#মধুবালা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৫
পালংকের ওপর মূর্তির ন্যায় বসে ছিলো মধু। তার ভেতরে কি চলছে তা কেবল সেই জানে। পরনের শাড়ি আলুথালু, মাথার চুল এলোমেলো। একরাতেই কোটরে বসে গেছে চোখ। কপালে ব্যান্ডেজ বাধানো। কালরাতের পর থেকে আজ সারাদিন নাওয়া খাওয়া কিছুই হয় নি তাঁর। উদ্ভ্রান্তের মত খোলা জানালার দিকে চেয়ে আছে। আরমান ভেতরে ঢুকে গলা খাঁকারি দিলো। সচকিত হলো মধু। নড়েচড়ে বসলো সে। তার মলিন মুখের দিকে আরমান মৃদু কোমল স্বরে বললো,’আশরাফি সাহেবদের কি তুমি আগে থেকেই চিনতে?’ আরমানের কথার জবাবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মধু। ক্ষীণ কন্ঠে বললো,’ইনিই সেই! যার কথা তোমাকে বলেছিলাম।’
একসময় আশরাফিকে নিয়ে সবার সাথে প্রচুর গল্প করতো মধু। তাঁর উদ্দেশ্যহীন জীবনের একমাত্র আনন্দ ছিলো আশরাফিকে নিয়ে গল্প করার সময়টুকুতেই। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই গল্পটাও পুরোনো হয়ে গেলো। এখন আর কেউ শুনতে চায় না সেই গল্প। মধুও বলে না। কিন্তু আশরাফি দেখার পর থেকেই পুরোনো সেই স্মৃতিগুলো আবার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। রঙিন, আনন্দঘন স্মৃতি! তার পরপরই আবার আশরাফির তীব্র ঘৃণাযুক্ত রাগত চেহারা!
আরমান মধুর মতিগতি পর্যবেক্ষণ করে সন্দিগ্ধ কন্ঠে বললো,’তারমানে ইনিই তোমার সেই পুরাতন প্রেমিক?’
জবাবে মলিন হাসলো মধু। প্রেমিক আবার পুরাতন হয় নাকি? প্রেমিক তো প্রেমিকই! কিন্তু এসব কথা আরমান বুঝবে না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, চুপ করে রইলো সে।
এদিকে কালরাতের পর থেক চিন্তায় আছে আরমান। মধুর রিয়েকশন দেখেই সে বুঝে নিয়েছিলো লোকগুলোর সঙ্গে পুরোনো কোন সংযোগ তাঁর আছে। তাই মনের ভেতর ভয় ঢুকে গিয়েছে তাঁর। সেধে সেধে লোকগুলোকে এখানে ডাকা মোটেই উচিৎ হয় নি। এখন যদি তাঁরা মধুকে এখান থেকে নিয়ে যেতে চায়? মধু চলে ফেলে আরমানের কি হবে? কে তাঁকে যত্ন করে ভাত বেড়ে খাওয়াবে? কে তাঁকে শাসন করবে? কে তাঁকে সৎপরামর্শ দেবে? কার মুখখানা ভেবে ঘরে ফিরবে আরমান?
নাহ! আর ভাবতে পারলো না সে। মধু চলে গেলে একমুহূর্তও শান্তিতে থাকতে পারবে না আরমান। অতএব যে করেই হোক মধুকে তাঁর চাই। দরকার হলে ডিলটা ক্যান্সেল করে দেবে কিন্তু তবুও মধুকে ছাড়বে না। তাঁর শঙ্কিত মুখের দিকে চেয়ে মধু ম্লান হেসে বললো,’তোমার ভয় নেই! সে আর এখন আমাকে চাইবে না। জেনেশুনে কেউ এমন মেয়েকে ঘরে তুলবে না।’
কথাটাআরমানের পছন্দ হলো। তবুও পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারলো না সে। সন্দিগ্ধ কন্ঠে বললো,’যদি চায়?’
আরমানের চোখেমুখে উৎকন্ঠা, ভয়! মধু স্থির দৃষ্টিতে সেদিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ফের হেসে ফেললো। বিষণ্ণ কণ্ঠে বললো,’চাইবে না। তবুও যদি চায়, আমি যাবো না।’
ভরসা পেলো আরমান। মুখে হাসি ফুটে উঠলো তাঁর! কৃতজ্ঞ হাসি! মধু যখন নিজমুখে স্বীকার করেছে তাঁরমানে আর কোন ভয় নেই। কোথাও যাবে না সে। অবশ্য খামোখাই ভয় পাচ্ছিলো আরমান! মধু যতই রূপসী হোক না কেন, যতই তাদের মধ্যে ভালোবাসা থাকুক না কেন, কোন ছেলেই বা এমন একটা মেয়েকে নিজের ঘরের বউ করতে চাইবে না। আরমানের সামাজিক কোন বাধা নেই তাই সে চাইলেই মধুকে বিয়ে করতে পারে। কিন্তু আশরাফি? তাঁর পক্ষে তো সমাজের বিপক্ষে গিয়ে মধুকে বিয়ে করাটা সম্ভব নয়। সমাজের চোখে মধু একজন প্রস্টিটিউট! এর চেয়ে ভালো কোন সামাজিক মর্যাদা তাঁর নেই!
অতএব মাথা থেকে চিন্তাটা সম্পূর্ণ ঝেড়ে ফেলে দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। তাছাড়া মধু নিজমুখেই বলেছে আশরাফি তাকে চায় না। সুতরাং এসব নিয়ে আর বেশি চিন্তা না করাই ভালো। যত বেশি চিন্তা করবে সমস্যা ততই বাড়বে।
মধুর বিষন্ন মুখের দিকে চেয়ে সান্ত্বনার সুরে বললো,’পুরোনো কথা মনে করে লাভ কি মধু? তাতে কি দুঃখ কমবে? মোটেও কমবে না উলটে আরো বাড়ে। তারচেয়ে বরং এসব চিন্তা বাদ দিয়ে যাও গোসল সেরে এসো। আজকে দুজন একসঙ্গে খাবো! তারপর তোমাকে নিয়ে বেড়াতে যাবো একজায়গায়।’
ছেলেমানুষি কথাবার্তা! হাসলো মধু! চারবছরে এই প্রথম আরমান তাকে নিয়ে বাইরে বেরোনোর কথা বলেছে। নতুবা এখানে যারা আসে তাদের জন্য বাইরের পৃথিবীর নিষিদ্ধ! চাইলেও বেরোনোর ক্ষমতা নেই তাদের। ঠাট্টার সুরে বললো,’আজকে হঠাৎ এত খাতির?’
