ছিল না দরজা জানালা না খুললে। শুধুমাত্র অক্সিজেন ছাড়া। আমরা সেখানেই থাকতাম আর যেদিন যেদিন পূর্নিমা হত সেদিন সেদিন বাবা আমাকে এক প্রকার বন্দি করে রাখতেন সেখানে। এর বিষয়ে বাবাকে আমি অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি। কিন্তু বাবা আমাকে একটা উত্তর’ই দিয়েছেন যে, “যখন সময় আসবে তখন সব জানতে পারবে” আমি উনার এ কথার উপরে আর কোন কথা বলিনি কখনো। কারণ বাবাকে আমি ভীষণ বিশ্বাস করি উনি হয়তো আমার ভালোর জন্যেই এমনটা করেছেন।
কিন্তু জানিনা সেদিন বাবার কি হলো। হঠাৎ করে কোথা থেকে যেন এসে আমাকে বললেন,
— কালকে তোমার ২২ তম জন্মদিন ও পূর্ণিমা রাত। আর কালকে’ই তোমার বিয়ে। কাল তোমাকে রুমের মাঝে বন্দী থাকতে হবেনা চাঁদনী। কাল তোমার বিয়ে তুমি বিয়ের জন্য রেডি হয়ে নাও। বাবার হঠাৎ করে এসে এমন কথায় বেশ অবাক হয়েছিলাম আমি। কেননা ওই পূর্ণিমা রাতে ছিল আমার জন্মদিন আর সেই রাতে বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছে। আর আমি যেটা জানি বাবা কখনোই আমাকে ওই রাতে বাসা থেকে বের হতে দেয় না। তাহলে সেই রাতেই আমাকে বিয়ে দেবে এটা আমার কল্পনার বাইরে ছিল। তবুও বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি হ্যা বলে দিয়েছিলাম। একটুও অমত করিনি। যদিও আমি জানতাম না আমার কার সাথে বিয়ে হবে। এমনকি যার সাথে বিয়ে হবে তার নামটাও!
পরেরদিন বিয়ের জন্য রেডি হয়ে যাই আমি। বাবা পার্লার থেকে কোন মানুষকে নিয়ে আসেনি আমাকে সাজাতে। বরং আমার সামনে টিভিতে একটি বিয়ের সাজের ভিডিও ছেড়ে দিয়ে বলেছিল, “এই ভিডিও দেখে নিজে নিজে সেজে নাও মা! তোমাকে সাজানোর জন্য আমি পার্লার থেকে কাউকে আনবো না।” বাবার কথা শুনে বেশ অবাক হলেও আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলেছিলাম। তারপর টিভিতে দেখে দেখে যেমন পেরেছি তেমন করে বিয়ের জন্য সেজে নিয়েছিলাম। আমার বিয়েতে গয়নাগাটি এবং বেনারসি কোন কিছুর অভাব ছিলো না। বরং সবকিছুই অনেক আভিজাত্যপূর্ণ ছিলো। আমি যখন বিয়ের সাজ কমপ্লিট করে আয়নার সামনে বসে বসে নিজেকে দেখছিলাম আর মনে মনে বিয়ের পরের জীবন নিয়ে কল্পনা করেছিলাম! তখনই বাবা কোথা থেকে যেন হন্তদন্ত হয়ে আমার কাছে আসেন, হাতে একটা কাগজ নিয়ে। তারপর কাগজটা আমার সামনে দিয়ে সাথে হাতে একটি কলম ধরিয়ে দিয়ে বলেন,
— চাঁদনী কোন প্রশ্ন করবিনা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখানে একটি সই করে দে মা।
বাবার কথায় আমি বেশ অবাক হয়ে উনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,
— কি হয়েছে বাবা তুমি কেন এমন করছো? তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে? আর কোথা থেকে আসলে তুমি এভাবে?
