মধুবালা পর্ব ১+২

#মধুবালা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১

চৌধুরী বাড়ির বড় মেয়ে মেহেরুন্নেসার বিয়ে! সারাবাড়িতে উৎসবমুখোর পরিবেশ বিরাজ করছে। এর মাঝেই সবাইকে ফাঁকি দিয়ে বোরখায় মুখ ঢেকে আশরাফি সাথে দেখা করতে বেরিয়েছে মেহের। উদ্দেশ্য শেষবারের মত বিদায় নেওয়া ভালোবাসার মানুষটার কাছ থেকে। তাদের বিগত চারবছরের সম্পর্কের ইতি হতে যাচ্ছে আজকে। বিয়ে আবশ্য আজ নয়। কাল গায়ে হলুদ, পরশু বিয়ে! মেহেরের বাবা ইরতিয়াজ চৌধুরীর পছন্দের পাত্রের সাথেই বিয়ে ঠিক হয়েছে মেহেরের। বাবার মতের বাইরে গিয়ে কিছু করার সাধ্য কিংবা সাহস কোনটাই নেই তাঁর! ভয়ানক মানুষ ইরতিয়াজ চৌধুরী। তিনি কিছুতেই আশরাফির মত অনাথ একটা ছেলেকে চৌধুরী বংশের জামাতা হিসেবে মেনে নেবেন না। তাই বাধ্য হয়েই বিয়েতে রাজী হতে হয়েছে মেহেরকে।

দশবছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছে আশরাফি। মা স্কুলের টিচার ছিলেন। ছাত্র পড়িয়ে মানুষ করেছেন ছেলেকে। কিন্তু গতবছর অ্যাক্সিডেন্টে মা-ও চলে গেলেন। তারপর থেকেই টিউশনি করে নিজের খরচ নিজে চালাচ্ছে আশরাফি। গ্রামে অবশ্য তাদের কিছু জমিজমা আছে। কিন্তু চাচারা সব কিছু থেকে বঞ্চিত করেছে তাঁকে। আশরাফি মা বেঁচে থাকতেও এসব সম্পত্তি নিয়ে কোন আপত্তি করেন নি। ছেলেকে মানুষ করাই ছিলো তাঁর একমাত্র লক্ষ্য!

ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে পরিচয় হয়েছিলো দুজনার। পরিচয় থেকেই আস্তে আস্তে মন বিনিময়। কখনো যে একে অপরের অপরিহার্য হয়ে উঠলো নিজেরাও টের পেলো না। যখন টের পেলো তখন আর কিছু করার রইলো না মেহেরের। ততদিনে আশরাফির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছিলো সে। যদিও বেশিরভাগ সময়ই বাবার ভয়ে দিন কাটতো তাঁর। তবুও, মনের ভেতর কিঞ্চিৎ আশা ছিলো, যদি বাবা কোনভাবে রাজি হয়? যদি কোনভাবে তাঁদের সম্পর্কটা মেনে নেয়? কত আশ্চর্যজনক কিছুই তো ঘটে পৃথিবীতে! তাদের ক্ষেত্রেও যদি ঘটে? এতগুলো দিন এমন অবাস্তব, মিথ্যে সান্ত্বনায় নিজেকে বুঝ দিয়ে এসেছে সে। কিন্তু এইমুহূর্তে এসে, বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে বুঝতে পারছে, কতটা ভুল আর ছেলেমানুষিতে ভরা ছিলো তার আশা আকাঙ্ক্ষা গুলো। যার কপাল মন্দ তাঁর ক্ষেত্রে যে কখনোই আশ্চর্য জনক কিছু ঘটে না! এইজন্যই হয়ত গুণীজনেরা বলে গেছেন,”ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিও না।” কিন্তু মেহের যে জেনেশুনেই বিষ পান করেছে। সেই বিষের জ্বালা যে তাঁকে সইতেই হবে!

আশরাফি করুণ মুখ করে চেয়ে আছে তাঁর প্রিয়তমার দিকে। তাঁর দুঃসময়ে মেহেরও তাঁকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে? বাস্তবতা কেন সবসময় এত নিষ্ঠুর হয়? কেন সবসময় মানুষের আবেগ, অনুভূতি নিয়ে এমন নিষ্ঠুরভাবে খেলা করে? মেহের অশ্রুসজল কন্ঠে বললো,’আমি তাহলে আসি?’