আরমান সলজ্জ হাসলো। মাথা নিচু করে বললো,’না মানে। তোমার মন ভালো নেই তাই বলছিলাম। তবে তোমার যদি কোন অসুবিধে থাকে তাহলে থাক।’
মধুর মুখের হাসি গুটিয়ে নিলো। এখন আর বাইরে যেতে মন চায় না তাঁর! নিজেকে ঘরবন্দি করে রাখতেই ভালো লাগে। আরমানের কথার জবাবে হ্যাঁ বা না কিছুই উত্তর দিলো না সে। ভেতরে ভেতরে ব্যথিত হলো আরমান। মধুকে সে কিসের অভাব দিয়েছে? সম্মান, শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালোবাসা কোনকিছুতেই তো কোন কমতি রাখে নি! তবে এতগুলো বছরেও কেন মধু তাকে ভালোবাসতে পারলো না? মৌনমুখে বললো,’তোমার বোধহয় যাওয়ার ইচ্ছে নেই তাই না?
-‘না।’
-‘কিন্তু কেন? এতদিন বাদে তোমাকে নিয়ে বাইরে বেরোতে যাবো বললাম অথচ তোমার কোন আগ্রহই নেই? কেন মধুবালা?’
-‘কারণ এখন আর আমার বাইরে যেতে ইচ্ছে করে না। সব ইচ্ছে মরে গেছে।’ আরমান শেষ চেষ্টাস্বরূপ আরেকবার জোর করতে চাইছিলো মধু বারণ করে দিয়ে বললো,’কুয়োর ব্যাঙ কুয়োতেই ঠিক আছে। আলোর ঝলকানি তাঁকে দেখিয়ো না। সইবে না।’
দমে গেলো আরমান। আর কথা বাড়ালো না সে। চুপচাপ বেরিয়ে গেলো।
★
কম্পিউটার টেবিলের সামনে দুম ধরে বসে আছে আশরাফি। বুকের ভেতরটা জ্বালাপোড়া করছে তাঁর। কিন্তু এতকিছুর পরেও মধুকে ঘৃণা করতে পারছে না সে। নিজের জ্বালা মেটাতেই কালরাতে মধুকে তীব্রভাবে অপমান করে এসেছে সে। কিন্তু সেই জ্বালা এখন বিষের মতন তাঁকেই দংশন করছে। মধুকে আঘাতের যন্ত্রণা শূল হয়ে প্রতিটা মুহূর্তে তাঁর বুকেই এসে বিঁধছে। যন্ত্রণায় সারারাত চোখের পাতা এক করতে পারে নি। চাপা মষ্টে বুকের ভেতরটা ভেঙে, গুড়িয়ে তছনছ হয়ে যাচ্ছে তাঁর, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। নিজেকে বড় অসহায়, নিরর্থক মনে হচ্ছে। কাউকে ভালোবাসার যন্ত্রনায় সত্যিই অদ্ভুত। এর জন্যেই।বোধহয় কবি বলে ছিলেন,
তুমি লহ নাই ভালোবাসিবার দায়।
দুহাতে শুধুই কুড়িয়েছো ঝরা ফুল।
কৃষ্ণচূড়ার তলে আমি বসে একা
বুনিয়াছি প্রেম, ঘৃণা বুনিবার ছলে।
যতবার করে আশরাফি নিজেকে বোঝাতে চাইছে, সে মধুকে ঘৃণা করে ততবারই ভেতর থেকে কেউ একজন যেন বলে উঠছে,’তুমি এখনো তাঁকে পাগলের মত ভালোবাসো আশরাফি। সমস্ত পৃথিবীর চাইতেও বেশি!
অথচ কালরাতে মেহেরকে জঘন্যভাবে অপমান করে এসেছে সে, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত কামনা করে এসেছে তাঁর। তীব্র ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এসেছে তাঁর দিকে। কিন্তু তএতকিছুর পরেও কেবল সেই জানে কতখানি গভীর ভালোবাসা লুকিয়ে ছিলো সেই ঘৃণার আড়ালে।
শেক্সপিয়ার বলেছিলেন,’লাভ মি অর হেইট মি, বোথ আর ইন মাই ফেভার। ইফ ইউ লাভ মি, আই উইল অলওয়েজ বি ইন ইউর হার্ট। ইফ ইউ হেইট মি, আই উইল অলওয়েজ বি ইন ইউর মাইন্ড!’ অর্থাৎ আমাকে ভালোবাসো কিংবা ঘৃণা করো দুটোই আমার পক্ষে। যদি তুমি আমাকে ভালোবাসো তবে আমি সর্বদা তোমার হৃদয়ে থাকবো আর যদি ঘৃণা করো তবে আমি থাকবো তোমার মনে।’ তাই এতকিছুর পরেও আশরাফির মন মস্তিষ্ক দুটোকেই দখল করে বসে আছে মধু। শত চেষ্টা করেও মন থেকে মধুর মুখটা মুছে ফেলতে পারছে না আশরাফি। রাগ করে মধুর পুরোনো সব ছবি ডিলিট করে দিয়েছে সে। কিন্তু তাতে কোনা লাভ হলো না। মধুর যেই জ্যান্ত ছবিখানা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে সেটা কিছুতেই মুছতে পারলো না। চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে সেই জ্বালাময়ী মুখ!
