মন পাড়ায় পর্ব ২০

#মন_পাড়ায়
#পর্ব_২০
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

প্রায় এক ঘন্টা হয়ে গেল সৈকতের আসার নাম নেই। কল দিলো কতগুলো তবুও এলো না। ঝিনুক কাঁদছিল ভীষণ। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলো। অবশেষে ঝিনুক হোয়াটস অ্যাপে ভয়েস রেকর্ডার পাঠালো, “আমি শুধু বলতে চেয়েছিলাম তোমার বাবাকে শান্ত গলায় বুঝাতে পারতে সেভাবে না বলে তুমি তার উপর চিল্লাচিল্লি করেছ। আমি জানি তোমার জন্য তোমার মা’য়ের মূল্য কতটুকু। আংকেল উনার সাথে ঠিকভাবে কথা বলে তাও বুঝি কিন্তু তুমি উনার সাথে এইভাবে কথা বললে বুঝি উনি আন্টিকে আর কখনো কিছু বলবে না? আরও বেশি বলবে। কিন্তু তুমি……. যেখানে আছো ফিরে আসো, নাহয় ঘরে এ-সব জানলে আরও সমস্যা হবে।”

প্রায় পাঁচ মিনিট পরে এলো সৈকতে এলো। ঝিনুকের ফর্সা গাল লালচে হয়ে গেছে। সৈকত কিছু মুহূর্ত ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে বাতি নিভিয়ে দিল।

ঝিনুকের কাছে এসে বসে তাকে বুকে জড়িয়ে নিল। ঝিনুক তাকে ফিরে জড়িয়ে ধরলো না। শুধু কাঁপা-কাঁপা কন্ঠে বলল, “আমি শুধু চেয়েছিলাম যে এই পরিবারে কোনো সমস্যা না হয়। তুমি আংকেলকে কিছু বললে কথা বাড়বে ও আন্টিরই বেশি কথা শুনতে হবে। এইটা তুমি বুঝতে চাও না কেন?”

সৈকত কিছু বলল না। ঝিনুককে শুধু বুকে জড়িয়ে ধরে রাখল।
.
.
রীতিমতো প্রভা উঠলো ফরজের আযানের সময়। চোখ খুলে যা দেখল তার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। অর্ক তাকে বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়েছে। সে চমকে উঠে পিছাতে নিলো কিন্তু পারলো না। অর্ক তাকে একটু বেশিই শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। মুহূর্তে তার বুকের ভেতর বয়ে অজস্র অস্বস্তি। সে অনুভব করতে পারছে সে যত নড়ছে অর্কের হাতগুলো ততই জড়িয়ে ধরছে তার পিঠ।

প্রভা এক ঢোক গিললো। মৃদু কন্ঠে ডাকল, “অর্ক….শুনছেন…..অর্ক……”

অর্ক মিটিমিটি করে আর চোখ খুলে আবারও চোখ বন্ধ করে নিলো। প্রভার চুলের খোপার কাঁটাটা খুলে দিয়ে চুলে মুখ ডুবিয়ে দিলো।

প্রভা মুহূর্তে কেঁপে উঠলো। চোখ দুটো চেপে ধরলো। সাথে আঁকড়ে ধরলো অর্কের পাঞ্জাবি। অর্কের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি তার গলায় এসে লাগছে।

অর্কের ছোঁয়ায় তার গলা দিয়ে যেন সকল শব্দ আটকে গেছে। তবুও সে বহু কষ্টে বলল, “অ-অর্ক দয়া করে ছেড়ে দিন। আপনি বোধহয় ঘুমে আছেন।”

অর্ক তাকে ছাড়লো না, বোধহয় ঘুম থেকেও উঠলো না। প্রভা সমানে কাঁপছে। তার নিশ্বাসও যেন আটকে আসছে। তবুও অর্কের ছাড়ার নামই নেই। অর্ক নড়ছিলো তখন তার ঠোঁট এসে ছুঁয়ে গেল প্রভার গলায়। মুহূর্তে প্রভা যেন স্থির হয়ে গেল। আর নড়তে পারলো না। তার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল।

তখন অর্ক তাকে ছেড়ে ঘুম ঘুম চোখে প্রভার দিকে তাকিয়ে ঘুমন্ত কন্ঠে বলল, “চিল্লাচ্ছ কেন?”

চোখে চোখ পড়লো। হলো দৃষ্টিমিলন। অর্ক সে চোখ দুটোয় ডুবে রইলো কতক্ষণ। অতীতে সে প্রায়ই ভাবতো বিয়ের পর প্রভার চোখে তাকিয়ে থাকবে ঘন্টার পর ঘন্টা। অথচ এক দমকা হাওয়া তার সকল ইচ্ছেগুলো মাখিয়ে দিলো ধুলোয়।

অর্ক এক ঢোক গিললো। এত মায়াময় চোখ সে আর কখনো দেখেছে বলে তার সন্দেহ হচ্ছে।
এত মায়াময়! এত গভীর!

সে প্রভার চুলে আঙুল ডুবিয়ে দিলো।
কেশকন্যার কেশ নিয়ে খেলতে খেলতেই কেশকন্যা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো, “ভাগ্যিস আপনি ঘুম থেকে উঠেছেন। দয়া করে এইবার ছাড়ুন আমাকে।”

অর্ক আবদারটা শুনেও যেন শুনল না। সে তাকিয়ে রইলো প্রভার চোখে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে। প্রভার তার পিঠে হাত রেখে অর্কের হাত সরানোর চেষ্টা করে আবারও বলল, “আপনার ঘুম কী ভাঙে নি?”

