মধুবালা পর্ব ৩+৪

#মধুবালা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৩

আরমানের পাতে মাছের ঝোলটা ঢেলে দিলো মধু। মাংসের বাটিটা এগিয়ে দিয়ে বললো,’আজ এত তাড়াতাড়ি ফিরলে যে?’

-‘তোমার মুখটা মনে পড়লো আর কিছুতেই থাকতে পারলাম না। সব কাজ ফেলে ছুটে চলে এলাম। এসে তোমার মুখটা দেখেছি এবার শান্তি।’, হাসিমুখে মধুর প্রশ্নের জবাব দিলো আরমান। মধুও হাসলো। নিষ্প্রভ, নিষ্প্রাণ হাসি। এই হাসিতে কোন জৌলুশ নেই, কোন আনন্দ কিংবা উচ্ছ্বাস কিছুই নেই। আছে কেবল একরাশ লুকোনো বেদনা। মর্মাহত হলো আরমান। মধুর সঙ্গে এইধরনের কথাবার্তা কখনোই ভালোভাবে জমাতে পারে নি সে। মধুই এড়িয়ে যায়। আরমান প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে নিলো। পাতের ভাতে ঝোল মাখাতে মাখাতে বললো,’মালদার একটা পার্টি পেয়েছি মধু। গুনে গুনে পঁচিশ হাজার দেবে বলেছে!’

অবাক হলো মধু। এখানে যারা আসে তাঁরা এরাতের জন্য সর্বোচ্চ এক থেকে দেড় হাজার টাকা দিতে রাজী হয়। খুব বেশি হলে দুইহাজার। কিন্তু আজ হঠাৎ এত টাকার কথা শুনে খানিকটা চিন্তায় পড়ে গেলো সে। বিস্মিত কণ্ঠে বললো,’পঁচিশ হাজার? কিন্তু কাজটা কি?’

-‘কাজ তেমন কিছু না। সুন্দর আর নাচজানা দুইতিনটা মেয়ে চাইছে তারা। তাও মাত্র দুইঘন্টার জন্য!’

আরমানের কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝলো না মধু। তাঁর পরের বক্তব্য শোনার অপেক্ষায় চুপ করে রইলো সে। আরমান ভাতের লোকমা মুখে পুরে দিয়ে সেটা চিবোতে চিবোতে বললো,’নতুন কম্পানী। আগামীকাল বিদেশ থেকে তাদের বায়ারদের সাথে জরুরী একটা মিটিং আছে। তাই পার্টিকে খুশি করার জন্য পুরোনো ধাঁচের জলসার আয়োজন করতে চাইছে তাঁরা। নামীদামী শিল্পীদের ভাড়া করতে গেলে তো মোটা টাকা খরচ করতে হবে সেইজন্যই আমাকে ধরেছে দুই তিনটা মেয়ে জোগাড় করে দিতে।’

-‘কিন্তু এখানে তো কেউ নাচ জানে না।’

-‘না জানলে টুকটাক শিখিয়ে দেবে।’

-‘আমি? তোমাকে কে বললো আমি নাচ জানি?’

-‘সে কি তুমি নাচ জানো না? কিন্তু তুমি যে বললে তুমি খুব বড় ঘরের মেয়ে?’

-‘বড় ঘরের মেয়েরা নাচ জানে এই কথা তোমাকে কে বলেছে?’

-‘বেশ! তাহলে আমি দেখি সস্তার ভেতর কোন নাচের গুরু জোগাড় করতে পারি কি না। অবশ্য তাঁর প্রয়োজন হবে কি না কে জানে। যতই তাঁরা নাচের কথা বলুক আসল উদ্দেশ্য কি সেটাতো তুমিও জানো আমিও জানি!’

এই কথার জবাবে বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে ফেললো মধু। ইতোপূর্বে এইধরনের কোন প্রস্তাব পায় নি আরমান। এইবারই প্রথম। তাই মধুর ভাষ্যমতে কাজটা তাঁর ভালোভাবে করা উচিৎ। হতে পারে সত্যিই কম্পানীর লোকজন জলসার আয়োজন করতে চাইছে? তারপর সেখানে গিয়ে যদি দেখা যায় মেয়েরা নাচতে পারলো না তবে তো প্রথমেই সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেলো। মুখে না বললেও প্রস্তাবটা মধুর পছন্দ হয়েছে। প্রথমবারে ভালোমত কাজটা করতে পারলে পরে হয়ত এই ধরণের সুযোগ আরো আসতে পারে। তাতে করে মেয়েগুলোর অন্তত একটা গতি হবে। নরপশুদের অত্যাচারের হাত থেকে কিছুটা হলেও রেহাই পাবে। তাই আরমানের গাফলতি পছন্দ হলো না তাঁর! গম্ভীর গলায় বললো,’তুমি বরং ভালো দেখে একজন নাচের গুরু জোগাড় করো।’

-‘তাতে তো খরচা বেশি হবে?’