আর যতবারই মধুর মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠেছে ততবার মাথায় আগুন জ্বলছে আশরাফির। নিজেকে কোনভাবেই শান্ত রাখতে পারছে না সে। শান্ত রাখবেই বা কি করে? তাঁর মেহের! তাঁর ভালোবাসার মানুষ! টাকার জন্য অন্য পুরুষের শয্যাসঙ্গী বানিয়েছে নিজকে! এই দুঃখ কি আদৌ মিটবে আশরাফির! আকস্মিক চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে এলো তাঁর। অশ্রমাখা কন্ঠে বিড়বিড় করে বললো,’তুমি মরে গেলেও বোধহয় এতটা কষ্ট হতো না মেহের, যতটা কষ্ট এখন হচ্ছে। আমার বড় দুর্বল জায়গায় আঘাত করেছো তুমি। তুমি যে আমার ছিলে কি তা তুমি নিজেও জানো না! কিন্তু আজকে তুমি সব শেষ করে দিলে।’
★
সোহাগ ভেতরে ঢুকে খাটের ওপর বসলো। আশরাফির বিধ্বস্ত মুখের দিকে চেয়ে ভ্রু কুঁচকে বিরক্ত গলায় বললো,’তুই এখনো এসব নিয়ে ভাবছিস? তোকে কতবার বারণ করেছি এসব আর ভাবিস না তবুও বারবার কেন ঘুরেফিরে ঐ মেয়েটার কথাই ভাবিস তুই? কি আছে ওর মাঝে? ঐ মেয়ে ছাড়া কি পৃথিবীতে আর কোন মেয়ে নেই? নিজের চোখেই তো দেখলি টাকার জন্য নিজেকে কতটা নিচে নামিয়েছে সে। তবুও কেন ওকে নিয়েই পড়ে আছিস তুই আমি বুঝি না। এতদিন নাহয় চোখে দেখিস নি তাই অন্ধের মত ভালোবেসে গেছিস কিন্তু এবার তো নিজের চোখেই দেখেছিস তাঁর কর্মকাণ্ড! এতকিছুর পরেও যদি তোর শিক্ষা নাহয় তাহলে আমার আর কিছু বলার নেই তোকে। তোর যা মন চায় তুই কর।’
আশরাফি একফোঁটাও জবাব দিলো না। পূর্বের ন্যায় থম মেরে রইলো সে। গা দিয়ে আগুন বেরোচ্ছে তাঁর! চোখ জ্বালাপোড়া করছে। সবকিছু ভেঙ্গে,গুড়িয়ে তছনছ করে দিতে মন চাইছে।
★
গতকাল রাতে মেহেরকে দেখার পর সোহাগ ওয়াশরুমে যাবার বাহানায় তাঁর সঙ্গে আলাদা করে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছিলো আশরাফিকে। কিন্তু মেহেরের বুক ফাটলো তবু মুখ ফাটলো না। নিজের সমস্ত,দুঃখ, কষ্ট, বেদনা সব নিজের মাঝেই রেখে দিলো সে। আশরাফি যখন সীমাহীন বিস্ময়ে ফ্যালফ্যাল করে তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলো তখন আশরাফিকে করা তার প্রথম প্রশ্নটা ছিলো ,’বিয়ে করেছো?’
আশরাফির জবাবহীন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কিন্তু তাঁর সকরুণ চোখের মনি সার্চলাইটের মত প্রদক্ষিণ করছিলো মধুর সমগ্র মুখে। বোধকরি, মধুর হাসিমুখের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বেদনার রহস্য খুঁজে বের করতে চাইছিলো সে। কিন্তু ধরা দিলো না। হতাশ হয়ে আশরাফি ধরে আসা কন্ঠে বিড়বিড় করে বললো,’সেটা জেনে তোমার লাভ কি মেহের?’
ভেবেছিলো সত্যিটা বলবে মধু। কিন্তু জবাবে হাসলো সে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাসিমুখেই বললো,’ভয় নেই। তোমার ঘাড়ে চেপে বসবো না। এমনিই জিজ্ঞেস করলাম!’
তখনো নিজেকে পুরোপুরি সামলাতে পারে নি আশরাফি। সে বিশ্বাসই করতে পারছিলো না মধুই সত্যিই তাঁর সামনে! সত্যিই বিশ্বাস করতে পারছিলো না সে। যাকে এতগুলো বছর ধরে সযত্নে নিজের হৃদয়ে লালন করে এসেছে তাঁর দেখা এমন জঘন্য জায়গায় মিলবে! মধুর ঠাট্টায় যোগ না দিয়ে বিস্ময়াবিষ্ট, সকরুণ কণ্ঠে বললো,’এই অবস্থা কেমন করে হলো মেহের?’
-‘মেহের বলে এখানে কেউ আমাকে ডাকে না। মধুবালা বললেই বেশি খুশি হবো।’
-‘এড়িয়ে যাচ্ছো?’
যদিও আশরাফির প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পেরেছিলো মধু। তথাপি না বোঝার ভান করে বললো,’এড়িয়ে যাবো কেন? বলো কি জানতে চাও?’
-‘তুমি এখানে কেন?’ আবারো করুণ কন্ঠস্বর আশরাফির।
-‘আমি তো এখানেই থাকি।’
-‘কিন্তু কেন? ঐ লোকটা কেন বলছে তুমি তাঁর স্ত্রী?’
সবার কাছে মধুকে নিজের বউ বলেই পরিচয় দেয় আরমান। মধুও অবশ্য এই নিয়ে কোন দিন কোন প্রতিবাদ করে নি। করে লাভই বা কি? এইখানে যারা আসে তাদের বিয়ে হলেও কি, না হলেও কি? তাঁদের জীবন এমনিতেই নিরর্থক! সম্মান পাবার কোন অধিকার তাদের নেই। তাদের কেবল একটাই কাজ। টাকার জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া। এর বাইরে আর কোন কাজ নেই তাদের।
হ্যাঁ! মধুকে হয়ত অন্যন্য মেয়েদের মত লোভী পুরুষদের শয্যাসঙ্গিনী হতে হয় নি কিন্তু তবুও চারবছর যাবত এখানে আছে সে। এখন আর নিজেকে আলাদা বলেই মনে হয় না। মনে হয় যেন, এদেরই একজন সে। তাই বিয়ে নিয়ে তেমন কোন মাথাব্যথা ছিলো না। কেউ জিজ্ঞেস করলে হাসিমুখেই আরমানের কথা সমর্থণ করে নিতো সে। কিন্তু আজকে পারলো না। বুকের ভেতর কোথাও গিয়ে যেন লাগলো আশরাফির প্রশ্নটা! জবাবে খুব করে বলতে ইচ্ছে হলো,’ভুলে বলেছে ও। আমি কারো বউ নই।’ কিন্তু পারলো না। মনের কথা মনেই চাপা দিয়ে জোরপূর্বক মুখে হাসি টেনে এনে বললো,’হ্যাঁ। ঠিকই তো বলেছে। আমি ওর বউ। বিয়ে হয়েছে আমাদের দুজনের।’
একের পর এক আঘাতে জর্জরিত আশরাফি। মধুর নিজমুখে স্বীকার করার পরেও তাঁর কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারছিলো না সে। সন্দিগ্ধ কন্ঠে বললো,’বিয়ে হয়েছে? নাকি ঐ লোকটা নিশ্চয়ই জোর করে তোমাকে এখানে ধরে এনেছে?’
-‘দেখে কি তাই মনে হচ্ছে?’
-‘মানে?’