-‘আরেকটু বসে যাও না? এইতো শেষ দেখা।’ করুণ, মর্মস্পর্শী আকুতি! টুক করে চোখের পানি গড়িয়ে পড়লো মেহেরের। কম তো নয়? চারটা বছরের সম্পর্ক দুজনার! কত ভালোবাসা আর খুনসুটিতে মেতে ছিলো দুজনে। কত স্বপ্ন, কত আশা ছিলো! আজকে সব বেকার, বিফল! চোখ মুছে বোরকার নেকাব ফেলে দিলো মেহের। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,’আসছি।’

আশরাফির ভেতরটা ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাচ্ছে। মেহেরকে সে কোনভাবেই পালিয়ে যাওয়ার জন্য কনভিন্স করতে পারে নি। মেহেরের এক কথা, দরকার হলে আত্মহত্যা করবে কিন্তু পালাবে না। তবুও শেষবারের মত অনুনয় করলো আশরাফি। ব্যাকুল কন্ঠে বললো,’চলো না পালিয়ে যাই? একবার বিয়ে করে নিলে দেখবেন তোমার বাবা ঠিক মেনে নেবেন!’

-‘না!’, দৃঢ় জবাব মেহেরের। কারণ পালিয়ে যাওয়ার ফলাফল কতটা ভয়ংকর হতে পারে সেটা জানে। মেহের হয়ত পালিয়ে গিয়ে বেঁচে যাবে ঠিকই কিন্তু তাঁর মাকে বাঁচতে দেবে ইরতিয়াজ চৌধুরী। এই সমাজে এখনো মেয়ের দোষের বোঝা মাকেই টানতে হয়! তাছাড়া ইরতিয়াজ সাহেব খুবই বদরাগী মানুষ। দুনিয়া উল্টে এদিক ওদিক হয়ে গেলেও তাঁর কথার বাইরে কেউ যেতে পারবে না! যে যাবে সে কেবল একা ভুক্তভোগী হবে না পরিবারের সবাইকে এর ফল ভোগ করতে হবে। আর সবচেয়ে ভয়ানক পরিনতি হবে মেহেরের মায়ের। তাই তিনি আগেই নিজের মাথায় হাত রেখে মেয়ের কাছ থেকে কথা আদায় করে নিয়েছেন। মায়ের মাথা হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করেছে মেহের, বাবার কথার বাইরে যাবে না সে। শুধু মায়ের নয় তাঁর দশবছরের ছোট বোন নিগারের মাথাও হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করিয়েছেন তাঁর মা জাহানারা বেগম। ইরতিয়াজ চৌধুরীকে জমের মতন ভয় পান তিনি। এই লোকটার অবাধ্য হওয়ার কথা ভুলেও কখনো মাথায় আসে নি তাঁর! অতএব নিরুপায় মেহের!

তবুও হাল ছাড়লো না আশরাফি। পুনরায় অনুনয় বিনয় করলো। কিন্তু মেহের কিছুতেই পালিয়ে যেতে রাজি নয়। উল্টো আশরাফিকে পরামর্শ দিলো সব ভুলে নিজের ক্যারিয়ারের দিকে ফোকাস করার জন্য! এইসব সান্ত্বনামূলক কথাবার্তা শুনে রাগে জ্বলজ্বল করে উঠলো আশরাফিত চোখজোড়া। সজোরে টেবিলে বাড়ি মেরে বললো,’আমি সব বুঝি। আসলে তোমার বাবার কোন দোষ নেই। তুমিই আমাকে বিয়ে করতে রাজি নও। এসব তোমার বাহানা! বড়লোক পাত্র পেয়ে আমাকে ভুলে গিয়েছো।’

মেহের জবাব দিলো না। নিরুত্তরমুখে বসে রইলো। সে জানে আশরাফি অতিরিক্ত রাগ থেকেই কথাগুলো বলছে। এইমুহূর্তে একটা মানুষের জন্য নিজেকে সামলে রাখা কতটা কষ্টকর তা মেহের বুঝতে পারে। আশরাফি ফের টেবিলে বাড়ি মেরে বললো,’চুপ করে আছো কেন তুমি? হোয়াই ডোন্ট ইউ আনসার মি? কেউ তুমি আমার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছো না?’