-‘হোক। হতে পারে কম্পানীর পছন্দ হলে এই ধরণের সুযোগ তাঁরা আরো জোগাড় করে দেবে।’

মধুর কথার বিপরীতে হাসলো আরমান। প্লেটে পানি ঢেলে হাত ধুতে ধুতে বললো,’বাহ্! বেশ ব্যবসা শিখে গেছো দেখছি তুমি?’

মধুও জবাব না দিয়ে হাসলো। আরমান আর কথা বাড়ালো না। হাত ধোয়া শেষে তোয়ালেতে হাত মুছে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। এঁটো বাসন পত্র নিয়ে চুপচাপ তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো মধু

উপরোক্ত কথোপকথন গুলো চলছিলো ঢাকার অদূরবর্তী একটা নিষিদ্ধপল্লির দুই বাসিন্দার মধ্যে। পুরুষ বক্তাটি মানে আরমান এই হাউজের পিম্প! বাংলায় যাকে বলে দালাল। যদিও এখানকার মালিক সে তবে মেয়ে জোগাড় করাই তাঁর প্রধান কাজ। আর মেয়ে বক্তাটি এখানকার হবু মালকিন। বর্তমানে এই হাউজের মোট একুশজন মেয়ের দেখাশোনার করাই তাঁর প্রধাণ কাজ।ইতোপূর্বে তাঁর নাম ছিলো মেহেরুন্নেসা চৌধুরী। যাকে ঘিরেই মধুবালা গল্পের যত কাহিনী!
অতএব বলা বাহুল্য তাঁর আগের নাম বদলে নতুন নাম রাখা হয়েছে মধুবালা। সবার পরিচিত মধুমা সে! বাকি মেয়েরা সবাই মধু-মা বলেই ডাকে তাঁকে। তাঁর মেহেরুন্নেসা থেকে মধুবালা হওয়ার ইতিহাসও এখানকার কারো অজানা নয়। প্রায় প্রতিটা মেয়েই শুনেছে তাঁর করুণ ইতিহাস। শুনে কেউ বা খুব সহজ স্বাভাবিক ভাবে নিয়েছে বিষয়টা আবার কেউ কেউ ডুঁকরে কেঁদে উঠেছে। এদের মধ্যে অনেকেই আবার নিরবে অশ্রু বিসর্জন করেছে তাঁর দুঃখে।