-‘মানে আমাকে দেখে কি কোনভাবেই মনে হচ্ছে যে জোর করে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে? কিংবা খুব কষ্টে আছি আমি?’
এবার জ্বলজ্বল করে উঠলো আশরাফি চোখজোড়া। চোয়ালের পেশিগুলো কঠিন হয়ে এলো তাঁর। ধারালো কণ্ঠে বললো,’কি বলতে চাইছো তুমি? এখানে খুব সুখে আছো?’
-‘আমি কিছুই বলতে চাইছি না। আমি শুধু তোমার ভুলটা ভাঙ্গিয়ে দিতে চাইছি। এখানকার মালকিন আমি। আমার কথাতে সব কিছু হয় এখানে। সুতরাং আমাকে জোর করার মত প্রশ্নই উঠে না।’
-‘আমার প্রশ্নের সরাসরি জবাব চাই। হ্যাঁ অথবা না?’
-‘না। আমি নিজের ইচ্ছেতেই এখানে এসেছি।’
-‘মিথ্যেকথা। নিজের ইচ্ছেই কেউ কখনো এখানে আসে না।’
-‘কিন্তু আমি এসেছি। আমার টাকার দরকার ছিলো। প্রচুর টাকার।’
-‘টাকা?’
-‘হ্যাঁ টাকা। আমার প্রথম স্বামী ইশতিয়াক মারা যাওয়ার পর তাঁর বাড়ির লোকজন আমাকে জোর করে আটকে রেখেছিলো তাঁদের কাছে। বন্দী অবস্থায় আমার ওপর অনেক অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে ছিলো তাঁরা। তাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে ছিলাম আমি। নিজের খরচ চালানোর মত তখন একটা কানাকড়িও ছিলো না আমার কাছে। ঠিক সেইমুহূর্তেই আরমানের সাথে দেখা হলো। সে আমাকে বিয়ে করে এখানে নিয়ে এসেছে।’
-‘ওর ব্যবসার কথা তুমি জানতে?’
-‘হ্যাঁ। প্রথম প্রথম একটু খারাপ লাগলেও এখন সয়ে গেছে। তাছাড়া আমাকে অনেক ভালোবাসে সে।’
মেহেরের এমন নিখুঁত মিথ্যে বর্ণনার পরেও আশরাফির সন্দেহ গেলো না। অবিশ্বাস্য কন্ঠে রাগত মুখে বললো,’ক্রমাগত মিথ্যে বলে যাচ্ছো তুমি। আমি জানি, ঐ লোকটা তোমাকে জোর করে এখানে ধরে নিয়ে এসেছে। নতুবা তোমার বাবা কোথায়?’
অন্য যে কেউই হলে আশরাফির রাগত চেহারা দেখে ঘাবড়ে যেত। কিন্তু মধু ঘাবড়ালো না। এবারেও মসৃণ মিথ্যে বর্ণণা করে গেলো সে। আশরাফির প্রশ্নের জবাবে শব্দ করে হেসে উঠে বললো,’তোমার ধারণা তুমি তোমার কাছেই রাখো না। ওসব আমি ভাবি না। আমি বাবার কাছে যাইনি তার কারণ বাবার ওপর রাগ ছিলো আমার। গেলেও বিশেষ কোন লাভ হতো কিনা জানি না। কারণ ইশতিয়াকের মৃত্যুর পর তিনিই আমাকে ওদের বাড়িতে রেখে এসেছিলেন। যাইহোক, সেসব কথা এখন থাক। কিন্তু নিজের মত করে এসব কেন ভাবছো আমি বুঝতে পারছি না? একটা কথা বলি তোমাকে, এতে হয়ত তোমার সন্দেহ কিছুটা হলেও দূর হবে, আরমান যতই খারাপ হোক না কেন আমাকে ও খুব ভালোবাসে। সুতরাং ভুল ভাবার কোন কারণ নেই। যথেষ্ট সুখে আছি আমরা। বেশ ভালো আছি। কোন কিছুর অভাব নেই। বলার আগেই সব হাজির রাখে আরমান।’
আশরাফি রাগে বাক্যহারা হয়ে গেলো। মুখের কথা মিলিয়ে গেলো তাঁর। এ কোন মেহেরকে দেখছে সে? টাকা মানুষকে এতটা পরিবর্তন করে দিতে পারে? তীব্র ঘৃণা মুখ ফিরিয়ে নিলো সে। তীরস্কারের সুরে বললো,’তারমানে নিশ্চয়ই টাকা রোজগারের জনে সে তোমাকেও এই ব্যবসায় নামিয়েছে?’
-‘আমাকে কারো নামানোর দরকার নেই। আমি নিজের ইচ্ছেতেই নেমেছি!’
মধুর কথা শেষ হতে না হতেই ঠাস করে চড় পড়লো তাঁর গালে। রাগ লাল হয়ে গেছে আশরাফির গৌরবর্ণ মুখখানা। মধুর মুখ থেকে এমন জঘন্য কথাবার্তা শুনে নিজেকে স্থির রাখতে পারে নি সে। সপাটে চড় বসিয়ে দিয়েছে মধুর গালে। চড় মেরেও রাগ কমলো না। ক্ষোভে দিশেহারা হয়ে চেঁচিয়ে উঠে বললো ,’মরে গেলে না কেন তুমি? এখনো কেন বেঁচে আছো? এবার আমি তোমাকে খুন করবো।’
কথাগুলো বলার সময় চোখ দিয়ে আগুন বেরোচ্ছিলো আশরাফির। সর্বাঙ্গে জ্বালা করছিলো! এমনিতেই এখানে আসার পর থেকেই গা ঘিনঘিন করছিলো তাঁর। প্রথমেই মেয়েগুলোকে দেখে তীব্র ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো সে। তারপর যখন মধুকে দেখলো হৃদপিন্ডটা পাঁজর ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছিলো! এত আঘাতের পর আবার মধুর এসব কথাবার্তা। সহ্যের তো একটা সীমা আছে মানুষের? এর পরেও একটা মানুষ কি করে নিজেকে শান্ত রাখতে পারে?
এদিকে চড় খেয়ে হাসছে মধু। হাসতে হাসতেই বললো,’তুমি এখনো বোকার মত আমাকে ভালোবাসো নাকি বিয়ে করেছো? কিন্তু দেখে তো মনে হচ্ছে না?’