বাবা তখন বেশ রাগান্বিত হয়ে ধমকের সুরে আমায় বলেছিলেন,
— আমি যেটা বলছি সেটা কর। তাড়াতাড়ি এখানে একটা সই করে দে তোর সাথে কথা বলার সময় নেই আমার।
বাবার কথা শুনে ভীষণ ঘাবড়ে যাই আমি। কেননা আমার জীবনে কখনো আমাকে ধমক দিয়ে তুই-তোকারি করে কোনো কথা বলেননি বাবা। সেদিন’ই প্রথম ছিল যেদিন বাবা আমার সাথে তুই-তোকারি করে ধমকের সুরে কথা বলেছিলেন। তাই আমি আর কোন কথা না বাড়িয়ে ঐ কাগজে সই করে দেই। যদিও জানি না কাগজটা আসলে কিসের ছিল। কাগজে সই করতেই বাবা তাড়াতাড়ি কাগজটা নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যান। আমার সাথে কোন প্রকার কথা বলেন না তিনি। বের হয়ে বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে দেন দরজার। আমি তখন অবাক হয়ে দরজার কাছে গিয়ে দরজা খোলার অনেক ট্রাই করি। কিন্তু খুলতে পারি না। কিছুক্ষণ পরে বাইরে অসম্ভব শব্দ এবং ঝড়ের মতো শুরু হয়। আমার এমন মনে হচ্ছিল যেন অনেক ঝড় তুফান চলছে রুমের মাঝে। হিংস্র অনেক প্রাণী হয়তো গর্জন করছে। আমি ভিষন ঘাবড়ে যাই। চিৎকার করে বাবার নাম ধরে কান্না করতে শুরু করি। কিন্তু না তবুও কেউ দরজা খোলে না। এভাবে বেশ অনেকটা সময় পার হয়ে যাওয়ার পর দরজাটা খুলে যায় আর রুমের মাঝে বাবা প্রবেশ করে তাড়াতাড়ি দরজা লাগিয়ে দেয়। বাবার পরনের শার্ট তখন পুরো রক্তে ভেজা ছিল। গলার কাছে চার-চারটে দাঁত বসানোর চিন্হ ছিল। সেখান থেকে গলগল করে রক্ত পরছিলো। আমি ভিষন ঘাবড়ে যাই বাবার এমন অবস্থা দেখে। আমি চিৎকার করে বাবার গলায় হাত দিয়ে ধরে কান্না করতে থাকি। আর জিজ্ঞেস করতে থাকি বাবার কি হয়েছে? বাবা তখন আমার সামনে মাটিতে পড়ে যায়। পড়ে গিয়ে আমার হাত ধরে সে অনেক কষ্টে বলে,
— আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না মা। তুমি দ্রুত পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যাও। এক মুহূর্তের জন্যও দাঁড়াবে না কোথাও। আমাকে নিয়ে ভেবো না। তাড়াতাড়ি পালিয়ে যাও এখান থেকে। নইলে আমার মত তুমিও মরবে। তোমার সাথে জড়িয়ে আছে অনেক গোপন কিছু। প্লিজ চলে যাও এখান থেকে চাঁদনী। তোমাকে আমার কসম লাগে।
বাবা কেন এমন বলছে আর আসলে কী হয়েছে কোন কিছুই বুঝতে পারছিলাম না আমি। আমার তখন কি করা উচিত কিছুতেই যেন আমার মাথা কাজ করছিল না। সেই মুহূর্তে দরজার ওপর অনেক জোরে জোরে ধাক্কা লাগতে থাকে। যেন এখনই দরজা টা ভেঙে যাবে। আমি তখনই বাবার দিকে তাকিয়ে দেখি বাবা আর দুনিয়ায় নেই। সে মারা গিয়েছেন। আমি কি করব ভেবে না পেয়ে বাবার কসম রাখতে গিয়ে দ্রুত পিছনের দরজা খুলে দৌড়াতে থাকি সামনের দিকে। আমার কলিজা শুকিয়ে গিয়েছিল তখন। সেই সাথে বাবার মৃত্যুর যন্ত্রনাও সহ্য করতে পারছিলাম না।
চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
#ভ্যাম্পায়ার_বর (সিজন ২)
#পর্ব_৩
#M_Sonali