মধুর দুঃখের ইতিহাসের বর্ণণা যদি অতি সংক্ষেপে দেওয়া হয় তবে এরজন্য মূলত দায়ী তাঁর বাবা। বাবা মা কখনোই সন্তানের খারাপ চায় না! কিন্তু কথায় আছে অতিরিক্ত চালাক মানুষের কপালে দুঃখ বেশি। তাঁরাই বেশি ঠকে। মধুর বাবার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। পরিবারের সবার অমতে একক সিদ্ধান্তে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন তিনি কিন্তু সুখ দিতে পারেন নি মেয়েকে। একদিনও টিকলো মধুর সংসার। তার স্বামী মৃত ইশতিয়াক ছিলো একজন এপিলেপটিক পেশেন্ট। বাংলায় যাকে বলে মৃগীরোগী। কিন্তু মধুর বাবার কাছে তাঁর অসুখের খবরটা গোপন করে যায় ইশতিয়াকের পরিবার।
কিন্তু গোপনটা সত্যিটা একদিনও গোপন থাকলো না মধুর কাছে। বিয়ের দিন রাতেই ফাঁস হয়ে গেলো।
সেদিন রাতে ইশতিয়াক ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশরুমে ঢুকে যখন একঘন্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরেও বেরোলো না তখন বাধ্য হয়ে দরজায় নক করলো মধু। সেইমুহূর্তে তাঁর নিজের মাথাও ঠিক ছিলো না। দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতেও কাঁদছিলো সে। আশরাফির জন্য ভেতরে ভেতরে চিন্তা অনুভব করছিলো। তবুও ভেতরের মানুষটার জন্য কিঞ্চিৎ উৎকন্ঠা বোধ করছিল সে। কিন্তু বেশ কয়েকবার দরজায় নক করার পরেও ভেতর থেকে কোন জবাব এলো না। শঙ্কিত মধু উপায়ান্তর না পেয়ে তাঁর ননদ কে ডেকে আনলো। ননদের চিৎকার চেঁচামেচিতে বাড়ির বাকিরাও একে একে সবাই হাজির হলো। শেষমেশ দরজা ভেঙ্গে বের করা হলো ইশতিয়াককে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। ওয়াশরুমেই কনভালসিভ অ্যাটাক হয়েছিলো তাঁর। অর্থাৎ খিঁচুনি শুরু হয়েছিলো। আচমকা অ্যাটাক শুরু হওয়ায় শরীরের ব্যালেন্স রাখতে পারে নি সে। বেকায়দায় ওয়াশরুমের পিচ্ছিল মেঝেতে পড়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলে। হস্পিটালে নেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু ডাক্তাররা জানান মস্তিষের অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের (হেমোরেজিক স্ট্রোক) কারণে অনেক আগেই মারা গেছে সে।
মধুর শ্বশুরবাড়ির লোকজন ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য চারদিকে মধুর নামে গুজব ছড়ানো শুরু করলো। মধুর সাথে থাকা জ্বীনের আছরেই নাকি মারা গেছে ইশতিয়াক।

আধুনিক যুগে যদিও এসব বিশ্বাস্যযোগ্য নয় কিন্তু তবুও এই সমাজে সবকিছুর দায়ভার মেয়েদের ওপরেরই চাপানো হয়। তাই ইশতিয়াকের মৃত্যুর জন্যেও ঘুরেফিরে মধুকে-ই দায়ী করা হলো। এরপর স্বামী মারা যাওয়ার অযুহাত দিয়ে চল্লিশদিন পর্যন্ত শ্বশুরবাড়িতে তাঁকে একঘরে আটকে রাখা হলো। সেইসময় টুকুকে তার ওপর করা অমানুষিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের কথা আজও ভুলতে পারে নি মধু। পরে তাঁর এক ননদের সহযোগীতায় শ্বশুরবাড়ির কাউকে কিছু না জানিয়ে একাই সেখান থেকে পালায় সে। কিন্তু সেখানেও তাঁর কপাল মন্দ। মাঝ পথেই দালালের খপ্পরে পড়ে গেলো অভাগিনী। তারপর থেকেই এখানকার বাসিন্দা।

কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও এই কথা সত্যি যে, আরমান তাঁর কোন ক্ষতি করে নি। কোনদিন তাঁকে কোনরকম অসম্মান করে নি কিন্তু এখান থেকে যেতেও দেয় নি। মধুকে প্রথম দেখাতে ভালো লেগে গিয়েছিলো তাঁর। তাঁর রেশ ধরেই পরবর্তীতে মধুকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলো সে! কিন্তু মধু রাজী নয়। বিয়ের সাধ মিটে গেছে তাঁর!
তবুও আরমানের বিশ্বাস খুবই শীঘ্রই রাজি হবে মধু। কারণ এখন আর নিজের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার কোন পথ খোলা নেই তাঁর আছে। এই নোংরা জায়গাতেই কেটে গেছে তাঁর জীবনের দীর্ঘ চারটা বছর। অতএব মুক্তির আর কোন পথ নেই।

ব্যবসাটা আরমানের পূর্বপুরুষের আমলের। তাঁর দাদা, পরদাদা, এমনকি তাঁর বাবাও এই ব্যবসা করে গেছে। আরমান লেখাপড়া বেশিদূর করে নি। ছোটবেলাতেই তাঁর বাবার অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে তাঁর মা সফুরা বানু আত্মহত্যা করেন। তারপর থেকে আরমানকে দেখার মত কেউ ছিলো না। বাবার সাথে এখানেই বড় হয়েছে! বর্তমানে চৌত্রিশ বছরের বলিষ্ঠ যুবা পুরুষ সে। বাবার মৃত্যুর পর এই কল-হাউজের দায়িত্ব এখন তাঁর!
মধুকে ভালোবাসে বিধায় এই ব্যবসায় কখনো জড়ায় নি। সে চায় মধুকে নিয়ে সুন্দর একটা সংসার গড়ে তুলতে। যেখানে ফুটফুটে সুন্দর দেখতে কয়েকটা ছেলেমেয়ে হবে তাঁদের।
কিন্তু মেয়েমানুষের লোভ যে তাঁর নেই তেমন নয় তথাপি কোন এক অজ্ঞাত কারণে মধুকে শ্রদ্ধা করে সে। মধুর কথার ওপরে কোন কথা বলতে পারে না।