আশরাফি মুখ দেখে মনে হলো পারলে এখনই মধুকে খুনই করে ফেলে সে। কিন্তু মধু বিন্দুমাত্রেও ঘাবড়ালো না। আশরাফি রাগকে ক্রমাগত বাড়িয়ে দিয়ে নির্লজ্জের মত হাসছে সে। আশরাফি রাগে দিশেহারা হয়ে সজোরে তাঁর বাহু চেপে ধরে দাঁতেদাঁত চেপে বললো,’এরপরেও হাসি আসছে তোমার? নির্লজ্জ, বেহায়া মেয়েমানুষ একটা! লজ্জা করে না তোমার? তোমার মুখ দেখাও পাপ।’ কথা শেষ করে সজোরে মধুকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো সে। ছিটকে পড়ে গেলো মধু। বেকায়দা পড়ে কপাল ফেটে গেলো তাঁর কিন্তু ফিরেও তাকালো না আশরাফি। গটগট করে বেরিয়ে গেলো। ততক্ষনে সোহাগকে নিয়ে ফিরে এসেছে আরমান। মধু মেঝেতে বসে দেখে অবাক হলো সে। রক্ত চোখে পড়তেই উদ্বিগ্ন কন্ঠ বললো,’একি মধু? তোমার এই অবস্থা কেন? রাফি সাহেব কোথায়?’
চোখে কোনে জল চিকচিক করছিলো মধুর। সোহাগ হতভম্ভ! চোখ বড়বড় করে চেয়ে ছিলো মধুর দিকে। আরমানের কথার জবাবে মধু মুচকি হেসে বললো,’উনি চলে গেছেন!’.
-‘কিছু বলে যায় নি?’
-‘না।’
আরমানের সন্দেহ হলো! সোহাগের হঠাৎ তাড়াহুড়ো করে ওয়াশরুমে যেতে চাওয়া, ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে বাড়িটা ঘুরে দেখতে চাওয়া, কাউকে কিছু না বলে আশরাফির বেরিয়ে যাওয়া, মধুর কপালে রক্ত, সবমিলিয়ে একটা না একটা ঘাপলা তো নিশ্চয়ই আছে। তথাপি কথা বাড়ালো না সে।সোহাগের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মধুকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো। মধু ছলছল চোখে একবার সোহাগের মুখের দিকে চেয়ে ধীরেধীরে ভেতরে ঢুকে গেলো তাঁর সঙ্গে।
.
.#মধুবালা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৬
ঘরের বাতি নিভিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে আশরাফি। কিচ্ছু ভালো লাগছে না তাঁর। অস্থির, অসহ্য লাগছে সবকিছু। পুরো বাসা ফাঁকা! সে ছাড়া আর কেউ নেই বাসায়। সোহাগ, নাঈম দুজনের বাইরে গেছে। সোহাগ গেছে তাঁর গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে ডেইটে আর নাঈম? সে গেছে বাড়িতে বাবা মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। আশরাফির তো বাবা মা কেউই নেই তাই ছুটির দিনগুলোতে একা বাসাতেই কাটাতে হয় তাঁকে। নাঈম অবশ্য বেশ জোরাজুরি করেছিলো তাঁর সঙ্গে যাওয়ার জন্য কিন্তু আশরাফি না করে দিয়েছে। এর আগেও বেশ কয়েকবার নাঈমদের বাড়িতে গিয়েছে সে, সোহাগদের বাড়িতেও গিয়েছিলো কিন্তু দুচারদিনের বেশি মন টেকে না। তাই বারণ করে দিয়েছিলো সে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে না গিয়ে ভুলই করেছে। একা বাসায় ভীষন বোরিং লাগছে। আর সবচেয়ে অসহ্যকর যে বিষয়টা, সেটা হলো একা থাকার কারণে তার সমস্ত চিন্তাভাবনা গুলো কেবল মেহেরকে কেন্দ্র করেই ঘুরছে। যেটা প্রতিটা মুহূর্তে অনেক বেশি যন্ত্রনা দিচ্ছে তাঁকে।চাইলেও মাথা থেকে মেহেরের চিন্তাভাবনা ঝেড়ে ফেলে দিতে পারছে না চায় সে। চোখ বন্ধ করলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে মোহর এবং তাঁর লজ্জাজনক পরিনতি! মেহের যতই বলুক ভালো আছে সে কিন্তু আশরাফি কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না তাঁর মেহের এমন একটা জায়গায় যেখানে টাকার বিনিময়ে খুব সস্তা এবং নোংরাভাবে নারীদের দেহ বেচাকেনা হয়। নারীদেরকে বানানো নয় লালসার বস্তু! যতবার এই কথাগুলো মনে পড়ে আশরাফি ততবার চিৎকার করে কাঁদতে মন চায় তাঁর কিন্তু পারে না। সময়ের সাথে সাথে কান্নাও হারিয়ে গেছে। কিন্তু দুঃখগুলো ঠিক আগেরমতই রয়ে গেছে। নিঃশব্দে, নির্জনে বুকের ভেতর রক্তপাত ঘটায় কেবল!
কাল থেকে ইউনিভার্সিটি খুলবে আশরাফির।
সেই অপেক্ষাতেই আছে সে। ক্যাম্পাস খুললে কাজের চাপ হয়ত একটু বাড়বে। কিন্তু তবুও শান্তি! কাজের মাঝে থাকলে নিজের দুঃখগুলোকে ভুলে থাকতে পারবে সে। ব্যস্ত রাখা যাবে নিজেকে। এমনিতে, একা যতক্ষণ থাকে দমবন্ধ হয়ে আসে তাঁর। মেহেরের সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে সেটা আরো বেড়েছে। সবকিছুই অসহ্য লাগছে তাঁর। মাথার ভেতর উল্টোপাল্টা চিন্তাভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে। মাঝে মাঝে তো মনে হচ্ছে একটা লোডেড পিস্তল নিয়ে ঠিক মাথার খুলি বরাবর গুলি করে উড়িয়ে দিতে মেহেরকে। কিন্তু পরোক্ষনেই আবার তাঁকে কাছে পাওয়া তীব্র আকুতি! আশরাফি নিজেও বুঝতে পারে না এ কেমন চাওয়া তাঁর? নিজের ওপর লজ্জা হয় কিন্তু তবুও অস্বীকার করতে পারে না মেহেরকে এখনো চায় সে। এখনো পাগলের মত ভালোবাসে তাঁকে!