রেস্টুরেন্টে উপস্থিত আশেপাশের কয়েকজোড়া কাপল অদ্ভুত বিস্ময় নিয়ে চেয়ে আছে তাদের দুজনার দিকে। মেহের উঠে দাঁড়ালো। বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই তাঁর পথ আটকালো আশরাফি। দাঁতেদাঁত চেপে বললো,’আমি তোমাকে কোথাও যেতে দেবো না। আমার জীবন নিয়ে তামাসা করার কোন অধিকার তোমার নেই। তুমি এইমুহূর্তে আমার সঙ্গে কাজি অফিসে যাবে। বিয়ে করবো আমরা!’

জবাবে মেহের সম্পূর্ণ অবিচল কন্ঠে বললো,’পথ ছাড়ো। সবাই দেখছে।’

-‘বললাম তো এখন তুমি কোথাও যেতে পারবে না।’ তারপর পকেট থেকে ফোন বের করে ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বন্ধুকে আসতে বললো আশরাফি। এবার মেহেরের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিলো। বাইরে থেকে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেও ভেতরে ভেতরে বুক কাঁপছে তাঁর। কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বললো,’তোমার সাথে দেখা করতে আসাটাই আমার ভুল হয়েছে।’

-‘ভুল যখন করেই ফেলেছো তখন তো এর খেসারত তোমাকে দিতেই হবে? কিছু করার নেই!’

ঢোক গিললো মেহের। কাঁপাকাঁপা কন্ঠে পুনরায় কিছু বলতে যাচ্ছিলো আশরাফি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো,’কোন লাভ হবে না। আমি আমার ডিসিশন নিয়ে নিয়েছি। এক্ষুনি বিয়ে করবো আমরা!’
আকস্মিক কেঁদে ফেললো মেহের। কাঁদতে কাঁদতেই বসে পড়লো সে। আশরাফির একটা হাত চেপে ধরে অসহায় কন্ঠে বললো,’দোহাই তোমার। তুমি ওদের আসতে বারণ করে দাও। বাবা আমার মাকে মেরে ফেলবেন। প্লিজ মায়ের কথাটা একবার ভাবো।’

থমকে গেলো আশরাফি! মেহের কি তবে এইজন্য বিয়েতে রাজি হয়েছে? মায়ের জন্য? হ্যাঁ! তা নয়ত কি? আশরাফি জানে মেহের তাঁকে কতটা ভালোবাসে! কিন্তু মা! যেখানে অন্য সকল শব্দ, সম্পর্ক, ভালোবাসা থেমে যায়! এই কথার জবাবে কি বলবে আশরাফি! সে কি বলবে তোমার মায়ের কথা বাদ দিয়ে আমার কথা ভাবো? না! আশরাফি কখনোই এই কথাটা বলতে পারবে না। তবুও হতাশা, আত্মগ্লানি, রাগ, ক্ষোভ সব গিয়ে পড়লো মেহেরের ওপর। নিরুপায় হয়ে হাত ঝাড়া মেরে সরিয়ে দিলো মেহেরকে। দুহাতে নিজের মাথার চুল টেনে ধরলো। চোখমুছে উঠে দাঁড়ালো মেহের। সে জানে এবার আর আশরাফি তাঁকে আটকাবে না। চোখ বন্ধ করে বড়বড় একটা দম নিলো আশরাফি। অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বললো,’আমি তোমাকে কখনো মাফ করবো না মেহের! তুমি জীবনেও সুখি হতে পারবে না।’

মেহের ফুঁপিয়ে উঠলো। তাকে রেখেই বেরিয়ে গেলো আশরাফি। মাথা দিয়ে আগুন বেরোচ্ছে তাঁর। মেহের কেবল নিজের মায়ের কথাই ভাবলো? আশরাফি কথাটা একবারও ভাবলো না? আশরাফি কি করে থাকবে মেহেরকে ছাড়া? বন্ধুর বাইক নিয়ে এসেছিলো সে। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে বাইক স্টার্ট দিয়ে গতি অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দিলো। মনে মনে প্রার্থণা করলো এই মুহূর্তেই যেন অ্যাক্সিডেন্ট করে মরে যায়। মেহেরকে যেন সারাজীবন আফসোস করতে হয় তাঁর জন্য!