পিছনের দরজা খুলে বাইরে বের হতেই দেখি গভীর রাত হয়ে গেছে। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। শুধু পূর্ণিমার রাত ছিল বলে আকাশের চাঁদটা স্পষ্ট ছিলো কিন্তু সেটাও আর বেশিক্ষণ রইল না হঠাৎ কোথা থেকে একঝাক নিকষ কালো মেঘ এসে ঢেকে দিল সুন্দর হালকা আলো ছড়ানো ঐ চাঁদটাকে। আর সেই সাথে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমি কোথায় যাচ্ছি কিভাবে যাচ্ছি কোন কিছুই মাথায় আসছিলো না আমার। তবুও প্রানপনে দৌড়ে চলেছি সামনের দিকে।
মনের মাঝে বাবাকে হারানোর হাজারো যন্ত্রণা চেপে রেখে বউয়ের সাজে সেজে অন্ধকারের মাঝে এভাবে দৌড়ানো টা যে কতটা কষ্টকর ছিল সেটা শুধু আমি জানি। দৌড়াতে দৌড়াতে অনেক বেশি হাঁপিয়ে যাই আমি। আর হঠাৎ করে কিছু একটার সাথে উস্টা খেয়ে ঠাস করে নিচে পড়ে যাই। যার কারণে আমার হাতে কিছু একটার সাথে লেগে হাত কেটে গল গল করে রক্ত পড়তে থাকে। রক্ত টা দেখে অনেক বেশি ঘাবড়ে যাই। কারন বাবার মৃত্যু দেখে যতোটুকু বুঝেছিলাম, ততটুকুতে মনে হয়েছিলো রক্তের সাথে কোন না কোন কালেকশন আছে সেই খুনির। তাই হাতটা আমি খুব জোরে চেপে ধরি যাতে আর রক্ত না পরে। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয়না আমার। হাত কেটে রক্ত পড়তে থাকে আর সেই মুহূর্তে আমার সামনে কোথা থেকে যেন দুজন লোক এসে দাঁড়ায়। যাদের পেছনে হয়তো পাখির মত পাখা ছিল। কিন্তু আমি সেটা দেখতে পাইনি। তবে তারা যখন এসেছিল তখন পুরো মনে হয়েছে আমার যে তারা হাওয়ায় ভেসে মানে উড়ে এসেছে। তাদের চোখ দুটো ছিল গাঢ় লাল, হাতের নখগুলো ছিল অনেক বড় বড়, আর সেইসাথে মুখে অনেক বড় বড় সরু দুইটা ধারালো দাঁত ছিল। আমি এমন লোক এর আগে কখনই দেখিনি। অসম্ভব ভয় পেয়ে যাই তাদের দেখে। তবে বিয়ের সাজে শাড়ি পড়ে থাকায় আর হাত পায়ে ব্যথা পাওয়ায় উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা ছিল না আমার। তাই ভয়ে ভয়ে পিছনদিকে পিছাতে থাকি। কিন্তু সেই মুহূর্তেই ঐ লোক দুটি আমার উপর আক্রমণ করে। নিমেষের মধ্যে তাদের মাঝের একজনের ধারালো দাঁত দুটো আমার গলায় বসিয়ে দেয়। আমি তখন মৃত্যুভয়ে একটি চিৎকার দিয়ে উঠি। আর কোনো কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলি। বুঝতে পারি সেই লোকটি আমার গলা থেকে জোকের মত রক্ত চুষে চুষে খাচ্ছে। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভেবেছিলাম এই বুঝি মরে গেলাম। চোখের কোনা দিয়ে এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে ছিল। কিন্তু সেই মুহূর্তে কোথা থেকে যেন হাওয়ার বেগে কিছু একটা আসে। আর ওই দুজনকে দূরে ছিটকে ফেলে দেয়। তারপর কোলে তুলে নেয় আমায়। আমাকে হাওয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে কোথাও একটা চলে যেতে থাকে।
এক নিঃশ্বাসে এতোটুকু বলে থামল চাঁদনী। ওকে থামতে দেখে আগ্রহী কন্ঠে বলে উঠলো ওই মেয়েটি,
— তারপর, তারপর কি হয়েছিল বল চাঁদনী?