গতকালকেও সারারাত বিছানায় এপাশওপাশ করেছে সে। অনেক ভেবেছে। কিন্তু কোনকিছুতেই কোন কূল পায় নি। একটা মেয়ে কি করে এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে? সারাজীবন ধরে শুনে এসেছে মেয়েদের মন হয় কোমল, স্নেহময়ী, দরদমাখা। কিন্তু মেহেরকে যত দেখছে ততই অবাক হচ্ছে সে। লাজলজ্জা, আবেগ অনুভূতি, মায়ামমতা শূন্য হয়ে গেছে সে। কিন্তু মেহের কি এমন ছিলো? মোটেও না! নরম,কোমল, শান্ত দিঘি মত একটা মন ছিলো তাঁর! আশরাফি একটু ছোঁয়াতে নুইয়ে পড়তো লজ্জাবতী লাজুকলতাটা! সেজন্যই আরো বেশি কষ্ট হয় আশরাফির। এমন মেহেরকে নিজের দুঃস্বপ্নের ভাবে নি যে।
এমন কেন হলো সবকিছু ? টাকার জন্য? মেহের তো নিজমুখেই স্বীকার করেছে। কিন্তু তবুও কেন বিশ্বাস করতে পারছে না আশরাফি? কেন বারবার মনে হয় মিথ্যে বলেছে মেহের। কিছু একটা রহস্য আছে তাঁর জীবনে!
এসব ভাবতে ভাবতেই আবার গভীন ধ্যানে মগ্ন হয়ে গিয়েছিলো আশরাফ। মোবাইলের রিংটোনের শব্দে ধ্যান ভাংলো। শোয়া থেকে উঠে বসে ফোন রিসিভ করলো সে। ওপাশ থেকে নীলা মিষ্টি করে সালাম দিয়ে বললো,’আপনি কি ফ্রি আছেন স্যার?’
সালামের জবাব দিলো আশরাফি। গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,’হ্যাঁ। বলো কি বলবে।’
নীলা তাঁদের ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভ। মানে সি আর! তাই ক্লাস রুটিন, এসাইনমেন্ট, থিসিস জমা দেওয়া সহ, যাবতীয় পড়াশোনামূলক বিষয়ে পুরো ক্লাসের হয়ে তাঁকেই আলাপ করতে হয় স্যারদের সাথে। সেই সুবাদে আশরাফিকেও প্রায়ই ফোন করার সুযোগ হয়েছে তাঁর। কিন্তু আজকে ফোন করার একটা বিশেষ কারণ আছে। কারণটা হচ্ছে আজকে নীলার জন্মদিন। বাসায় পার্টি হবে। সব বন্ধুবান্ধবদের, পরিচিত কয়েকজন স্যার ম্যাডামদের দাওয়াত করেছে সে। কিন্তু আশরাফিকে কি করে দাওয়াত দেবে সেটাই বুঝতে পারছিলো না। দাওয়াত দেওয়ার পরে সে কি রিয়েক্ট করে সেটা ভেবেও ভয় হচ্ছিলো।
শেষমেশ একটা উপায় বের করে ফেললো। নিজের রিসার্চে অ্যাসিস্ট করার জন্য আশরাফি তাঁকে কিছু আগ্রহী ছাত্রছাত্রীদের লিস্ট তৈরী করতে বলেছিলো। লিস্ট রেডি! তাই ফোন করে খবরটা আশরাফিকে জানানো যেতেই পারে। সেই সুযোগে জন্মদিনের কথাটাও বলে ফেলবে।
আশরাফির কাছ থেকে অনুমতি পেয়ে বিনীত কন্ঠে বললো,’রিসার্চে অ্যাসিস্ট করার জন্য আপনি আগ্রহী ছাত্রছাত্রীদের যেই লিস্টটা আমাকে তৈরী করতে বলেছিলেন সেটা রেডি হয়ে গেছে স্যার।’
-‘ঠিক আছে। তুমি তাহলে লিস্টটা মেইল করে পাঠিয়ে দাও আমাকে।’
-‘এখনই?’
-‘হ্যাঁ এখনই। কেন কোন সমস্যা?’
-‘জ্বী না স্যার। আমি এখনই মেইল পাঠাচ্ছি আপনাকে।’
‘ঠিক আছে’, ফোন রেখে দিচ্ছিলো আশরাফি তখনই নীলা তড়িঘড়ি করে বললো,’হ্যালো স্যার?’
ফের ফোন কানে দিলো আশরাফি। শীতল কন্ঠে বললো,’আর কিছু বলবে?’
-‘জি স্যার।’
-‘কি?’
নীলার ভয় লাগছে। আশরাফি সঙ্গে পড়াশোনার বাইরে অন্যকোন কোন আলোচনা কখনোই হয় নি তাঁর। তাই অন্য স্যার ম্যাডামদের চাইতে বেশি ভয় হয় তাঁর সঙ্গে কথা বলতে। তারওপর আজকে তো সরাসরি বাসায় আসার দাওয়াত। বুঝতে পারছিলো না কি হবে! ভীত, ইতস্তত কন্ঠে বললো,’না মানে। আজকে আমার জন্মদিন স্যার। তাই বাবা ছোটখাটো করে একটা পার্টির…’ তার কথার মাঝখানেই আশরাফি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো,’তাই নাকি?’
-‘জি স্যার!’
-‘তাহলে তো উইস করা উচিৎ তোমাকে?’
জবাবে নীলা কিছু বললো না। হাত পা কাঁপছিলো তাঁর। আশরাফি মুচকি হেসে বললো,’ শুভ জন্মদিন। অনেক বড় তুমি। আর খুব খুশি থাকো।’
বিশেষ মানুষদের কাছে থেকে শুভেচ্ছা পেতে সবারই ভালো লাগে। হোক না সেটা খুবই সামান্য। তবুও অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করে। প্রশান্তিতে ভরে যায় মন! কানায় কানায় ভয়ে জায় আনন্দের মাত্রা! নীলার মনটাও আনন্দে ভরে গেলো। আজকের দিনটা স্বার্থক তাঁর। লাজুক কন্ঠে বললো,’থ্যাংক ইউ স্যার।’
আশরাফি ফের হাসলো। হাসিমুখেই জিজ্ঞেস করলো সে,’তারপর? তুমি যেন কি বলছিলে? বাসায় পার্টি হবে তাইতো?’
-‘জি স্যার। তবে খুব বড় করে নয়। বাবা, মা, আমি আর আমার সব বন্ধুরা থাকবে। লায়লা ম্যাম, আরিফ স্যারকেও বলেছি। উনারা আসবেন। আপনি কি আসবেন স্যার? আপনি এলে খুব খুশি হবো আমি।’
-‘আমি?’