রাত দুটো! নিজের ঘরে বাতি নিভিয়ে শুয়ে আছে মেহের। বুকের ভেতর তীব্র যন্ত্রনা হচ্ছে তাঁর! মনটা কু ডাকছে। আশরাফির জন্য ছটফট করছে। সে ঠিক আছে তো? আশরাফির করুণ মুখটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে তাঁর! ফোন করে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘চলো পালিয়ে যাই!’ কিন্তু আফসোস কিছুই করার নেই তাঁর!
দুহাতে মুখ চেপে ধরে অস্ফুটস্বরে গুঙিয়ে উঠলো সে। চোখ জ্বালা করছে। এই কয়দিনে এত কেঁদেছে যে এখন চোখে পানি এলেই চোখ জ্বালা করে। ফোন বের করে আশরাফির নাম্বারে ডায়াল করলো। দুবার রিং হওয়ার পর রিসিভ করলো আশরাফি। সে ‘হ্যালো’ বলতেই মেহের বুক থেকে পাথর নেমে গেলো। আশরাফি ঠিক আছে! চোখের পানি মুছে গলাটা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললো,’ঘুমাও নি?’

-‘না।’

-‘এত রাত জেগে কি করছো।’

-‘প্ল্যান করছি।’

-‘কিসের প্ল্যান?’

-‘তোমাকে খুন করার। তুমি আমার সাথে যা করেছো এরপরে তোমাকে ছেড়ে দিলে আমার ভালোবাসার অপমান হবে।’

এত কষ্টের মাঝেও হাসি পেয়ে গেলো মেহেরের। মেহের তো এমনিতেই মরে গেছে! তাঁকে আর কি মারবে আশরাফি? দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে। অথচ সে জানে না আশরাফি তখন আঘাতে আঘাতে কতটা বিকৃতমনষ্ক! বাস্তবিকই তাঁকে খুন করার প্ল্যান করছিলো আশরাফি! হ্যাঁ! মেহেরকে খুন করে তারপর নিজে মরবে সে! রাতের অন্ধকার, তীব্র হতাশায় নানারকম উল্টোপাল্টা চিন্তাভাবনা মাথায় আসছে তাঁর।

তীব যন্ত্রণায় জর্জরিত মেহের! কিঞ্চিৎ ঠাট্টার সুরে বললো,’সত্যিই মারতে চাও?’

থমকে গেলো আশরাফি! নিমিষেই চুপসে গেলো এতক্ষনের ফুলতে থাকা প্রতিশোধের বেলুনটা! মেহের! যাকের সে নিজের চাইতে বেশি ভালোবাসে! তাঁকে আঘাত করার কথা কেবল কল্পনাতেই ভাবা যায়! বাস্তবে নয়। হতাশা, ক্ষোভ, তীব্র যন্ত্রণায় বুকের ভেতরটা আবারো ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেলো। মেহেরের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে রাগে ফোন কেটে দিলো সে। এইমুহূর্তে সমস্ত পৃথিবী ওলটপালট করে দিতে ইচ্ছে করছে তাঁর। ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে মন চাইছে সব কিছু।
.
.#মধুবালা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২

মেসের শক্ত কাঠের চৌকিতে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে আশরাফি। বন্ধুরা বেশ কয়েকবার ডাকাডাকি করলো কিন্তু কোন সাড়া দিলো না। কাল রাত থেকে কারো সাথে কথাবার্তা বলছে না। রাতের খাবার, সকালের নাশতা সব টেবিলের ওপর পড়ে আছে। দুপুরের খাবার সময়ও হয়ে গেছে কিন্তু আশরাফির কোন নড়চড় নেই। মরার মত শুয়ে আছে।
এবার বন্ধুরা চিন্তায় পড়ে গেলো। মেহেরের সঙ্গে ঝামেলার কথা সব তাদের খুলে না বললেও বিয়ের কথা ওদের জানিয়েছে আশরাফি। কিন্তু কবে সেটা জানায় নি। সোহাগ আশরাফির কাছে গিয়ে নরম গলায় ডাক দিলো,’ওঠ দোস্ত। দুইটা বাজে। আর কতক্ষন ঘুমাবি?’