মেয়েটা এত বোকা কেন!
ওকে কিছু মুহূর্ত কাছে পাওয়ার জন্য সে সারাটা রাত সজাগ কাটিয়েছে অথচ মেয়েটা দূরে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে গেছে।

অর্ক প্রভাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, “হুম একটু ঘুমে ছিলাম।”

প্রভা শুধু বলল, “অসুবিধা নেই।” আর উঠে দৌড় দিয়ে চলে গেল বাথরুমে। ওকে দেখে মনে হয় নি যে অসুবিধা নেই।

অর্ক দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশের বালিশটা বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। সারাটারাত তার নির্ঘুম কেটেছে তাই এই ভোরে ঘুম দিতে হবে।
.
.
পরেরদিন সকালের ভার্সিটির অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো ঝিনুক ও ইকবাল। কিছু সমস্যা হওয়ায় অফিসের ভেতরে সৈকত কথা বলছে।

ঝিনুক বলল, “থ্যাঙ্কিউ ভাইয়া আমার জন্য আপনি এত জলদি আসলেন।”

“আরে ধন্যবাদের কী আছে? সৈকত একবার বললে আমি যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো জায়গায় এসে হাজির হতে পারব।”

“অনেক কাছের ও আপনার তাই না?”

“তা আর বলতে? ও একবার বললে আমি আমার জীবন দিতেও পিছপা হব না।”

ঝিনুক মৃদু হেসে বলল, “সৈকত অনেক ভাগ্যবান যে আপনার মতো বন্ধু পেয়েছে।”

“ভুল, আমি অনেক বেশি ভাগ্যবান যে আমি ওর মতো বন্ধু পেয়েছি।”

ঝিনুকের ঠোঁটের হাসি নেই হয়ে গেল।

ইকবাল তা খেয়াল করল। সে তার পিছনের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে হাত আড়াআড়ি ভাঁজ করে বলল, “মাহমুদ আংকেলের ড্রাইভার আব্দুল্লাহকে চেনো?”

ঝিনুক মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল। ইকবাল হেসে বলল, “উনি আমার আব্বা হয়। ড্রাইভারের ছেলেকে কতজন এত কাছের বন্ধু বানায় বলো? আর শুধু বন্ধু বানায় নি বন্ধুত্ব পালনও করেছে। কখনো এইটা বুঝতে দেয় নি যে আমাদের মাঝে কোনো বৈষম্য আছে। ও আমার জন্য কত কি করেছে তা বলার বাহিরে। আমার ভার্সিটির সেমিস্টার ফি ও বেশিরভাগ ও দেয় নিজের হাত খরচ বাঁচিয়ে। এমনকি কয়দিন আগে নিজের বাইক বিক্রি করে দিয়েছে আমার মা’য়ের চিকিৎসার জন্য। তোমাদের বিয়েতেও এইজন্য আসতে পারি নি। আব্বা মাহমুদ আংকেলের কাছ থেকে চেয়েছিল কিন্তু উনি বলেন যে পরে দেখবে অথচ সৈকতকে বলতেও হয় নি কিছু ও শুনেই নিজেই বাইকটা বিক্রি করে দিলো। যেখানে সেইটা ওর ভীষণ প্রিয় ছিলো। তো এইবার বলো কে বেশি ভাগ্যবান ও না আমি?”

ঝিনুক কিছু বলতে পারলো না। সে বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে পারছে না।

সৈকত এলো ততক্ষণে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “কাজ শেষ।”

ইকবাল বলল, “আয় তাহলে ক্যান্টিনে যাই। ঝিনুক তুমিও চলো। আমাদের ক্যান্টিনের ফুসকা খাওয়াই।”

“না,” সৈকত ইকবালকে উদ্দেশ্য করে বলল, “ভার্সিটির মধ্যে ওর সাথে কথা বলার প্রয়োজন নেই।”

সৈকত আবারও ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি অঞ্জলিকে ফোন করে আসতে বলেছিলাম। তুমি তোমাদের ক্লাসরুমে যাও ওকে সেখানেই পাবে। আর হ্যাঁ, খালি পেটে ক্যান্টিনের কোনো খাবার খাবে না। পরে পেট ব্যাথা শুরু হবে।”

সৈকত ইকবালের গলা একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বলল, “চল নিহান ও পার্বতী অপেক্ষা অপেক্ষা করছে ক্যান্টিনে।”

ঝিনুক সৈকতের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। আজ অনেকদিন পর তার ভালো লাগছে সৈকতকে দেখে। সৈকত তাদের সম্পর্ক থাকার সময়ও কখনো বলে নি যে ইকবাল তাদের ড্রাইভারের ছেলে। এমনকি কখনো তার কোনো বন্ধুকে ছোট করার কোনো কথাই তার সামনে বলেনি।

কিন্তু সে ঠিক বুঝতে পারছে না যে সৈকত এতটা ভালো হলে তার ও অন্যান্য এতজনের সাথে অন্যায় করলো কেন? আর সৈকতের কথামতো যদি সে ভুল হয় তাহলে সে প্রমাণ গুলোও কী ভুল যেগুলোর সাক্ষী সে নিজে?

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here