— তারপর আমার ঠিক মনে নেই। তবে শেষবার জ্ঞান হারানোর আগে আমি শুধু গাঢ় নীল রঙের দুটি চোখ দেখে ছিলাম। তাছাড়া চেহারা দেখতে পাইনি তার। আর সেই সাথে দেখেছিলাম গোল্ডেন রঙের সিল্ক এলোমেলো চুল। আমার যতটুকু মনে হয় সেটা কোন মানুষ ছিল। না না মানুষ বললে ভুল হবে, সে আমার জন্যে কোন একটা ফেরেশতা ছিল। যে আমায় বাঁচিয়েছে।
এতোটুকু বলেই থেমে গেল চাঁদনী। ওর কথা শুনে চুপ করে কিছুক্ষণ বসে রইলো মেয়েটি। তারপর ওর দিকে তাকিয়ে কিছুটা ভ্রু কুঁচকে বলে উঠল,
— আচ্ছা চাঁদনী তুমি বলছ যে তুমি যখন জঙ্গলের মধ্যে পড়ে যাও তোমার হাতে আঘাত পেয়ে রক্ত বের হয়েছিল। সেই সাথে গলায় নাকি ওখানকার একটা লোক কামড় দিয়েছিল যে কারণে সেখান দিয়ে রক্ত বের হয়েছিল! কিন্তু তোমাকে পাওয়ার পরে তো তোমার শরীরে কোনো রকম কাটা দাগ পায়নি আমরা! এখনো তো কোনো কাটা দাগ নেই! এটা কিভাবে সম্ভব?
— এই বিষয়টা নিয়ে যে আমি ভাবি নি তা কিন্তু নয় আপু! আমিও জ্ঞান ফেরার পর যখন দেখেছি যে আমার শরীরে কোথাও কোনো কাটা দাগ নেই। এমনকি গলার কাছে কামড়ের জায়গায় রক্ত পড়ছিল সেখানেও কোন চিহ্ন বা কাটা দাগ নেই! তখন আপনার মত আমিও ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। আমি সত্যিই জানি না এটা কিভাবে হলো। তবে আমার বিশ্বাস যে আমাকে বাঁচিয়েছে সেই হয়তো এটা কোন ভাবে করেছে।
— কিন্তু একটি মানুষের দ্বারা এটা কিভাবে সম্ভব?
— সেটা তো আমিও জানি না আপু। সে কি সত্যিই কোনো মানুষ ছিল নাকি অন্যকিছু? তবে সে যাই হয়ে থাকুক না কেন সে আমায় বাঁচিয়েছে। আমার কাছে সে আল্লাহর পাঠিয়ে দেওয়া কোনো ফেরেশতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
— হুমম বুঝেছি। আচ্ছা অনেক হয়েছে এখন চলো আমরা নিছে যাই। সন্ধ্যা হয়ে এলো। এখন আর এখানে বসে থাকা ঠিক হবে না।
———————-
রাত তিনটা 45 মিনিট,
গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে আছে চাঁদনী। কিন্তু ঘুমের মাঝে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছে সে । সে ভীষন অন্ধকারের মাঝে একা একা দাড়িয়ে আছে। তবে তার গলায় থাকা লকেটটা চারিদিকে নীল আলো ছড়াচ্ছে। যে আলোতে আশেপাশের সব কিছুই দেখতে পাচ্ছে সে। চাঁদনী একা একা অন্ধকারে হেঁটে চলেছে সামনের দিকে। কোথায় আছে কোন জায়গা কোন কিছুই যেন মাথায় খেলছে না তার। তবে আশেপাশে দেখে যেমনটা মনে হচ্ছে যেন এটা কোন মৃত্যু পড়িতে এসে গেছে সে। কেমন যেন কোন দিকে কোন গাছপালা নাই। যে কয়েকটা গাছ দেখা যাচ্ছে তার সবগুলোই একদম শুকনো কাঠ। মাটির দিকে তাকাতে আরো বেশি অবাক হয়ে যায় চাঁদনী। কেননা মাটিগুলো একদম খরখরে শুকনো হয়ে আছে। আশেপাশে শুধু ধু ধু মরুভূমির মতো। কয়েকটা গাছ থাকলেও সবগুলোই মরা ও শুকনা। এমন পরিবেশ দেখে ভয়ে চাঁদনীর শিরদাঁড়া বেয়ে বারবার শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তবুও