-‘তুই যা!’ গম্ভীর, আড়ষ্ট জবাব আশরাফির।

সোহাগ পুনরায় ডাক দিলো কিন্তু সাড়া দিলো না আশরাফি। এবার নাঈমও এগিয়ে এলো। বিষন্ন বন্ধুর পিঠে হাত আলতো করে কয়েকবার চাপড় মেরে বললো,’ওঠ, দোস্ত। ওই মেয়ের জন্য আর মন খারাপ করিস না। অই একটা চিটার, বাটপার।’

-‘তোরা তোদের কাজে যা।’

তাঁর কথায় গা করলো না কেউ। টানাটানি শুরু করে দিলো। সারারাত নির্ঘুম কাটানোর পর একটা মানুষের মেজাজ কখনোই ভালো থাকার কথা নয়। আশরাফির মেজাজও চূড়ান্ত খারাপ। কাল সারারাতএকফোঁটাও ঘুমায় নি সে। ঘুমের ভান ধরে পড়ে ছিলো কেবল। কিন্তু বন্ধুদের ডাকাডাকিতে ক্ষেপে গেলো। এমনিতে কপালের শিরাগুলো চিনচিন করছে। প্রচন্ড মানসিক চাপে শিরা ছেড়ে রক্ত বেরিয়ে আসবে মনে হচ্ছে। তারওপর বন্ধুদের ক্রমাগত ডাকাডাকি। লাফ দিয়ে উঠে বসলো সে। দুই বন্ধুকে উদ্দেশ্য করে বিচ্ছিরি একটা গালি দিয়ে বললো,’দরদ দেখাতে কে বলেছে তোদের? যা ভাগ আমার সামনে থেকে!’ কথা শেষ করে আবার গালি দিলো সে।

সোহাগ ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো,’ওই নষ্ট মেয়ের জন্য তুই আমাদের গালি দিয়েছিস?’

এমনিতেই মেজাজ খিটখিটে হয়ে আছে আশরাফির। তারওপর সোহাগের কথাটা শুনে শরীরের রক্ত সব ফুটতে শুরু করলো তাঁর। রাগে দিশেহারা হতে সোহাগের কলার চেপে ধরলো সে। মুখ দিয়ে আবারো বেরোলো কুরুচিপূর্ণ গালি। সোহাগের গালে সজোরে ঘুষি মেরে বললো,’হারামির বাচ্চা নিষেধ করেছিলাম না! কথা কানে যায় না? কে বলেছে তোকে কথা বলতে? বেশি দরদ দেখাইতে আসছিস না?’

নাঈম হতভম্ভ! অবাক হলো সোহাগও! বেশকিছুক্ষন হাঁ করে বন্ধুর মুখের দিকে চেয়ে রইলো তাঁরা। ধীরেধীরে ব্যপারটা ক্লিয়ার হলো। একরাতেই বিধ্বস্ত অবস্থা আশরাফির। মুখের দিকে তাকানোর জো নেই। বোধকরি এবার বন্ধুর মনের অবস্থা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছে তারা। কতটা মানসিক যন্ত্রণায় থাকলে একটা মানুষ এমন পাগলের মত আচরণ করতে পারে এবার আর বুঝতে অসুবিধে হলো না তাদের। প্রিয়তম বন্ধুর দুঃখে ব্যথিত হলো দুজনেই। অনেক কষ্টে আশরাফির হাত থেকে সোহাগের কলার ছাড়ালো নাঈম। বন্ধুকে শান্ত করার চেষ্টায় বিষন্ন কন্ঠে বললো,’ওর ওপর রাগ দেখিয়ে কোন লাভ আছে? তুই যার জন্যে মরছিস সে তো ঠিকই আরেকজনকে বিয়ে করে নিচ্ছে।’
এদিকে মার খেয়েও প্রতিবাদ করলো না সোহাগ। ঘুরেফিরে আবার আশরাফি পাশেই বসলো সে। তাঁর পিঠে একটা হাত রেখে নাঈমের কথায় সমর্থণ করে বললো,’নাঈম ঠিকই বলেছে দোস্ত। তুই ওই মেয়েকে নিয়ে ভাবা বন্ধ কর। একদিনেই তোর চেহারার কি হাল হয়েছে তুই দেখেছিস? মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না।’
জবাবে আশরাফি ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো সোহাগের দিকে। তারপর হাত দুটো চেপে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে দিলো। ফুঁপিয়ে উঠে বললো,’আমার কলিজা ফেটে যাচ্ছে দোস্ত! ওকে তোরা বুঝা! আমি মরে যাবো। ও ছাড়া আমার আর কেউ নাই!’