অবশ্য মধু আছে বলে এখানকার মেয়েগুলোরও রক্ষে। নতুবা ছোট ছোট মেয়েগুলোকেও রোজ নরপশুদের অমানুষিক নির্যাতনের স্বীকার হতে হতো। কিন্তু মধু আসার পর থেকে পারতপক্ষে কমবয়সী মেয়েদের খদ্দেরের কাছে পাঠায় না সে। কারো শরীর খারাপ হলে কিংবা বয়স একটু কম হলে যতটুক সম্ভব আগলে রাখার চেষ্টা করে। আরমান অবশ্য মনে মনে এই নিয়ে একটু নাখুশ হলেও মধুর সম্মুখে কোনদিন কিছু বলে নি। বলার সাহসই পায় নি। একরত্তি মেয়ের মাঝে কি যেন একটা আছে। একে দেখলেই ভয়ে তাঁর বুকের ভেতরটা কেমন যেন সেঁধিয়ে আসে। কেন এমন হয় আরমান নিজেও জানে না। কিন্তু হবেই বা না কেন? ওপাশ থেকে যে কেউ একজন এখনো মনে মনে মধুর প্রত্যাশাতেই বসে আছে!
.
.
.#মধুবালা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৪

শেষ প্রশ্নের উত্তর একেবারে গুলিয়ে ফেলেছে নীলা। ফেলবেই না কেন? তার পাশেই যে দাঁড়িয়ে আছেন আশরাফি স্যার। মানুষটাকে দেখলেই বুকের ভেতর দুপদাপ শুরু হয়ে যায় নীলার। আর চোখ ফেরাতে পারে না সে। কি সুন্দর মুখ! কি সুন্দর হাসি! কি সুন্দর চেহারা!
নীলার ভাষ্যমতে, একেবারে হলিউডের হিরো!
আজকেও বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো সে। দারুণ ড্যাশিং লাগছে। ইন করা সাদা শার্টের সাথে ব্ল্যাক জিন্স! শার্টের হাতা সামান্য গুটিয়ে রেখেছে। রোজকার মত মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি আর মাথাভর্তি একরাশ ঝাঁকড়া চুল। চোখে পাওয়ারি চশমা। উফ! তবুও যেন চোখ ফেরানো দায়! কথাবার্তায়ও তো মারাত্মক কিলার টাইপ অ্যাটিটিউড! আপন মনেই হেসে ফেললো নীলা।
পরোক্ষনেই আবার মনটা খারাপ হয়ে গেলো তাঁর। মানুষটা দেখতে যতটা হ্যান্ডসাম তার চেয়ে বেশি রিজার্ভ! একেবারে মেপে মেপে কথা বলা টাইপ মানুষ। কলিগের সাথে অবশ্য মাঝে মাঝে হাসাহাসি করতে দেখা যায় তাঁকে কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের সাথে? ক্ষেত্র বিশেষে দারুণ মুডি। বিশেষ করে ছাত্রীদের সাথে। ছাত্রদের সাথে কখনো কখনো সামান্য ফ্রি হলেও ছাত্রীদের সাথে সবসময় শিক্ষকসুলভ ডিসটেন্স মেইনটেইন করেই চলেন। বস্তুত সেইজন্যই তাঁকে এত পছন্দ করে নীলা! এত হ্যান্ডসাম মানুষের একটুখানি ভাব না থাকলে হয়?