-‘হ্যাঁ স্যার। আসবেন ?’ খানিকটা আবদারের সুরেই জিজ্ঞেস করলো নীলা। বারণ করতে পারলো না আশরাফি। এমনিতেও বাসায় ভালো লাগছিলো না তাঁর। তাছড়া ওখানে কলিগরাও আসবে, আড্ডা দেওয়া যাবে সবার সঙ্গে।’ আগ্রহের সাথেই জিজ্ঞেস করলো,’অনুষ্ঠান কয়টায়?’
-‘সাতটায়।’
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো আশরাফি!তারপর নীলাকে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে বললো,’ঠিক আছে আমি আসবো!’
খুশিতে চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো নীলার। সে স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি এত সহজে রাজি হয়ে যাবে আশরাফি। রীতিমতো কল্পনার বাইরে তাঁর! উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বললো,’থ্যাংক ইউ স্যার। আপনি আসবেন, অনেক খুশি হয়েছি আমি।’
-‘ঠিক আছে। আমি তাহলে এখন রাখি।’
-‘জি স্যার। খোদা হাফেজ!’
পুনরায় সালাম দিয়ে ফোন কাটলো নীলা। আনন্দের নাচতে ইচ্ছে করছে তাঁর। পরীক্ষায় ফার্স্ট হলেও এতখুশি লাগে নি আজকে যতটা খুশি লাগছে। তড়িঘড়ি করে সাজতে বসে গেলো সে। এদিকে ফোন রেখে ঘড়ির দিকে চাইলো আশরাফি। সবে সাড়ে সাড়ে চারটা বাজে। হাতে এখনো সময় আছে। ঘড়িয়ে পৌনে ছয়টার এলার্ম সেট করে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লো সে। যদিও এখন ঘুম আসবে না। তবুও বৃথা চেষ্টা। বাসায় বসে এমনিতেও তেমন কোন কাজ নেই। তারচেয়ে চোখবন্ধ করে শুয়ে থাকলেও রেস্ট হবে।
★
ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে পারফিউম স্প্রে করছিলো আশরাফি। ফোনটা বেজে উঠতেই ভাবলো নীলা ফোন করেছে। না দেখেই রিসিভ করলো সে। কিন্তু সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবে ওপাশ থেকে কেউ একজন ‘হ্যালো’ বলে উঠলো ওমনিই হৃদপিন্ডটা ধড়াস করে লাফিয়ে উঠলো তাঁর। মেহের ফোন করেছে! কণ্ঠ চিনতে একটুও ভুল হয় নি আশরাফির। কি করে হবে? সম্পর্কটা হয়ত মিথ্যে হয়ে গেছে কিন্তু যতগুলো রাত সে মেহেরের মিষ্টিমধুর, আদুরে কণ্ঠস্বর শুনে পার করেছে সে রাত গুলোতো আর মিথ্যে হয়ে যায় নি। আশরাফি এখনো মনে পড়ে, সারারাত ফিসফিস করে কথা বলে ভোরবেলায় ঘুমাতো দুজনে, এরজন্য কত ক্লাস মিস হয়েছে তাঁর। স্যার ম্যাডামদের কত বকা শুনতে হয়েছে তাঁকে ! অথচ সেই প্রেম, সেই অনুভূতি সবই এখন ফিকে! অর্থহীন! মূলহীন পীড়াদায়ক এক অতীত কেবল! যেটা ধুয়ে মুছে শেষ করে ফেলেছে মেহের! কিন্তু আশরাফি? সে এখনো মেহেরের স্মৃতি নিয়েই পড়ে আছে। তাঁর ঘৃণা, ভালোবাসা, রাগ, অভিমান সব এখনো মেহেরকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। চাইলেও সত্যিটা অস্বীকার করতে পারে না। কারণ মানুষ নিজের কাছে কখনোই মিথ্যে বলতে পারে না! নিজের অজান্তেতই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিরে। ওপাশ থেকে আবারো মেহেরের অধৈর্য কন্ঠস্বর শোনা গেলো,’হ্যালো, হ্যালো? কি হলো শুনতে পাচ্ছো না? আমি মধু!’
মুহূর্তেই মেজাজটা আবার খারাপ হয়ে গেলো আশরাফির। মধু নামটা শুনেই মাথায় রক্ত উঠে যায় তাঁর। তারপরেও কতবড় সাহস মেহেরের তাকে ফোন করে মধু নামে পরিচয় দিচ্ছে। দাঁতমুখ খিঁচে বললো,’কিন্তু আমি মৌমাছি নই।’ কথা শেষ সটাং ফোন কেটে দিলো সে।
এদিকে মধু হতভম্ভ! এটা কি হলো? আশরাফি এটা কি বললো? মৌমাছি নই মানে? সে কি মধু বলে পরিচয় দেওয়াতে খেপে গেছে? নাকি অন্যকিছু? পুনরায় আশরাফির নাম্বারে ডায়াল করলো সে।
সময়ে অসময়ে যোগাযোগের জন্য ছোট এই বাটন ফোনটা আরমান কিনে দিয়েছিলো তাঁকে। সেটা থেকেই আশরাফিকে ফোন করেছে সে। নাম্বার জোগাড় করতেও বেশ কাঠখড় পোহাতে হয়েছে। চুরি করে আরমানের ফোন থেকে আশরাফির জোগাড় করেছে। শুধুমাত্র একবার আশরাফি কন্ঠটা শোনার জন্য!
আশরাফি সেদিন রাগ করে বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকেই মনটা বড় অশান্ত হয়ে আছে তাঁর।খুব দেখতে ইচ্ছে করছিলো তাঁকে! একবার তাঁর কণ্ঠ শোনার জন্য আকুপাকু করছিলো মনটা। কিন্তু ফোন করার কোন বাহানা খুঁজে পাচ্ছিলো না।
কিন্তু কথায় আছে, ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। অবশেষে মধুও পেয়ে গেলো উপায়! আশরাফি তাঁদের কম্পানীর জন্য যেই মেয়েগুলো খোঁজ করছিলো তাদেরকে মোটামুটি সব শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছে মধু। চাইলেই সেই ব্যপারেই আলাপ করার জন্য আশরাফিকে ফোন করতে পারে সে। আশরাফি যদি কিছু বলে তবে মধুও বলতে পারবে ব্যবসার ব্যপারে আলাপ করতেই ফোন করেছে তাঁকে। তখন আর নিশ্চই কিছু বলতে পারবে না আশরাফি?