সে শুকনো ঢোক গিলতে গিলতে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। বুঝতে পারছেনা কোথায় কেন এসেছে আর কোথায় বা যাচ্ছে। এভাবে বেশ কিছুক্ষন যাওয়ার পর এই হঠাৎ করে কোথা থেকে যেন খুব ঠান্ডা একটা হাওয়া এসে স্পর্শ করে যায় চাঁদনীর শরীর। এতে যেন আরো বেশি ভয় পেয়ে কেঁপে ওঠে সে। অসহায় দৃষ্টিতে চারি দিকে তাকায়। কিন্তু না আশেপাশে বা কোথাও কেউ নেই শুধু ও ছাড়া। কিন্তু তবুও কেন যেন চাঁদনীর বারবার মনে হচ্ছে ওর আশেপাশে কেউ আছে। যে ওকে খুব কাছ থেকে দেখছে। চাঁদনী ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। তাই সেখানে আর স্থির থাকতে না পেরে সামনের দিকে ছুটতে থাকে। দৌড়াতে দৌড়াতে অনেকদূর পৌঁছে যায় সে। কিন্তু তবুও কাউকে নজরে পড়ে না তার। সেই মুহূর্তে ওর মনে হয় যেনো ওর বাবা ওকে ডাকছে পিছন থেকে। সাথে সাথে চাঁদনী খুশি হয়ে বাবা বলে ডেকে পিছন দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। আর চমকে ওঠে। কেননা ওর বাবার জায়গায় সেই অচেনা লোক দুজন দাঁড়িয়ে আছে। যাদেরকে আরো বেশি হিংস্র লাগছে সেদিনের চাইতে। চোখদুটি দিয়ে যেন আগুন বের হচ্ছে তাদের। তাদের দেখে চাঁদনী অসম্ভব ঘাবড়ে যায়। ভয়ে শুকনো ঢোক গেলে। থরথর করে কাঁপতে থাকে সে। তার সারা শরীর ঘেমে একাকার অবস্থা। সে পিছন দিকে একপা একপা করে পেছাতে থাকে। যদিও সে জানে এই ভাবে তাদের হাত থেকে বাঁচতে পারবে না। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হল ঐ লোক দুটি একটুও নড়াচড়া করছে না। মূর্তির মত এক জায়গায় চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। চাঁদনী ভিষন ঘাবড়ে গিয়ে পেছাতে পেছাতে হঠাৎ করে কিছু একটার সাথে ধাক্কা খায়। কিন্তু ও পিছনদিকে ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই কেউ ওর কানে ফিসফিস করে বলে ওঠে,
— ভয় পেয়ো না চাঁদপাখি। যতক্ষণ আমি তোমার সাথে আছি, আর তোমার গলায় ঐ লকেটটা আছে, ততক্ষণ কেউ তোমার ক্ষতি করতে পারবে না। মনে সাহস রাখো আর এগিয়ে যাও নিজের আপন গতিতে। তুমি ঠিক তোমার সঠিক জায়গা খুঁজে পাবে। তবে মনে রেখো ভয় পাবে তো সব শেষ হয়ে যাবে। ভয় কে জয় করতে শেখো।
কথাগুলো শুনতেই দ্রুত পিছন দিকে ঘুরে দাঁড়ায় চাঁদনী। কিন্তু না ওর পিছনে কেউ বা কিচ্ছু নেই। অবাক হয়ে যায় সে। আবার ঘুরে সামনের দিকে দাড়িয়ে ঐ লোক দুজনকে দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু না সামনের লোক দুটোও নেই। হঠাৎ করে চারিদিকে একদম আলোকিত হয়ে যায়। চাঁদনী খেয়াল করে ও যেখানে আছে সেটা ওর নিজের রুমের মধ্যে দাঁড়িয়ে। এতটুকু দেখেই ঘুম ভেঙে যায় ওর। হাপাতে হাপাতে লাফিয়ে উঠে বসে চাঁদনী। দেখে নিজের বিছানায় ঘুমিয়ে আছে। সারাশরীর ঘেমে একাকার তার।
চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,