পরীক্ষার হলে গার্ড হিসেবে দায়িত্ব পড়েছে আশরাফির। অভ্যাসবশতই হাঁটতে হাঁটতে ক্লাসের মাঝ বরাবর একজায়গায় এসে দাঁড়িয়েছিলো সে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেই একজায়গাটাই পড়লো নীলার ঠিক পাশে। ব্যস! শুরু হলো বেচারীর হাটু কাঁপাকাঁপি! বুকের ভেতর দুরুদুরু। পারা প্রশ্নের উত্তর গুলিয়ে গেলো! কলম মুখে দিয়ে চুপচাপ বসে রইলো সে।
তাঁকে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললো আশরাফি। ইশারায় জিজ্ঞেস করলো,’কি সমস্যা?’ আশরাফির সরাসরি চাহনীতে হৃদকম্পন আরো বেড়ে গেলো নীলার। সেটা সামলানোর জন্য দ্রুত দুদিকে মাথা নাড়ালো। এর মানে কোন সমস্যা নেই। এবার আশরাফি তার খাতার দিকে ইশারা করে বললো,’তাহলে লিখছো না কেন? প্রশ্ন বুঝতে কোন অসুবিধে আছে?’ এবারেও না-সূচক মাথা নাড়ালো নীলা। আশরাফিও আর কিছু না বললো না। হাঁটতে হাঁটতে সামনে এগিয়ে গেলো সে। এবং আবারো শুরু হলো তাঁর পায়চারি। নীলাও লিখায় মনোযোগ দিলো।

পনেরো বিশমিনিট বাদেই টুং করে বেল বাজার আওয়াজ হলো। হাত ঘড়ির দিকে একপলক তাকিয়েই দ্রুত সবার খাতা কালেক্ট করতে শুরু করে দিলো আশরাফি। নীলা শেষবারের মত খাতাটা একবার দেখে নিলো। তার জমা দিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে এলো।

বেরোতেই দেখলো বন্ধুরা সব জটলা পাকিয়ে প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করছে। কাছে এগিয়ে গেলো সে। কার কেমন হয়েছে জিজ্ঞেস করলো। সবারই একই জবাব! ‘মোটামুটি ভালো হয়েছে।’ তাঁর কথা জিজ্ঞেস করতেই মুখখানা লাজুক বানিয়ে দুষ্টু একটা হাসি দিলো নীলা। ইঙ্গিতটা বুঝতে কারো অসুবিধে হলো না। হো!হো! করে হেসে উঠলো সবাই।
ক্লাসে নীলার অধিকাংশ বন্ধুবান্ধবই জানে আশরাফি স্যার তাঁর ক্রাশ। শুধু নীলার কেন? আরো অনেকেরই ক্রাশ! কিন্তু সাহস করে কেএ বলতে পারে নি! একমাত্র নীলাই সাহস করে সবার কাছে তাঁর ক্রাশের কথা বলে বেড়াচ্ছে।

খাতা গোনা শেষে হলরুম থেকে বেরিয়ে এলো আশরাফি। ছাত্রছাত্রীরা তখনো করিডোরে দাঁড়িয়ে হাসাহাসি করছিলো। তাঁদেরকে দেখে হাঁটার ওপরেই জিজ্ঞেস করলো সে,’পরীক্ষা কেমন হয়েছে তোমাদের?’

প্রতিউত্তরে সবাই হাসিমুখেই জবাব দিলো,’ভালো হয়েছে স্যার।’ আশরাফিও চলে যাচ্ছিলো তখনই জটলার মাঝখান থেকে দুষ্টুটাইপ একটা ছাত্র বলে উঠলো,’খাতা একটু ছাড় দিয়ে কাটবেন প্লিজ। নইলে ইউনিভার্সিটি থেকে আর বেরোতে পারবো না।’

আশরাফি মুচকি হাসলো। হাঁটা থামিয়ে পিছন ফিরে ছাত্রছাত্রীদের দিকে একঝলক চাইলো সে। তারপর কৃত্রিম ভয় দেখিয়ে বললো,’কোন ছাড় নেই। ভালো না লিখলে সবাই ফেল।’

এবার একযোগে সবাই ‘না স্যার’ বলে প্রতিবাদ করে উঠলো। ততক্ষনে আশরাফি আর দাঁড়ালো না। দ্রুত প্রস্থান করলো। যাওয়ার সময় ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ্যে বিদায় জানিয়ে বললো,’ঠিক আছে, ভালো থাকবে সবাই। নেক্সট সেমিস্টারে আবার দেখা হবে ইনশাআল্লাহ।’ সে চলে গেলেই পূর্বের আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো সবাই। কিন্তু নীলার জমলো না। ইউনিভার্সিটি একসপ্তাহের জন্য বন্ধ। আচমকাই মনটা খারাপ হয়ে গেলো তাঁর!