চোখের পানি টলমল করছে দুই বন্ধুরও। সাময়িক মন দেওয়া নেওয়ার ঘটনা হলে হয়ত এইমুহূর্তে আশরাফিকে নিয়ে হাসি তামাসা করতো দুজনে। কিন্তু ব্যপারটা সিরিয়াস! আশরাফি পাগলের মত ভালোবাসে মেহেরকে! তাই সান্ত্বনা দেওয়ার মত কোন ভাষা খুঁজে পেলো না তারা। নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো দুজনে। খুব অসহায় লাগছে নিজেদেরকে! মেহেরকে ডেকে এনে জিজ্ঞেস করতে মন চাইছে ঠিক কি কারণে তাদের প্রাণপ্রিয় বন্ধুটিকে এতটা দুঃখ দিয়েছে মেহের? কেন তাকে এতটা কষ্টের মাঝে ফেলে দিয়ে গেলো সে?’


পার্লারের লোকেরা হলুদের জন্য সাজাচ্ছে মেহেরকে। পাশেই তার ফোন অনবরত বেজে চলেছে। দুবার রিং হওয়ার পর ফোনটা রিসিভ করলো মেহের। ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে অপরিচিত একটা কন্ঠস্বর বলে উঠলো,’মেহের বলছো?’

-‘জি! আপনি কে?’

-‘আমি সোহাগ। আশরাফির বন্ধু!

নামটা শুনতেই বুকের ভেতর খামচি মেরে উঠলো মেহেরের। অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠলো বুকটা। কাঁপাকাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো সে,’ও ঠিক আছে ভাইয়া?’

মেহেরের কাছ থেকে প্রথমেই এই ধরণের প্রশ্ন আশা করে নি সোহাগ। সে ধরেই নিয়েছিলো মেহের যেহেতু বিয়ে করছে তারমানে এইমুহূর্তে আশরাফিকে না চেনার ভান করবে সে। কিংবা ফোনও কেটে দিতে পারে। সেই মোতাবেক কিছু কঠিন কথা শুনিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছিলো সে। তাই মেহেরের প্রশ্নের উত্তরটা সাথে সাথেই দিতে পারলো না। থমকে গেলো। তার নিরব থাকা মেহেরের ভয়ের মাত্রাটাকে আরো বেশি করে বাড়িয়ে দিলো। নিমিষেই চোখে পানি চলে এলো তাঁর। অধৈর্য কন্ঠে বারবার ‘হ্যালো ভাইয়া, হ্যালো! শুনতে পাচ্ছেন আপনি? কথা বলছেন না কেন?’ বলে গেলো সে। এদিকে পার্লারের মহিলা খেঁকিয়ে উঠে বললো,’কাঁদবেন না প্লিজ! মেকাপ খারাপ হয়ে যাচ্ছে।’
চোখের পানি মুছে নিলো মেহের। ওপাশ থেকে সোহাগ তখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে নরম গলায় বললো,’রাফি ঠিক আছে। কিন্তু তুমি এমন কেন করলে বোন?’
এবার আর অবরুদ্ধ ক্রন্দন ঠেকিয়ে রাখতে পারলো না মেহের। সোহাগের নরম গলা শুনে ডুঁকরে কেঁদে উঠলো সে। কান্নারত কন্ঠেই বললো,’উপায় নেই ভাইয়া। আমি নিরুপায়! বিশ্বাস করুন আমাকে বাধ্য করা হয়েছে! কিন্তু আপনাদের কাছে আমার একটাই অনুরোধ, আমি জানি আপনারা ওর খেয়াল রাখবেন কিন্তু তবুও বলছি এইমুহূর্তে ওর খুব প্রয়োজন আপনাদেরকে! আপনারা ছাড়া ওকে দেখে রাখার মতন আর কেউ নেই।’