এদিকে তখনো রাগে গজগজ করছিলো আশরাফি। এতবড় সাহস তাকে ফোন করে বলে কি না মধু! সামনে পেলে মুখ সেলাই করে দিতো একদম! কিন্তু আশরাফি হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিউর মধু একদিন নির্ঘাত খুন হবে তাঁর হাতে! হবেই হবে!
এসব চিন্তার মাঝখানেই আবারো ফোন বেজে উঠলো আশরাফি। আগের নাম্বার থেকেই এসেছে। রিসিভ করে শুরু হলো ঝাড়ি। মধুকে কোন কথাই বলতে দিলো না সে। ইচ্ছে মত ঝাড়লো। আধঘন্টা বাদে কিছুটা শান্ত হলে মধু মুচকি হেসে বললো,’আমার ফোন ব্যালেন্স কম। তোমার যদি খুব বেশি বকতে ইচ্ছে হয় তবে নিজের ফোন থেকে করো। কিন্তু এবার দয়া করে আমাকে কাজের কথাটা বলতে দাও প্লিজ!’
এমনিতেই আশরাফির মেজাজ সপ্তম আকাশে! তারওপর যখন দেখলো সে এতক্ষণ যাবত চেঁচামেচি করার পরেও মধু বিন্দুমাত্রও বিচলিত হয় নি তখন মেজাজ আরো খিঁচড়ে গেলো। তাই আরো বেশি খেপে গেলো সে। ফোনের ওপাশ থেকে ঝাড়ি মেরে বললো,’এই ফোন রাখো তুমি! তোমার সাথে কোন কথা বলার রুচি আমার নেই। আমি তোমার সাথে কোন কাজের কথা বলবো না।’
-‘বলতে হবে। কারণ তুমি আমার স্বামীকে তোমার একটা কাজ করে দেওয়ার জন্য টাকা দিয়েছো। সেটার ব্যপারে কথা বলতেই তোমাকে ফোন করেছি।’
অত্যাধিক রাগে কিছুক্ষনের জন্য নির্বাক হয়ে গেলো আশরাফি। রিয়েক্ট করার মত আর কোন ভাষা খুঁজে পেলো না সে। মেহের তাঁকে স্বামী দেখাচ্ছে! স্বামী? স্বামীর চৌদ্দগুষ্ঠির কাঁথায় আগুন। চিৎকার করতে, করতে হয়রান হয়ে গেছে সে আর মেহের এসেছে তাঁকে স্বামী দেখাতে? এবার দ্বিগুণ জোরে চেঁচিয়ে উঠলো সে,’স্বামী না? খুব স্বামী স্বামী করছো? তোমার স্বামী আমার…’
ভয়ানক একটা গালি দিলো সে। বিগত চারবছর যাবত শান্তই ছিলো সে। ইউনিভার্সিটি সবচেয়ে কুল এন্ড কাম লেকচারার পরিচিত ছাত্রছাত্রীদের কাছে। অথচ দুদিনেই তাঁর মাথা কি পরিমান গরম করে দিয়েছে মধু। নিজের মানমর্যাদা, অবস্থা, পরিস্থিতে সব ভুলে গিয়ে মুখ দিয়ে কুরুচিপূর্ণ গালি বেরোচ্ছে! সব দোষ মেহেরের। এবার আরো বেশি করে গালি দেবে আশরাফি!
এদিকে লজ্জায় জিভ কাটলো মধু। সঙ্গে সঙ্গে কানের কাছ থেকে ফোন সরিয়ে নিলো সে। একটুবাদে আবার কানে দিয়ে অবাক হয়ে বললো,’ছিঃছিঃ মুখের ভাষা এত খারাপ কি করে হলো তোমার? আগে তো এমন ছিলে না তুমি?’
-‘সেই কৈফিয়ত তোমাকে দেবো নাকি? ইচ্ছে হয়েছে গালি দিয়েছি দরকার হলে আবার দেবো। তুমি ফোন রাখো! কেন ফোন করেছো ফোন আমাকে? যার মুখের ভাষা ভালো তাকে নিয়েই থাকো না। শুধুশুধু আমাকে কেন জ্বালাচ্ছো?’
-‘বললাম তো কাজের জন্য ফোন করেছি।’
-‘তোমার সঙ্গে আমার কোন কাজের কথা নেই, থাকতে পারে না আর ভবিষ্যতেও থাকবে না।’
-‘একবার আসতে পারবে?’
হঠাৎ এইপ্রস্তাবে থতমত খেয়ে গেলো আশরাফি। সে ভাবতেই পারে নি মধু তাঁকে এমন প্রস্তাব দেবে! রাগী আশরাফি আড়ালে যেই কঠিন প্রেমিক আশরাফি বাস করছে মুহূর্তেই সে যাওয়ার জন্য সায় দিয়ে দিলো। কিন্তু রাগী, অভিমানী আশরাফি নিজের রাগ, অভিমান ডাঁট বজায় রেখে বললো,’তোমার সাহস তো কম না? তুমি আমাকে ঐ নোংরা জায়গায় যেতে বলছো? তুমি কি তোমার মত ভাবো সবাইকে? আমি তোমার ঐ….. জায়গায় যাবো? হাউ ক্যান ইউ এক্সপেক্ট দিজ ফ্রম মি?’
এবারেও যথারীতি শুন্যস্থানে একটা বড়সড় গালি বসবে! এবারে অবশ্য ইচ্ছে করে দিতে চায় নি আশরাফি! কিন্তু মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেছে। জবাবে মেহের একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো কেবল। তারপর ম্লান কন্ঠে বললো,’তারমানে আসবে না তুমি? ঠিক আছে। আমি তাহলে রাখি।’ কথা শেষ করে ফোন কেটে দিলো সে। ফোন হাতে নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো আশরাফি। আবারো একরাশ শূন্যতা এসে ঘিরে ধরলো তাঁকে। বুকের ভেতরে পিনপিন শুরু হলো। মেহের তাঁকে এ-কি অসহ্য যন্ত্রণা ফেলেছে। না পারছে সইতে না পারছে কিছু বলতে। পৃথিবীতে এর চাইতে ভয়ংকর এর চাইতে যন্ত্রনার আর কিছু হতেই পারে না। কারণ এই যন্ত্রনার কোন প্রতিকার নেই! নিরবে নিভৃতে সহ্য করে নিতে হয় কেবল!
.
.
.
চলবে
.
চলবে