ইউনিভার্সিটির এরিয়া থেকে বেরোতে না বেরোতেই সোহাগের ফোন। আশরাফি ফোন রিসিভ করে বললো,’হ্যাঁ! দোস্ত আমি বাসার কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। কিছু লাগবে?’

-‘না। মিটিং এর কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য ফোন দিয়েছি। তুই তো আবার ভুলে যাবি।’

আশরাফি হাসলো। বললো,’মনে আছে আমার। আজকে আরমান সাহেবের সাথে দেখা করার কথা! আমি বাসার নিচে, তুই ফোন রাখ।’

ফোন কেটে দিলো সোহাগ। ইউনিভার্সিটি লাইফ থেকে এখনো একসাথেই আছে তিনবন্ধু। তিনজনের কেউই এখনো বিয়ে করে নি। সোহাগ অবশ্য রিলেশনে আছে, নাঈমের জন্য পাত্রী দেখা হচ্ছে। বাকি আছে আশরাফি! সে আদৌ বিয়ে করবে কি না তাও সিউর না বন্ধুরা। তাঁদের ইচ্ছে ছিলো বিয়ের পর যেহেতু সবাইকে আলাদা থাকতে হবে তাই তাঁরা যাওয়ার আগেই আশরাফিকে একটা বিয়ে করিয়ে দিয়ে যেতে। কিন্তু আশরাফি কোনমতেই রাজি নয়। তাঁকে বিয়ের কথা বলে বলে বিরক্ত হয়ে গেছে বাকি দুই বন্ধু। তাই এখন আর বলে না।

ব্যাংকে আশরাফির মায়ের রেখে যাওয়া কিছু টাকা আর সামান্য ধার দেনা করে প্রায় সাড়ে তেরো’শ স্কয়ার ফিটের একটা ফ্ল্যাট কিস্তিতে কিনেছে আশরাফি। নিজের জমানো কিছু টাকাও ছিলো। সব মিলিয়ে শুরুতেই ফ্ল্যাটের টাকার তিনভাগের একভাগ শোধ করে ফেলেছে সে। এরপর ধাপে ধাপে টাকা দিতে হয়েছে। এখন আর অল্প কিছু বাকী আছে। তাঁর কেনা ফ্ল্যাটেই একসাথে আছে তিনবন্ধু।

সোহাগ, নাঈম দুজনেই চাকরী করছে। তবে চাকরীর পাশাপাশি গতবছরই তিন বন্ধু মিলে নতুন একটা ব্যবসা শুরু করেছিলো। তারপর অল্প কয়েকদিনেই ব্যবসা অবস্থা মোটামুটি ভালোই দাঁড়িয়ে যায়। ইতোমধ্যেই বিদেশ থেকে ডিলাররা যোগাযোগ করতে শুরু করেছে। করবেই বা না কেন? চাকরী বাইরে পুরোটা সময় যে ব্যবসার কাজেই লাগাচ্ছে তিন বন্ধু। প্রথমে আশরাফির তেমন কোন আগ্রহ ছিলো না। জোর করে তাকে পার্টনারশিপে ঢুকিয়েছে সোহাগ এবং নাঈম। মেহেরের সাথে সম্পর্ক ভাঙ্গার পর থেকে জোঁকের মত সারাক্ষণ আশরাফির পাশে লেগেছিলো তাঁরা। কোনভাবেই বিগড়ে যেতে দেয় নি তাঁকে। আপন ভাইয়ের মত আগলে রেখেছে। আসলে একটা কথা আছে, যার কেউ নেই তাঁর আল্লাহ আছেন। বস্তুত তিনি মানুষকে তাঁর দুঃখ থেকে পরিত্রাণের একটা না একটা উপায় ঠিক বের করে দেন। নতুবা কোন মানুষই এত তাড়াতাড়ি নিজেদের সামলাতে পারতো না।

সোহাগ এবং আশরাফি দুজনেই ঠিক সাড়ে চারটার দিকে নির্ধারিত রেস্টুরেন্টে পৌঁছে দেখলো তাদের আগেই রেস্টুরেন্টে এসে বসে আছে আরমান। ওদেরকে দেখে সম্মানে দাঁড়িয়ে গেলো সে। সালাম দিয়ে বললো,’আপনাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম স্যার।’