ইতোপূর্বে খেঁকিয়ে উঠা পার্লারের সেই মহিলা এবার বুঝতে পারলেন হৃদয়ঘটিত কোন সমস্যা চলছে বউয়ের। তাই আর কিছু বললেন না। টিস্যু দিয়ে আলতো করে মেহেরের চোখের পানি মুছে দিয়ে পুনরায় মেকাপে মনোযোগ দিলেন তিনি।

সোহাগ ম্লান কণ্ঠে বললো,’আজকে সারাদিন না খেয়ে আছে। কাল রাত থেকেই সবার সাথে কথাবার্তা বন্ধ করে দিয়েছে। দুপুরে আমরা ডাকতে যাওয়ায় আমাদের সাথেও উল্টো রাগারাগি করেছে। কি যে করবো বুঝতে পারছি না।’

মেহের নিরবে চোখের পানি ছেড়ে দিলো। সাহসে কুলাচ্ছে না নতুবা এই মুহূর্তে নিজেকে শেষ করে ফেলতো সে। নিজেকে ভীষণ অসহায়, নিরুপায় লাগছে। তাঁর ভালোবাসার মানুষটাকে নিদারুণ যন্ত্রণার মাঝে ছেড়ে দিয়ে এসেছে সে। এতটা যন্ত্রণা কোন শত্রুও বোধহয় তাঁর শত্রুকে দেয় না! আঁচড়ে, কামড়ে, খামচে শেষ করে দিতে মন চাইছে নিজেকে! কিন্তু আফসোস সেটুকুও করার ক্ষমতাও তার নেই। কাঁদতে কাঁদতেই জিজ্ঞেস করলো সে,’ও এখন কোথায়?’

-‘মেসেই আছে। চুপচাপ বসে আছে। বললাম না কালরাত থেকেই চুপচাপ।’

কথাগুলো শোনার পর থেকে মেহেরের বুক আরো বেশি করে কেঁপে উঠলো। আশরাফি কোন অঘটন ঘটাবে না তো? চিৎকার চেঁচামেচি তবুও ভালো। কিন্তু মনের মধ্যে রাগ পুষে রাখা তো ভালো লক্ষণ নয়? এর পরিণাম ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে হতাশভাবে কান্না চাপলো সে। চোখ বন্ধ করে সৃষ্টিকর্তার কাছে মনে মনে একটাই প্রার্থণা করলো সে,আশরাফির যেন কোন ক্ষতি না হয়!’

এদিকে মেহেরের কাছ থেকে কোন জবাব না পেয়ে ফোন রেখে দিলো সোহাগ। বড় রাগ লাগছে তাঁর! পৃথিবীটা এমন কেন? কেন এখানে সত্যিকারের ভালোবাসাগুলোর মিলন হয় না?
মেহেরের সাথে তাঁর পুরো কথোপকথন নাঈমের সাথে আলোচনা করলো সে। সব শুনে নাঈম বিরক্ত মুখে বললো,’নাটক করছে ঐ মেয়ে! নাটক! এদের চেনা বড় মুশকিল। আসল কথা হলো বড়লোক ছেলে দেখে রাফিকে ভুলে গেছে। এখন মিথ্যে নাটক করছে! তুই বুঝবি না এসব।’

অসন্তোষে মাথা নাড়ালো সোহাগ। মেহেরের কান্নারত,উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর না শুনলে সে-ও হয়ত পূর্বের মত নাঈমের সঙ্গে একমত হতে পারতো কিন্তু এইমুহূর্তে পারছে না। চোখে না দেখলেও মেহেরের কান্নার মাঝে লুকিয়ে থাকা ভয়ানক কষ্টের আভাস উপলব্ধি করতে পেরেছে সে। পেরেছে বলেই নাঈমের মত ঘৃণা করতে পারছে না মেহেরকে। তবে হ্যাঁ! রাগ লাগছে মেহেরের ওপর! সে যদি আগেই জানতো তাঁর বাবা আশরাফিকে মেনে নেবে না তবে কেন সে আশরাফির সাথে এমন করলো? এর উত্তরটা এখনো পরিষ্কার নয় সোহাগের কাছে। মেহের কি সত্যিই নিরুপায়? নাকি নাঈমই ঠিক বলছে?
.
.
.
চলবে
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here