আশরাফি এবং সোহাগ দুজনেই সালামের উত্তর নিয়ে সরাসরি কাজের কথায় ঢুকে পড়লো। এই লোকটার সাথে যত তাড়াতাড়ি ঝামেলা চুকানো যায় ততই মঙ্গল। এসব লোকের বিশ্বাস নেই! কখন কোন ঝামেলায় ফাঁসিয়ে দেয় কে জানে। তাই আরমানকে বাড়তি কোন কথার সুযোগ দিলো না তাঁরা।

কথাবার্তার এক পর্যায়ে আরমান তাদেরকে আর্জি জানিয়ে বললো,’আপনারা চাইলে মেয়েগুলোর সাথে কথা বলে নিতে পারেন স্যার। পছন্দ না হলে নতুন জোগাড় করে দিবো।’

-‘কিন্তু হাতে তো সময় বেশি নেই। আপনি নতুন মেয়ে পাবেন কোথায়?’

আরমান সলজ্জ হেসে বললো,’কি যে বলেন স্যার। আমাদের তো পেশাই এটা। আপনি খালি বলুন কয়টা লাগবে?’

শেষ প্রশ্নটা খুব উৎসাহের সাথে জিজ্ঞেস করছিলো আরমান। জবাবে সোহাগ তাকে নিরুৎসাহিত করে দিয়ে বললো,’মেয়েগুলো কি পড়াশুনা জানে?’

প্রশ্নটা শুনে দমে গেলো আরমান। মনে মনে সোহাগের ওপর বিরক্ত হলো সে। সে কি স্কুল খুলে বসেছে যে মেয়েদের লেখাপড়া শেখাবে? ঐসব জায়গায় লেখাপড়ার কি কাজ? কথাটা মুখের ওপরেই বলতো কিন্তু পঁচিশ হাজার টাকার মায়া তাঁকে আটকে দিলো! পাছে ডিলটা ক্যান্সেল হয়ে যায় তাই গলায় যথেষ্ঠ মোলায়েম ভাব বজায় রেখে বললো,’এইটা তো আগে বলেন নি স্যার?’

তাঁর ভীত মুখের দিকে তাকিয়ে আশরাফি সান্ত্বনার সুরে বললো,’না মানে, জানতেই হবে তেমন কোন কথা নেই। কিন্তু জানলে ভালো হতো আরকি। আসলে,বিদেশি ক্লায়েন্ট তো। টুকটাক কথা চালানোর মতও যদি নাহয় তাহলে তো বুঝতেই পারছেন? তাই টুকটাক কথা চালানোর মতও যদি কেউ থেকে থাকে তাহলে সমস্যা নেই বাকিটুকু শিখিয়ে দেওয়া যাবে।’

চট করে মধুর কথাটা মাথায় এলো আরমানের। হেসে উঠে বললো,’কোন সমস্যা নেই স্যার আমার ওয়াইফ পড়ালেখা জানে তিনি শিখিয়ে দিতে পারবেন। আপনারা বরং তাঁর সাথে একবার দেখা করে তাঁকেই সবকিছু বুঝিয়ে বলুন।’

আশরাফি দ্রুত একবার সোহাগের মুখের দিকে চাইলো। ঐ জায়গায় যাওয়া মানে মানসম্মান সব শেষ! কেউ দেখতে পেলে বিরাট কেলেঙ্কারি। এদিকে কাজটা জরুরী! তথাপি সোহাগ বন্ধুর মনের কথা বুঝতে পেরে মাথা নাড়িয়ে বললো,’দুঃখিত আমরা যেতে পরবো না।আপনিই বরং উনাকে বুঝিয়ে বলবেন!’

আরমান বাধা দিয়ে বললো,’বুঝেছি স্যার। আপনারা ভদ্রলোক! ঐসব জায়গায় যেতে মানসম্মানের ভয় করেন। কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি, কোন সমস্যা হবে না। রাতে যাবেন। রাতের বেলা এদিকে মানুষজন তেমন থাকে না। কেউ চিনবে না আপনাদের। কথাবার্তা শেষ করে আবার চলে আসবেন!’

মুখে যতই সাধু সাজার চেষ্টা করুক না কেন আরমানের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে কোনভাবে সোহাগ এবং আশরাফিকে সেখানে নিয়ে যাওয়া। ব্যাচেলর ছেলে একবার নিয়ে গিয়ে মেয়েমানুষের চক্করে ফেলে দিতে পারলেই বেশ ভালো টাকা আয় করা যাবে।

এরপরেও কিছুক্ষণ ইতস্তত করলো দুই বন্ধু। আশরাফি বারণ করে দিয়ে বললো,’আমাদেরকে দেখানোর দরকার নেই। মিটিংয়ের দিন আপনি সময়মত উনাকে নিয়ে হাজির হলেই চলবে।’

আরমান নাছোড় বান্দা, বিটকেল মার্কা একটা হাসি দিয়ে বললো,’এতগুলো টাকা দিয়েছেন। আপনাদেরও ব্যবসার ব্যপার আমারও ব্যবসার ব্যপার। তাই বলি কি, একবার যদি আপনারা আমার ওয়াইফকে সব কিছু বুঝিয়ে বলতেন আমার জন্যেও সুবিধা হতো। তিনি আপনাদের মনমত করে তৈরী করে দিতে পারতেন মেয়েগুলোকে। তার হাতের কাজ খুবই পাঁকা!’

এবারে সোহাগ ফিসফিস করে বললো,’কি বলিস যাবি নাকি?’

আশরাফি বিরক্তমুখে বললো,’তুই যা।’

অতঃপর সোহাগ আরমানকে উদ্দেশ্য করে বললো,’ঠিক আছে আমরা যাবো। এখন তাহলে আসি। কখন যেতে পারবো আপনাকে ফোনে জানিয়ে দেওয়া হবে।’

দুইবন্ধু রাত সাড়ে দশটার দিকে সময় দিলো আরমানকে। কিন্তু সাড়ে দশটায় বললেও তাঁরা হাজির হলো রাত সাড়ে বারোটায়। রাত গভীর হওয়ার অপেক্ষায় ছিলো দুজনে। আরো দেরী করতো কিন্তু আরমানের ফোনের জ্বালায় টিকতে না পেরে বাধ্য হয়ে তাড়াতাড়ি আসতে হয়েছে। কিছুক্ষন কথাবার্তার পর আরমান মধুকে ডেকে আনার জন্য লোক পাঠালো।

লোক পাঠানোর মিনিট পাঁচেক বাদেই উপরতলার সিঁড়ি বেয়ে নামতে দেখা গেলো মধুকে। তার পরণে গাড় নীল রংয়ের কাতান শাড়ি। ফুলহাতা ব্লাউজের সাথে বাঙালী ধাঁচে একপ্যাঁচি করে পরেছে শাড়িখানা। শাড়ির আঁচলে একগোছা চাবি বাঁধানো। পোশাক আশাক, চলুনভঙ্গী, সাজগোজ দেখে যে কেউ ভাববে আগেকার দিনের কোন জমিদার ঘরের বউ সে।
মধুর দিকে চোখ পড়তেই সোহাগ হতভম্ভ। বন্ধুর ফোনে মেহেরের ছবি অনেকবার দেখেছে সে। অতএব সন্দেহের কোন অবকাশ নেক এই মেয়েটাই মেহের! অবাক হয়ে আশরাফির দিকে চাইলো সে। আশরাফি নির্বাক! ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে তাঁর সমস্ত পৃথিবী! একনিমিষেই সরে গেছে পায়ের তলার মাটি! কেউ যেন আচমকাই তাকে ধাক্কা মেরে কোন এক অন্ধকার গুহায় ফেলে দিয়েছে। চোখেমুখে একরাশ বিস্ময়,হতাশা, গ্লানি নিয়ে অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করলো সে,’মেহের!’ আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনি হয়ে ছড়াতে শুরু করলো তাঁর কথাটা!
চমকে উঠলো মধু! কতদিন বাদে আবার নিজের নামটা শুনেছে সে। কিন্তু তবুও কোন আনন্দ, উচ্ছ্বাস কিছুই প্রকাশ করতে পারলো না! উল্টো বুকের ভেতর শুরু হলো তীব্র মাত্রার কম্পন! পলকহীনভাবে চেয়ে রইলো সামনের মানুষটার দিকে! তথাপি সামনে এগোতে পারলো না! কেউ যেন তাঁর হঠাৎ করেই চলৎশক্তিটুকু কেড়ে নিয়েছে। মাথা ঘুরেই পড়ে যাচ্ছিলো, সিঁড়ি হাতল ধরে কোনমতে সামলে নিলো। কিন্তু তখনো নিজেকে সামলাতে পারে নি আশরাফি। সে হতবাক, বিমূঢ়, বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে রইলো সামনের মানুষটার দিকে!
.
.
.
চলবে
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here